অধ্যক্ষ শায়খ মোহাম্মদ আবদুল করীম সিরাজনগরী
নূরে মোহাম্মদীর সৃষ্টির রহস্য
মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বপ্রথম যে মাখলুক সৃষ্টি করেছিলেন, তা ছিলো মহা-সম্মানী একখানা নূর মোবারক এবং সেই নূর মোবারকের নামকরণ করেছিলেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর এ আজিমুশশান নূর মোবারককেই বলা হয়ে থাকে নূরে মোহাম্মদী। মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টির পূর্বে যেহেতু আর কোনো মাখলুক-ই ছিল না, সেহেতু আল্লাহ তাকারাকা ওয়া তা’য়ালা হেকমতে কামেলা দ্বারা তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছিলেন। কোনো ধাতু ছাড়াই কীভাবে যে আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করলেন, তা কেউ বলতে পারে না। নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির এই অজানা রহস্যকেই বলা হয় নূরে মোহাম্মদীর হাকীকত।
আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নূরানী ফরমান -
ﻳﺎ ﺍﺑﺎ ﺑﻜﺮ ﻟﻢ ﻳﻌﺮﻓﻨﻰ ﺣﻘﻴﻘﺔ ﻏﻴﺮ ﺭﺑﻰ -
অর্থাৎ, ‘হে আবু বকর! আমার প্রভু ভিন্ন আমার হাকীকত সম্বন্ধে কেউই অবগত নন।’
এ হাদিস শরীফের মর্ম অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে -
ﻣﺤﻤﺪ ﺳﺮ ﻗﺪﺭﺕ ﮨﮯ - ﮐﻮﺉ ﺭﻣﻮﺯ ﺍﺱ ﮐﺎ ﮐﯿﺎ ﺟﺎﻧﮯ
ﺷﺮﯾﻌﺖ ﻣﯿﮟ ﺗﻮ ﺑﻨﺪﮦ ﮨﮯ- ﺣﻘﯿﻘﺖ ﻣﯿﮟ ﺧﺪﺍ ﺟﺎﻧﮯ
অর্থাৎ, ‘আল্লাহর হাবিব মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুদরতে এলাহির এক গোপনীয় সুক্ষ্ম রহস্য, যার ভেদ কেউ জানতে পারে নাই। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনিতো আল্লাহর একজন বান্দা, কিন্তু তাঁর মূল হাকীকত কী, তা জানেন একমাত্র আল্লাহতা’য়ালাই।’
এ প্রসঙ্গে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন (আলাইহির রহমত) তাঁর লিখিত ‘সিলাতুস সাফা ফি নূরীল মোস্তফা’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেন -
ﻋﺎﻟﻢ ﻣﯿﮟ ﺫﺍﺕ ﺭﺳﻮﻝ ﮐﻮ ﺗﻮ ﮐﻮﺉ ﭘﮩﭽﺎﻧﺘﺎ ﻧﮩﯿﮟ
অর্থাৎ, ‘এ নশ্বর পৃথিবীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সঠিক পরিচিতি কেউই অবগত নন।’
তিনি আরো বলেন -
ﺍﺱ ﺗﺨﻠﯿﻖ ﮐﮯ ﺍﺻﻞ ﻣﻌﻨﯽ ﺗﻮ ﺍﻟﻠﮧ ﻭﺭﺳﻮﻝ ﺟﺎﻧﯿﮟ ﺟﻞ
ﻭﻋﻠﯽ ﻭﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ -
অর্থাৎ, ‘মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সৃষ্টির মূল রহস্য একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা ও তাঁর রাসূল-ই জানেন।’
অন্যত্র বলেন -
ﮐﮧ ﻧﻮﺭ ﻣﺤﻤﺪﯼ ﺟﺐ ﻗﺪﯾﻢ ﺍﻭﺭ ﺍﺯﻟﯽ ﻧﻮﺭ ﮐﯽ ﭘﮩﻠﯽ ﺗﺠﻠﯽ
ﮨﮯ ﺗﻮ ﮐﺎﺋﻨﺎﺕ ﻣﯿﮟ ﺑﮭﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﮯ ﻭﺟﻮﺩ ﮐﺎ ﻭﮬﯽ
ﺳﺐ ﺳﮯ ﭘﮩﻠﮧ ﻣﻈﮭﺮ ﮨﮯ -
অর্থাৎ, ‘নূরে মোহাম্মদী যখন নূরে কাদীম ও নূরে আজলি, অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালার জাতের প্রথম তাজাল্লি, তাতে প্রমাণিত হয় সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তিনি-ই আল্লাহতা’য়ালার অজুদ বা অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশক।’
আ’লা হযরত আরো বলেন -
ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﻧﮯ ﻣﺤﻤﺪ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﮐﯽ ﺫ
ﺍﺕ ﭘﺎﮎ ﮐﻮ ﺍﭘﻨﯽ ﺫﺍﺕ ﮐﺮﯾﻢ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍﮐﯿﺎ ﯾﻌﻨﯽ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ
ﮐﯽ ﺗﺠﻠﯽ ﺑﻼ ﻭﺍﺳﻄﮧ ﮨﻤﺎﺭﮮ ﺣﻀﻮﺭ ﮨﯿﮟ ﺑﺎﻗﯽ ﺳﺐ
ﮨﻤﺎﺭﮮ ﺣﻀﻮﺭ ﮐﮯ ﻧﻮﺭ ﻭﻇﮭﻮﺭ ﮨﯿﮟ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ -
অর্থাৎ, ‘আল্লাহতা’য়ালা হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তাকে আল্লাহর জাতে পাকের স্বীয়জাতে করিম কর্তৃক সৃষ্টি করেছেন; অর্থাৎ, আমাদের হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহতা’য়ালার জাতের তাজাল্লি, আর বাকি কুল-কায়েনাত আমাদের নূর নবীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নূর মোবারক আল্লাহ পাকের কাদীম ও আজলি নূরের প্রথম তাজাল্লি; অর্থাৎ, আল্লাহর জাত কর্তৃক সৃষ্ট নূর।
আল্লাহর নূর কর্তৃক নবীজীর নূর সৃষ্টি কথাটির ব্যাখ্যা
নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন ও আলোচনার ক্ষেত্রে হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিসখানা উল্লেখযোগ্য -
ﻳﺎ ﺝ
ﺍﺑﺮ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺪ ﺧﻠﻖ ﻗﺒﻞ ﺍﻻﺷﻴﺎﺀ ﻧﻮﺭ ﻧﺒﻴﻚ ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ -
-
‘হে জাবির! নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা সব কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর মোবারক স্বীয় নূর কর্তৃক সৃষ্টি করছেন।’
এ হাদিস শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত বলেন -
ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ ﺍﻯ ﻣﻦ ﻧﻮﺭ ﻫﻮ ﺫﺍﺗﻪ -
অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওই নূর কর্তৃক সৃষ্টি করেছেন, যা ﻋﻴﻦ
ﺫﺍﺕ ﺍﻟﻬﻰ আল্লাহর প্রকৃত জাত, অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা স্বীয় জাত কর্তৃক তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহতা’য়ালার নূর নবী সৃষ্টির ধাতু। আল্লাহতা’য়ালা কোনো মাধ্যম ছাড়াই ‘কুন’ বলেছেন, ‘ফাইয়াকুন’ অতঃপর নবী (দ:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টি হয়ে গেল।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী আলাইহির রহমত নিজ ‘সিলাতুস সফা ফি
নূরিল মোস্তফা’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেছেন -
ﮬﺎﮞ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﻧﮯ ﮐﮯ ﯾﮧ ﻣﻌﻨﯽ ﻧﮩﯿﮟ
ﮐﮧ ﻣﻌﺎﺫ ﺍﻟﻠﮧ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺫﺍﺕ ﺭﺳﺎﻟﺖ ﮐﮯ ﻟﮱ ﻣﺎﺩﮦ ﮨﮯ
ﺟﯿﺴﮯ ﻣﭩﯽ ﺳﮯ ﺍﻧﺴﺎﻥ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﺍ ﻋﯿﺎﺫ ﺑﺎﻟﻠﮧ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﮐﺎ
ﮐﻮﺉ ﺣﺼﮧ ﯾﺎ ﮐﻞ ﺫﺍﺕ ﻧﺒﯽ ﮨﻮﮔﯿﺎ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ ﺣﺼﮯ
ﺍﻭﺭ ﭨﮑﺮﮮ ﺍﻭﺭ ﮐﺴﯽ ﮐﮯ ﺳﺎﺗﮧ ﻣﺘﺤﺪ ﮨﻮﺟﺎﻧﮯ ﯾﺎ ﮐﺴﯽ
ﻣﯿﮟ ﺣﻠﻮﻝ ﻓﺮﻣﺎﻧﮯ ﺳﮯ ﭘﺎﮎ ﻭﻣﻨﺰﮦ ﮨﮯ ﺣﻀﻮﺭ ﺳﯿﺪ ﻋﺎﻟﻢ
ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﺧﻮﺍﮦ ﮐﺴﯽ ﺷﺊ ﮐﻮ ﺟﺰﺀ ﺫﺍﺕ
ﺍﻟﮭﯽ ﺧﻮﺍﮦ ﮐﺴﯽ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﮐﻮ ﻋﯿﻦ ﻭﻧﻔﺲ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ
ﻣﺎﻧﻨﺎ ﮐﻔﺮ ﮨﮯ -
(আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত ﺣﻀﻮﺭ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﺍ -এর ভাবার্থ উদঘাটন করতে গিয়ে উল্লেখ করেন)
ভাবার্থ: আইনে জাতে এলাহি বা আল্লাহর প্রকৃত জাত থেকে (নূরে হাকিকী আল্লাহর জাত কর্তৃক) হাবিবে খোদা সৃষ্টি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জাত সৃষ্টির জন্য মাদ্দা বা মূল ধাতু (নাউজুবিল্লাহ)। যেমন মাটি দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাতের কোনো অংশ বা আল্লাহর কুল জাত নবী হয়ে গিয়েছেন (নাউজুবিল্লাহ)।
মহান আল্লাহ অংশ, টুকরো এবং কোনো কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোনো বস্তুর মধ্যে হুলুল হওয়া থেকে পবিত্র। হুজুর সাইয়িদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকি কোনো বস্তুকে আল্লাহর জাতের অংশ, এমনকি কোনো সৃষ্টিকে প্রকৃত জাত ও নফসে জাতে এলাহি মানা বা আক্বিদা রাখা কুফুরি।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালার জাত মোবারক এমন একটি নূর যার কোনো উদাহরণ বা মিসাল নেই। বেনজীর বেমিসাল নূর। যে নূরের অংশ হয় না, ভাগ হয় না, টুকরো হয় না, লাল, হলুদ,সবুজ, এক কথায় সৃষ্টির মধ্যে যার কোনো তুলনা নেই।
মোটকথা, আল্লাহর নূর হলো নূরে হাকিকী এবং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর হলো নূরে তাখলিকী বা আল্লাহর সৃষ্ট নূর।
আ’লা হযরত নিজ ‘নূরুল মোস্তফা’ শীর্ষক গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
ﻧﻮﺭ ﻋﺮﻑ ﻋﺎﻣﮧ ﻣﯿﮟ ﺍﯾﮏ ﮐﯿﻔﯿﺖ ﮨﮯ ﮐﮧ ﻧﮕﺎﮦ ﭘﮩﻠﮯ ﺍﺳﮯ
ﺍﺩﺭﺍﮎ ﮐﺮﺗﯽ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﺍﺱ ﮐﮯ ﻭﺍﺳﻄﮯ ﺳﮯ ﺩﻭﺳﺮﯼ ﺍﺷﯿﺎﺋﮯ
ﺩﯾﺪﻧﯽ ﮐﻮ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺴﯿﺪ ﻓﯽ ﺗﻌﺮﯾﻔﺎﺗﮧ ﺍﻟﻨﻮﺭ ﮐﯿﻔﯿۃ ﺗﺪﺭﮐﮭﺎ
ﺍﻟﺒﺎﺻﺮۃ ﺍﻭﻻ ﻭﺑﻮﺍﺳﻄﺘﮭﺎ ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻟﻤﺒﺼﺮﺍﺕ- ﺍﻭﺭ ﺣﻖ ﯾﮧ ﮐﮧ
ﻧﻮﺭ ﺍﺱ ﺳﮯ ﺍﺟﻠﯽ ﮨﮯ ﮐﮧ ﺍﺱ ﮐﯽ ﺗﻌﺮﯾﻒ ﮐﯽ ﺟﺎﺋﮯ - ﯾﮧ
ﺟﻮ ﺑﯿﺎﻥ ﮨﻮﺍ ﺗﻌﺮﯾﻒ ﺍﻟﺠﻠﯽ ﺑﺎﻟﺨﻔﯽ ﮨﮯ ﮐﻤﺎ ﻧﺒﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻓﯽ
ﺍﻟﻤﻮﺍﻗﻒ ﻭﺷﺮﺣﮭﺎ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﯾﮟ ﻣﻌﻨﮯ ﺍﯾﮏ ﻋﺮﺽ ﻭﺣﺎﺩﺙ ﮨﮯ
ﺍﻭﺭ ﺍﺏ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ ﺍﺱ ﺳﮯ ﻣﻨﺰﮦ ﮨﮯ -
অর্থাৎ, উরফে আম বা প্রচলিত সংজ্ঞায় নূর হচ্ছে একটি কাইফিয়ত বা অবস্থা, দৃষ্টিশক্তি প্রথমে যেটিকে অনুধাবন করে এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য দৃষ্ট জিনিসও অনুধাবন করা হয়।
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺴﻴﺪ ﻓﻰ ﺗﻌﺮﻳﻔﺎﺗﻪ ﺍﻟﻨﻮﺭ
ﻛﻴﻔﻴﺔ ﺗﺪﺭﻛﻪ ﺍﻟﺒﺎﺻﺮﺓ ﺍﻭﻻ ﻭﺑﻮﺍﺳﻄﺘﻬﺎ ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻟﻤﺒﺼﺮﺍﺕ
সঠিক তত্ত্ব হলো, এখানে যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা থেকে নূর অনেক উর্ধ্বে। এটা ﺗﻌﺮﻳﻒ ﺍﻟﺠﻠﻰ
ﺑﺎﻟﺨﻔﻰ ‘তা’রিফুল জলি বিল খফি’। যেমন ﻣﻮﺍﻗﻒ ও তার ব্যাখ্যা গ্রন্থে তা বর্ণনা করা হয়েছে। এই অর্থে নূর হচ্ছে আরজ ও হাদেস তথা যা অন্যের মাধ্যমে স্থিতিশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। আর আল্লাহতা’য়ালা এগুলো থেকে পবিত্র। (এ জন্যে উপরোক্ত অর্থে আল্লাহ তা’য়ালার পবিত্র সত্তাকে নূর বলা যেতে পারে না।)
একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী শায়খ আহমদ ফারূকী সিরহিন্দী আলাইহির রহমত (বেসাল: ১০৩৪ হিজরি) স্বপ্রণীত
ﻣﻜﺘﻮﺑﺎﺕ ﺍﻣﺎﻡ
ﺭﺑﺎﻧﻰ ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ শীর্ষক কিতাবের তৃতীয় জিলদের (উর্দু) ১৬১৫/১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
ﻣﻤﮑﻦ ﭼﮧ ﺑﻮﺩ ﮐﮧ ﻇﻞ ﻭﺍﺟﺐ ﺑﺎﺷﺪ
ﻭﺍﺟﺐ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﺎ ﺳﺎﯾﮧ ﮐﯿﻮﮞ ﮨﻮﮔﺎ ﮐﯿﻮﻧﮑﮧ ﻣﺜﻞ ﮐﯽ ﺗﻮﻟﯿﺪ
ﮐﺎ ﻣﻮﮨﻢ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﻋﺪﻡ ﮐﻤﺎﻝ ﻟﻄﺎﻓﺖ ﮐﮯ ﺷﺎﺋﺒﮧ ﮐﯽ ﺧﺒﺮ
ﺩﯾﺘﺎﮨﮯ- ﺟﺒﮑﮧ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﮧ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﮐﺎ
ﻟﻄﺎﻓﺖ ﮐﯽ ﻭﺟﮧ ﺳﮯ ﺳﺎﯾﮧ ﻧﮧ ﺗﮭﺎ ﺗﻮ ﺧﺪﺍﮰ ﻣﺤﻤﺪ ﮐﺎ
ﺳﺎﯾﮧ ﮐﯿﻮﮞ ﮨﻮﮔﺎ- ﺧﺎﺭﺝ ﻣﯿﮟ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﺎﻟﺬﺍﺕ ﺍﻭﺭ
ﺑﺎﻻﺳﺘﻘﻼﻝ ﺻﺮﻑ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺫﺍﺕ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﯾﺎﭘﮭﺮ ﺍﻟﻠﮧ
ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺻﻔﺎﺕ ﺛﻤﺎﻧﯿﮧ ﺣﻘﯿﻘﯿﮧ ﺍﻭﺭ ﺍﻥ ﮐﮯ ﺳﻮﺍ ﺟﻮ
ﮐﭽﮫ ﺑﮭﯽ ﮨﮯ ﻭﮦ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺍﯾﺠﺎﺩ ﺳﮯ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﮨﻮﺍ ﮨﮯ
ﺍﻭﺭ ﻣﻤﮑﻦ ﺍﻭﺭ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﺍﻭﺭ ﺣﺎﺩﺙ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﮐﻮﺉ ﻣﺨﻠﻮﻕ
ﺍﭘﻨﮯ ﺧﺎﻟﻖ ﮐﺎ ﻇﻞ ﻧﮩﯿﻦ ﮨﮯ -
ভাবার্থ: মমকিনের কী ক্ষমতা যে, ওয়াজিবের প্রতিচ্ছায়া হয়। ওয়াজিব বা অবশ্যম্ভাবী জাত বা সত্তার (আল্লাহতা’য়ালার) ছায়া কেন হবে? যেহেতু ছায়াবিশিষ্ট হওয়া অনুরূপ বস্তুর সাদৃশ্যের ধারণার জন্ম দিয়ে থাকে। ছায়াবিশিষ্ট না হওয়া পূর্ণ সূক্ষ্ম অস্তিত্বের নিদর্শন জ্ঞাপক। যখন সূক্ষ্মতা বশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র শরীর মোবারকের ছায়া ছিল না, তবে মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র রব বা প্রতিপালকের ছায়া হবে কেন?
খারেজ বা বহিঃজগতে ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﺎﻟﺬﺍﺕ ‘মাওজুদ বিজজাত’ বা স্বীয় অস্তিত্বে অস্তিত্ববান এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার যাত বা সত্তা। আল্লাহতা’য়ালার অষ্ট সিফাতে খাসসা বা খাস গুণাবলীতে প্রকৃত আদি বা বাস্তব গুণ বিদ্যমান। এটি ছাড়া অন্যান্য গুণাবলী যা আছে, তা সম্ভাব্য সৃষ্ট ও হাদেস বা নতুন বস্তু। কোনো সৃষ্ট বস্তু স্বীয় স্রষ্টার ছায়া নয়।
ﺩﺭ ﺧﻮﺍﺳﺘﮧ ﺍﺳﺖ ﺍﻧﺤﻀﺮﺕ ﺍﮮ ﺧﺪﺍ ﮐﮧ ﺩﺭ ﺟﻤﯿﻊ ﺍﻋﻀﺎ
ﻭﺟﮭﺎﻥ ﻧﻮﺭ ﺑﺨﺸﺪ ﻭﺩﺭ ﺁﺧﺮ ﺁﮔﻔﺘﮧ ﻭﺍﺟﻌﻠﻨﯽ ﻧﻮﺭﺍ ﻭﭼﻮﮞ
ﺁﻧﺤﻀﺮﺕ ﻋﯿﻦ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﺷﺪ ﻧﻮﺭ ﺭﺍﺳﺎﯾﮧ ﻧﻤﯿﺒﺎﺷﺪ ( ﻣﺪﺍﺭﺝ
ﺍﻟﻨﺒﻮۃ ﺹ ১/ ۱ ٤٦ ﻓﺎﺭﺳﯽ )
ভাবার্থ: নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাজাত করতেন, ইয়া আল্লাহ! আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও চতুর্দিকে নূর দান করুন (নূরানী করে দিন)। দো’য়ার শেষাংশে উল্লেখ রয়েছে- ﻭﺍﺟﻌﻠﻨﻰ ﻧﻮﺭﺍ আমাকে নূরে পরিণত করে দিন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﻋﻴﻦ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﺷﺪ
‘আইনে নূরে বাসদ’, অর্থাৎ, নিজেই নূর ছিলেন, আর নূরের তো ছায়া হয় না।’
উপরেলিখিত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম নবী (দ:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এবং নবীর নূর মোবারক দ্বারা সবকিছু তথা কুল কায়েনাত আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা নূরে হাকিকী, বরং হাকিকতে বা প্রকৃতপক্ষে তিনি-ই একমাত্র নূর। অর্থাৎ,
ﻣﻨﻮﺭ ‘মুনাওইর’ বা নূরের সৃষ্টিকর্তা এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন নূরে তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। ﻟﻄﺎﻓﺖ ‘লতিফ’ বা সূক্ষ্ম হওয়ার কারণে নবী (দ:)-এর যেমন ছায়া ছিল না, আল্লাহতা’য়ালারও তেমনি ছায়া নাই। কারণ তিনি হচ্ছেন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম।
ওয়াজিবুল ওজুদ ও নূরে হাকিকী একমাত্র আল্লাহ
ওয়াজিবুল ওজুদ একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা। তিনি ছাড়া ওয়াজিবুল ওজুদ আর কেউই নেই। কেননা, ওয়াজিবুল ওজুদ ওই সত্তাকে বলে, যিনি সত্তাগতভাবে স্বয়ং অস্তিত্বশীল, অন্যের দ্বারা অস্তিত্বশীল নন। যিনি কখনো অস্তিত্বহীন ছিলেন না এবং অস্তিত্বহীন হবেনও না। এমন সত্তা একমাত্র আল্লাহ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয় لا موجود الا الله অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা অন্যের দ্বারা একবার অস্তিত্বশীল হন আবার এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েন, তাঁদেরকে বলা হয় মমকিনুল ওজুদ। আর এর উদাহরণ হল সমস্ত মাখলুক।
এভাবে নূরে হাকিকী বা নূরে মতলক একমাত্র আল্লাহ। কেননা, নূরে হাকিকী বা প্রকৃত অর্থে নূর একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার জাত বা সত্তাকেই বুঝায়। আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া যা কিছু আছে, তাকে বিজ্জাত মুজলিম বা অন্ধকার বলা হয়। হ্যাঁ, আল্লাহপাক যাঁকে নূর বানিয়েছেন বা নূর দান করেছেন, তাঁকে রূপক অর্থে নূর বলা হয়। এ ধরনের নূরকে ’নূরে মুজাজি’ বলে। অতএব, আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া যে সকল সম্মানিত মাখলুককে আমরা নূর বলে থাকি, তা নূরে মজাজি; নূরে মতলক বা নূরে হাকিকী নয়।
এ প্রসঙ্গে তাফসিরে রূহুল মায়ানী ৬ষ্ঠ খণ্ড ১৮ পারা - الله نور السموات والارض - এ আয়াতের তাফসিরে ১৬৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
فالوجود الحق- والله تعالى كما ان النور الحق هو الله عزوجل-
‘অতএব, যেমনভাবে ওজুদে হক একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা, তেমনিভাবে নূরে হক-ও আল্লাহতা’য়ালা-ই।’
এর কয়েক লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
وفسر النور فى هذه الاية اعنى قوله تعالى (الله نور السموات والارض) بذلك ثم اشار الى وجه الاضافة الى (السموات والارض) بقوله: لا ينبغى ان يخفى عليك ذلك بعد ان عرفت انه تعالى هو النور ولا نور سواه-
অর্থাৎ, الله نور السموات والارض - এ আয়াতে কারীমার মধ্যে যে নূর রয়েছে, এ নূর দ্বারা আল্লাহ যে নূরে হাকিকী তারই প্রমাণ বহন করে একমাত্র আল্লাহতা’য়ালাই ‘হাকিকী নূর’। অন্য নূরের সঙ্গে যার কোনো তুলনা হতে পারে না। এ নূর হচ্ছে আজলি ও কাদীম যার কোনো আরম্ভ নেই।
তারপর অানুমানিক ১১ লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
معنى النور وهو الظهور فى نفسه واظهار لغيره-
আল্লাহতা’য়ালাই হাকিকী নূর যা নিজে নিজে প্রকাশকারী এবং অন্যকেও প্রকাশকারী।
এরপর আরো ১১ লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
وقيل: نور بمعنى منور وروى ذلك عن الحسن- وابى العاليه والضحاك وعليه جماعة عن المفسرين-
অর্থাৎ, ‘نور ‘নূর’-এর অর্থ হচ্ছে منور ‘মুনাওইর’ যা অন্য সব কিছুকে আলোকিতকারী। হাসান আবু আলীয়া ও জেহহাকসহ এবং এক জামাত মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত এর ওপর রয়েছে।
আল্লামা রাগেব ইস্পাহানির লিখিত ‘আল মুফরিদাত’ শীর্ষক কিতাবের ৫০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
وسمى الله تعالى نفسه نورا من حيث انه هو المنور- قال: (الله نور السموات والارض)
অর্থাৎ, ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা স্বীয় নাফস বা জাতকে নূর বলে নামকরণ করেছেন, এ মর্মে যে এ নূরের অর্থ হলো منور ‘মুনাওইর’ বা আলোদানকারী। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর দানকারী।’ অর্থাৎ, আল্লাহ হচ্ছেন হাকিকী নূর আর নবী হচ্ছেন তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এ নূর মোবারককে সৃষ্টি করে, এর সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর জাত মোবারকের দিকে রেখেছেন। এ জন্যে বলা হয়, আল্লাহর জাত কর্তৃক নবী (দ:)-এর জাতের সৃষ্টি।
ষষ্ঠ শতাব্দীর পঞ্চম মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত (বেসাল: ৫০৫ হিজরি) ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ শীর্ষক একখানা কিতাব প্রণয়ন করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহর দলিল-আদিল্লাহর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আল্লাহতা’য়ালা-ই একমাত্র নূর, নূরে হাকিকী, নূরে মতলক, আল্লাহর জাত হলো নূর এবং আল্লাহ ছাড়া সবই مظلم ‘মুজলিম’ বা অন্ধকার। আল্লাহ যাঁকে নূর দান করেছেন তিনি-ই একমাত্র নূর নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى সর্বসৃষ্টির পূর্বে আল্লাহতা’য়ালা আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহতা’য়ালার সৃষ্ট নূর।
সপ্তম শতাব্দীর ষষ্ঠ মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত (ওফাত ৬০৪ হিজরি) নিজ ‘তাফসিরে কবির’ শীর্ষক কিতাবের ১২ নম্বর জিলদের ২৩ নম্বর জুজ-এর ২৩০ পৃষ্ঠায় ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত’এর - مشكوة الانوار ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ নামক কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন -
والممكن لذاته يستحق العدم من ذاته والوجود من غيره والعدم هو الظلمة- ( ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: মুমকিন বিজ্জাত বা সত্তাগত মুমকিন বলা হয় তাকে যা স্বয়ং অস্তিত্বশীল নয়, অন্যের দ্বারা অস্তিত্বশীল হয়, আর সকল عدم ‘আদম’ বা অস্তিত্বহীন হচ্ছে জুলমত বা অন্ধকার (যা নূরের বিপরীত)।
অতঃপর ইমাম রাযী (রহ:) বলেন -
الحاصلة والوجود هو النور- فكل ما سوى الله مظلم لذاته مستنير بانارة الله تعالى (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: সারকথা হচ্ছে, আল্লাহতা’য়ালার ওজুদ-ই হচ্ছে একমাত্র নূর (বা হাকিকী নূর বমা’না منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী)
অতএব, আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু সত্তাগতভাবে জুলমত বা অন্ধকার এবং আল্লাহ প্রদত্ত নূরের দ্বারাই নূরানী।
এককথায়, আল্লাহ হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ যার আরম্ভ নেই, শেষও নেই, যিনি বিজ্জাত মওজুদ, অর্থাৎ, নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল।
অতঃপর ইমাম রাযী (রহ:) আরো বলেন -
وعند هذا يظهر ان النور المطلق هو الله سبحانه وان اطلاق النور على غيره مجاز اذ كل ما سوى الله (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, নিশ্চয় মতলক নূর হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা। আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর নূরের এতলাক বা অন্য কাউকে নূর আখ্যায়িত করা মজাজ বা রূপক অর্থে প্রয়োগ হবে। (হাকিকী নূর একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা-ই। আল্লাহ তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন।)
অতঃপর হযরত ইমাম আরো বলেন -
فثبت انه سبحانه هو النور- وان كل ما سواه فليس بنور الاعلى سبيل المجاز (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: অতএব, স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা-ই একমাত্র নূর। আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া অন্য যা কিছুই রয়েছে কাউকে নূর বলে আখ্যায়িত করা যায় না; কিন্তু তা হবে মজাজ বা রূপক অর্থে নূর। অতঃপর তিনি আরো বলেন -
واعلم ان هذا الكلام الذى روينا عن الشيخ الغزالى رحمه الله كلام مستطاب ولكن يرجع حاصله بعد التحقيق الى ان معنى كونه سبحانه نورا انه خالق للعالم وانه خالق للقوى الدراكة وهو المعنى من قولنا معنى كونه نورا السموات والارض انه هادى اهل السموات والارض- فلاتفاوت بين ما قاله وبين الذى نقلناه عن المفسرين فى المعنى والله اعلم (جلد ۱۲ ص ۲۳۱ جزء ۲۳ تفسير كبير)
ভাবার্থ: (ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত বলেন) জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই এই বক্তব্য যা আমি বর্ণনা করেছি, তা হলো শায়খ ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত হতে كلام مستطاب উত্তম কালাম বা গ্রহণযোগ্য বক্তব্য। এই ভাষ্য তাহকিক বা বিশ্লেষণ করে যা প্রাধান্য পায়, তা হলো এ অর্থে আল্লাহতা’য়ালা নূর যে তিনি জগতের স্রষ্টা এবং নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহতা’য়ালা) শক্তিশালী জ্ঞান বা বোধগম্যতা সৃষ্টিকারী। আমাদের বক্তব্য এ অর্থই বহন করে যে, আল্লাহতা’য়ালার কালাম الله نور السموات والارض - ‘আল্লাহতা’য়ালা আসমান জমিনের নূর’, অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহতা’য়ালা) নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের অধিবাসীদের পথপ্রদর্শক।
আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত যে ফয়সলা দিয়েছেন এবং মুফাসসিরীনগণ থেকে আমরা যা বর্ণনা করেছি, এর উভয়ের মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য নেই। সহিহ মুসলিম শরীফ ১ম জিলদের ৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
عن ابى ذر قال سالت رسول الله صلى الله عليه وسلم هل رأيت ربك قال نور انى اراه-
عن قتادة عن عبد الله بن شقيق قال قلت لابى ذر لو رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم لسألته فقال عن اى شئ كنت تسأله قال كنت اسأله هل رأيت ربك قال ابو ذر قد سألته فقال رأيت نورا-
অর্থাৎ, হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি আরজ করেছি, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? আল্লাহর হাবিব উত্তরে বললেন, তিনি নূর আমি তাঁকে কীভাবে দেখবো?
হযরত কাতাদা কর্তৃক হযরত আব্দুল্লাহ বিন শাকীক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছি যে, যদি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ পেতাম, তাহলে আমি জিজ্ঞেস করতাম। তখন আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি কোন্ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে? তিনি বললেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম: আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তাঁকে নূর (রূপে) দেখেছি।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ গ্রন্থে বলেন,
جیسا کہ رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم نے اللہ تعالی کو دیکھنے کے سوال کے جواب میں فرمایا تھا کہ وہ تو نور ھے میں اسے کیسے دیکھ سکتا ہو-
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতায়ালার দর্শনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি তো নূর আমি তাঁকে কীভাবে দেখবো।
উপরোক্ত হাদিস শরীফ ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত-এর দলিলভিত্তিক ভাষ্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহর জাত নূর বমা’না منور ‘মানাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী।
শরহে ফেকহে আকবর নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে -
(كما وصف) اى الله سبحانه (نفسه) اى ذاته؟ وفيه دليل على جواز اطلاق النفس على ذاته تعالى- ... وقد ورد تفكروا فى كل شئ ولا تفكروا فى ذات الله-
ভাবার্থ: যেভাবে তিনি গুণান্বিত, অর্থাৎ, আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা نفسه ‘নাফসাহু’, অর্থাৎ, তাঁর পবিত্র জাত বা সত্তা এতে দলিলভিত্তিক প্রমাণিত হলো, النفس ‘আন নফস’ প্রযোজ্য আল্লাহতা’য়ালার জাতের ওপর হয়ে থাকে।... এবং বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক বস্তুর ওপর চিন্তা ফিকির করো। আল্লাহর জাত বা সত্তার ওপর চিন্তা-ফিকির করো না। কারণ, আল্লাহর জাত কী তা বোঝার মতো জ্ঞান কারোরই নেই।
‘তাফসিরে আবিস সউদ’ নামক কিতাবের মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ এমাদি আলাইহির রহমত (ওফাত ৯৫১ হিজরি) الله نور السموات والارض এর আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেন-
وعبر عن المنور بنفس النور تنبيها على قوة التنوير وشدة التأثير وايذانا بانه تعالى ظاهر بذاته وكل ما سواه ظاهر باظهاره كما ان النور نير بذاته وما عداه مستنير به-
ভাবার্থ: নূরকে মুনাওইর (আলো দানকারী) অর্থে গণ্য করা হয়েছে। কারণ আলো দান করার শক্তি, ভীষণ প্রভাবের দরুণ শুধু নূরকে মুনাওইর অর্থে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহতা’য়ালা স্বয়ং জাহের বা প্রকাশমান এবং তাঁকে ছাড়া অন্য সবকিছু প্রকাশ হয়ে থাকে তাঁরই দ্বারা প্রকাশ করার কারণে। যেমন নিশ্চয় তিনি নিজে নিজেই আলোকিত। আর অন্য সব কিছুকে আলো দানকারী।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত স্বপ্রণীত نور المصطفى নামক কিতাবে উল্লেখ করেন -
محققین کے نزدیک نور وہ کہ خود ظاھر ہو اور دوسروں کا مظھر کما ذکرہ الامام حجۃ الاسلام الغزالی ثم العلامہ الزرقانی فی شرح المواھب الشریف باین معنی اللہ عز وجل نور حقیقی ہے بلکہ حقیقۃ وھی نور ہے اور آیۃ کریمہ اللہ نور السموات والارض بلا تکلف وبلاتاویل اپنے معنی حقیقی پرہے فان اللہ عز وجل ھو الظاھر بنفسہ المظھر لغیرہ من السموات والارض ومن فیھن وسائر المخلوقات-
حضور پرنور سید عالم صلی اللہ علیہ وسلم بلا شبہ اللہ عز وجل کے نور ذاتی سے پیدا ہیں- حدیث شریف میں وارد ہے: ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره- اے جابر بیشک اللہ تعالی نے تمام اشیاء سے پہلے ترے نبی کا نور اپنے نور سے پیدا فرمایا- رواہ عبد الرزاق ونحوہ عند البیھقی حدیث میں نورہ فرمایا جسکی ضمیر اللہ کی طرف ہے کہ اسم ذات ہے من نور جمالہ یا نور علمہ یا نور رحمتہ وغیرہ نہ فرمایا کہ نور صفات سے تخلیق ہو- علامہ زرقانی رحمہ اللہ تعالی اسی حدیث کے تحت میں فرما تے ہیں (من نورہ) ای من نور ھو ذات یعنی اللہ عز وجل نے نبی صلی اللہ علیہ وسلم کو اس نور سے پیدا کیا جو عین ذات الھی ہے یعنی اپنی ذات سے بلا واسطہ پیدا فرمایا کما سیاتی تقریرہ-
ভাবার্থ: মুহাক্কিক বা বিশ্লেষকদের মতে নূর তাকেই বলে, যে স্বয়ং প্রকাশমান এবং অন্যকেও প্রকাশকারী, যেমনটি হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত, আল্লামা যারকানী নিজ ’শরহে মাওয়াহিব শরীফে’ উল্লেখ করেছেন। এ অর্থে মহান আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন নূরে হাকিকী বা প্রকৃত حقيقة তিনি-ই একমাত্র নূর, আর الله نور السموات والارض ‘আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি’ আয়াতে কারীমায় জটিল ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে স্বীয় হাকিকী অর্থে প্রযোজ্য হবে। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা নিজেই প্রকাশমান এবং অন্যকেও প্রকাশকারী। আসমান, জমিন উভয়ের অধিবাসী এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতকে জাহির বা প্রকাশ করেছেন। হুজুর পুর নূর সাইয়েদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃসন্দেহে আল্লাহতা’য়ালার জাতি নূর কর্তৃক সৃষ্ট। (অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিবের জাতি নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করে সেই নূরের সম্পর্ক বেলাওয়াসেতা বা ডাইরেক্ট আল্লাহর জাতের সঙ্গে রেখেছেন। এ অর্থে আল্লাহর জাতি নূর কর্তৃক সৃষ্টি বলা হয়ে থাকে।)
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে -
ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره-
হে জাবির! নিশ্চয় আল্লাহতা’য়ালা সবকিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর স্বীয় নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। শায়খ আব্দুর রাজ্জাক এ হাদিসখানা বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ ইমাম বায়হাকিও বর্ণনা করেছেন।
হাদিস শরীফে من نوره ‘মিননূরুহি’ বর্ণিত হয়েছে, যার ضمير ‘জমির’ আল্লাহতা’য়ালার ইসমে জাতের দিকে প্রত্যার্পন করেছে। من نور جماله ‘মিন নূরে জামালিহি’ অথবা نور علمه ‘নূরে ইলমিহি’ অথবা نور رحمته ‘নূরে রাহমাতিহি’ ইত্যাদি বলেননি, যেহেতু নূরে সিফাত দ্বারা সৃষ্টি বলা হয়নি।
আল্লামা জারকানী আলাইহির রহমত উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন - من نوره اى من نور هو ذات - অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওই নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যা عين ذات الهى‘আইনে জাতে ইলাহি’ বা আল্লাহর প্রকৃত জাত, অর্থাৎ, নিজ জাত কর্তৃক কোনো মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন।
শারিহে বোখারি আল্লামা ইমাম কাসতালানী রাদিয়াল্লাহু আনহু مواهب لدنيه ‘মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ শীর্ষক কিতাবে হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একখানা দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিস শরীফে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সম্বোধন করে বলেন -
قال يا جابر ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره (الحديث)
অর্থাৎ, ‘হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রশ্নের জবাবে আল্লাহর হাবিব বললেন, হে জাবির! নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা সমুদয় বস্তু সৃষ্টির পূর্বে তাঁর নূর কর্তৃক তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।’
উক্ত হাদিস শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানী আলাইহির রহমত ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেন -
من نوره اضافة تشريف واشعار بانه خلق عجيب وان له شانا مناسبة ما الى الحضرة الربوبية على حد قوله تعالى ونفخ فيه من روحه وهى بيانية اى من نور هو ذاته لابمعنى انها مادة خلق نوره منها بل بمعنى تعلق الارادة به بلا واسطة شئ فى وجوده-
অর্থাৎ, মিন নূরিহি তাঁর (আল্লাহর) নূর হতে বা নূর কর্তৃক - এটি ইজাফতে তাশরিফি বা সম্মানসূচক সম্বন্ধ এবং এ কথা জানিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য যে, এটি সৃষ্টিজগতের এক আশ্চর্য বস্তু। এর একটি পৃথক শান রয়েছে আল্লাহতা’য়ালার দরবারে। এ শানটির একটি মুনাসিবত বা সাদৃশ্য হতে পারে আল্লাহতা’য়ালার ওই বাণীর সাথে, যেখানে এরশাদ হয়েছে - ونفخ فيه من روحه আদম আলাইহিস সালামের দেহ মোবারকে তাঁর (আল্লাহর) রূহ ফুঁকলেন, অর্থাৎ, এখানে রূহের সম্বন্ধ আল্লাহতা’য়ালার দিকে সম্মানার্থে করা হয়েছে।
من نوره -এর মধ্যে من ‘হরফে জার’ বয়ানিয়া, বর্ণনামূলক।من نوره এর মধ্যে যে নূর রয়েছে, এর ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত বলেন -
اى من نور هو ذاته - অর্থাৎ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, সে নূর আল্লাহতা’য়ালার জাত; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টির মাদ্দা বা মূল ধাতু, বরং এর অর্থ এই যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টি করার মধ্যে আল্লাহতা’য়ালার এরাদা বা ইচ্ছার সম্পর্ক বেলা ওয়াসেতা বা সরাসরি অর্থাৎ কোনো কিছুর মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন।
আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত-এর উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালা হেকমতে কামেলার দ্বারা সর্বপ্রথম তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সৃষ্ট নূরের ডাইরেক্ট বা সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর জাতের সঙ্গে রয়েছে।
এ জন্যে বলা হয়ে থাকে, আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম عین ذات الھی سے پیدا ہوا আল্লাহর প্রকৃত জাত কর্তৃক সৃষ্ট।
সুতরাং আল্লাহ হচ্ছেন নূরে হাকিকী, অর্থাৎ, নূর সৃষ্টিকারী; আর রাসূলেপাক হচ্ছেন সৃষ্টিতে নূর جنس ‘জিনছে’ বা জাতিতে বশর, অর্থাৎ, নূরের মনুষ্য আকৃতি।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আল্লাহর জাত বা মূল সত্তা হচ্ছেন নূরে হাকিকী বা হাকিকী নূর। আল্লাহতা’য়ালার নূরের অংশ হয় না, টুকরো হয় না, ভাগ হয় না, এ নূরের কোনো উদাহরণ বা মিসাল নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ফাসী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘মাতালিউল মুসাররাত শরহে দালাইলুল খায়রাত’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেন -
قد قال الاشعرى انه تعالى نور ليس كا الانوار والروح النبوة القدسية لمعة من نوره والملئكة شرر تلك الانوار وقال صلى الله تعالى عليه وسلم اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق كل شئ وغيره مما فى معناه-
অর্থাৎ, ইমামে আহলে সুন্নাত আবুল হাসান আশআরী আলাইহির রহমত এরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহতা’য়ালা নূর; কিন্তু অন্য কোনো নূরের মত নন (যার কোন উদাহরণ নেই)। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহ মোবারক সেই নূরেরই ঝলক এবং ফেরেশতাগণ ওই জ্যোতি থেকে ঝড়ে পড়া নূরের খণ্ডসমূহ। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর মোবারককে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর হতেই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।
শায়খ মুহাক্কিক আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০৫২ হিজরি) নিজ ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ শীর্ষক গ্রন্থের ২/৭৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
انبیاء مخلوق انداز اسماء ذاتیہ حق واولیاء ازاسماء صفاتیہ وبقیہ کائنات ازصفات فعلیہ وسید رسل مخلوق ست ازذات حق و ظھور حق دروی بالذات ست-
অর্থাৎ, ‘আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে আল্লাহতা’য়ালার ইসমে জাত (সত্তাগত নাম) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আউলিয়ায়ে কেরামগণকে আসমায়ে সিফাতিয়া (গুণগত নামসমূহ) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যান্য সকলকে সৃষ্টি করা হয়েছে সিফাতে ফে’লিয়া (ক্রিয়াগত গুণসমূহ) থেকে। সাইয়িদুল মুরসালিন (দ:)-কে হক তা’য়ালার জাত (সত্তা) কর্তৃক সৃষ্টি করা হয়েছে। আর হক তা’য়ালার বহিঃপ্রকাশ বা বিকাশ ঘটেছে তাঁর মধ্যে সত্তাগতভাবে।’
আল্লাহপাকের জাত সম্পর্কে মুফতি মোস্তফা হামিদী সাহেবের ভুল ব্যাখ্যা
শর্ষিণা দারুচ্ছুন্নাত কামেল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ মোস্তফা হামিদী সাহেব ‘ফাতাওয়ায়ে দারুচ্ছুন্নাত’ নামের একখানা পুস্তক সংকলন করেছেন। উক্ত পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডের ২১ পৃষ্ঠায় - الله نور السموات والارض ‘আল্লাহতা’য়ালা আসমান জমিনের নূর’ - এ আয়াতে কারীমার তাফসির করতে গিয়ে ‘তাফসিরে কবির’ নামক কিতাবের নিম্নলিখিত এবারত পেশ করে প্রমাণ করতে অপচেষ্টা করেছেন যে - نور ‘নূর’ আল্লাহতা’য়ালার জাত হতে পারে না।
اعلم ان لفظ النور موضوع فى اللغة لهذه الكيفية الفائضة من الشمس والقمر والنار على الارض والجدران وغيرهما وهذه الكيفية يسحيل ان تكون الها لوجوه الخ-
জানা উচিত যে, আভিধানিক অর্থে নূর ওই আলোকে বলে, যা সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি হতে ভুপৃষ্ঠে প্রাচীর ও অন্যান্য বস্তুর ওপর পতিত হয়। আর আলোর এ অবস্থাকে কয়েকটি কারণে ইলাহ (প্রভু) বলা অসম্ভব।
উপরোক্ত এবারতের যে ভাবার্থ, তা হলো সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালার نور হচ্ছে হাকিকী নূর, যার অর্থ منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী। আল্লাহর নূর হচ্ছে নূরে মতলক।
আল্লাহ-ই হচ্ছেন একমাত্র নূর। আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর যে নূরের এতলাক হয়, তা হচ্ছে বিজ্জাত জুলমত বা অন্ধকার। যাঁকে আল্লাহ নূর করেছেন, তিনি-ই হচ্ছেন আল্লাহর সৃষ্টি নূর। যেমন সহিহ হাদিস শরীফে রয়েছে, আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন’। নবী হচ্ছেন আল্লাহর সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালার নূর হচ্ছে হাকিকী নূর। যার আরম্ভও নেই, শেষও নেই। তিনি হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ। অবশ্যম্ভাবী যার তুলনা সৃষ্টির মধ্যে কেউই নেই, এবং আল্লাহতা’য়ালার জাতে কোনো শরীক নেই। তেমনি আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লার সিফাতে খাসসা বা খাস গুণাবলীরও কোনো নজির নেই।
ইতিপূর্বে ‘তাফসিরে কবির’ নামের কিতাব হতে মুহাক্কিকীনদের তাহকিক-এর দলিল সহকারে ৫টি এবারতের মাধ্যমে উল্লেখ করে প্রমাণ করা হয়েছে:
১. আল্লাহতা’য়ালাই একমাত্র নূর। আল্লাহ ছাড়া সব কিছু بالذات বা সত্তাগতভাবে মুজলিম বা অন্ধকার।
২. আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন নূরে মতলক এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর নূরের এতলাক বা অন্য কাউকে নূর বলে আখ্যায়িত করা রূপক অর্থে (মজাজি) নূর।
হামিদী সাহেব ‘তাফসিরে কবির’ নামের কিতাবের সৃষ্ট নূর-এর এবারত পেশ করে আল্লাহর জাত নূর নয় বলে যে দাবি করেছেন, তা সঠিক নয়। তা ব্যাখ্যার নামে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কিন্তু এ তাফসিরে আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমতের তাহকিকাত পেশ করে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত স্পষ্টভাবে তাহকিকের সাথে আল্লাহর ‘জাত’ যে নূর যার অর্থ منور ‘মুনাওইর’ তা প্রমাণ করেছেন।
হামিদী সাহেব তাফসিরে কবিরের আদ্যপান্ত পাঠ করেন নাই। তাই নিজের মনগড়া মতে ফতওয়া দিয়েছেন। তার এ ফতওয়া সংশোধন আমরা কামনা করি।
আল্লাহপাকের জাত ও সিফাত সম্পর্কে আকিদা
হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত-এর ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন -
انه واحد لاشريك له فرد لا مثل له صمد لا ضد له منفرد لا ند له وانه قديم لا اول له ازلى لا بداية له مستمر الوجود لا اخر له ابدى لا نهاية له قيوم لا انقطاع له دائم لا انصرام له لم يز
ل ولا يزال موصوف نبعوث الجلال لا يقضى عليه بالانقضاء والانفصال بتصرم الاماد (اى لا يقضى عليه بانقضاء تصرم الاماد) وانقراض الاجال بل هو الاول والاخر والظاهر والباطن-
অর্থাৎ, নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) তাঁর অস্তিত্বে অদ্বিতীয়; তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো সাদৃশ্য-ও নেই; তিনি অভাবশূন্য, তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই; তিনি সর্বেসর্বা, তাঁর কোনো অংশীদার নেই; তিনি অনাদি ও অসীম, সর্বক্ষণ বিরাজমান, তাঁর কোন বিরাম নেই; তিনি অনন্তকাল স্থায়ী, তাঁর কোনো শেষ নেই, তিনি গৌরবের গুণে সকল সময়ই গুণান্বিত ছিলেন, আছেন ও থাকবেন, সময়ের অতীতেও তাঁর শেষ নেই। তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গুপ্ত এবং সর্ব বিষয়ে তিনি-ই মহাজ্ঞানী।
তারপর ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত উক্ত কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন -
وانه ليس بجسم مصور ولا جوهر محدود مقدر انه لا يماثل الاجسام لا فى التقدير ولا فى قبول الانقسام وانه ليس بجوهر ولا تحله الجوهر ولا يعرض ولا تحله الاعراض بل لا يماثل موجودا ولا يماثله موجود ليس كمثله شئ ولا هو مثل شئ وانه لا يحده المقدار ولا تحويه الاقطار ولا تحيط به الجهات ولا تكشفه الارضون ولا السموات وانه مستو على العرش على الوجه الذى قاله وبالمعنى الذى اراده استواء منزها عن المماسة والاستقرار والتمكن والحلول والانتقال لا يحمله العرش بل العرش وحملته محمولون بلطف قدرته ومقهورون فى قبضته-
ভাবার্থ: আল্লাহ অশরীরী, নিরাকার, পরিমাণশূণ্য, সাদৃশ্যহীন, তকদীরহীন, অবিভাজ্য, অণু-পরমাণূশূন্য, তাঁর দৈর্ঘ বা প্রস্থ নেই, কোনো জিনিস দ্বারা তাঁর দৃষ্টান্ত দেয়া যায় না, তিনি কোনো জিনিসের তুল্য-ও নন, তাঁর মতো আর কিছুই নেই। তিনি কোনো জিনিসের মতো নন। তিনি পরিমাণের ভেতর সীমাবদ্ধ নন, কোনো স্থানের ভেতর তিনি আবদ্ধ নন, কোনো দিক তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না। আসমান ও জমিন তাঁকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তিনি পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে মুক্ত। তিনি আরশের সম্মুখে অবস্থিত, যার সম্মন্ধে আল্লাহ নিজেই বলেছেন - استوى على العرش - আর ইসতাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে তিনি (আল্লাহ) মুক্ত। আরশ তাঁকে বহন করে না (অর্থাৎ, আল্লাহ আরশে বসতে পারেন না, কারণ আল্লাহ নিরাকার, অশরীরী), বরং আরশ ও তার বহনকারী (ফেরেশতা)-কে আল্লাহর কুদরতের করুণা বহন করে আসছে। সবকিছুই আল্লাহর আয়ত্তাধীন।’
তারপর তিনি বলেন -
وهو الان على ما عليه كان وانه بائن عن خلفه بصفاته ليس فى ذاته
অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) পূর্বে যেরূপ ছিলন, এখনও তিনি সেরূপই আছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির কাছে গুণ দ্বারা প্রকাশ, অস্তিত্ব বা জাত দ্বারা নয়।
আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন’ শীর্ষক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৪ পৃষ্ঠায় আরো বলেন -
يرى من غير حدقة واجفان ويسمع من غير ضمخة واذان كما يعلم بغير قلب ويبطش بغير جارخة ويخلق بغير اله اذ لاتشبه صفاته صفات الخلق كما لا تشبه ذاته ذات الخلق-
অর্থাৎ, আল্লাহ পাক চক্ষু ব্যতিরেকে দেখেন, কর্ণ ব্যতিরেকে শুনেন, দ্বিল ব্যতিরেকে জ্ঞান রাখেন, হস্ত ব্যতিরেকে ধরেন, যন্ত্র ব্যতিরেকে সৃষ্টি করেন, তাঁর গুণ সৃষ্টির তুল্য নয়। যেরূপ তাঁর অস্তিত্ব সৃষ্টির অস্তিত্বের তুল্য নন।
সারকথা, আল্লাহর মহান গুণ হলো আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী বা মুহতাজ নন, الله الصمد - আল্লাহ হলেন সমদ বা বে-নিয়াজ। অর্থাৎ, আল্লাহর দেখতে চোখের প্রয়োজন নেই, শুনতে কানের প্রয়োজন নেই, জ্ঞান রাখতে দিলের প্রয়োজন নেই, ধরতে হাতের প্রয়োজন নেই।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘তাকমীলুল ঈমান’ শীর্ষক কিতাবে আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন -
وليس مجسم ولا جوهر ولا عرض ولا مصور ولا مركب ولا معدود ولا محدود ولا فى جهة ولا فى مكان ولا فى زمان-
অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) দেহবিশিষ্ট নন, তিনি জওহর বা বস্তু বিশেষ নন, আরজ বা বস্তু বিশিষ্টও নন। তিনি আকারবিশিষ্ট নন, তিনি মুরাক্বাব নন (তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই); সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন, পরিমাণযোগ্য নন, তিনি দিকশূন্য, তিনি কোনো স্থানে অবস্থান করেন না এবং তাঁর ওপর কোনো সময় অতিক্রান্ত হয় না। অর্থাৎ, তিনি নিরাকার, জমান-মকান ও দিক থেকে তিনি পবিত্র।
তারপর তিনি উক্ত কিতাবে আরো বলেন -
لا مثل له ولا شبه ولا ضد ولا ند له ولا ظهر ولا معين-
অর্থ: তিনি উপমাহীন, রূপকহীন, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তাঁর সাহায্যকারী ও সহযোগী কেউ নেই; অর্থাৎ, তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি হলেন সমদ বা কারো মুখাপেক্ষী নন।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি কোনো বস্তুর মতো নন, কোনো বস্তুও তাঁর মতো নয়; গোটা আলম তথা আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবই হাদস, অর্থাৎ, ধ্বংসশীল/বিনাশপ্রবণ। যখন এসব কিছুই ছিল না, তিনি তখনও ছিলেন; আবার যখন কোনো কিছুই থাকবে না, তিনি তখনও থাকবেন। তিনি একাই নিজের কুদরত দ্বারা সম্পূর্ণ ‘নেই’ হতে সব কিছু সৃজন করেছেন, তথা অস্তিত্ব দান করেছেন; তিনি-ই হলেন আল্লাহ। তিনি এক, একক ও অদ্বিতীয়, অনাদি, অবিনশ্বর, শাশ্বত ও চিরঞ্জীব, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা এবং স্বাধীন ও কার্যকর ইচ্ছাশক্তির মালিক। তিনি عرض ‘আরজ’ তথা এমন বস্তু নন, যা অন্যের মাধ্যম ছাড়া স্থিতিশীল হতে পারে না। যথা - রং, গন্ধ, স্বাদ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি। তিনি জিসিম তথা দেহবিশিষ্ট নন। কেননা, দেহ বহু অবিভাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং স্থান দখলকারী। অথচ এ সবই নশ্বর সৃষ্টিকুলের বৈশিষ্ট্য। তিনি মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর আকার-আকৃতিবিশিষ্টও নন। কেননা, এটি (আকৃতি) দেহের বৈশিষ্ট্য, যা দেহের প্রান্তসীমা ও পরিধি তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ দ্বারা অর্জিত অবস্থা তথা আয়তন ও পরিমাণ হতে সৃষ্টি হয়ে থাকে। তিনি প্রান্ত, সীমা ও পরিধিবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ, তিনি সসীম তথা পরিমাণযোগ্য নন। বরং তিনি আদি, অন্ত ও মধ্যহীন; তিনি অনন্ত, অসীম। তিনি সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ, তিনি গণণা ও পরিসংখ্যানযোগ্য নন। তিনি অংশ ও আংশিকতামুক্ত। তাঁর জাত বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডে ও অংশে বিভক্ত ও বিভাজ্য হয় না। বহু পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্র অংশে মিলিত হয়ে তাঁর জাত গড়ে ওঠেনি। কেননা, যার অংশ থাকে এবং যা বহু বিচ্ছিন্ন অংশ দ্বারা সংযোজিত, তার অস্তিত্ব লাভের ক্ষেত্রে ওই সব অংশের প্রতি মুখাপেক্ষিতা অপরিহার্য। আর এই মুখাপেক্ষিতা আল্লাহর অনিবার্য সত্তার পরিপন্থী। তাঁর ওপর কোনো সময় অতিক্রান্ত হয় না। তাঁর সাথে কোনো বস্তুর সাদৃশ্য নেই। তাঁর ইলম ও কুদরত-বহির্ভুত কোনো বস্তু নেই। তাঁর জাতের মধ্যে অন্য কোনো বস্তু স্থান পায় না এবং পেতে পারে না। তিনি কোনো বস্তুতে প্রবেশ করেন না এবং তাঁর মধ্যেও কোনো বস্তু প্রবেশ করে না এবং করতেও পারে না; আর তিনি কোনো বস্তুর সাথে এক হয়ে যান না। তিনি অনন্ত ও অসীম। কেননা সসীম হওয়া পরিমাণ ও পরিসংখ্যানযোগ্য বস্তুর বৈশিষ্ট্য। তিনি অংশ ও আংশিকতামুক্ত। তিনি কোনো বস্তুর শ্রেণিভুক্ত নন। তিনি দেহের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুণাবলী যথা - রং, স্বাদ, গন্ধ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি হতে মহাপবিত্র। কেননা, এসবই দেহ তথা সংযোজিত ও সংমিশ্রিত বস্তুর গুণ। তিনি কোনো স্থানে অবস্থান করেন না।
অনুরূপভাবে, শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজ ‘আল কাওলুল জামিল’ শীর্ষক কিতাবের ৩৭ পৃষ্ঠা লিখেছেন -
منزه من جميع سمات النقص والزوال من الجسمية والتحير والعرضية والجهة والالوان والاشكال-
অর্থাৎ, ‘আল্লাহতা’য়ালা অপূর্ণতা ও নশ্বরতা, এ জাতীয় সবকিছু থেকে মুক্ত। তিনি দেহধারী, স্থান গ্রহণকারী, কোনো দিকে অবস্থানকারী, বর্ণ ও আকৃতিধারী এবং দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী নন।
‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের (উর্দু) ১১৫৮/৬২পৃষ্ঠায় মাকতুবাত নং ৬৭) উল্লেখ করেন -
اور اللہ کسی چیز سے متحد نہیں ہوتے اور نہ ھی کوئ اور چیز ان سے متحد ہوتی ہے اور اللہ تعالی کسی چیز میں حلول بھی نہیں کرتا اور نہ ھی کوئ چیز اللہ میں حلول کرتی ھے اور اللہ تعالی کے لۓ اجزاء اور حصص کا ہونا بھی محال ہے اور ترکیب وتحلیل اللہ تعالی کی بارگاہ میں ممنوع ھے اور اللہ تعالی کا کوئ مثل اور کفو نہیں ھے بیوی بچے نہیں ہیں- اسکی ذات وصفات بے چوں بے جگون اور بے شبیہ اور بے نمونہ ہیں- ھم صرف اتناجنتے ہیں کہ اللہ تعالی اور اسماء وصفات کاملہ سے جن سے اپنے آپ کی تعریف کی ہے ان سے متصف ہے ان میں جو چیز بھی ہمارے فھم وادراک اۓ اور ہم اسے سمجہ سکیں اور تصور کرسکا وہ اس سے پاک اور بلند ہے-
ভাবার্থ: আল্লাহতা’য়ালা কোনো বস্তুর সাথে একত্রিত নন এবং কোনো বস্তু তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায় না। আল্লাহতা’য়ালা কোনো বস্তুর ভেতর অনুপ্রবেশ করেন না। আল্লাহতা’য়ালার পক্ষে খণ্ড ও অংশ হওয়া অসম্ভব। তরকীব বা সংমিশ্রণ, তাহলিল বা দ্রবীভূত হওয়া তাঁর পাক জাতে দুষ্কর ও নিষিদ্ধ। আল্লাহতা’য়ালার কোনো অনুরূপ ও সমশ্রেণিভূক্ত কেউই নেই। তাঁর স্ত্রী-পুত্রও নেই। তাঁর জাতে ও সিফাত বা গুণাবলীসমূহ রকম বা প্রকারবিহীন এবং অনুরূপ ও নিদর্শন রহিত। আমরা শুধু এতোটুকু জানি (ঈমান রাখি) যে আল্লাহতা’য়ালা আছেন এবং তিনি যেরূপ নিজের প্রশংসা করেছেন, তদ্রুপ তাঁর নাম ও কামেল গুণাবলীতে বর্তমান আছেন।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা স্বেচ্ছায় অস্তিত্ববান এবং অপরাপর সবকিছুই তাঁর সৃষ্টির কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে, আল্লাহপাক আপন জাত ও সিফাত এবং কর্মকাণ্ডের মাঝে সম্পূর্ণ একা। প্রকৃতপক্ষে কোনো বিষয়েই, চাই তা অস্তিত্ব হোক, অথবা অস্তিত্বহীন হোক, কেউই তাঁর সঙ্গে অংশীদার নন। নামগত অংশিদারিত্ব ও শব্দগত সম্পর্ক আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
মাকতুবাত ৩/১১৫৭/৬২ পৃষ্ঠা মাকতুবাত নং ৬৭ উল্লেখ রয়েছে -
اللہ سبحانہ وتعالی اکیلا ہے ان کا کوئ شریک نہیں نہ وجوب ووجود میں اور نہ عبادت کے مستحق ہونے میں- وجود وجوب (لازمی طور پر قائم رھنا) اللہ تعالی کے سوا کسی کے لۓ لائق نہیں اور نہ عبادت کا استحقاق اس کے سوا کسی کے لۓ درست نہیں-
اللہ تعالی صفات کاملہ رکھتا ہے جن میں سے حیات- علم- قدرت- اردہ- سمع- بصر- کلام اور تکوین بھی ہیں- یہ صفات ازلی اور قدیمی ہیں- اور اللہ جل سلطانہ کی ذات کے ساتھ قائم ہیں
ভাবার্থ: আল্লাহপাক সুবহানাহু ওয়াতায়ালা এক তাঁর কোন শরিক বা সমকক্ষ নেই। অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী হিসেবে হোক অথবা এবাদতের উপযোগী হিসেবেই হোক, তিনি সমকক্ষবিহীন। তিনি ছাড়া অন্য কেউই অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের উপযোগী নন এবং ইবাদতের যোগ্যতাও কেউই রাখেন না।
আল্লাহতা’য়ালার সিফাতে কামেলা বা পূর্ণাঙ্গ গুণ সর্বমোট ৮টি; এগুলো নিম্নরূপ -
১. হায়াত বা জীবনী শক্তি
২. এলম বা জ্ঞান
৩. কুদরত বা ক্ষমতা
৪. এরাদত বা ইচ্ছাশক্তি
৫. ছামা বা শ্রবণশক্তি
৬. বছর বা দর্শনশক্তি
৭. কালাম বা বাকশক্তি
৮. তাকবিন বা সৃষ্টিশক্তি
এ ৮টি সিফাতসমূহ কাদীম ও আজলি বা অনাদি (যার কোনো আরম্ভ নেই) ও অনন্ত (যার কোনো শেষ নেই)। এ গুণসমূহ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর জাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নবজাত বস্তুসমূহের সাথে সম্পর্ক সিফাতসমূহের অনাদিত্বের মধ্যে কোনোরূপ ব্যতিক্রম ঘটাতে সক্ষম হয় না। সম্পর্কিত বস্তুর নতুনত্ব এদের চিরস্থায়িত্বের প্রতিবন্ধক হয় না।’
মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী ৩/১৬১৩/১৫৩ পৃষ্ঠা মকতুব নং ১২২ উল্লেখ রয়েছে -
آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی اس جاہ وجلال اور اس بلندی شان کے با وجود ہمیشہ ممکن ہیں اور ہرگز امکان سے باہر نہیں آسکتے اور نہ واجب سے مل سکتے کیونکہ یہ الوھیت سے متصف ہونے کو مستلزم ہے اور تعالی اس سے بلند ھے کہ کوئ اسکا شریک اور برابری کرنے والا ہو-
دع ما ادعتہ النصاری فی نبیھم
واحکم بما شئت مدحا فیہ واحتکم
ভাবার্থ: হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ শান-শওকত ও কুল-কায়েনাতের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবসময় (চিরকালই) তিনি হচ্ছেন ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য ও সৃষ্ট। নিশ্চয় তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য হতে নিষ্কৃতি লাভ করেননি এবং আল্লাহতা’য়ালা যিনি واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী জাতে পাকের সাথে মিলিত হতে পারেন না; এজন্য জাতে উলুহিয়াতের সাথে মিলিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা তাঁর সমকক্ষ ও শরিক হওয়া হতে তিনি অতি উর্ধ্বে ও পবিত্র।
কহিল নাছারা যাহা স্বীয় নবীর ’পরে
কহিও না তোমরা তাহা মম নবী-বরে।
মাহবুবে খোদা আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি নূর
আল্লাহর হাবিব সৃষ্ট নূর এবং তাঁর নূর দ্বারা আল্লাহ পাক কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন। একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজ مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ শীর্ষক কিতাবের ২/২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
بدانکہ اول مخلوقات وواسطۂ صدور کائنات وواسطۂ خلق عالم وآدم نور محمدست صلی اللہ علیہ وسلم- چنانکہ درحدیث صحیح وارد شدہ کہ اول ما خلق اللہ نوری وسائرمکونات علوی وسفلی ازان نور وازان جوھر پاک پیدا شدہ ازارواح واشباح وعرش وکرسی ولوح وقلم وبہشت ودوزخ وملک وفلک وانس وجن وآسمان وزمین وبحار وجبال واشجار وسائر مخلوقات ودرکیفیت صدور این کثرت ازان وحدت وبروز وظھور مخلوقات ازان جوھر عبارات وتغيرات غر
يب آوردہ اند وحدیث اول ما خلق اللہ العقل نزد محققین ومحدثین بصحت نرسیدہ وحدیث اول ما خلق اللہ القلم نیزگفتہ اند کہ مراد بعد العرش والماءاست کہ واقع شدہ است وکان عرشہ علی الماء الخ-
ভাবার্থ: এ এক চিরন্তন বাস্তবতা যে, নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির প্রথম, সমস্ত কায়েনাতের ওসিলা, বিশ্বজগৎ এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টির মাধ্যম হচ্ছে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সহিহ হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী’
অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা সমস্ত মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং ঊর্ধ্ব ও অধঃজগতের সবকিছুই নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূর মোবারক থেকে সৃষ্ট। তাঁর পবিত্র নূরী জাওহার থেকে সৃষ্টি হয়েছে রূহসমূহ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, ফেরেশতা, ইনসান, জিন, আসমান, জমিন, সাগর, পাহাড়, গাছ, বৃক্ষ এবং কুল মাখলুকাত। এ সকল কিছুর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে তাঁরই ওসিলায়। সেই হাকিকতের প্রকাশে বিজ্ঞ বিজ্ঞ আলেমগণ বিস্ময়কর ও সূক্ষ বর্ণনা পেশ করেছেন।’
এক রেওয়ায়েতে এসেছে -اول ما خلق الله العقل ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহুল আকলু’; আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আকল সৃষ্টি করেছেন। তবে এই হাদিস মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিসগণের মতে সহিহ-এর স্তরে পৌঁছেনি। অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে - اول ما خلق الله القلم ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু কলম’ সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা কলম সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটির অর্থ মুহাদ্দিসগণ এভাবে করেছেন যে, আরশ ও পানি সৃষ্টির পরে প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার কোনো কোনো হাদিসের ব্যাখ্যায় এ রকম এসেছে যে, পানি সৃষ্টি হয়েছিল আরশের পূর্বে وكان عرشه على الماء
এর পরপরই আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন, হাদিস শরীফে এসেছে, যখন কলম সৃষ্টির পর আল্লাহতা’য়ালা তাকে বললেন লেখো, তখন কলম বললো, কী লেখবো? আল্লাহতা’য়ালা বললেন, ما كان وما يكون الى الابد ‘মা কানা ওয়ামা ইয়াকুনু ইলাল আবাদ’ অতীত এবং ভবিষ্যতের সবকিছু লিখো। এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, কলম সৃষ্টির পূর্বেও কিছু সৃষ্টি হয়ে ছিল। আলেমগণ বলেন, আরশ, কুরসি এবং রূহসমূহ সৃষ্টির পূর্বে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক প্রকাশ্য জগতে এসেছে। ما كان ‘মা কানা’ যা কিছু হয়েছিল এ অর্থই বহন করে। তা হলো নূরে মুহাম্মদীর হাল ও সিফাতসমূহ। কেননা, সমগ্র জগতের মধ্যে নূরে মুহাম্মদী অগ্রগণ্যতা সুসাব্যস্ত اول ما خلق الله نورى অপরদিকে وما يكون ‘ওমা ইয়াকুনু’-এর অর্থ হলো, পৃথিবীর পরবর্তীতে প্রকাশিতব্য সকল কিছু। আলমে জহুর বা বাহ্যিকজগতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রমাণিত ছিল। যেমন আল্লাহর হাবিব বলেছেন, كنت نبيا وادم بين الروح والجسد অর্থ: আমি ওই সময়ও নবী ছিলাম, যখন আদম আলাইহিস সালাম আত্মা ও দেহের মাঝামাঝিতে ছিলেন। (মাদারিজুন নবুয়ত- ২-৩ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত হাদিসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন -
ودر اخبار آمدہ است کہ چون مخلوق شد نور انحضرت وبیرون آمدازوی انوار انبیاء علیہم السلام امرکرد اورا پروردگار تعالی کہ نظر کند بجانب انوار ایشان پس نظر کرد آنحضرت وپوشید انوار ایشاں را گفتندای پروردگار ما این کیست کہ پوشید نوروی انوار ما را گفت اللہ تعالی این نور محمد بن عبد اللہ است اگر ایمان آرید بوے میگرادنم شمارا انبیاء گفتند ایمان آوردیم یارب بوے وبہ نبوت وی پس گفت رب العزت جل جلالہ گواہ شدم برشمادانیست معنی قول حق سبحانہ تعالی واذا اخذ اللہ میثاق النبیین لما اتیتکم من کتاب رحکمۃ الایۃ- مدارج النبوۃ ص ۳/ ۲
ভাবার্থ: ‘হাদিস শরীফে এসেছে, যখন নূরে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হলো এবং তাঁর নূর থেকে (আল্লাহর হাবিবের নূর থেকে) সকল নবীগণ আলাইহিমুস সালাম-এর নূরসমূহ বের করা হলো, তখন আল্লাহতায়ালা নূরে মোস্তফা আলাইহিস সালামকে বললেন, ওই নূরসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। তিনি তাই করলেন। ফলে তাঁর নূর সকল নূরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করলো এবং অন্যান্য নূর হয়ে গেল আলোকবিহীন। তাঁরা নিবেদন করলেন, হে পরওয়ারদিগারে আলম! তা কার নূর, যা আমাদের সকলের নূরকে ম্লান করে দিলো? আল্লাহতা’য়ালা ইরশাদ করলেন, এ নূর মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর। তোমরা যদি তাঁর প্রতি ঈমান আনো, তবে আমি তোমাদেরকে নবী বানাবো। সকলেই সমস্বরে বললেন, হে আমাদের রব! আমরা তাঁর প্রতি ও তাঁর নবুয়তের প্রতি ঈমান আনলাম। আল্লাহতা’য়ালা অতঃপর বলেন, আমি তোমাদের এ কথার সাক্ষী রইলাম। এদিকে ইঙ্গিত করেই কোরআন মজীদের এক আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে -
واذ اخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب و حكمة الخ
অর্থাৎ, আল্লাহ যখন নবীগণের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করবো। (মাদারিজুন নবুয়ত, ২-৩ পৃষ্ঠা)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৩য় জিল্দ ৮ পারা ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
(وانا اول المسلمين ۱٦۳) وقيل: هذا اشارة الى قوله عليه الصلوة والسلام- اول ما خلق الله تعالى نورى-
অর্থাৎ, আলোচ্য আয়াতে কারীমার তাফসিরে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর اول ما خلق الله نورى ’সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন’ বাণীতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
تفسير روح البيان ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ ৩য় জিলদের সূরায়ে আনআম ১২৯ পৃষ্ঠায় আশ শায়খ ইসমাঈল হক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) বলেন -
(وانا اول المسلمين) يعنى اول من استسلك عند الايجاد لامركن وعند قبول فيض المحبة لقوله (يحبهم ويحبونه) والاستلام للمحبة فى قوله يحبونه دل عليه قوله عليه السلام (اول ما خلق الله نورى)
অর্থাৎ, وانا اول المسملين ’আমি সর্বপ্রথম মুসলমান’ - এর অর্থ হলো, সর্বপ্রথম সৃষ্টি করার সময় আল্লাহতা’য়ালার আদেশ كن ‘কুন’ ’হয়ে যাও’কে আমি সর্বপ্রথম মেনে নিয়েছি। অনুরূপভাবে, মহব্বতের ফয়েজ গ্রহণ করার সময় আমি-ই সর্বপ্রথম তা গ্রহণ করেছি। কারণ আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন, তিনি তাঁদের মহব্বত করেন। আর তাঁরাও আল্লাহকে মহব্বত করেন। এ মহব্বতে ফয়েজ গ্রহণের বেলায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম, যা তাঁর বাণী ‘আল্লাহ তা’য়ালা আমার নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন’ প্রমাণ করছে।
শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন -
فضيلت اعلی واکمال وی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم آنست کہ پرور دگار تعالی روح اورا پیشتر ازارواح خلائق پیدا کردہ وارواح سائر مکونات را از روح وے منشعب گردایندہ ہمہ را از نوروی آفریدہ ووی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم نبی بودہ وآدم ھنوزمیاں روح وجسد بود کما رواہ الترمذی عن ابیھریرۃ رضی اللہ عنہ ودر عالم ارواح نیز فیض بارواح انبیاء از روح او رسیدہ، (مدارج النبوت جلد ۱ ص ۱٤۳)
ভাবার্থ: নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে উন্নত ও পরিপূর্ণ মর্যাদা হলো এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারককে অন্যান্য সকল রূহ মোবারকের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহর হাবিবের রূহ মোবারক হতে সমস্ত রূহ সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম রূহ ও জসদ বা শরীরাকৃতির মধ্যে থাকা অবস্থায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ছিলেন, যেমনটি তিরমিজি শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। অপরদিকে, আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে এমনকি সমস্ত নবীগণের রূহ মোবারকগণ ও সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক হতে পূর্ণ ফয়েজ ও বরকত প্রাপ্ত হয়েছেন।
শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজস্ব ‘ইনতেবাহ ফি সালাসিলিল আউলিয়া আল্লাহ’ নামের কিতাবের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
نور اول کہ آں نور محمدی ست صلی اللہ علیہ وسلم ونیز آں را شھود اول می گویند-
অর্থাৎ, নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম সৃষ্টি। এজন্য তিনি-ই সর্বপ্রথম আল্লাহর একত্বের স্বাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।
মোল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত مرقاة شرح مشكوة ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ শীর্ষক কিতাবের ১ম জিলদের ১৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
ان اول شئ خلق الله القلم وهو غير صحيح ... فا الاولية اضافيه والاول الحقيقى هو النور المحمدى على ما بينته فى المورد للمولد-
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। আর সেটা হচ্ছে গায়রে সহিহ বা অশুদ্ধ; অতএব, সেটা আউয়ালিয়তে এজাফি বা প্রথম। আর আউয়ালিয়তে হাকিকী প্রকৃত অর্থে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে নূরে মুহাম্মদী। এ সম্পর্কে আমি ‘মাওরিদু লিল মাওলিদ’ নামের কিতাবে সবিস্তারে বর্ণনা করেছি।
হুব্বে এলাহির প্রথম বিকাশ
সৃষ্টির প্রথমেই আল্লাহতা’য়ালার حب ‘হুব্ব’ اراده ‘ইরাদা’। সুতরাং তওয়াজুহে হুব্বী-ই, অর্থাৎ, মহব্বতের দৃষ্টি-ই হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি যা আল্লাহতা’য়ালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি সমস্ত মাখলুকাত সেই প্রথম সৃষ্টির শাখা এবং সমস্ত হাকিকত حب ‘হুব্ব’-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত তাঁর ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ (তৃতীয় জিলদের ১৬০৭ পৃষ্ঠা ও ১৪৯ পৃষ্ঠা ১২২ নং মাকতুব) কিতাবে উল্লেখ করেন -
اور حقیقت محمدی علیہ وعلی آلہ الصلوۃ والسلام جوکہ حقیقت الحقائق ہے- مراتب ظلال طے کرنے کے بعد اس فقیر پر آخرکار جو کچھ منکشف ہوا ہے وتعین وظھور حبی ہے جوکہ تمام ظھورات کا مبدآ اور تمام مخلوقات کی پیدائش کا منشا ہے- مشھور حدیث قدسی میں آیا ہے- كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف (میں ایک مخفی خزانہ تھا میں نے محبوب رکھاکہ میں پہچانا جاؤں پھر میں نے مخلوق کو پیدا کیا تاکہ میں پہچانا جاؤں) سب سے پہلی چیز جو اس مخفی خزانہ سے ظھور کے تخت پرجلوہ گرہوئ وہ محبت تھی جو کہ مخلوقات کی پیدائش کا سبب ہوئ- اگر یہ محبت نہ ہوتی تو ایجاد کا دروازہ نہ کھلتا اور عالم عدم میں مستقل طور پر اپنا ٹھکانا رکھتا- حديث قدسى لو لاك لما خلقت الافلاك (اگر تونہ ہوتا تو میں آسمانوں کو پیدا نہ کرتا) جوکہ خاتم الرسل کی شان میں واقع ہے کا راز اس جگہ سے معلوم کرنا چاھۓ اور لو لاك لما اظهرت الربوبيت (اگر تونہ ہوتا تو میں ربوبیت کو ظاھر نہ کرتا) کی حقیقت کو اس مقام میں تلاش کرنا چاھۓ
ভাবার্থ: হাকীকতে মুহাম্মদী আলাইহি ওয়ালা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম حقيقت الحقائق ‘হাকিকাতুল হাকাইক’ বা সমস্ত হাকিকতের হাকিকত বা মূল। সর্বশেষে প্রতিবিম্বসমূহের স্তরসমূহ অতিক্রম করার পর এ ফকিরের প্রতি যা বিকশিত হলো, তা আল্লাহপাকের ‘হুব্ব বা মহব্বতের বিকাশ, যা সৃষ্টিজগতের উৎপত্তির কারণ এবং আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা, হাদিসে কুদসিতে মশহুর রয়েছে -
(كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف)
‘আমি গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছিলাম। তৎপর আমি মুহব্বত রাখলাম যে, আমি পরিচিত হবো; এরপর আমি এক মাখলুক সৃষ্টি করলাম যাতে আমি পরিচিত হই।’
গুপ্ত ধনভাণ্ডার হতে সর্বপ্রথম যা প্রকাশ পেয়েছে, তাই হলো حب ‘হুব্ব’ বা মহব্বত। বিশ্বজগত সৃষ্টির কারণ এটি-ই। যদি এ হুব্ব বা মহাব্বত না হতো, তাহলে সৃষ্টির দ্বার উম্মুক্ত হতো না এবং জগতসমূহ নাস্তি বা শূন্যের গর্ভে দৃঢ়রূপে চিরস্থায়ী থাকতো।
এ ব্যাপারে হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ রয়েছে -
(لو لا ك لما خلقت الافلاك)
’যদি আপনি না হতেন, তাহলে আমি (খোদা) আকাশমণ্ডল সৃষ্টি করতাম না’, যা সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে এসেছে। তাঁর হাকীকত বা রহস্য এ স্থলে অন্বেষণ করা উচিত এবং لو لاك لما اظهرت الربوبيت ‘আপনি না হলে আমি নিজ প্রভুত্বও প্রকাশ করতাম না’ - এ হাদিসের তত্ব এস্থলে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামের কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ৭৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
(وصل در بیان سر تسمیہ وی صلی اللہ علیہ وسلم الخ)
অনুবাদ: রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারক حبيب خدا ‘হাবিবে খোদা’ হওয়ার রহস্যবলীর আলোচনা এবং তাঁর নাম মোবারক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাব্যস্ত হওয়ার কারণ।
এ সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে - আল্লাহর হাবিব বলেছেন, একদিন সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আল্লাহর হাবিব তাশরিফ আনলেন এবং সাহাবায়ে কেরামের নিকটবর্তী হলেন। শুনতে পেলেন, সাহাবিগণ পরস্পর আলোচনা করছেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার মাখলুকের মধ্য থেকে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে তাঁর খলিল বানিয়েছেন। অপরজন বললেন, আল্লাহতায়ালা মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে কথা বলেছেন। তৃতীয়জন বললেন, আল্লাহতা’য়ালা ঈসা আলাইহিস সালামকে কালিমুল্লাহ এবং রূহুল্লাহর মর্যাদা দান করেছেন। চতুর্থজন বললেন, আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা সফিউল্লাহ বানিয়েছেন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের কথোপকথন শুনলাম। তোমরা বলেছো, আল্লাহতা’য়ালা ইব্রাহিমকে খলিল, মুসাকে কালিমউল্লাহ, ঈসাকে রূহুল্লাহ এবং আদমকে সফিউল্লাহ বানিয়েছেন। তোমরা জেনে রাখো এবং হুশিয়ার হয়ে যাও যে, আল্লাহতা’য়ালা আমাকে حبيب الله ‘হাবিবুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এবং এতে আমার কোনো অহংকার নেই। কিয়ামত দিবসে আমি লিওয়াউল হাম্দ বা প্রশংসার পতাকা বহনকারী হবো। এতেও আমার কোন ফখর নেই। আমি কিয়ামতের দিন প্রথম শাফায়াতকারী হবো এবং আমার শাফায়াত সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতেও আমার কোনো ফখর নেই। কিয়ামতের দিন আমি-ই সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবো, তখন আমার জন্যে সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজা খোলা হবে। সেদিন আমি-ই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবো। তখন আমার সঙ্গে থাকবে আমার উম্মতের ফকির দরবেশগণ। আমি-ই اولين واخرين পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের মধ্যে অধিক সম্মানিত হবো, এতে আমার কোনো দর্প বা ফখর নেই। হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কামালাত ও সর্বসৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনায় এ হাদিসটি পূর্ণাঙ্গ দলিল হিসেবে পরিগণিত।’
ইমাম ইবনে হজর হাইতমী আলাইহির রহমত (বেসাল: ৯৭৪ হিজরি) নিজ ‘আদদুররুল মনদুদ’ নামের কিতাবের ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
قال الفخر الرازى: وقع الاجماع على ان افضل النوع الانسان نبينا سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم لقوله صلى الله عليه وسلم- انا سيد ولد ادم ولا فخر-
ভাবার্থ: হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুষ্য আকৃতিসম্পন্ন, এর ওপর ইজমা হয়েছে। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেন, আমি আদম সন্তানদের সরদার। এতে আমার কোনো গর্ব নেই।
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক বর্ণনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহ তায়ালা নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বসৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে তাঁকে حبيب ‘হাবিব’ নামে ভূষিত করেছেন।
অতঃপর আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ৭৮২ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ করেন -
وبتحقیق گذشت بیان علو مکان ومکانت وی صلی اللہ علیہ وسلم مقصود اینجا اگاھے بسر تخصیص اوست صلی اللہ علیہ وسلم باسم الحبیب پس بدانکہ مقام حبی اعلا مقامات کمالیہ است ۔۔۔ الخ
অর্থাৎ ‘নিঃসন্দেহে ইতিপূর্বে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উচ্চস্থান এবং উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বর্ণনা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য حبيب ‘হাবিব’ শব্দটির রহস্য উদঘাটন। সুতরাং গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নাও যে, কামালাতের মাকামসমূহের মধ্যে উন্নততর মাকাম হচ্ছে مقام حبى ‘মাকামে হুব্বী’ বা মহব্বতের স্থল। به تحقيق তাহকিক সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে।
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন -
كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق وتعرف اليهم فبى عرفونى وعرفت بهم-
(আমি রহস্যের গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছিলাম; তৎপর আমি মহব্বত রাখলাম যে আমি পরিচিত হবো, এরপর আমি এক মাখলুক সৃষ্টি করলাম এবং আমি তাদের কাছে পরিচিত হলাম। এ দ্বারা তারা আমাকে চিনলো, আমিও তাদেরকে চিনলাম।
সুতরাং توجه حبى ‘তাওয়াজ্জুহে হুব্বীই’, অর্থাৎ, মহব্বতের দৃষ্টি-ই হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি। যা আল্লাহতা’য়ালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি সমস্ত মাখলুকাত সেই প্রথম সৃষ্টির শাখা এবং সমস্ত হাকিকত حب ‘হুব্ব’-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সৃষ্টির যে প্রথম হুব্ব (ইরাদা) তা যদি না হতো, তাহলে কোনো মাখলকু-ই পয়দা হতো না। আর যদি মাখলুক পয়দা না হতো, তাহলে আসমা ও সিফাতে এলাহিকে কেউ জানতো না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহে মোবারকের ওসিলায় মাখলুক প্রকাশিত হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, রূহে মুহাম্মদী না হলে কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না এবং আল্লাহতায়ালাকে কেউ জানতো না। কারণ হুব্ব حب হচ্ছে ওজুদে মওজুদা বা সৃষ্টির অস্তিত্বের জন্যে প্রথম ওয়াসেতা বা মাধ্যম।
(اگر روح پاک محمدی نمی بود نمی شناخت خدارا ھیچ احدی زیرا کہ پیدا نمی بود ھیچ احدی پس حب واسطہ اولی است مروجود موجودات را)
به تحقيق তাহকিকের মাধ্যমে বর্ণিত আছে, আল্লাহতায়ালা মে’রাজের রাত্রিতে তাঁর হাবিবকে বলেছিলেন -
لو لا ك لما خلقت الافلاك
‘লাউ লাকা লামা খালাকতুল আফলাক’, অর্থাৎ, হে আমার হাবিব! আপনি না হলে আমি আসমানসমূহ সৃষ্টি করতাম না।
সুতরাং স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোপন ভাণ্ডার পরিচয়ের জন্য توجه حبى ‘তাওয়াজুহে হুব্বী’ই হলো মুল মাকসুদ। তারপর তিনি ছাড়া যতো কিছু, সব কিছুই তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। তিনি-ই حب الهى ‘হুব্বে এলাহি’র মূল মাকসুদ। তিনি ছাড়া অন্য সব তার শাখা তুল্য। সেই জন্য আল্লাহতা’য়ালা তাঁকে حبيب ‘হাবিব’ নাম দ্বারা খাস করেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কাউকে হাবিব নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। আল্লাহর হাবিবের উম্মতের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তাঁর অনুসরণ করবে, আল্লাহপাক তাকে محبوب ‘মাহবুব’ বানাবেন। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা নিজেই ইরশাদ করেছেন -
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله-
হে হাবিব! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহতা’য়ালার ভালোবাসা বা মুহব্বত লাভ করতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহতা’য়ালা তোমাদেরকে মহব্বত করবেন।
মাদারিজুন নবুয়ত ২য় জিলদের ৭৮৩ পৃষ্ঠায় (ফার্সি) উল্লেখ রয়েছে -
‘প্রকাশ থাকে যে, حب على الاطلاق ‘হুব্ব আলাল ইতলাক’, অর্থাৎ, হুব্বে মতলাক বা সাধারণত ‘হুব্ব’-এর নয়টি স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে একটি স্তর খালেক-এর মধ্যে। আর বাকি স্তরসমূহ মাখলুকের মধ্যে বিদ্যমান।
প্রথম স্তর যা খালেক এর মধ্যে বিদ্যমান তার নাম হচ্ছে حب ‘হুব্ব’, তবে এ ‘হুব্ব’-এর প্রকাশের জন্যে হরকত বা প্রতিক্রিয়া হওয়া জরুরি নয়। এই ‘হুব্ব’ যখন সৃষ্টি হবে, তখন তাঁর মধ্যে পাওয়া যাবে اراده ‘এরাদা’ বা অভিপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে اراده ‘ইরাদা’ হক তা’য়ালার জন্য খাস।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহতায়ালার আটটি সিফাতে খাসসা রয়েছে; এর মধ্যে একটি হল اراده ।
আল্লাহতা’য়ালার সিফাতে কামেলা হলো,
১. حيات হায়াত বা জীবনী শক্তি
২. قدرت কুদরত বা ক্ষমতা
৩. علم বা জ্ঞান
৪. كلام কালাম বা বাকশক্তি
৫. بصر বা দর্শনশক্তি
৬. سمع সামা বা শ্রবণশক্তি
৭. اراده ইরাদা বা ইচ্ছাশক্তি
৮. تكوين তাকবিন বা সৃষ্টিশক্তি।
এ সকল সিফাত আজলি এবং কাদীমী। যার আরম্ভও নেই, শেষও নেই। আল্লাহতা’য়ালার জাতের সঙ্গে বিদ্যমান।
হুব্ব-এর নয়টি স্তর
(১.) ميلان ‘ময়লান’ মাকলুকের মধ্যে যে ‘হুব্ব’ হয়ে থাকে, তার প্রথম স্তর হচ্ছে ميل ‘ময়ল’ বা মহব্বত করা। আর ময়লান হচ্ছে মতলব বা কাম্য বস্তুর প্রতি মনে আকর্ষণ।
(২.) رغبت ‘রগবত’ বা আকর্ষণ। এই আকর্ষণ যখনই বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে বলা হয় ‘রগবত’ বা আকৃষ্ট হওয়া।
(৩.) طلب ‘তলব’ রগবত বা আকৃষ্ট হওয়ার মাত্রা অধিক হলে তাকে বলা হয় ‘তলব’ বা তালাশ করা।
(৪.) ولع ‘ওলা’ তলব-এর মাত্রা অধিক হলে তাকে বলা হয় ‘ওলা’ বা হালকা পাতলা অবস্থায় অতিক্রম করা।
(৫.) صابه ‘সবা’ বা বুদ্ধিহীনতা। ‘ওলা’র মধ্যে যখন কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সে অবস্থা স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন তাকে বলা হয় صابه ‘সবা’ বা বুদ্ধিহীনতা।
(৬.) ہوا ‘হাওয়া’ বা শূন্যস্থান। এ অবস্থা যখন প্রবল হয় এবং অন্তরের গভীরে নেমে আসে এবং কাম্য বস্তুলাভে শান্তি পায় তখন বলে ‘হাওয়া’ বা শূন্যস্থান।
(৭.) شغف ‘শাগাফ’ বা হৈচৈ। হাওয়া যখন প্রবল আকার ধারণ করে এবং তা অন্তঃকরণে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ‘শাগাফ’ বা হৈচৈ।
(৮.) عزم ‘এযাম’ এই শাগাফ যখন প্রেমিককে ফানা করে দেয়, সেই ফানা এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, নিজের সত্তা থেকেও পৃথক হয়ে যায় এবং ফানা থেকেও ফানা হয়ে যায়, তখন তাকে ‘এযাম’ বা ফানার মাদ্দায় বা প্রাণপনে দৌঁড়ানোকে বলা হয় ‘এযাম’।
(৯.) এই ‘এযাম’ যখন সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বাহ্যিকতায় অবস্থান গ্রহণ করে, তখন ‘মুহিব’ ও ‘হাবিব’ ফানার মাধ্যমে দু’জনের দু’সত্তা থাকে না। অর্থাৎ, একজন ফানা হয়ে বিলীন হয়ে যায় এবং অপরজন আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব-ই একমাত্র বহাল থাকে তাকে حب مطلق হুব্বে মতলক বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আশিক আল্লাহতায়ালার প্রেমে বিলীন হয়ে যায়, এটি-ই ফানা ফিল্লাহ।
উপরোক্ত ‘হুব্ব’-এর নয়টি স্তর প্রকৃতপক্ষে মাখলুকের জন্যে খাস। আল্লাহতায়ালার শানে তা ব্যবহার করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, এ সমস্ত স্তরসমূহের সৃষ্টিকারী একমাত্র আল্লাহতায়ালা-ই।
حب ‘হুব্ব’ ও اراده ‘ইরাদা’ একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্যে খাস। এ ‘হুব্ব’-এর আরেকটি স্তর আছে, যা আল্লাহতায়ালা ও মাখলুকের মধ্যে প্রকাশ পায়; তাকে مرتبه جامعه ‘মুরাত্বাবায়ে জামিয়া’ বা সমন্বিত স্তর নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আবার দ্বিতীয় স্তরও বলা হয়।
আসমায়ে এলাহির মধ্যে একটি নাম আছে ودود ‘ওয়াদুদ’। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাঁকে চান, তাঁকে প্রেমদান করে থাকেন এবং বান্দাও তাঁর সাথে (আল্লাহর সাথে) প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। আল্লাহতা’য়ালা কালামে পাকে এরশাদ করেন -
فسوف يأتى الله بقوم يحبهم ويحبونه-
নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি (আল্লাহ) মহব্বত করবেন বা ভালোবাসবেন এবং তাঁরাও আল্লাহতা’য়ালাকে মহব্বত করবেন। এখানে উভয়েই মহব্বতের এ স্তরে পরস্পর শরিক। ভালোবাসার এ স্তরটি আলমে জহুরে (প্রকাশ্যজগতে) উভয় পক্ষ থেকে হওয়ার কারণে মহব্বতের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বশেষ মাকাম।
মাখলুকাতের জন্য ইশকে এলাহির স্তর থেকে অগ্রগামী কিছুই নেই -
اذ هو نار الله الموقدة التى تطلع على الافئدة-
যেহেতু এটি আল্লাহতা’য়ালার প্রজ্বলিত এশক্, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন قديم ‘কাদীম’ যার কোনো আরম্ভ নেই, শেষও নেই। যিনি ওয়াজিবুল ওয়াজুদ - الله موجود بالذات ।
আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন হেকমতে কামেলা দ্বারা এবং এ সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহতা’য়ালা ‘হুব্ব’ বা ইরাদা ছিল সরাসরি, যার মধ্যে কোনো ওয়াসেতা ব মাধ্যম ছিল না। আল্লাহ হচ্ছেন খালিক বা সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি, যাঁকে আল্লাহ মহব্বতের সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সৃষ্টির মধ্যে বে-নজির (অনুপম)।
আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর, আপাদমস্তক নূর যাঁর ছায়া ছিলনা; আইনী নূর কিন্তু جنس بشر জিনসে বশর বা জাতিতে মনুষ্য আকৃতির, কিন্তু সৃষ্টির মধ্যে তাঁর কোনো তুলনা নেই। তাঁকে আমাদের মতো মানুষ বা দশজনের মধ্যে একজন মানুষ বলা বা আকিদা রাখা কুফুরি। অপরদিকে, আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন جنس بشر জাতিতে মনুষ্য আকৃতির, اكمل بشر পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানব-সুরত, خير البشر সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-সুরত বা মহামানব-সুরতের।
[লেখাটি হালনাগাদ করা হবে]
নূর নবীর বেনজির বাশারিয়াত
নূরে মুজাসসাম রহমতে আলম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূরানীয়ত যেমন এক বিস্ময়কর ব্যাপার,যা ইতোপূর্বে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। তেমনিভাবে নবীজীর বাশারিয়াত বা মানবত্বও এক অলৌকিক বিস্ময়কর ব্যাপার।
নবীজীর আপাদমস্তক দেহ মোবারক ছিল নূর, যাকে বলা হয় নূরে মুজাসসাম। তিনি এক অলৌকিক মহামানব, যার কোন তুলনা হয় না। যার দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না।
নবীজীর বাশারিয়াতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামগণ লিখেছেন যে,তিনি হলেন-
خير البشر- اكمل بشر- نورانى بشر- افضل بشر- سيد البشر-
سيد ولد ادم- - جنس بشر- النوع الانسان ও سيد كل حادث
প্রভৃতি।
মূলকথা নবীজীর নূরানীয়ত আর বাশারিয়াত সর্বদিক দিয়ে তিনি এক স্বতন্ত্র বেনজির মহা সম্মাানিত মাখলুক সৃষ্টিজগতে যার কোন তুলনা নেই।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা আল্লাহর হাবিব সৃষ্টি নূর এবং জাতিতে মহামানব।
এ প্রসঙ্গে মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা সৈয়দ মাহমদু আলুছি বাগদাদী তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল মায়ানী’ নামক কিতাবের ২য় খণ্ড ৬ষ্ঠ পারা ৯৭ পৃষ্ঠায়- قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেন-
(قد جاء كم من الله نور) عظيم هو نور الانوار والنبى المختار صلى الله عليه وسلم والى هذا ذهب قتادة واختاره الزجاج وقال ابو على الجبائى عنى بالنور القران لكشفه واظهاره طرق الهدى واليقين واقتصر على ذلك الزمخشرى وعليه فالعطف فى قوله تعالى) كتاب مبين) لتنزيل المغائرة بالعنوان منزلة المغائرة بالذات واما على الاول فهو ظاهر
ভাবার্থ: আয়াত قد جاء كم من الله نور(নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে এক মহা সম্মানিত নূর এসেছে) সেই নূর হচ্ছে সকল নূরসমূহের নূর।সেই নূর দ্বারা মুরাদ হল,নবীয়ে মুখতার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।তাবেয়ী মুফাসসির হযরত কাতাদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অনুরুপ মতপোষণ করেছেন এবং জুজাজও এই অভিমত গ্রহণ করেছেন (মুতাজিলীদের নেতা) আবু আলী জুবাঈ বলেন- এখানে নূর দ্বারা মুরাদ হল কোরআন।কেননা কোরআনের দ্বারা হেদায়ত ও ইয়াকিনের পথসমূহ প্রকাশিত ও উম্মোচিত হয়ে থাকে। মু’তাজিলীপন্থি জমকশরীও অনুরূপ মত পোষণ করেছেন।
(আল্লামা আলুছি বলেন) মুদ্দাকথা হলো আল্লাহতা’য়ালার বাণী- كتاب مبين (রৌশন কিতাব) অংশকে নূর এর عطف (আতফ) দ্বারা দুইটি বিষয়ের প্রোপট অবতরণ হওয়া বুঝানো হয়েছে। কেননা- معطوف و معطوف عليه (মা’তুফ ও মা’তুফ আলাইহি) দ্বারা مغايرة بالذات (মুগাইরাত বিজ্জাত) বুঝানো হয়ে থাকে।এই প্রথম ব্যাখ্যাই অধিক সুস্পষ্ট।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তাফসির দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আয়াতে কারীমায় نور ‘নূর’ দ্বারা মুরাদ হচ্ছেন নবীউল মুখতার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইহাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অভিমত যে, আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে নূরই এসেছেন।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মহিউস সুন্নাহ আবি মুহাম্মদ হুসাইন ইবনে মাসউদ বগবী আলাইহির রহমত (ওফাত ৫১৬ হিজরি) ‘তাফসিরে মুয়ালিমুত তানজিল’ ৩৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
قد جاء كم من الله نور يعنى محمد صلى الله عليه وسلم
উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় نور ‘নূরুন’ দ্বারা মুরাদ হচ্ছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মাদারিজুন নবুয়ত ১/২৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে-
آنحضرت راسایہ نہ در آفتاب ونہ در قمر رواہ الحکیم الترمذی عن ذکوان فی نوادر الاصول وعجب است ازیں بزرگان کہ ذکر نکردند چراغ را ونور یکی از اسماء آنحضرت ست ونور راسایہ نمی باشد-
নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না।রৌদ্রের প্রচন্ড কিরণে কিংবা চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোতে তাঁর পবিত্র নূরের কায়ার কোন ছায়া পরতো না। হাকিম ও তিরমিজি যাকওয়ান হতে নাওয়াদিরুল উসূলে ইহা বর্ণনা করেছেন।উল্লেখিত বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ কেবল মাত্র চন্দ্র এবং সূর্যের রশ্মির কথাই উল্লেখ করেছেন।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রদীপের কথা উল্লেখ করেন নাই। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার একটি নাম হল নূর বা আলো,নূরের কোন ছায়া হয় না।
দশম শতাব্দীর নবম মুজাদ্দিদ হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত (ওফাত ৯১১ হিজরি) الخصائص الكبرى নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
اخرج الحكيم الترمذى عن ذكوان ان رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يكن يرى له ظل فى شمس ولاقمر قال ابن سبع: من خصائصه ان ظله كان لا يقع على الارض وانه كان نورا فكان اذا مشى فى الشمس او القمر لا ينظر له ظل- قال بعضهم: ويشهد له حديث قوله صلى الله عليه فى دعائه- واجعلى نورا-
অর্থাৎ হাকিম তিরমিজি হযরত যাকওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছায়া- না সূর্যের আলোতে দেখা যেত, না চন্দ্রের আলোতে (দেখা যেত)। ইবনে সাবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বৈশিষ্ট্য যে, নিশ্চয় তাঁর ছায়া জমিনে পতিত হতো না, কেননা তিনি ছিলেন নূর। অতএব, তিনি যখন সূর্যের আলোতে অথবা চন্দ্রের আলোতে চলতেন, তখন তাঁর ছায়া দেখা যেত না। কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ছায়া না থাকার বিষয়টি হাদিসশরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার মাধ্যমে এরশাদ করেন, আয় আল্লাহ আমাকে নূর করে দাও।
তাফসিরে দুররে মানসুরে রয়েছে-
اخرج ابن ابى عمر العدنى عن ابن عباس ان قريشا كانت نورا بين يدى الله تعالى قبل ان يخلق الخلق بالفى عام يسبح ذلك النور وتسبح الملائكة بتسبيحه- فلما خلق الله ادم عليه السلام القى ذلك النور فى صلبه- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: فاهبطنى الله الى الارض فى صلب ادم عليه السلام وجعلنى فى صلب نوح وقذف بى فى صلب ابراهيم ثم لم يزل الله ينقلنى من الاصلاب الكريمة الى الارحام الطاهرة حتى اخرجنى من بين ابوى لم يلتقيا على سفاح قط- (الدر المنثور ص ٤/۳۲৯ لقد جاء كم رسول من انفسكم پاره ۱۱ توبه ۱۲٨ اية)
ভাবার্থ: ইবনে আবু উমর আদনী ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন নিশ্চয় তিনি কোরেশি বা কুরেশ বংশীয়। তিনি মাখলুক (আদম আলাইহি সালাম) সৃষ্টির দুইহাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহর দরবারে নূর ছিলেন।সেই নূর তাসবিহ পাঠ করতো এবং তাঁর তাসবির সাথে ফেরেশতাগণও তাসবিহ পাঠ করতো। অতঃপর যখন আল্লাহতা’য়ালা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন,তখন আদম আলাইহিস সালাম এর পৃষ্টদেশে সেই নূর মোবারক স্থাপন করলেন।রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- অতঃপর আল্লাহতা’য়ালা আমাকে হযরত আদম আলাইহিস সালামের পৃষ্টদেশে থাকা অবস্থায় জমিনে পাঠালেন। অতঃপর হযরত নূহ আলাইহিস সালাম এর পৃষ্টদেশে আমাকে স্থাপন করলেন। বংশ পরম্পরায় আমাকে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পৃষ্টে থাকাকালীন নমরূদের তৈরি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এভাবে স্থানান্তরিত হতে হতে পবিত্র পৃষ্টদেশে থেকে পবিত্র রেহেমে স্থানান্তরিত হতে থাকি এমনকি আমার পিতা-মাতা পর্যন্ত। আমার পূর্ব পুরুষের মধ্যে কখনো জিনা সংঘটিত হয়নি।’
উপরোক্ত হাদিসশরীফের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর হাবিবের নূর সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা সৃষ্টি করে আদম আলাইহিস সালামের পৃষ্ট হতে একের পর এক স্থানান্তরিত হতে হতে হযরত আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর রেহেম মোবারকে স্থির হয়ে এই নূর মোবারকই জমিনে অবতীর্ণ হয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর জাতিতে বশর।
মিশকাত শরীফ ৫১৩ পৃষ্ঠায় আছে-
عن العرباض بن ساريه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم انه قال انى عند الله مكتوب خاتم النبيين وان ادم لمنجدل فى طينته وساخبركم باول امرى دعوة ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امى التى رأت حين وضعتنى وقد خرج لها نور اضاءلها منه قصور الشام- رواه فى شرح السنة ورواه احمد عن ابى امامة من قوله ساخبركم الى اخره- (دلائل النبوة ومعرفة احوال صاحب الشريفة للبيهقى ص ۲/۱۳٠ (مشكوة شريف ص ۵۱۳(
অর্থাৎ ‘ইরবাজ বিন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন নিশ্চয় আমি আল্লাহর দরবারে খাতামুন নাবিয়ীন বা সর্বশেষ নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। ঐ সময় হযরত আদম আলাইহিস সালামের দেহ মোবারক মাটিতে মিশ্রিত ছিল। আর অচিরেই তোমাদেরকে আমার প্রথম অবস্থার সংবাদ দিব। আমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার আম্মার চাক্ষুস দর্শন, যা তিনি আমাকে আমার প্রসবকালীন সময়ে দেখেছিলেন।নিশ্চয়ই তাঁর থেকে এক নূর প্রকাশ হয়েছিল, যার দ্বারা শ্যাম বা সিরিয়ার দালানগুলো আলোকিত হয়ে ছিল।’
মিশকাত শরীফ ৫১৩ পৃষ্ঠায় আছে-
عن عرباض بن ساريا صاحب رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: انى عبد الله وخاتم النبيين وابى منجدل فى طينته وساخبركم عن ذلك: دعوة ابى ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امى التى رأت وكذلك امهات (النبيين) يرين وان ام رسول الله صلى الله عليه وسلم رأت حين وضعته نورا اضائت له قصور الشام ثم تلا يا ايها النبى انا ارسلناك شاهدا ومبشرا ونذيرا وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا) مشكوة ص ۵۱۳ اشعة لمعات ص ٤/٤۷٤ مرقاة ص ۳٦۷
ভাবার্থ: আল্লাহতা’য়ালার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাহাবি হযরত ইবরাদ বিন সারিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন- নিশ্চয়ই আমি আল্লাহতা’য়ালার বান্দা ও সর্বশেষ নবী ঐসময়ও ছিলাম যখন আমার পিতা (হযরত আদম আলাইহিস সালাম) এর দেহ মোবারক মাটি ও পানিতে ছিল। আমি অচিরেই তোমাদেরকে এ সম্পর্কে অর্থাৎ আমার প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিব, আমি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়ার ফসল, আমি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার মায়ের চাক্ষুস দর্শন। এভাবে সকল নবীগণের মাতাগণের দর্শন এবং নিশ্চয় আল্লাহর রাসূলের জননী এ ধরাতেই আগমনের সময়কালীন সময়ে দেখে ছিলেন যে, তার থেকে একটি নূর প্রকাশিত হয়েছিল, যদ্বারা সিরিয়া দেশের অট্টালিকাসমূহ আলোকিত হয়েছিল। অতঃপর পাঠ করলেন-
يا ايها النبى انا ارسلناك شاهدا ومبشرا ونذيرا وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا-
অর্থ: হে নবী (গায়েবের সংবাদদাতা) নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে হাজির নাজির, সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর আদেশ আহ্বানকারী এবং উজ্জ্বল সূর্য করে প্রেরণ করেছি।
(সূরা আহযাব, আয়াত- ৪৫)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৪র্থ জিলদ ১১ পারা ৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
(لقد جاء كم) الخطاب للعرب (رسول) اى رسول عظيم القدر (من انفسكم) اى من جنسكم ومن نسبكم عربى مثلكم ... وقيل: الخطاب للبشر على الاطلاق ومعنى كونه عليه الصلوة والسلام من انفسهم انه من جنس البشر الخ-
অর্থাৎ لقد جاء كم رسول নিশ্চয় তোমাদের নিকট এসেছেন অতি সম্মানিত একজন রাসূল তোমাদের থেকে অর্থাৎ তোমাদের جنس ‘জাত’ থেকে এবং তোমাদের আরবি সম্প্রদায় থেকে। ...
আরো বর্ণিত আছে, আয়াতে গোটা মানব সম্প্রদায়কে সম্বোধন করা হয়েছে।অর্থাৎ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে এসেছেন। নিশ্চয় তিনি جنس بشر ‘জিনসে বশর’ বা জাতিতে মানব। (কিন্তু সৃষ্টিতে নূর)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ২য় জিল্দ ৪ নং পারা ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
لقد من على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা সৈয়দ মাহমদু আলুছি বাগদাদী (ওফাত ১২৭০ হিজরি) উল্লেখ করেন-
(رسولا) عظيم القدر جليل الشان (من انفسهم) اى من نسبهم او من جنسهم عربيا مثلهم او من بنى ادم لاملكا ولا جنيا الخ-
অর্থাৎ رسولا من انفسهم অতি সম্মানিত ও মহান শানের অধিকারী রাসূল প্রেরিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে অর্থাৎ তাদের সম্প্রদায় থেকে অথবা তাদের স্বজাতি থেকে, তাদের ন্যায় আরবীয় সম্প্রদায় থেকে। অথবা বনি আদম থেকে। তিনি ফিরিশতা জাতি ও নন, জিন জাতিও নন।
আল্লামা আলুছি উক্ত তাফসিরের ১১৩ পৃষ্ঠায় আবার উল্লেখ করেন-
وقد سئل الشيخ ولى الدين العراقى هل العلم بكونه صلى الله عليه وسلم بشرا ومن العرب شرط فى صحة الايمان او من فروض الكفاية؟ فاجاب بانه شرط فى صحة الايمان- ثم قال: فلو قال شخص: او من برسالة محمد صلى الله عليه وسلم الى جميع الخلق لكن لا ادرى هل هو من البشر او من الملائكة او من الجن- اولا ادرى هل هو من العرب او العجم؟ فلا شك فى كفره لتكذيبه القران وجحده ما تلقته قرون الاسلام خلفا عن سلف وصار معلوما بالضرورة عند الخاص والعام-
ভাবার্থ: শায়খ ওলিউদ্দিন ইরাকী আলাইহির রহমতকে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ছিল যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে بشرا ومن العرب জাতিতে মানব এবং তিনি আরবি এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা কি ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত অথবা তা কি ফরজে কিফায়া? তদোত্তরে তিনি বলেন- নিশ্চয় আল্লাহর হাবিবকে জাতিতে মানব এবং তিনি আরবীয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখা বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শর্ত। অতঃপর তিনি বলেন- যদি কোন ব্যক্তি বলেন যে, আমি বিশ্বাস করি বা ঈমান রাখি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাসূল হয়ে প্রেরিত হয়েছেন কিন্তু আমি জানি না যে, তিনি কি মানব জাতি না ফেরেশতা জাতীয়, না জ্বিন জাতীয় অথবা আমি জানি না তিনি কি আরবীয় না অনারবীয়? (উত্তরে তিনি ফতওয়া প্রদান করে বলেন) فلا شك فى كفره لتكذيبه القران ঐ ব্যক্তির কুফরি সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই কেননা সে কোরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বাদশ মুজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত (ওফাত ১২৩৯ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে আজিজি ফার্সী’ ২১৪ পৃষ্ঠা ২৯ পারা الا من ارتضى من رسول আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেন-
(ক)
یعنی مگر کسے کہ پسند میکند وآں کس رسول میبا شد خواہ ازجنس ملک باشد مثل حضرت جبریل علیہ السلام وخواہ ازجنس بشر مثل حضرت محمد صلی اللہ علیہ وسلم وموسی وعیسی علیہم الصلوات والتسلیمات کہ اورا اظھار بر بعضے از غیوب خاصۂ خود می فرماید تا آں غیوب را مکلفین برسا ند الج-
অর্থাৎ আল্লাহর পছন্দনীয় রাসূল ব্যতিত কারো নিকট সেই খাস গায়েব প্রকাশ করেন না। যাদের কাছে প্রকাশ করেন, তারা হচ্ছেন রাসূল, সেই রাসূল হয়তো জিনসে মালাক বা ফেরেশতা জাতীয়, যেমন হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অথবা জিনসে বশর বা মানব জাতীয় যেমন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হযরত মুসা ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালাম তাঁদের নিকট আল্লাহ কতক খাস গায়েব সম্পর্কে অবহিত করান।
উপরোক্ত এবারত দ্বারা প্রমাণিত হলো আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর হাবিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিনসে বাশার ও মানব জাতীয়। হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর ও বশর উভয়েই।পরকালে তাঁর নূরানীয়তের প্রাধান্য সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। বাশারিয়াতের অস্তিত্বের প্রাধান্য থাকবে না। শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত এর নিম্নে এবারত তা প্রমাণ করে।
(খ)
তাফসিরে আজিজি ফার্সি (২৭১ পৃষ্ঠা আম পারা) وللاخرة خير لك من الاولى এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত উল্লেখ করেন-
یعنی والبتہ ہر حالت آخر بہتر باشد ترا از معاملت اول تا آنکہ بشریت ترا اصلا وجود نماند وغلبۂ نور حق برتو علی سبیل الدوام-
অর্থাৎ আপনার জন্য ইহকাল থেকে পরকাল উত্তম। যেন আপনার বাশারিয়াত বা মনবত্বের অস্তিত্ব পরকালে থাকবে না। সর্বদা নূরানীয়তের প্রাধান্য আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন-
آنحضرت بتمام از فرق تا قدم ہمہ نور بود کہ دیدۂ حیرت در جمال باکمال وی خیرہ میشد مثل ماہ وآفتاب تابان وروشن بود واگر نہ نقاب بشریت پوشیدہ بودی ہیچکس را مجال نظر وادراک حسن او ممکن نبودی وہمیشہ جوہروی نوری بود کہ انتقال کرد از اصلاب آباوا رحام امھات اززمن آدم تا انتقال بصلب عبد اللہ ورحم آمنہ سلام اللہ عليهم اجمعين- مدارج النبوة فارسى ص ۱/۱۳۷ اردو ص ۱/۲۱۳
ভাবার্থ: আমাদের নবী সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপদমস্তক ছিলেন নূর। তাঁর নূর বা সৌন্দর্য প্রভায় দৃষ্টিশক্তি উল্টা যেন ফিরে আসত। তিনি যদি মানবীয় পোশাক পরিধান না করতেন, তবে কারো জন্য তাঁর সৌন্দর্য প্রভা উপলব্ধি করা সম্ভব হত না। তাঁর جوهر نورى ‘জাওহারে নূরী’ বা নূরানী জাওহার হযরত আদম আলাইহিস সালাম হতে শুরু করে হযরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত পবিত্র ঔরসে ও পবিত্র রেহেমে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসছিল।
چنانچہ فرمودوی سبحانب ( ما زاغ البصر وما طغی) چنانچہ بندگان خاص در حضرت ملوک میکنند واین کمال ست کہ جز اکمل بشر وسید رسل را صلوات اللہ وسلامہ میسر نیست ( مدارج النبوة فارسى ۱/ص ۲٠٤)
ভাবার্থ: আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন ما زاع البصر وما طفى যেরূপভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিগণ বাদশাহ এর দরবারে উপস্থিত হয়ে থাকেন। ইহা এমন পূর্ণত্ব যা পূর্ণত্ব মানব اكمل بشر মহামানব ও সকল রাসূলের সরদার আলাইহিস সালাম ব্যতিত আর কেউই লাভ করতে পারেনি।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতের ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ এর উপরোক্ত দু’টি এবারত থেকে স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হল তার তাহকিক মতে আল্লাহর হাবিব আপাদমস্তক নূর এবং তিনি আকমলে বশর বা পরিপূর্ণ মানব (মহামানব)।
উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষায় জাত বা জাতি শব্দটি বংশ, গোত্র ও সম্প্রদায় ইত্যাদি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে আরবি ذات জাত শব্দটি সত্বা বা অস্তিত্ব বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এর সাথে নিসবত বা সম্পর্কিত বুঝানোর ক্ষেত্রে ذاتى (জাতি) শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
সহজ কথায় جنس بشر বা ‘মানব জাতি’ বলতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর আওলাদ বা বংধরগণকে বুঝানো হয়ে থাকে। যেহেতু রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন انا سيد ولد ادم অর্থাৎ আমি আদম সন্তানের সরদার। (মুসলিম শরীফ ২/২৪৫ পৃষ্ঠা) এ হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
আরো প্রমাণিত হলো রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যিক আদম আলাইহিস সালামের সন্তান হিসেবে মানব কিন্তু তিনি হচ্ছেন বনী আদমের সরদার। এজন্য তিনি বেনজির ও বেমিসাল বশর বা মানব। নূরানী মানুষ যার কোন তুলনা সৃষ্টির মধ্যে নেই।
তাফসিরে রুহুল বয়ানে রয়েছে-
(لقد جاء كم من انفسكم) (من انفسكم) اى من جنسكم ادمى مثلكم لا من الملائكة ولا من غيرهم- (تفسير روح البيان ص ۳/۵٤۲)
ভাবার্থ: নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্যে থেকে একজন সম্মানিত রাসূল আগমন করেছেন। এখানে من انفسكم (তোমাদের মধ্য থেকে) এর তাফসির হচ্ছে اى من جنسكم অর্থাৎ তোমাদের স্বজাত থেকে। বাহ্যত তোমাদের ন্যায় মানব, তিনি ফিরিশতা জাতিও নন। মানব ছাড়া অন্য কোন জাতিও নন।
(قل انما انا بشر مثلكم) قل يا محمد ما انا الا ادمى مثلكم فى الصورة ومساويكم فى بعض البشرية (يوحى الى) من ربى (انما الهمكم اله واحد) ما هو الا متفرد فى الا لوهية لا تظيرله فى ذاته ولا شريك له فى صفاته يعنى انا معترف ببشريتى ولكن الله من على من بينكم بالنبوة والرسالة- (تفسير روح البيان ص ۵/۳٠৯)
(হে হাবিব! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমি তোমাদের ন্যায় মানব।) হে মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন, আমি মানব ছাড়া অন্য কিছুই নই। সুরত বা আকৃতিগত দিক থেকে তোমাদের ন্যায় এবং মানবীয় কতিপয় গুণ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তোমাদের সাথে আমার মিল রয়েছে। আমার প্রতি ওহি আসে আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে (নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ বা মা’বুদ এক অভিন্ন) উলুহিয়ত বা উপাস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক ও অভিন্ন। তার জাত বা স্বত্ত্বার কোন মিসাল বা উপমা নেই। তাঁর গুণাবলী থেকেও কোন অংশিদার নেই। আমি মানব জাতি তার স্বীকৃতি আমি দিচ্ছি কিন্তু আল্লাহতা’য়ালা তোমাদের মধ্যে আমাকে নবুয়ত ও রিসালাত দিয়ে বড়ই অনুগ্রহ করেছেন।
‘তাফসিরে রুহুল’ বয়ান নামক কতিাবের প্রথম জিলদের ৩৯৫ পৃষ্ঠায় والذين اوتوا العلم درجات (১৫পারা সূরা বনি ইসরাঈল) আয়াতের ব্যাখ্যা রয়েছে, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত উল্লেখ করেন-
فانه صلى الله عليه وسلم ما بقى مكان ولا فى الامكان لانه كان فانيا عن ظلمة وجوده باقيا بنور وجوده لهذا سماه الله نورا فى قوله تعالى قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين فالنور هو محمد عليه السلام والكتاب هو القران-
অর্থাৎ ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মে’রাজের রজনীতে) কোন স্থানে বা সৃষ্টিজগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার অতিক্রম করে তাঁর নূরের অস্তিত্বে বিদ্যমান থাকলেন। এ কারণেই কোরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা তাঁকে নূর বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন- قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين (নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান নূর ও একটি সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে)
অতএব উক্ত আয়াতে কারীমায় নূর দ্বারা মুরাদ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং কিতাব দ্বারা মুরাদ হচ্ছে কোরআনুল করিম।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো মেরাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত ফানা হয়ে নূরের ওজুদ বিদ্যমান ছিল।
হুজুরকে আমাদের মতো মানুষ বলা কুফুরি।কেননা হুজুর হচ্ছেন সৃষ্টিতে নূর আপাদমস্তক নূর তাঁর ছায়া ছিল না। কিন্তু তিনি জাতিতে মানুষ।
একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ আল্লামা মুল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০১৪ হিজরি) তদীয়- المورد الروى فى المولد النبوى ‘আল মাওরিদুর রাউয়ী ফি মাওলিদিন নববী’ নামক কিতাবের ৫৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
الحاصل ان مجئ الرسول نعمة جسيمة- وكونه من جنس البشر منحة عظيمة وقال بعضهم قوله من انفسكم اى جنس العرب- وهو لا ينافى ما سبق-
সারকথা নিশ্চয় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন এক মহান নিয়ামত বা বড় অনুগ্রহ। অথচ তিনি হচ্ছেন جنس البشر বা জাতিতে মানব। অনেকেই বলেন- আল্লাহর বাণী- من انفسكم এর তাফসির جنس العرب আরব দেশীয়। ইতোপূর্বে যা আলোচনা হয়েছিল ইহা এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ جنس البشر ও جنس العرب উভয় তাফসিরে কোন বৈপিরিত্ব নেই।
মিশকাত শরীফ ৫২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخصف نعله ويخيط ثوبه ويعمل فى بيته كما يعمل احدكم فى بيته وقالت كان بشرا من البشر يغلى ثوبه ويحلب شاته ويخدم نفسه- رواه الترمذى-
ভাবার্থ: হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জুতা মোবারকের ফিতা লাগাতেন, নিজের কাপড় সেলাই করতেন, নিজ গৃহের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন। যেমন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ করে থাক। তিনি আরো বলেন- তিনি মানুষ জাতীর মধ্য থেকে একজন মহামানব ছিলেন। নিজ কাপড় পরিচ্ছন্ন রাখতেন, নিজ হাতে দুধ দোহন করতেন, নিজে নিজের কাজ আঞ্জাম দিতেন। (তিরমিজি)
নূরে মোহাম্মদীর সৃষ্টির রহস্য
মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বপ্রথম যে মাখলুক সৃষ্টি করেছিলেন, তা ছিলো মহা-সম্মানী একখানা নূর মোবারক এবং সেই নূর মোবারকের নামকরণ করেছিলেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর এ আজিমুশশান নূর মোবারককেই বলা হয়ে থাকে নূরে মোহাম্মদী। মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টির পূর্বে যেহেতু আর কোনো মাখলুক-ই ছিল না, সেহেতু আল্লাহ তাকারাকা ওয়া তা’য়ালা হেকমতে কামেলা দ্বারা তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছিলেন। কোনো ধাতু ছাড়াই কীভাবে যে আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করলেন, তা কেউ বলতে পারে না। নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির এই অজানা রহস্যকেই বলা হয় নূরে মোহাম্মদীর হাকীকত।
আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নূরানী ফরমান -
ﻳﺎ ﺍﺑﺎ ﺑﻜﺮ ﻟﻢ ﻳﻌﺮﻓﻨﻰ ﺣﻘﻴﻘﺔ ﻏﻴﺮ ﺭﺑﻰ -
অর্থাৎ, ‘হে আবু বকর! আমার প্রভু ভিন্ন আমার হাকীকত সম্বন্ধে কেউই অবগত নন।’
এ হাদিস শরীফের মর্ম অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে -
ﻣﺤﻤﺪ ﺳﺮ ﻗﺪﺭﺕ ﮨﮯ - ﮐﻮﺉ ﺭﻣﻮﺯ ﺍﺱ ﮐﺎ ﮐﯿﺎ ﺟﺎﻧﮯ
ﺷﺮﯾﻌﺖ ﻣﯿﮟ ﺗﻮ ﺑﻨﺪﮦ ﮨﮯ- ﺣﻘﯿﻘﺖ ﻣﯿﮟ ﺧﺪﺍ ﺟﺎﻧﮯ
অর্থাৎ, ‘আল্লাহর হাবিব মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুদরতে এলাহির এক গোপনীয় সুক্ষ্ম রহস্য, যার ভেদ কেউ জানতে পারে নাই। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনিতো আল্লাহর একজন বান্দা, কিন্তু তাঁর মূল হাকীকত কী, তা জানেন একমাত্র আল্লাহতা’য়ালাই।’
এ প্রসঙ্গে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন (আলাইহির রহমত) তাঁর লিখিত ‘সিলাতুস সাফা ফি নূরীল মোস্তফা’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেন -
ﻋﺎﻟﻢ ﻣﯿﮟ ﺫﺍﺕ ﺭﺳﻮﻝ ﮐﻮ ﺗﻮ ﮐﻮﺉ ﭘﮩﭽﺎﻧﺘﺎ ﻧﮩﯿﮟ
অর্থাৎ, ‘এ নশ্বর পৃথিবীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সঠিক পরিচিতি কেউই অবগত নন।’
তিনি আরো বলেন -
ﺍﺱ ﺗﺨﻠﯿﻖ ﮐﮯ ﺍﺻﻞ ﻣﻌﻨﯽ ﺗﻮ ﺍﻟﻠﮧ ﻭﺭﺳﻮﻝ ﺟﺎﻧﯿﮟ ﺟﻞ
ﻭﻋﻠﯽ ﻭﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ -
অর্থাৎ, ‘মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সৃষ্টির মূল রহস্য একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা ও তাঁর রাসূল-ই জানেন।’
অন্যত্র বলেন -
ﮐﮧ ﻧﻮﺭ ﻣﺤﻤﺪﯼ ﺟﺐ ﻗﺪﯾﻢ ﺍﻭﺭ ﺍﺯﻟﯽ ﻧﻮﺭ ﮐﯽ ﭘﮩﻠﯽ ﺗﺠﻠﯽ
ﮨﮯ ﺗﻮ ﮐﺎﺋﻨﺎﺕ ﻣﯿﮟ ﺑﮭﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﮯ ﻭﺟﻮﺩ ﮐﺎ ﻭﮬﯽ
ﺳﺐ ﺳﮯ ﭘﮩﻠﮧ ﻣﻈﮭﺮ ﮨﮯ -
অর্থাৎ, ‘নূরে মোহাম্মদী যখন নূরে কাদীম ও নূরে আজলি, অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালার জাতের প্রথম তাজাল্লি, তাতে প্রমাণিত হয় সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তিনি-ই আল্লাহতা’য়ালার অজুদ বা অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশক।’
আ’লা হযরত আরো বলেন -
ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﻧﮯ ﻣﺤﻤﺪ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﮐﯽ ﺫ
ﺍﺕ ﭘﺎﮎ ﮐﻮ ﺍﭘﻨﯽ ﺫﺍﺕ ﮐﺮﯾﻢ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍﮐﯿﺎ ﯾﻌﻨﯽ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ
ﮐﯽ ﺗﺠﻠﯽ ﺑﻼ ﻭﺍﺳﻄﮧ ﮨﻤﺎﺭﮮ ﺣﻀﻮﺭ ﮨﯿﮟ ﺑﺎﻗﯽ ﺳﺐ
ﮨﻤﺎﺭﮮ ﺣﻀﻮﺭ ﮐﮯ ﻧﻮﺭ ﻭﻇﮭﻮﺭ ﮨﯿﮟ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ -
অর্থাৎ, ‘আল্লাহতা’য়ালা হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তাকে আল্লাহর জাতে পাকের স্বীয়জাতে করিম কর্তৃক সৃষ্টি করেছেন; অর্থাৎ, আমাদের হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহতা’য়ালার জাতের তাজাল্লি, আর বাকি কুল-কায়েনাত আমাদের নূর নবীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র নূর মোবারক আল্লাহ পাকের কাদীম ও আজলি নূরের প্রথম তাজাল্লি; অর্থাৎ, আল্লাহর জাত কর্তৃক সৃষ্ট নূর।
আল্লাহর নূর কর্তৃক নবীজীর নূর সৃষ্টি কথাটির ব্যাখ্যা
নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন ও আলোচনার ক্ষেত্রে হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিসখানা উল্লেখযোগ্য -
ﻳﺎ ﺝ
ﺍﺑﺮ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺪ ﺧﻠﻖ ﻗﺒﻞ ﺍﻻﺷﻴﺎﺀ ﻧﻮﺭ ﻧﺒﻴﻚ ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ -
-
‘হে জাবির! নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা সব কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর মোবারক স্বীয় নূর কর্তৃক সৃষ্টি করছেন।’
এ হাদিস শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত বলেন -
ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ ﺍﻯ ﻣﻦ ﻧﻮﺭ ﻫﻮ ﺫﺍﺗﻪ -
অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওই নূর কর্তৃক সৃষ্টি করেছেন, যা ﻋﻴﻦ
ﺫﺍﺕ ﺍﻟﻬﻰ আল্লাহর প্রকৃত জাত, অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা স্বীয় জাত কর্তৃক তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহতা’য়ালার নূর নবী সৃষ্টির ধাতু। আল্লাহতা’য়ালা কোনো মাধ্যম ছাড়াই ‘কুন’ বলেছেন, ‘ফাইয়াকুন’ অতঃপর নবী (দ:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টি হয়ে গেল।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী আলাইহির রহমত নিজ ‘সিলাতুস সফা ফি
নূরিল মোস্তফা’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেছেন -
ﮬﺎﮞ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﻧﮯ ﮐﮯ ﯾﮧ ﻣﻌﻨﯽ ﻧﮩﯿﮟ
ﮐﮧ ﻣﻌﺎﺫ ﺍﻟﻠﮧ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺫﺍﺕ ﺭﺳﺎﻟﺖ ﮐﮯ ﻟﮱ ﻣﺎﺩﮦ ﮨﮯ
ﺟﯿﺴﮯ ﻣﭩﯽ ﺳﮯ ﺍﻧﺴﺎﻥ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﺍ ﻋﯿﺎﺫ ﺑﺎﻟﻠﮧ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﮐﺎ
ﮐﻮﺉ ﺣﺼﮧ ﯾﺎ ﮐﻞ ﺫﺍﺕ ﻧﺒﯽ ﮨﻮﮔﯿﺎ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ ﺣﺼﮯ
ﺍﻭﺭ ﭨﮑﺮﮮ ﺍﻭﺭ ﮐﺴﯽ ﮐﮯ ﺳﺎﺗﮧ ﻣﺘﺤﺪ ﮨﻮﺟﺎﻧﮯ ﯾﺎ ﮐﺴﯽ
ﻣﯿﮟ ﺣﻠﻮﻝ ﻓﺮﻣﺎﻧﮯ ﺳﮯ ﭘﺎﮎ ﻭﻣﻨﺰﮦ ﮨﮯ ﺣﻀﻮﺭ ﺳﯿﺪ ﻋﺎﻟﻢ
ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﺧﻮﺍﮦ ﮐﺴﯽ ﺷﺊ ﮐﻮ ﺟﺰﺀ ﺫﺍﺕ
ﺍﻟﮭﯽ ﺧﻮﺍﮦ ﮐﺴﯽ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﮐﻮ ﻋﯿﻦ ﻭﻧﻔﺲ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ
ﻣﺎﻧﻨﺎ ﮐﻔﺮ ﮨﮯ -
(আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত ﺣﻀﻮﺭ ﻋﯿﻦ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﮭﯽ ﺳﮯ ﭘﯿﺪﺍ ﮨﻮﺍ -এর ভাবার্থ উদঘাটন করতে গিয়ে উল্লেখ করেন)
ভাবার্থ: আইনে জাতে এলাহি বা আল্লাহর প্রকৃত জাত থেকে (নূরে হাকিকী আল্লাহর জাত কর্তৃক) হাবিবে খোদা সৃষ্টি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জাত সৃষ্টির জন্য মাদ্দা বা মূল ধাতু (নাউজুবিল্লাহ)। যেমন মাটি দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাতের কোনো অংশ বা আল্লাহর কুল জাত নবী হয়ে গিয়েছেন (নাউজুবিল্লাহ)।
মহান আল্লাহ অংশ, টুকরো এবং কোনো কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোনো বস্তুর মধ্যে হুলুল হওয়া থেকে পবিত্র। হুজুর সাইয়িদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকি কোনো বস্তুকে আল্লাহর জাতের অংশ, এমনকি কোনো সৃষ্টিকে প্রকৃত জাত ও নফসে জাতে এলাহি মানা বা আক্বিদা রাখা কুফুরি।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালার জাত মোবারক এমন একটি নূর যার কোনো উদাহরণ বা মিসাল নেই। বেনজীর বেমিসাল নূর। যে নূরের অংশ হয় না, ভাগ হয় না, টুকরো হয় না, লাল, হলুদ,সবুজ, এক কথায় সৃষ্টির মধ্যে যার কোনো তুলনা নেই।
মোটকথা, আল্লাহর নূর হলো নূরে হাকিকী এবং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর হলো নূরে তাখলিকী বা আল্লাহর সৃষ্ট নূর।
আ’লা হযরত নিজ ‘নূরুল মোস্তফা’ শীর্ষক গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
ﻧﻮﺭ ﻋﺮﻑ ﻋﺎﻣﮧ ﻣﯿﮟ ﺍﯾﮏ ﮐﯿﻔﯿﺖ ﮨﮯ ﮐﮧ ﻧﮕﺎﮦ ﭘﮩﻠﮯ ﺍﺳﮯ
ﺍﺩﺭﺍﮎ ﮐﺮﺗﯽ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﺍﺱ ﮐﮯ ﻭﺍﺳﻄﮯ ﺳﮯ ﺩﻭﺳﺮﯼ ﺍﺷﯿﺎﺋﮯ
ﺩﯾﺪﻧﯽ ﮐﻮ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺴﯿﺪ ﻓﯽ ﺗﻌﺮﯾﻔﺎﺗﮧ ﺍﻟﻨﻮﺭ ﮐﯿﻔﯿۃ ﺗﺪﺭﮐﮭﺎ
ﺍﻟﺒﺎﺻﺮۃ ﺍﻭﻻ ﻭﺑﻮﺍﺳﻄﺘﮭﺎ ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻟﻤﺒﺼﺮﺍﺕ- ﺍﻭﺭ ﺣﻖ ﯾﮧ ﮐﮧ
ﻧﻮﺭ ﺍﺱ ﺳﮯ ﺍﺟﻠﯽ ﮨﮯ ﮐﮧ ﺍﺱ ﮐﯽ ﺗﻌﺮﯾﻒ ﮐﯽ ﺟﺎﺋﮯ - ﯾﮧ
ﺟﻮ ﺑﯿﺎﻥ ﮨﻮﺍ ﺗﻌﺮﯾﻒ ﺍﻟﺠﻠﯽ ﺑﺎﻟﺨﻔﯽ ﮨﮯ ﮐﻤﺎ ﻧﺒﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻓﯽ
ﺍﻟﻤﻮﺍﻗﻒ ﻭﺷﺮﺣﮭﺎ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﯾﮟ ﻣﻌﻨﮯ ﺍﯾﮏ ﻋﺮﺽ ﻭﺣﺎﺩﺙ ﮨﮯ
ﺍﻭﺭ ﺍﺏ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ ﺍﺱ ﺳﮯ ﻣﻨﺰﮦ ﮨﮯ -
অর্থাৎ, উরফে আম বা প্রচলিত সংজ্ঞায় নূর হচ্ছে একটি কাইফিয়ত বা অবস্থা, দৃষ্টিশক্তি প্রথমে যেটিকে অনুধাবন করে এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য দৃষ্ট জিনিসও অনুধাবন করা হয়।
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺴﻴﺪ ﻓﻰ ﺗﻌﺮﻳﻔﺎﺗﻪ ﺍﻟﻨﻮﺭ
ﻛﻴﻔﻴﺔ ﺗﺪﺭﻛﻪ ﺍﻟﺒﺎﺻﺮﺓ ﺍﻭﻻ ﻭﺑﻮﺍﺳﻄﺘﻬﺎ ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻟﻤﺒﺼﺮﺍﺕ
সঠিক তত্ত্ব হলো, এখানে যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা থেকে নূর অনেক উর্ধ্বে। এটা ﺗﻌﺮﻳﻒ ﺍﻟﺠﻠﻰ
ﺑﺎﻟﺨﻔﻰ ‘তা’রিফুল জলি বিল খফি’। যেমন ﻣﻮﺍﻗﻒ ও তার ব্যাখ্যা গ্রন্থে তা বর্ণনা করা হয়েছে। এই অর্থে নূর হচ্ছে আরজ ও হাদেস তথা যা অন্যের মাধ্যমে স্থিতিশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। আর আল্লাহতা’য়ালা এগুলো থেকে পবিত্র। (এ জন্যে উপরোক্ত অর্থে আল্লাহ তা’য়ালার পবিত্র সত্তাকে নূর বলা যেতে পারে না।)
একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী শায়খ আহমদ ফারূকী সিরহিন্দী আলাইহির রহমত (বেসাল: ১০৩৪ হিজরি) স্বপ্রণীত
ﻣﻜﺘﻮﺑﺎﺕ ﺍﻣﺎﻡ
ﺭﺑﺎﻧﻰ ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ শীর্ষক কিতাবের তৃতীয় জিলদের (উর্দু) ১৬১৫/১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
ﻣﻤﮑﻦ ﭼﮧ ﺑﻮﺩ ﮐﮧ ﻇﻞ ﻭﺍﺟﺐ ﺑﺎﺷﺪ
ﻭﺍﺟﺐ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﺎ ﺳﺎﯾﮧ ﮐﯿﻮﮞ ﮨﻮﮔﺎ ﮐﯿﻮﻧﮑﮧ ﻣﺜﻞ ﮐﯽ ﺗﻮﻟﯿﺪ
ﮐﺎ ﻣﻮﮨﻢ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﻋﺪﻡ ﮐﻤﺎﻝ ﻟﻄﺎﻓﺖ ﮐﮯ ﺷﺎﺋﺒﮧ ﮐﯽ ﺧﺒﺮ
ﺩﯾﺘﺎﮨﮯ- ﺟﺒﮑﮧ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﮧ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭﺳﻠﻢ ﮐﺎ
ﻟﻄﺎﻓﺖ ﮐﯽ ﻭﺟﮧ ﺳﮯ ﺳﺎﯾﮧ ﻧﮧ ﺗﮭﺎ ﺗﻮ ﺧﺪﺍﮰ ﻣﺤﻤﺪ ﮐﺎ
ﺳﺎﯾﮧ ﮐﯿﻮﮞ ﮨﻮﮔﺎ- ﺧﺎﺭﺝ ﻣﯿﮟ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﺎﻟﺬﺍﺕ ﺍﻭﺭ
ﺑﺎﻻﺳﺘﻘﻼﻝ ﺻﺮﻑ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺫﺍﺕ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﯾﺎﭘﮭﺮ ﺍﻟﻠﮧ
ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺻﻔﺎﺕ ﺛﻤﺎﻧﯿﮧ ﺣﻘﯿﻘﯿﮧ ﺍﻭﺭ ﺍﻥ ﮐﮯ ﺳﻮﺍ ﺟﻮ
ﮐﭽﮫ ﺑﮭﯽ ﮨﮯ ﻭﮦ ﺍﻟﻠﮧ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﮐﯽ ﺍﯾﺠﺎﺩ ﺳﮯ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﮨﻮﺍ ﮨﮯ
ﺍﻭﺭ ﻣﻤﮑﻦ ﺍﻭﺭ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﺍﻭﺭ ﺣﺎﺩﺙ ﮨﮯ ﺍﻭﺭ ﮐﻮﺉ ﻣﺨﻠﻮﻕ
ﺍﭘﻨﮯ ﺧﺎﻟﻖ ﮐﺎ ﻇﻞ ﻧﮩﯿﻦ ﮨﮯ -
ভাবার্থ: মমকিনের কী ক্ষমতা যে, ওয়াজিবের প্রতিচ্ছায়া হয়। ওয়াজিব বা অবশ্যম্ভাবী জাত বা সত্তার (আল্লাহতা’য়ালার) ছায়া কেন হবে? যেহেতু ছায়াবিশিষ্ট হওয়া অনুরূপ বস্তুর সাদৃশ্যের ধারণার জন্ম দিয়ে থাকে। ছায়াবিশিষ্ট না হওয়া পূর্ণ সূক্ষ্ম অস্তিত্বের নিদর্শন জ্ঞাপক। যখন সূক্ষ্মতা বশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র শরীর মোবারকের ছায়া ছিল না, তবে মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র রব বা প্রতিপালকের ছায়া হবে কেন?
খারেজ বা বহিঃজগতে ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﺎﻟﺬﺍﺕ ‘মাওজুদ বিজজাত’ বা স্বীয় অস্তিত্বে অস্তিত্ববান এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার যাত বা সত্তা। আল্লাহতা’য়ালার অষ্ট সিফাতে খাসসা বা খাস গুণাবলীতে প্রকৃত আদি বা বাস্তব গুণ বিদ্যমান। এটি ছাড়া অন্যান্য গুণাবলী যা আছে, তা সম্ভাব্য সৃষ্ট ও হাদেস বা নতুন বস্তু। কোনো সৃষ্ট বস্তু স্বীয় স্রষ্টার ছায়া নয়।
ﺩﺭ ﺧﻮﺍﺳﺘﮧ ﺍﺳﺖ ﺍﻧﺤﻀﺮﺕ ﺍﮮ ﺧﺪﺍ ﮐﮧ ﺩﺭ ﺟﻤﯿﻊ ﺍﻋﻀﺎ
ﻭﺟﮭﺎﻥ ﻧﻮﺭ ﺑﺨﺸﺪ ﻭﺩﺭ ﺁﺧﺮ ﺁﮔﻔﺘﮧ ﻭﺍﺟﻌﻠﻨﯽ ﻧﻮﺭﺍ ﻭﭼﻮﮞ
ﺁﻧﺤﻀﺮﺕ ﻋﯿﻦ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﺷﺪ ﻧﻮﺭ ﺭﺍﺳﺎﯾﮧ ﻧﻤﯿﺒﺎﺷﺪ ( ﻣﺪﺍﺭﺝ
ﺍﻟﻨﺒﻮۃ ﺹ ১/ ۱ ٤٦ ﻓﺎﺭﺳﯽ )
ভাবার্থ: নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাজাত করতেন, ইয়া আল্লাহ! আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও চতুর্দিকে নূর দান করুন (নূরানী করে দিন)। দো’য়ার শেষাংশে উল্লেখ রয়েছে- ﻭﺍﺟﻌﻠﻨﻰ ﻧﻮﺭﺍ আমাকে নূরে পরিণত করে দিন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﻋﻴﻦ ﻧﻮﺭ ﺑﺎﺷﺪ
‘আইনে নূরে বাসদ’, অর্থাৎ, নিজেই নূর ছিলেন, আর নূরের তো ছায়া হয় না।’
উপরেলিখিত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম নবী (দ:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এবং নবীর নূর মোবারক দ্বারা সবকিছু তথা কুল কায়েনাত আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা নূরে হাকিকী, বরং হাকিকতে বা প্রকৃতপক্ষে তিনি-ই একমাত্র নূর। অর্থাৎ,
ﻣﻨﻮﺭ ‘মুনাওইর’ বা নূরের সৃষ্টিকর্তা এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন নূরে তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। ﻟﻄﺎﻓﺖ ‘লতিফ’ বা সূক্ষ্ম হওয়ার কারণে নবী (দ:)-এর যেমন ছায়া ছিল না, আল্লাহতা’য়ালারও তেমনি ছায়া নাই। কারণ তিনি হচ্ছেন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম।
ওয়াজিবুল ওজুদ ও নূরে হাকিকী একমাত্র আল্লাহ
ওয়াজিবুল ওজুদ একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা। তিনি ছাড়া ওয়াজিবুল ওজুদ আর কেউই নেই। কেননা, ওয়াজিবুল ওজুদ ওই সত্তাকে বলে, যিনি সত্তাগতভাবে স্বয়ং অস্তিত্বশীল, অন্যের দ্বারা অস্তিত্বশীল নন। যিনি কখনো অস্তিত্বহীন ছিলেন না এবং অস্তিত্বহীন হবেনও না। এমন সত্তা একমাত্র আল্লাহ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয় لا موجود الا الله অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা অন্যের দ্বারা একবার অস্তিত্বশীল হন আবার এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েন, তাঁদেরকে বলা হয় মমকিনুল ওজুদ। আর এর উদাহরণ হল সমস্ত মাখলুক।
এভাবে নূরে হাকিকী বা নূরে মতলক একমাত্র আল্লাহ। কেননা, নূরে হাকিকী বা প্রকৃত অর্থে নূর একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার জাত বা সত্তাকেই বুঝায়। আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া যা কিছু আছে, তাকে বিজ্জাত মুজলিম বা অন্ধকার বলা হয়। হ্যাঁ, আল্লাহপাক যাঁকে নূর বানিয়েছেন বা নূর দান করেছেন, তাঁকে রূপক অর্থে নূর বলা হয়। এ ধরনের নূরকে ’নূরে মুজাজি’ বলে। অতএব, আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া যে সকল সম্মানিত মাখলুককে আমরা নূর বলে থাকি, তা নূরে মজাজি; নূরে মতলক বা নূরে হাকিকী নয়।
এ প্রসঙ্গে তাফসিরে রূহুল মায়ানী ৬ষ্ঠ খণ্ড ১৮ পারা - الله نور السموات والارض - এ আয়াতের তাফসিরে ১৬৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
فالوجود الحق- والله تعالى كما ان النور الحق هو الله عزوجل-
‘অতএব, যেমনভাবে ওজুদে হক একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা, তেমনিভাবে নূরে হক-ও আল্লাহতা’য়ালা-ই।’
এর কয়েক লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
وفسر النور فى هذه الاية اعنى قوله تعالى (الله نور السموات والارض) بذلك ثم اشار الى وجه الاضافة الى (السموات والارض) بقوله: لا ينبغى ان يخفى عليك ذلك بعد ان عرفت انه تعالى هو النور ولا نور سواه-
অর্থাৎ, الله نور السموات والارض - এ আয়াতে কারীমার মধ্যে যে নূর রয়েছে, এ নূর দ্বারা আল্লাহ যে নূরে হাকিকী তারই প্রমাণ বহন করে একমাত্র আল্লাহতা’য়ালাই ‘হাকিকী নূর’। অন্য নূরের সঙ্গে যার কোনো তুলনা হতে পারে না। এ নূর হচ্ছে আজলি ও কাদীম যার কোনো আরম্ভ নেই।
তারপর অানুমানিক ১১ লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
معنى النور وهو الظهور فى نفسه واظهار لغيره-
আল্লাহতা’য়ালাই হাকিকী নূর যা নিজে নিজে প্রকাশকারী এবং অন্যকেও প্রকাশকারী।
এরপর আরো ১১ লাইন পরে উল্লেখ রয়েছে -
وقيل: نور بمعنى منور وروى ذلك عن الحسن- وابى العاليه والضحاك وعليه جماعة عن المفسرين-
অর্থাৎ, ‘نور ‘নূর’-এর অর্থ হচ্ছে منور ‘মুনাওইর’ যা অন্য সব কিছুকে আলোকিতকারী। হাসান আবু আলীয়া ও জেহহাকসহ এবং এক জামাত মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত এর ওপর রয়েছে।
আল্লামা রাগেব ইস্পাহানির লিখিত ‘আল মুফরিদাত’ শীর্ষক কিতাবের ৫০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
وسمى الله تعالى نفسه نورا من حيث انه هو المنور- قال: (الله نور السموات والارض)
অর্থাৎ, ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা স্বীয় নাফস বা জাতকে নূর বলে নামকরণ করেছেন, এ মর্মে যে এ নূরের অর্থ হলো منور ‘মুনাওইর’ বা আলোদানকারী। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর দানকারী।’ অর্থাৎ, আল্লাহ হচ্ছেন হাকিকী নূর আর নবী হচ্ছেন তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এ নূর মোবারককে সৃষ্টি করে, এর সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর জাত মোবারকের দিকে রেখেছেন। এ জন্যে বলা হয়, আল্লাহর জাত কর্তৃক নবী (দ:)-এর জাতের সৃষ্টি।
ষষ্ঠ শতাব্দীর পঞ্চম মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত (বেসাল: ৫০৫ হিজরি) ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ শীর্ষক একখানা কিতাব প্রণয়ন করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহর দলিল-আদিল্লাহর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আল্লাহতা’য়ালা-ই একমাত্র নূর, নূরে হাকিকী, নূরে মতলক, আল্লাহর জাত হলো নূর এবং আল্লাহ ছাড়া সবই مظلم ‘মুজলিম’ বা অন্ধকার। আল্লাহ যাঁকে নূর দান করেছেন তিনি-ই একমাত্র নূর নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى সর্বসৃষ্টির পূর্বে আল্লাহতা’য়ালা আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহতা’য়ালার সৃষ্ট নূর।
সপ্তম শতাব্দীর ষষ্ঠ মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত (ওফাত ৬০৪ হিজরি) নিজ ‘তাফসিরে কবির’ শীর্ষক কিতাবের ১২ নম্বর জিলদের ২৩ নম্বর জুজ-এর ২৩০ পৃষ্ঠায় ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত’এর - مشكوة الانوار ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ নামক কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন -
والممكن لذاته يستحق العدم من ذاته والوجود من غيره والعدم هو الظلمة- ( ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: মুমকিন বিজ্জাত বা সত্তাগত মুমকিন বলা হয় তাকে যা স্বয়ং অস্তিত্বশীল নয়, অন্যের দ্বারা অস্তিত্বশীল হয়, আর সকল عدم ‘আদম’ বা অস্তিত্বহীন হচ্ছে জুলমত বা অন্ধকার (যা নূরের বিপরীত)।
অতঃপর ইমাম রাযী (রহ:) বলেন -
الحاصلة والوجود هو النور- فكل ما سوى الله مظلم لذاته مستنير بانارة الله تعالى (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: সারকথা হচ্ছে, আল্লাহতা’য়ালার ওজুদ-ই হচ্ছে একমাত্র নূর (বা হাকিকী নূর বমা’না منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী)
অতএব, আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু সত্তাগতভাবে জুলমত বা অন্ধকার এবং আল্লাহ প্রদত্ত নূরের দ্বারাই নূরানী।
এককথায়, আল্লাহ হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ যার আরম্ভ নেই, শেষও নেই, যিনি বিজ্জাত মওজুদ, অর্থাৎ, নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল।
অতঃপর ইমাম রাযী (রহ:) আরো বলেন -
وعند هذا يظهر ان النور المطلق هو الله سبحانه وان اطلاق النور على غيره مجاز اذ كل ما سوى الله (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, নিশ্চয় মতলক নূর হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা। আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর নূরের এতলাক বা অন্য কাউকে নূর আখ্যায়িত করা মজাজ বা রূপক অর্থে প্রয়োগ হবে। (হাকিকী নূর একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা-ই। আল্লাহ তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন।)
অতঃপর হযরত ইমাম আরো বলেন -
فثبت انه سبحانه هو النور- وان كل ما سواه فليس بنور الاعلى سبيل المجاز (ص ۲۳٠ جزء ۲۳)
ভাবার্থ: অতএব, স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা-ই একমাত্র নূর। আল্লাহতা’য়ালা ছাড়া অন্য যা কিছুই রয়েছে কাউকে নূর বলে আখ্যায়িত করা যায় না; কিন্তু তা হবে মজাজ বা রূপক অর্থে নূর। অতঃপর তিনি আরো বলেন -
واعلم ان هذا الكلام الذى روينا عن الشيخ الغزالى رحمه الله كلام مستطاب ولكن يرجع حاصله بعد التحقيق الى ان معنى كونه سبحانه نورا انه خالق للعالم وانه خالق للقوى الدراكة وهو المعنى من قولنا معنى كونه نورا السموات والارض انه هادى اهل السموات والارض- فلاتفاوت بين ما قاله وبين الذى نقلناه عن المفسرين فى المعنى والله اعلم (جلد ۱۲ ص ۲۳۱ جزء ۲۳ تفسير كبير)
ভাবার্থ: (ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত বলেন) জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই এই বক্তব্য যা আমি বর্ণনা করেছি, তা হলো শায়খ ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত হতে كلام مستطاب উত্তম কালাম বা গ্রহণযোগ্য বক্তব্য। এই ভাষ্য তাহকিক বা বিশ্লেষণ করে যা প্রাধান্য পায়, তা হলো এ অর্থে আল্লাহতা’য়ালা নূর যে তিনি জগতের স্রষ্টা এবং নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহতা’য়ালা) শক্তিশালী জ্ঞান বা বোধগম্যতা সৃষ্টিকারী। আমাদের বক্তব্য এ অর্থই বহন করে যে, আল্লাহতা’য়ালার কালাম الله نور السموات والارض - ‘আল্লাহতা’য়ালা আসমান জমিনের নূর’, অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহতা’য়ালা) নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের অধিবাসীদের পথপ্রদর্শক।
আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত যে ফয়সলা দিয়েছেন এবং মুফাসসিরীনগণ থেকে আমরা যা বর্ণনা করেছি, এর উভয়ের মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য নেই। সহিহ মুসলিম শরীফ ১ম জিলদের ৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
عن ابى ذر قال سالت رسول الله صلى الله عليه وسلم هل رأيت ربك قال نور انى اراه-
عن قتادة عن عبد الله بن شقيق قال قلت لابى ذر لو رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم لسألته فقال عن اى شئ كنت تسأله قال كنت اسأله هل رأيت ربك قال ابو ذر قد سألته فقال رأيت نورا-
অর্থাৎ, হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি আরজ করেছি, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? আল্লাহর হাবিব উত্তরে বললেন, তিনি নূর আমি তাঁকে কীভাবে দেখবো?
হযরত কাতাদা কর্তৃক হযরত আব্দুল্লাহ বিন শাকীক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছি যে, যদি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ পেতাম, তাহলে আমি জিজ্ঞেস করতাম। তখন আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি কোন্ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে? তিনি বললেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম: আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তাঁকে নূর (রূপে) দেখেছি।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ গ্রন্থে বলেন,
جیسا کہ رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم نے اللہ تعالی کو دیکھنے کے سوال کے جواب میں فرمایا تھا کہ وہ تو نور ھے میں اسے کیسے دیکھ سکتا ہو-
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতায়ালার দর্শনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি তো নূর আমি তাঁকে কীভাবে দেখবো।
উপরোক্ত হাদিস শরীফ ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত-এর দলিলভিত্তিক ভাষ্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহর জাত নূর বমা’না منور ‘মানাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী।
শরহে ফেকহে আকবর নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে -
(كما وصف) اى الله سبحانه (نفسه) اى ذاته؟ وفيه دليل على جواز اطلاق النفس على ذاته تعالى- ... وقد ورد تفكروا فى كل شئ ولا تفكروا فى ذات الله-
ভাবার্থ: যেভাবে তিনি গুণান্বিত, অর্থাৎ, আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা نفسه ‘নাফসাহু’, অর্থাৎ, তাঁর পবিত্র জাত বা সত্তা এতে দলিলভিত্তিক প্রমাণিত হলো, النفس ‘আন নফস’ প্রযোজ্য আল্লাহতা’য়ালার জাতের ওপর হয়ে থাকে।... এবং বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক বস্তুর ওপর চিন্তা ফিকির করো। আল্লাহর জাত বা সত্তার ওপর চিন্তা-ফিকির করো না। কারণ, আল্লাহর জাত কী তা বোঝার মতো জ্ঞান কারোরই নেই।
‘তাফসিরে আবিস সউদ’ নামক কিতাবের মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ এমাদি আলাইহির রহমত (ওফাত ৯৫১ হিজরি) الله نور السموات والارض এর আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেন-
وعبر عن المنور بنفس النور تنبيها على قوة التنوير وشدة التأثير وايذانا بانه تعالى ظاهر بذاته وكل ما سواه ظاهر باظهاره كما ان النور نير بذاته وما عداه مستنير به-
ভাবার্থ: নূরকে মুনাওইর (আলো দানকারী) অর্থে গণ্য করা হয়েছে। কারণ আলো দান করার শক্তি, ভীষণ প্রভাবের দরুণ শুধু নূরকে মুনাওইর অর্থে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহতা’য়ালা স্বয়ং জাহের বা প্রকাশমান এবং তাঁকে ছাড়া অন্য সবকিছু প্রকাশ হয়ে থাকে তাঁরই দ্বারা প্রকাশ করার কারণে। যেমন নিশ্চয় তিনি নিজে নিজেই আলোকিত। আর অন্য সব কিছুকে আলো দানকারী।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন আলাইহির রহমত স্বপ্রণীত نور المصطفى নামক কিতাবে উল্লেখ করেন -
محققین کے نزدیک نور وہ کہ خود ظاھر ہو اور دوسروں کا مظھر کما ذکرہ الامام حجۃ الاسلام الغزالی ثم العلامہ الزرقانی فی شرح المواھب الشریف باین معنی اللہ عز وجل نور حقیقی ہے بلکہ حقیقۃ وھی نور ہے اور آیۃ کریمہ اللہ نور السموات والارض بلا تکلف وبلاتاویل اپنے معنی حقیقی پرہے فان اللہ عز وجل ھو الظاھر بنفسہ المظھر لغیرہ من السموات والارض ومن فیھن وسائر المخلوقات-
حضور پرنور سید عالم صلی اللہ علیہ وسلم بلا شبہ اللہ عز وجل کے نور ذاتی سے پیدا ہیں- حدیث شریف میں وارد ہے: ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره- اے جابر بیشک اللہ تعالی نے تمام اشیاء سے پہلے ترے نبی کا نور اپنے نور سے پیدا فرمایا- رواہ عبد الرزاق ونحوہ عند البیھقی حدیث میں نورہ فرمایا جسکی ضمیر اللہ کی طرف ہے کہ اسم ذات ہے من نور جمالہ یا نور علمہ یا نور رحمتہ وغیرہ نہ فرمایا کہ نور صفات سے تخلیق ہو- علامہ زرقانی رحمہ اللہ تعالی اسی حدیث کے تحت میں فرما تے ہیں (من نورہ) ای من نور ھو ذات یعنی اللہ عز وجل نے نبی صلی اللہ علیہ وسلم کو اس نور سے پیدا کیا جو عین ذات الھی ہے یعنی اپنی ذات سے بلا واسطہ پیدا فرمایا کما سیاتی تقریرہ-
ভাবার্থ: মুহাক্কিক বা বিশ্লেষকদের মতে নূর তাকেই বলে, যে স্বয়ং প্রকাশমান এবং অন্যকেও প্রকাশকারী, যেমনটি হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত, আল্লামা যারকানী নিজ ’শরহে মাওয়াহিব শরীফে’ উল্লেখ করেছেন। এ অর্থে মহান আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন নূরে হাকিকী বা প্রকৃত حقيقة তিনি-ই একমাত্র নূর, আর الله نور السموات والارض ‘আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি’ আয়াতে কারীমায় জটিল ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে স্বীয় হাকিকী অর্থে প্রযোজ্য হবে। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা নিজেই প্রকাশমান এবং অন্যকেও প্রকাশকারী। আসমান, জমিন উভয়ের অধিবাসী এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতকে জাহির বা প্রকাশ করেছেন। হুজুর পুর নূর সাইয়েদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃসন্দেহে আল্লাহতা’য়ালার জাতি নূর কর্তৃক সৃষ্ট। (অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিবের জাতি নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করে সেই নূরের সম্পর্ক বেলাওয়াসেতা বা ডাইরেক্ট আল্লাহর জাতের সঙ্গে রেখেছেন। এ অর্থে আল্লাহর জাতি নূর কর্তৃক সৃষ্টি বলা হয়ে থাকে।)
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে -
ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره-
হে জাবির! নিশ্চয় আল্লাহতা’য়ালা সবকিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর স্বীয় নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। শায়খ আব্দুর রাজ্জাক এ হাদিসখানা বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ ইমাম বায়হাকিও বর্ণনা করেছেন।
হাদিস শরীফে من نوره ‘মিননূরুহি’ বর্ণিত হয়েছে, যার ضمير ‘জমির’ আল্লাহতা’য়ালার ইসমে জাতের দিকে প্রত্যার্পন করেছে। من نور جماله ‘মিন নূরে জামালিহি’ অথবা نور علمه ‘নূরে ইলমিহি’ অথবা نور رحمته ‘নূরে রাহমাতিহি’ ইত্যাদি বলেননি, যেহেতু নূরে সিফাত দ্বারা সৃষ্টি বলা হয়নি।
আল্লামা জারকানী আলাইহির রহমত উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন - من نوره اى من نور هو ذات - অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওই নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যা عين ذات الهى‘আইনে জাতে ইলাহি’ বা আল্লাহর প্রকৃত জাত, অর্থাৎ, নিজ জাত কর্তৃক কোনো মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন।
শারিহে বোখারি আল্লামা ইমাম কাসতালানী রাদিয়াল্লাহু আনহু مواهب لدنيه ‘মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ শীর্ষক কিতাবে হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একখানা দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিস শরীফে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সম্বোধন করে বলেন -
قال يا جابر ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره (الحديث)
অর্থাৎ, ‘হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রশ্নের জবাবে আল্লাহর হাবিব বললেন, হে জাবির! নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা সমুদয় বস্তু সৃষ্টির পূর্বে তাঁর নূর কর্তৃক তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।’
উক্ত হাদিস শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানী আলাইহির রহমত ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেন -
من نوره اضافة تشريف واشعار بانه خلق عجيب وان له شانا مناسبة ما الى الحضرة الربوبية على حد قوله تعالى ونفخ فيه من روحه وهى بيانية اى من نور هو ذاته لابمعنى انها مادة خلق نوره منها بل بمعنى تعلق الارادة به بلا واسطة شئ فى وجوده-
অর্থাৎ, মিন নূরিহি তাঁর (আল্লাহর) নূর হতে বা নূর কর্তৃক - এটি ইজাফতে তাশরিফি বা সম্মানসূচক সম্বন্ধ এবং এ কথা জানিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য যে, এটি সৃষ্টিজগতের এক আশ্চর্য বস্তু। এর একটি পৃথক শান রয়েছে আল্লাহতা’য়ালার দরবারে। এ শানটির একটি মুনাসিবত বা সাদৃশ্য হতে পারে আল্লাহতা’য়ালার ওই বাণীর সাথে, যেখানে এরশাদ হয়েছে - ونفخ فيه من روحه আদম আলাইহিস সালামের দেহ মোবারকে তাঁর (আল্লাহর) রূহ ফুঁকলেন, অর্থাৎ, এখানে রূহের সম্বন্ধ আল্লাহতা’য়ালার দিকে সম্মানার্থে করা হয়েছে।
من نوره -এর মধ্যে من ‘হরফে জার’ বয়ানিয়া, বর্ণনামূলক।من نوره এর মধ্যে যে নূর রয়েছে, এর ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত বলেন -
اى من نور هو ذاته - অর্থাৎ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, সে নূর আল্লাহতা’য়ালার জাত; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টির মাদ্দা বা মূল ধাতু, বরং এর অর্থ এই যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টি করার মধ্যে আল্লাহতা’য়ালার এরাদা বা ইচ্ছার সম্পর্ক বেলা ওয়াসেতা বা সরাসরি অর্থাৎ কোনো কিছুর মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন।
আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত-এর উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালা হেকমতে কামেলার দ্বারা সর্বপ্রথম তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সৃষ্ট নূরের ডাইরেক্ট বা সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর জাতের সঙ্গে রয়েছে।
এ জন্যে বলা হয়ে থাকে, আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম عین ذات الھی سے پیدا ہوا আল্লাহর প্রকৃত জাত কর্তৃক সৃষ্ট।
সুতরাং আল্লাহ হচ্ছেন নূরে হাকিকী, অর্থাৎ, নূর সৃষ্টিকারী; আর রাসূলেপাক হচ্ছেন সৃষ্টিতে নূর جنس ‘জিনছে’ বা জাতিতে বশর, অর্থাৎ, নূরের মনুষ্য আকৃতি।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আল্লাহর জাত বা মূল সত্তা হচ্ছেন নূরে হাকিকী বা হাকিকী নূর। আল্লাহতা’য়ালার নূরের অংশ হয় না, টুকরো হয় না, ভাগ হয় না, এ নূরের কোনো উদাহরণ বা মিসাল নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ফাসী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘মাতালিউল মুসাররাত শরহে দালাইলুল খায়রাত’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করেন -
قد قال الاشعرى انه تعالى نور ليس كا الانوار والروح النبوة القدسية لمعة من نوره والملئكة شرر تلك الانوار وقال صلى الله تعالى عليه وسلم اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق كل شئ وغيره مما فى معناه-
অর্থাৎ, ইমামে আহলে সুন্নাত আবুল হাসান আশআরী আলাইহির রহমত এরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহতা’য়ালা নূর; কিন্তু অন্য কোনো নূরের মত নন (যার কোন উদাহরণ নেই)। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহ মোবারক সেই নূরেরই ঝলক এবং ফেরেশতাগণ ওই জ্যোতি থেকে ঝড়ে পড়া নূরের খণ্ডসমূহ। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর মোবারককে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর হতেই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।
শায়খ মুহাক্কিক আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০৫২ হিজরি) নিজ ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ শীর্ষক গ্রন্থের ২/৭৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
انبیاء مخلوق انداز اسماء ذاتیہ حق واولیاء ازاسماء صفاتیہ وبقیہ کائنات ازصفات فعلیہ وسید رسل مخلوق ست ازذات حق و ظھور حق دروی بالذات ست-
অর্থাৎ, ‘আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে আল্লাহতা’য়ালার ইসমে জাত (সত্তাগত নাম) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আউলিয়ায়ে কেরামগণকে আসমায়ে সিফাতিয়া (গুণগত নামসমূহ) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যান্য সকলকে সৃষ্টি করা হয়েছে সিফাতে ফে’লিয়া (ক্রিয়াগত গুণসমূহ) থেকে। সাইয়িদুল মুরসালিন (দ:)-কে হক তা’য়ালার জাত (সত্তা) কর্তৃক সৃষ্টি করা হয়েছে। আর হক তা’য়ালার বহিঃপ্রকাশ বা বিকাশ ঘটেছে তাঁর মধ্যে সত্তাগতভাবে।’
আল্লাহপাকের জাত সম্পর্কে মুফতি মোস্তফা হামিদী সাহেবের ভুল ব্যাখ্যা
শর্ষিণা দারুচ্ছুন্নাত কামেল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ মোস্তফা হামিদী সাহেব ‘ফাতাওয়ায়ে দারুচ্ছুন্নাত’ নামের একখানা পুস্তক সংকলন করেছেন। উক্ত পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডের ২১ পৃষ্ঠায় - الله نور السموات والارض ‘আল্লাহতা’য়ালা আসমান জমিনের নূর’ - এ আয়াতে কারীমার তাফসির করতে গিয়ে ‘তাফসিরে কবির’ নামক কিতাবের নিম্নলিখিত এবারত পেশ করে প্রমাণ করতে অপচেষ্টা করেছেন যে - نور ‘নূর’ আল্লাহতা’য়ালার জাত হতে পারে না।
اعلم ان لفظ النور موضوع فى اللغة لهذه الكيفية الفائضة من الشمس والقمر والنار على الارض والجدران وغيرهما وهذه الكيفية يسحيل ان تكون الها لوجوه الخ-
জানা উচিত যে, আভিধানিক অর্থে নূর ওই আলোকে বলে, যা সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি হতে ভুপৃষ্ঠে প্রাচীর ও অন্যান্য বস্তুর ওপর পতিত হয়। আর আলোর এ অবস্থাকে কয়েকটি কারণে ইলাহ (প্রভু) বলা অসম্ভব।
উপরোক্ত এবারতের যে ভাবার্থ, তা হলো সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালার نور হচ্ছে হাকিকী নূর, যার অর্থ منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী। আল্লাহর নূর হচ্ছে নূরে মতলক।
আল্লাহ-ই হচ্ছেন একমাত্র নূর। আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর যে নূরের এতলাক হয়, তা হচ্ছে বিজ্জাত জুলমত বা অন্ধকার। যাঁকে আল্লাহ নূর করেছেন, তিনি-ই হচ্ছেন আল্লাহর সৃষ্টি নূর। যেমন সহিহ হাদিস শরীফে রয়েছে, আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন’। নবী হচ্ছেন আল্লাহর সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালার নূর হচ্ছে হাকিকী নূর। যার আরম্ভও নেই, শেষও নেই। তিনি হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ। অবশ্যম্ভাবী যার তুলনা সৃষ্টির মধ্যে কেউই নেই, এবং আল্লাহতা’য়ালার জাতে কোনো শরীক নেই। তেমনি আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লার সিফাতে খাসসা বা খাস গুণাবলীরও কোনো নজির নেই।
ইতিপূর্বে ‘তাফসিরে কবির’ নামের কিতাব হতে মুহাক্কিকীনদের তাহকিক-এর দলিল সহকারে ৫টি এবারতের মাধ্যমে উল্লেখ করে প্রমাণ করা হয়েছে:
১. আল্লাহতা’য়ালাই একমাত্র নূর। আল্লাহ ছাড়া সব কিছু بالذات বা সত্তাগতভাবে মুজলিম বা অন্ধকার।
২. আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন নূরে মতলক এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর নূরের এতলাক বা অন্য কাউকে নূর বলে আখ্যায়িত করা রূপক অর্থে (মজাজি) নূর।
হামিদী সাহেব ‘তাফসিরে কবির’ নামের কিতাবের সৃষ্ট নূর-এর এবারত পেশ করে আল্লাহর জাত নূর নয় বলে যে দাবি করেছেন, তা সঠিক নয়। তা ব্যাখ্যার নামে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কিন্তু এ তাফসিরে আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমতের তাহকিকাত পেশ করে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী আলাইহির রহমত স্পষ্টভাবে তাহকিকের সাথে আল্লাহর ‘জাত’ যে নূর যার অর্থ منور ‘মুনাওইর’ তা প্রমাণ করেছেন।
হামিদী সাহেব তাফসিরে কবিরের আদ্যপান্ত পাঠ করেন নাই। তাই নিজের মনগড়া মতে ফতওয়া দিয়েছেন। তার এ ফতওয়া সংশোধন আমরা কামনা করি।
আল্লাহপাকের জাত ও সিফাত সম্পর্কে আকিদা
হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত-এর ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন -
انه واحد لاشريك له فرد لا مثل له صمد لا ضد له منفرد لا ند له وانه قديم لا اول له ازلى لا بداية له مستمر الوجود لا اخر له ابدى لا نهاية له قيوم لا انقطاع له دائم لا انصرام له لم يز
ل ولا يزال موصوف نبعوث الجلال لا يقضى عليه بالانقضاء والانفصال بتصرم الاماد (اى لا يقضى عليه بانقضاء تصرم الاماد) وانقراض الاجال بل هو الاول والاخر والظاهر والباطن-
অর্থাৎ, নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) তাঁর অস্তিত্বে অদ্বিতীয়; তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো সাদৃশ্য-ও নেই; তিনি অভাবশূন্য, তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই; তিনি সর্বেসর্বা, তাঁর কোনো অংশীদার নেই; তিনি অনাদি ও অসীম, সর্বক্ষণ বিরাজমান, তাঁর কোন বিরাম নেই; তিনি অনন্তকাল স্থায়ী, তাঁর কোনো শেষ নেই, তিনি গৌরবের গুণে সকল সময়ই গুণান্বিত ছিলেন, আছেন ও থাকবেন, সময়ের অতীতেও তাঁর শেষ নেই। তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গুপ্ত এবং সর্ব বিষয়ে তিনি-ই মহাজ্ঞানী।
তারপর ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত উক্ত কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন -
وانه ليس بجسم مصور ولا جوهر محدود مقدر انه لا يماثل الاجسام لا فى التقدير ولا فى قبول الانقسام وانه ليس بجوهر ولا تحله الجوهر ولا يعرض ولا تحله الاعراض بل لا يماثل موجودا ولا يماثله موجود ليس كمثله شئ ولا هو مثل شئ وانه لا يحده المقدار ولا تحويه الاقطار ولا تحيط به الجهات ولا تكشفه الارضون ولا السموات وانه مستو على العرش على الوجه الذى قاله وبالمعنى الذى اراده استواء منزها عن المماسة والاستقرار والتمكن والحلول والانتقال لا يحمله العرش بل العرش وحملته محمولون بلطف قدرته ومقهورون فى قبضته-
ভাবার্থ: আল্লাহ অশরীরী, নিরাকার, পরিমাণশূণ্য, সাদৃশ্যহীন, তকদীরহীন, অবিভাজ্য, অণু-পরমাণূশূন্য, তাঁর দৈর্ঘ বা প্রস্থ নেই, কোনো জিনিস দ্বারা তাঁর দৃষ্টান্ত দেয়া যায় না, তিনি কোনো জিনিসের তুল্য-ও নন, তাঁর মতো আর কিছুই নেই। তিনি কোনো জিনিসের মতো নন। তিনি পরিমাণের ভেতর সীমাবদ্ধ নন, কোনো স্থানের ভেতর তিনি আবদ্ধ নন, কোনো দিক তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না। আসমান ও জমিন তাঁকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তিনি পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে মুক্ত। তিনি আরশের সম্মুখে অবস্থিত, যার সম্মন্ধে আল্লাহ নিজেই বলেছেন - استوى على العرش - আর ইসতাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে তিনি (আল্লাহ) মুক্ত। আরশ তাঁকে বহন করে না (অর্থাৎ, আল্লাহ আরশে বসতে পারেন না, কারণ আল্লাহ নিরাকার, অশরীরী), বরং আরশ ও তার বহনকারী (ফেরেশতা)-কে আল্লাহর কুদরতের করুণা বহন করে আসছে। সবকিছুই আল্লাহর আয়ত্তাধীন।’
তারপর তিনি বলেন -
وهو الان على ما عليه كان وانه بائن عن خلفه بصفاته ليس فى ذاته
অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) পূর্বে যেরূপ ছিলন, এখনও তিনি সেরূপই আছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির কাছে গুণ দ্বারা প্রকাশ, অস্তিত্ব বা জাত দ্বারা নয়।
আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন’ শীর্ষক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৪ পৃষ্ঠায় আরো বলেন -
يرى من غير حدقة واجفان ويسمع من غير ضمخة واذان كما يعلم بغير قلب ويبطش بغير جارخة ويخلق بغير اله اذ لاتشبه صفاته صفات الخلق كما لا تشبه ذاته ذات الخلق-
অর্থাৎ, আল্লাহ পাক চক্ষু ব্যতিরেকে দেখেন, কর্ণ ব্যতিরেকে শুনেন, দ্বিল ব্যতিরেকে জ্ঞান রাখেন, হস্ত ব্যতিরেকে ধরেন, যন্ত্র ব্যতিরেকে সৃষ্টি করেন, তাঁর গুণ সৃষ্টির তুল্য নয়। যেরূপ তাঁর অস্তিত্ব সৃষ্টির অস্তিত্বের তুল্য নন।
সারকথা, আল্লাহর মহান গুণ হলো আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী বা মুহতাজ নন, الله الصمد - আল্লাহ হলেন সমদ বা বে-নিয়াজ। অর্থাৎ, আল্লাহর দেখতে চোখের প্রয়োজন নেই, শুনতে কানের প্রয়োজন নেই, জ্ঞান রাখতে দিলের প্রয়োজন নেই, ধরতে হাতের প্রয়োজন নেই।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত স্বরচিত ‘তাকমীলুল ঈমান’ শীর্ষক কিতাবে আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন -
وليس مجسم ولا جوهر ولا عرض ولا مصور ولا مركب ولا معدود ولا محدود ولا فى جهة ولا فى مكان ولا فى زمان-
অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) দেহবিশিষ্ট নন, তিনি জওহর বা বস্তু বিশেষ নন, আরজ বা বস্তু বিশিষ্টও নন। তিনি আকারবিশিষ্ট নন, তিনি মুরাক্বাব নন (তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই); সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন, পরিমাণযোগ্য নন, তিনি দিকশূন্য, তিনি কোনো স্থানে অবস্থান করেন না এবং তাঁর ওপর কোনো সময় অতিক্রান্ত হয় না। অর্থাৎ, তিনি নিরাকার, জমান-মকান ও দিক থেকে তিনি পবিত্র।
তারপর তিনি উক্ত কিতাবে আরো বলেন -
لا مثل له ولا شبه ولا ضد ولا ند له ولا ظهر ولا معين-
অর্থ: তিনি উপমাহীন, রূপকহীন, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তাঁর সাহায্যকারী ও সহযোগী কেউ নেই; অর্থাৎ, তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি হলেন সমদ বা কারো মুখাপেক্ষী নন।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি কোনো বস্তুর মতো নন, কোনো বস্তুও তাঁর মতো নয়; গোটা আলম তথা আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবই হাদস, অর্থাৎ, ধ্বংসশীল/বিনাশপ্রবণ। যখন এসব কিছুই ছিল না, তিনি তখনও ছিলেন; আবার যখন কোনো কিছুই থাকবে না, তিনি তখনও থাকবেন। তিনি একাই নিজের কুদরত দ্বারা সম্পূর্ণ ‘নেই’ হতে সব কিছু সৃজন করেছেন, তথা অস্তিত্ব দান করেছেন; তিনি-ই হলেন আল্লাহ। তিনি এক, একক ও অদ্বিতীয়, অনাদি, অবিনশ্বর, শাশ্বত ও চিরঞ্জীব, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা এবং স্বাধীন ও কার্যকর ইচ্ছাশক্তির মালিক। তিনি عرض ‘আরজ’ তথা এমন বস্তু নন, যা অন্যের মাধ্যম ছাড়া স্থিতিশীল হতে পারে না। যথা - রং, গন্ধ, স্বাদ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি। তিনি জিসিম তথা দেহবিশিষ্ট নন। কেননা, দেহ বহু অবিভাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং স্থান দখলকারী। অথচ এ সবই নশ্বর সৃষ্টিকুলের বৈশিষ্ট্য। তিনি মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর আকার-আকৃতিবিশিষ্টও নন। কেননা, এটি (আকৃতি) দেহের বৈশিষ্ট্য, যা দেহের প্রান্তসীমা ও পরিধি তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ দ্বারা অর্জিত অবস্থা তথা আয়তন ও পরিমাণ হতে সৃষ্টি হয়ে থাকে। তিনি প্রান্ত, সীমা ও পরিধিবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ, তিনি সসীম তথা পরিমাণযোগ্য নন। বরং তিনি আদি, অন্ত ও মধ্যহীন; তিনি অনন্ত, অসীম। তিনি সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ, তিনি গণণা ও পরিসংখ্যানযোগ্য নন। তিনি অংশ ও আংশিকতামুক্ত। তাঁর জাত বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডে ও অংশে বিভক্ত ও বিভাজ্য হয় না। বহু পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্র অংশে মিলিত হয়ে তাঁর জাত গড়ে ওঠেনি। কেননা, যার অংশ থাকে এবং যা বহু বিচ্ছিন্ন অংশ দ্বারা সংযোজিত, তার অস্তিত্ব লাভের ক্ষেত্রে ওই সব অংশের প্রতি মুখাপেক্ষিতা অপরিহার্য। আর এই মুখাপেক্ষিতা আল্লাহর অনিবার্য সত্তার পরিপন্থী। তাঁর ওপর কোনো সময় অতিক্রান্ত হয় না। তাঁর সাথে কোনো বস্তুর সাদৃশ্য নেই। তাঁর ইলম ও কুদরত-বহির্ভুত কোনো বস্তু নেই। তাঁর জাতের মধ্যে অন্য কোনো বস্তু স্থান পায় না এবং পেতে পারে না। তিনি কোনো বস্তুতে প্রবেশ করেন না এবং তাঁর মধ্যেও কোনো বস্তু প্রবেশ করে না এবং করতেও পারে না; আর তিনি কোনো বস্তুর সাথে এক হয়ে যান না। তিনি অনন্ত ও অসীম। কেননা সসীম হওয়া পরিমাণ ও পরিসংখ্যানযোগ্য বস্তুর বৈশিষ্ট্য। তিনি অংশ ও আংশিকতামুক্ত। তিনি কোনো বস্তুর শ্রেণিভুক্ত নন। তিনি দেহের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুণাবলী যথা - রং, স্বাদ, গন্ধ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি হতে মহাপবিত্র। কেননা, এসবই দেহ তথা সংযোজিত ও সংমিশ্রিত বস্তুর গুণ। তিনি কোনো স্থানে অবস্থান করেন না।
অনুরূপভাবে, শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজ ‘আল কাওলুল জামিল’ শীর্ষক কিতাবের ৩৭ পৃষ্ঠা লিখেছেন -
منزه من جميع سمات النقص والزوال من الجسمية والتحير والعرضية والجهة والالوان والاشكال-
অর্থাৎ, ‘আল্লাহতা’য়ালা অপূর্ণতা ও নশ্বরতা, এ জাতীয় সবকিছু থেকে মুক্ত। তিনি দেহধারী, স্থান গ্রহণকারী, কোনো দিকে অবস্থানকারী, বর্ণ ও আকৃতিধারী এবং দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী নন।
‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের (উর্দু) ১১৫৮/৬২পৃষ্ঠায় মাকতুবাত নং ৬৭) উল্লেখ করেন -
اور اللہ کسی چیز سے متحد نہیں ہوتے اور نہ ھی کوئ اور چیز ان سے متحد ہوتی ہے اور اللہ تعالی کسی چیز میں حلول بھی نہیں کرتا اور نہ ھی کوئ چیز اللہ میں حلول کرتی ھے اور اللہ تعالی کے لۓ اجزاء اور حصص کا ہونا بھی محال ہے اور ترکیب وتحلیل اللہ تعالی کی بارگاہ میں ممنوع ھے اور اللہ تعالی کا کوئ مثل اور کفو نہیں ھے بیوی بچے نہیں ہیں- اسکی ذات وصفات بے چوں بے جگون اور بے شبیہ اور بے نمونہ ہیں- ھم صرف اتناجنتے ہیں کہ اللہ تعالی اور اسماء وصفات کاملہ سے جن سے اپنے آپ کی تعریف کی ہے ان سے متصف ہے ان میں جو چیز بھی ہمارے فھم وادراک اۓ اور ہم اسے سمجہ سکیں اور تصور کرسکا وہ اس سے پاک اور بلند ہے-
ভাবার্থ: আল্লাহতা’য়ালা কোনো বস্তুর সাথে একত্রিত নন এবং কোনো বস্তু তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায় না। আল্লাহতা’য়ালা কোনো বস্তুর ভেতর অনুপ্রবেশ করেন না। আল্লাহতা’য়ালার পক্ষে খণ্ড ও অংশ হওয়া অসম্ভব। তরকীব বা সংমিশ্রণ, তাহলিল বা দ্রবীভূত হওয়া তাঁর পাক জাতে দুষ্কর ও নিষিদ্ধ। আল্লাহতা’য়ালার কোনো অনুরূপ ও সমশ্রেণিভূক্ত কেউই নেই। তাঁর স্ত্রী-পুত্রও নেই। তাঁর জাতে ও সিফাত বা গুণাবলীসমূহ রকম বা প্রকারবিহীন এবং অনুরূপ ও নিদর্শন রহিত। আমরা শুধু এতোটুকু জানি (ঈমান রাখি) যে আল্লাহতা’য়ালা আছেন এবং তিনি যেরূপ নিজের প্রশংসা করেছেন, তদ্রুপ তাঁর নাম ও কামেল গুণাবলীতে বর্তমান আছেন।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা স্বেচ্ছায় অস্তিত্ববান এবং অপরাপর সবকিছুই তাঁর সৃষ্টির কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে, আল্লাহপাক আপন জাত ও সিফাত এবং কর্মকাণ্ডের মাঝে সম্পূর্ণ একা। প্রকৃতপক্ষে কোনো বিষয়েই, চাই তা অস্তিত্ব হোক, অথবা অস্তিত্বহীন হোক, কেউই তাঁর সঙ্গে অংশীদার নন। নামগত অংশিদারিত্ব ও শব্দগত সম্পর্ক আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
মাকতুবাত ৩/১১৫৭/৬২ পৃষ্ঠা মাকতুবাত নং ৬৭ উল্লেখ রয়েছে -
اللہ سبحانہ وتعالی اکیلا ہے ان کا کوئ شریک نہیں نہ وجوب ووجود میں اور نہ عبادت کے مستحق ہونے میں- وجود وجوب (لازمی طور پر قائم رھنا) اللہ تعالی کے سوا کسی کے لۓ لائق نہیں اور نہ عبادت کا استحقاق اس کے سوا کسی کے لۓ درست نہیں-
اللہ تعالی صفات کاملہ رکھتا ہے جن میں سے حیات- علم- قدرت- اردہ- سمع- بصر- کلام اور تکوین بھی ہیں- یہ صفات ازلی اور قدیمی ہیں- اور اللہ جل سلطانہ کی ذات کے ساتھ قائم ہیں
ভাবার্থ: আল্লাহপাক সুবহানাহু ওয়াতায়ালা এক তাঁর কোন শরিক বা সমকক্ষ নেই। অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী হিসেবে হোক অথবা এবাদতের উপযোগী হিসেবেই হোক, তিনি সমকক্ষবিহীন। তিনি ছাড়া অন্য কেউই অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের উপযোগী নন এবং ইবাদতের যোগ্যতাও কেউই রাখেন না।
আল্লাহতা’য়ালার সিফাতে কামেলা বা পূর্ণাঙ্গ গুণ সর্বমোট ৮টি; এগুলো নিম্নরূপ -
১. হায়াত বা জীবনী শক্তি
২. এলম বা জ্ঞান
৩. কুদরত বা ক্ষমতা
৪. এরাদত বা ইচ্ছাশক্তি
৫. ছামা বা শ্রবণশক্তি
৬. বছর বা দর্শনশক্তি
৭. কালাম বা বাকশক্তি
৮. তাকবিন বা সৃষ্টিশক্তি
এ ৮টি সিফাতসমূহ কাদীম ও আজলি বা অনাদি (যার কোনো আরম্ভ নেই) ও অনন্ত (যার কোনো শেষ নেই)। এ গুণসমূহ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর জাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নবজাত বস্তুসমূহের সাথে সম্পর্ক সিফাতসমূহের অনাদিত্বের মধ্যে কোনোরূপ ব্যতিক্রম ঘটাতে সক্ষম হয় না। সম্পর্কিত বস্তুর নতুনত্ব এদের চিরস্থায়িত্বের প্রতিবন্ধক হয় না।’
মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী ৩/১৬১৩/১৫৩ পৃষ্ঠা মকতুব নং ১২২ উল্লেখ রয়েছে -
آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی اس جاہ وجلال اور اس بلندی شان کے با وجود ہمیشہ ممکن ہیں اور ہرگز امکان سے باہر نہیں آسکتے اور نہ واجب سے مل سکتے کیونکہ یہ الوھیت سے متصف ہونے کو مستلزم ہے اور تعالی اس سے بلند ھے کہ کوئ اسکا شریک اور برابری کرنے والا ہو-
دع ما ادعتہ النصاری فی نبیھم
واحکم بما شئت مدحا فیہ واحتکم
ভাবার্থ: হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ শান-শওকত ও কুল-কায়েনাতের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবসময় (চিরকালই) তিনি হচ্ছেন ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য ও সৃষ্ট। নিশ্চয় তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য হতে নিষ্কৃতি লাভ করেননি এবং আল্লাহতা’য়ালা যিনি واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী জাতে পাকের সাথে মিলিত হতে পারেন না; এজন্য জাতে উলুহিয়াতের সাথে মিলিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা তাঁর সমকক্ষ ও শরিক হওয়া হতে তিনি অতি উর্ধ্বে ও পবিত্র।
কহিল নাছারা যাহা স্বীয় নবীর ’পরে
কহিও না তোমরা তাহা মম নবী-বরে।
মাহবুবে খোদা আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি নূর
আল্লাহর হাবিব সৃষ্ট নূর এবং তাঁর নূর দ্বারা আল্লাহ পাক কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন। একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজ مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ শীর্ষক কিতাবের ২/২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
بدانکہ اول مخلوقات وواسطۂ صدور کائنات وواسطۂ خلق عالم وآدم نور محمدست صلی اللہ علیہ وسلم- چنانکہ درحدیث صحیح وارد شدہ کہ اول ما خلق اللہ نوری وسائرمکونات علوی وسفلی ازان نور وازان جوھر پاک پیدا شدہ ازارواح واشباح وعرش وکرسی ولوح وقلم وبہشت ودوزخ وملک وفلک وانس وجن وآسمان وزمین وبحار وجبال واشجار وسائر مخلوقات ودرکیفیت صدور این کثرت ازان وحدت وبروز وظھور مخلوقات ازان جوھر عبارات وتغيرات غر
يب آوردہ اند وحدیث اول ما خلق اللہ العقل نزد محققین ومحدثین بصحت نرسیدہ وحدیث اول ما خلق اللہ القلم نیزگفتہ اند کہ مراد بعد العرش والماءاست کہ واقع شدہ است وکان عرشہ علی الماء الخ-
ভাবার্থ: এ এক চিরন্তন বাস্তবতা যে, নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির প্রথম, সমস্ত কায়েনাতের ওসিলা, বিশ্বজগৎ এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টির মাধ্যম হচ্ছে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সহিহ হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন - اول ما خلق الله نورى ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী’
অর্থাৎ, আল্লাহতা’য়ালা সমস্ত মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং ঊর্ধ্ব ও অধঃজগতের সবকিছুই নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূর মোবারক থেকে সৃষ্ট। তাঁর পবিত্র নূরী জাওহার থেকে সৃষ্টি হয়েছে রূহসমূহ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, ফেরেশতা, ইনসান, জিন, আসমান, জমিন, সাগর, পাহাড়, গাছ, বৃক্ষ এবং কুল মাখলুকাত। এ সকল কিছুর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে তাঁরই ওসিলায়। সেই হাকিকতের প্রকাশে বিজ্ঞ বিজ্ঞ আলেমগণ বিস্ময়কর ও সূক্ষ বর্ণনা পেশ করেছেন।’
এক রেওয়ায়েতে এসেছে -اول ما خلق الله العقل ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহুল আকলু’; আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আকল সৃষ্টি করেছেন। তবে এই হাদিস মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিসগণের মতে সহিহ-এর স্তরে পৌঁছেনি। অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে - اول ما خلق الله القلم ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু কলম’ সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা কলম সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটির অর্থ মুহাদ্দিসগণ এভাবে করেছেন যে, আরশ ও পানি সৃষ্টির পরে প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার কোনো কোনো হাদিসের ব্যাখ্যায় এ রকম এসেছে যে, পানি সৃষ্টি হয়েছিল আরশের পূর্বে وكان عرشه على الماء
এর পরপরই আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন, হাদিস শরীফে এসেছে, যখন কলম সৃষ্টির পর আল্লাহতা’য়ালা তাকে বললেন লেখো, তখন কলম বললো, কী লেখবো? আল্লাহতা’য়ালা বললেন, ما كان وما يكون الى الابد ‘মা কানা ওয়ামা ইয়াকুনু ইলাল আবাদ’ অতীত এবং ভবিষ্যতের সবকিছু লিখো। এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, কলম সৃষ্টির পূর্বেও কিছু সৃষ্টি হয়ে ছিল। আলেমগণ বলেন, আরশ, কুরসি এবং রূহসমূহ সৃষ্টির পূর্বে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক প্রকাশ্য জগতে এসেছে। ما كان ‘মা কানা’ যা কিছু হয়েছিল এ অর্থই বহন করে। তা হলো নূরে মুহাম্মদীর হাল ও সিফাতসমূহ। কেননা, সমগ্র জগতের মধ্যে নূরে মুহাম্মদী অগ্রগণ্যতা সুসাব্যস্ত اول ما خلق الله نورى অপরদিকে وما يكون ‘ওমা ইয়াকুনু’-এর অর্থ হলো, পৃথিবীর পরবর্তীতে প্রকাশিতব্য সকল কিছু। আলমে জহুর বা বাহ্যিকজগতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রমাণিত ছিল। যেমন আল্লাহর হাবিব বলেছেন, كنت نبيا وادم بين الروح والجسد অর্থ: আমি ওই সময়ও নবী ছিলাম, যখন আদম আলাইহিস সালাম আত্মা ও দেহের মাঝামাঝিতে ছিলেন। (মাদারিজুন নবুয়ত- ২-৩ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত হাদিসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন -
ودر اخبار آمدہ است کہ چون مخلوق شد نور انحضرت وبیرون آمدازوی انوار انبیاء علیہم السلام امرکرد اورا پروردگار تعالی کہ نظر کند بجانب انوار ایشان پس نظر کرد آنحضرت وپوشید انوار ایشاں را گفتندای پروردگار ما این کیست کہ پوشید نوروی انوار ما را گفت اللہ تعالی این نور محمد بن عبد اللہ است اگر ایمان آرید بوے میگرادنم شمارا انبیاء گفتند ایمان آوردیم یارب بوے وبہ نبوت وی پس گفت رب العزت جل جلالہ گواہ شدم برشمادانیست معنی قول حق سبحانہ تعالی واذا اخذ اللہ میثاق النبیین لما اتیتکم من کتاب رحکمۃ الایۃ- مدارج النبوۃ ص ۳/ ۲
ভাবার্থ: ‘হাদিস শরীফে এসেছে, যখন নূরে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হলো এবং তাঁর নূর থেকে (আল্লাহর হাবিবের নূর থেকে) সকল নবীগণ আলাইহিমুস সালাম-এর নূরসমূহ বের করা হলো, তখন আল্লাহতায়ালা নূরে মোস্তফা আলাইহিস সালামকে বললেন, ওই নূরসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। তিনি তাই করলেন। ফলে তাঁর নূর সকল নূরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করলো এবং অন্যান্য নূর হয়ে গেল আলোকবিহীন। তাঁরা নিবেদন করলেন, হে পরওয়ারদিগারে আলম! তা কার নূর, যা আমাদের সকলের নূরকে ম্লান করে দিলো? আল্লাহতা’য়ালা ইরশাদ করলেন, এ নূর মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর। তোমরা যদি তাঁর প্রতি ঈমান আনো, তবে আমি তোমাদেরকে নবী বানাবো। সকলেই সমস্বরে বললেন, হে আমাদের রব! আমরা তাঁর প্রতি ও তাঁর নবুয়তের প্রতি ঈমান আনলাম। আল্লাহতা’য়ালা অতঃপর বলেন, আমি তোমাদের এ কথার সাক্ষী রইলাম। এদিকে ইঙ্গিত করেই কোরআন মজীদের এক আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে -
واذ اخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب و حكمة الخ
অর্থাৎ, আল্লাহ যখন নবীগণের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করবো। (মাদারিজুন নবুয়ত, ২-৩ পৃষ্ঠা)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৩য় জিল্দ ৮ পারা ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে -
(وانا اول المسلمين ۱٦۳) وقيل: هذا اشارة الى قوله عليه الصلوة والسلام- اول ما خلق الله تعالى نورى-
অর্থাৎ, আলোচ্য আয়াতে কারীমার তাফসিরে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর اول ما خلق الله نورى ’সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন’ বাণীতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
تفسير روح البيان ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ ৩য় জিলদের সূরায়ে আনআম ১২৯ পৃষ্ঠায় আশ শায়খ ইসমাঈল হক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) বলেন -
(وانا اول المسلمين) يعنى اول من استسلك عند الايجاد لامركن وعند قبول فيض المحبة لقوله (يحبهم ويحبونه) والاستلام للمحبة فى قوله يحبونه دل عليه قوله عليه السلام (اول ما خلق الله نورى)
অর্থাৎ, وانا اول المسملين ’আমি সর্বপ্রথম মুসলমান’ - এর অর্থ হলো, সর্বপ্রথম সৃষ্টি করার সময় আল্লাহতা’য়ালার আদেশ كن ‘কুন’ ’হয়ে যাও’কে আমি সর্বপ্রথম মেনে নিয়েছি। অনুরূপভাবে, মহব্বতের ফয়েজ গ্রহণ করার সময় আমি-ই সর্বপ্রথম তা গ্রহণ করেছি। কারণ আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন, তিনি তাঁদের মহব্বত করেন। আর তাঁরাও আল্লাহকে মহব্বত করেন। এ মহব্বতে ফয়েজ গ্রহণের বেলায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম, যা তাঁর বাণী ‘আল্লাহ তা’য়ালা আমার নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন’ প্রমাণ করছে।
শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন -
فضيلت اعلی واکمال وی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم آنست کہ پرور دگار تعالی روح اورا پیشتر ازارواح خلائق پیدا کردہ وارواح سائر مکونات را از روح وے منشعب گردایندہ ہمہ را از نوروی آفریدہ ووی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم نبی بودہ وآدم ھنوزمیاں روح وجسد بود کما رواہ الترمذی عن ابیھریرۃ رضی اللہ عنہ ودر عالم ارواح نیز فیض بارواح انبیاء از روح او رسیدہ، (مدارج النبوت جلد ۱ ص ۱٤۳)
ভাবার্থ: নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে উন্নত ও পরিপূর্ণ মর্যাদা হলো এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারককে অন্যান্য সকল রূহ মোবারকের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহর হাবিবের রূহ মোবারক হতে সমস্ত রূহ সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম রূহ ও জসদ বা শরীরাকৃতির মধ্যে থাকা অবস্থায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ছিলেন, যেমনটি তিরমিজি শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। অপরদিকে, আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে এমনকি সমস্ত নবীগণের রূহ মোবারকগণ ও সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক হতে পূর্ণ ফয়েজ ও বরকত প্রাপ্ত হয়েছেন।
শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত নিজস্ব ‘ইনতেবাহ ফি সালাসিলিল আউলিয়া আল্লাহ’ নামের কিতাবের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
نور اول کہ آں نور محمدی ست صلی اللہ علیہ وسلم ونیز آں را شھود اول می گویند-
অর্থাৎ, নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম সৃষ্টি। এজন্য তিনি-ই সর্বপ্রথম আল্লাহর একত্বের স্বাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।
মোল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত مرقاة شرح مشكوة ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ শীর্ষক কিতাবের ১ম জিলদের ১৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
ان اول شئ خلق الله القلم وهو غير صحيح ... فا الاولية اضافيه والاول الحقيقى هو النور المحمدى على ما بينته فى المورد للمولد-
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। আর সেটা হচ্ছে গায়রে সহিহ বা অশুদ্ধ; অতএব, সেটা আউয়ালিয়তে এজাফি বা প্রথম। আর আউয়ালিয়তে হাকিকী প্রকৃত অর্থে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে নূরে মুহাম্মদী। এ সম্পর্কে আমি ‘মাওরিদু লিল মাওলিদ’ নামের কিতাবে সবিস্তারে বর্ণনা করেছি।
হুব্বে এলাহির প্রথম বিকাশ
সৃষ্টির প্রথমেই আল্লাহতা’য়ালার حب ‘হুব্ব’ اراده ‘ইরাদা’। সুতরাং তওয়াজুহে হুব্বী-ই, অর্থাৎ, মহব্বতের দৃষ্টি-ই হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি যা আল্লাহতা’য়ালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি সমস্ত মাখলুকাত সেই প্রথম সৃষ্টির শাখা এবং সমস্ত হাকিকত حب ‘হুব্ব’-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত তাঁর ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ (তৃতীয় জিলদের ১৬০৭ পৃষ্ঠা ও ১৪৯ পৃষ্ঠা ১২২ নং মাকতুব) কিতাবে উল্লেখ করেন -
اور حقیقت محمدی علیہ وعلی آلہ الصلوۃ والسلام جوکہ حقیقت الحقائق ہے- مراتب ظلال طے کرنے کے بعد اس فقیر پر آخرکار جو کچھ منکشف ہوا ہے وتعین وظھور حبی ہے جوکہ تمام ظھورات کا مبدآ اور تمام مخلوقات کی پیدائش کا منشا ہے- مشھور حدیث قدسی میں آیا ہے- كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف (میں ایک مخفی خزانہ تھا میں نے محبوب رکھاکہ میں پہچانا جاؤں پھر میں نے مخلوق کو پیدا کیا تاکہ میں پہچانا جاؤں) سب سے پہلی چیز جو اس مخفی خزانہ سے ظھور کے تخت پرجلوہ گرہوئ وہ محبت تھی جو کہ مخلوقات کی پیدائش کا سبب ہوئ- اگر یہ محبت نہ ہوتی تو ایجاد کا دروازہ نہ کھلتا اور عالم عدم میں مستقل طور پر اپنا ٹھکانا رکھتا- حديث قدسى لو لاك لما خلقت الافلاك (اگر تونہ ہوتا تو میں آسمانوں کو پیدا نہ کرتا) جوکہ خاتم الرسل کی شان میں واقع ہے کا راز اس جگہ سے معلوم کرنا چاھۓ اور لو لاك لما اظهرت الربوبيت (اگر تونہ ہوتا تو میں ربوبیت کو ظاھر نہ کرتا) کی حقیقت کو اس مقام میں تلاش کرنا چاھۓ
ভাবার্থ: হাকীকতে মুহাম্মদী আলাইহি ওয়ালা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম حقيقت الحقائق ‘হাকিকাতুল হাকাইক’ বা সমস্ত হাকিকতের হাকিকত বা মূল। সর্বশেষে প্রতিবিম্বসমূহের স্তরসমূহ অতিক্রম করার পর এ ফকিরের প্রতি যা বিকশিত হলো, তা আল্লাহপাকের ‘হুব্ব বা মহব্বতের বিকাশ, যা সৃষ্টিজগতের উৎপত্তির কারণ এবং আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা, হাদিসে কুদসিতে মশহুর রয়েছে -
(كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف)
‘আমি গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছিলাম। তৎপর আমি মুহব্বত রাখলাম যে, আমি পরিচিত হবো; এরপর আমি এক মাখলুক সৃষ্টি করলাম যাতে আমি পরিচিত হই।’
গুপ্ত ধনভাণ্ডার হতে সর্বপ্রথম যা প্রকাশ পেয়েছে, তাই হলো حب ‘হুব্ব’ বা মহব্বত। বিশ্বজগত সৃষ্টির কারণ এটি-ই। যদি এ হুব্ব বা মহাব্বত না হতো, তাহলে সৃষ্টির দ্বার উম্মুক্ত হতো না এবং জগতসমূহ নাস্তি বা শূন্যের গর্ভে দৃঢ়রূপে চিরস্থায়ী থাকতো।
এ ব্যাপারে হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ রয়েছে -
(لو لا ك لما خلقت الافلاك)
’যদি আপনি না হতেন, তাহলে আমি (খোদা) আকাশমণ্ডল সৃষ্টি করতাম না’, যা সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে এসেছে। তাঁর হাকীকত বা রহস্য এ স্থলে অন্বেষণ করা উচিত এবং لو لاك لما اظهرت الربوبيت ‘আপনি না হলে আমি নিজ প্রভুত্বও প্রকাশ করতাম না’ - এ হাদিসের তত্ব এস্থলে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামের কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ৭৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন -
(وصل در بیان سر تسمیہ وی صلی اللہ علیہ وسلم الخ)
অনুবাদ: রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারক حبيب خدا ‘হাবিবে খোদা’ হওয়ার রহস্যবলীর আলোচনা এবং তাঁর নাম মোবারক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাব্যস্ত হওয়ার কারণ।
এ সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে - আল্লাহর হাবিব বলেছেন, একদিন সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আল্লাহর হাবিব তাশরিফ আনলেন এবং সাহাবায়ে কেরামের নিকটবর্তী হলেন। শুনতে পেলেন, সাহাবিগণ পরস্পর আলোচনা করছেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার মাখলুকের মধ্য থেকে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে তাঁর খলিল বানিয়েছেন। অপরজন বললেন, আল্লাহতায়ালা মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে কথা বলেছেন। তৃতীয়জন বললেন, আল্লাহতা’য়ালা ঈসা আলাইহিস সালামকে কালিমুল্লাহ এবং রূহুল্লাহর মর্যাদা দান করেছেন। চতুর্থজন বললেন, আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা সফিউল্লাহ বানিয়েছেন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের কথোপকথন শুনলাম। তোমরা বলেছো, আল্লাহতা’য়ালা ইব্রাহিমকে খলিল, মুসাকে কালিমউল্লাহ, ঈসাকে রূহুল্লাহ এবং আদমকে সফিউল্লাহ বানিয়েছেন। তোমরা জেনে রাখো এবং হুশিয়ার হয়ে যাও যে, আল্লাহতা’য়ালা আমাকে حبيب الله ‘হাবিবুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এবং এতে আমার কোনো অহংকার নেই। কিয়ামত দিবসে আমি লিওয়াউল হাম্দ বা প্রশংসার পতাকা বহনকারী হবো। এতেও আমার কোন ফখর নেই। আমি কিয়ামতের দিন প্রথম শাফায়াতকারী হবো এবং আমার শাফায়াত সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতেও আমার কোনো ফখর নেই। কিয়ামতের দিন আমি-ই সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবো, তখন আমার জন্যে সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজা খোলা হবে। সেদিন আমি-ই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবো। তখন আমার সঙ্গে থাকবে আমার উম্মতের ফকির দরবেশগণ। আমি-ই اولين واخرين পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের মধ্যে অধিক সম্মানিত হবো, এতে আমার কোনো দর্প বা ফখর নেই। হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কামালাত ও সর্বসৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনায় এ হাদিসটি পূর্ণাঙ্গ দলিল হিসেবে পরিগণিত।’
ইমাম ইবনে হজর হাইতমী আলাইহির রহমত (বেসাল: ৯৭৪ হিজরি) নিজ ‘আদদুররুল মনদুদ’ নামের কিতাবের ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
قال الفخر الرازى: وقع الاجماع على ان افضل النوع الانسان نبينا سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم لقوله صلى الله عليه وسلم- انا سيد ولد ادم ولا فخر-
ভাবার্থ: হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুষ্য আকৃতিসম্পন্ন, এর ওপর ইজমা হয়েছে। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেন, আমি আদম সন্তানদের সরদার। এতে আমার কোনো গর্ব নেই।
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক বর্ণনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহ তায়ালা নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বসৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে তাঁকে حبيب ‘হাবিব’ নামে ভূষিত করেছেন।
অতঃপর আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ৭৮২ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ করেন -
وبتحقیق گذشت بیان علو مکان ومکانت وی صلی اللہ علیہ وسلم مقصود اینجا اگاھے بسر تخصیص اوست صلی اللہ علیہ وسلم باسم الحبیب پس بدانکہ مقام حبی اعلا مقامات کمالیہ است ۔۔۔ الخ
অর্থাৎ ‘নিঃসন্দেহে ইতিপূর্বে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উচ্চস্থান এবং উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বর্ণনা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য حبيب ‘হাবিব’ শব্দটির রহস্য উদঘাটন। সুতরাং গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নাও যে, কামালাতের মাকামসমূহের মধ্যে উন্নততর মাকাম হচ্ছে مقام حبى ‘মাকামে হুব্বী’ বা মহব্বতের স্থল। به تحقيق তাহকিক সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে।
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন -
كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق وتعرف اليهم فبى عرفونى وعرفت بهم-
(আমি রহস্যের গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছিলাম; তৎপর আমি মহব্বত রাখলাম যে আমি পরিচিত হবো, এরপর আমি এক মাখলুক সৃষ্টি করলাম এবং আমি তাদের কাছে পরিচিত হলাম। এ দ্বারা তারা আমাকে চিনলো, আমিও তাদেরকে চিনলাম।
সুতরাং توجه حبى ‘তাওয়াজ্জুহে হুব্বীই’, অর্থাৎ, মহব্বতের দৃষ্টি-ই হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি। যা আল্লাহতা’য়ালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি সমস্ত মাখলুকাত সেই প্রথম সৃষ্টির শাখা এবং সমস্ত হাকিকত حب ‘হুব্ব’-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সৃষ্টির যে প্রথম হুব্ব (ইরাদা) তা যদি না হতো, তাহলে কোনো মাখলকু-ই পয়দা হতো না। আর যদি মাখলুক পয়দা না হতো, তাহলে আসমা ও সিফাতে এলাহিকে কেউ জানতো না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহে মোবারকের ওসিলায় মাখলুক প্রকাশিত হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, রূহে মুহাম্মদী না হলে কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না এবং আল্লাহতায়ালাকে কেউ জানতো না। কারণ হুব্ব حب হচ্ছে ওজুদে মওজুদা বা সৃষ্টির অস্তিত্বের জন্যে প্রথম ওয়াসেতা বা মাধ্যম।
(اگر روح پاک محمدی نمی بود نمی شناخت خدارا ھیچ احدی زیرا کہ پیدا نمی بود ھیچ احدی پس حب واسطہ اولی است مروجود موجودات را)
به تحقيق তাহকিকের মাধ্যমে বর্ণিত আছে, আল্লাহতায়ালা মে’রাজের রাত্রিতে তাঁর হাবিবকে বলেছিলেন -
لو لا ك لما خلقت الافلاك
‘লাউ লাকা লামা খালাকতুল আফলাক’, অর্থাৎ, হে আমার হাবিব! আপনি না হলে আমি আসমানসমূহ সৃষ্টি করতাম না।
সুতরাং স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোপন ভাণ্ডার পরিচয়ের জন্য توجه حبى ‘তাওয়াজুহে হুব্বী’ই হলো মুল মাকসুদ। তারপর তিনি ছাড়া যতো কিছু, সব কিছুই তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। তিনি-ই حب الهى ‘হুব্বে এলাহি’র মূল মাকসুদ। তিনি ছাড়া অন্য সব তার শাখা তুল্য। সেই জন্য আল্লাহতা’য়ালা তাঁকে حبيب ‘হাবিব’ নাম দ্বারা খাস করেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কাউকে হাবিব নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। আল্লাহর হাবিবের উম্মতের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তাঁর অনুসরণ করবে, আল্লাহপাক তাকে محبوب ‘মাহবুব’ বানাবেন। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা নিজেই ইরশাদ করেছেন -
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله-
হে হাবিব! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহতা’য়ালার ভালোবাসা বা মুহব্বত লাভ করতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহতা’য়ালা তোমাদেরকে মহব্বত করবেন।
মাদারিজুন নবুয়ত ২য় জিলদের ৭৮৩ পৃষ্ঠায় (ফার্সি) উল্লেখ রয়েছে -
‘প্রকাশ থাকে যে, حب على الاطلاق ‘হুব্ব আলাল ইতলাক’, অর্থাৎ, হুব্বে মতলাক বা সাধারণত ‘হুব্ব’-এর নয়টি স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে একটি স্তর খালেক-এর মধ্যে। আর বাকি স্তরসমূহ মাখলুকের মধ্যে বিদ্যমান।
প্রথম স্তর যা খালেক এর মধ্যে বিদ্যমান তার নাম হচ্ছে حب ‘হুব্ব’, তবে এ ‘হুব্ব’-এর প্রকাশের জন্যে হরকত বা প্রতিক্রিয়া হওয়া জরুরি নয়। এই ‘হুব্ব’ যখন সৃষ্টি হবে, তখন তাঁর মধ্যে পাওয়া যাবে اراده ‘এরাদা’ বা অভিপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে اراده ‘ইরাদা’ হক তা’য়ালার জন্য খাস।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহতায়ালার আটটি সিফাতে খাসসা রয়েছে; এর মধ্যে একটি হল اراده ।
আল্লাহতা’য়ালার সিফাতে কামেলা হলো,
১. حيات হায়াত বা জীবনী শক্তি
২. قدرت কুদরত বা ক্ষমতা
৩. علم বা জ্ঞান
৪. كلام কালাম বা বাকশক্তি
৫. بصر বা দর্শনশক্তি
৬. سمع সামা বা শ্রবণশক্তি
৭. اراده ইরাদা বা ইচ্ছাশক্তি
৮. تكوين তাকবিন বা সৃষ্টিশক্তি।
এ সকল সিফাত আজলি এবং কাদীমী। যার আরম্ভও নেই, শেষও নেই। আল্লাহতা’য়ালার জাতের সঙ্গে বিদ্যমান।
হুব্ব-এর নয়টি স্তর
(১.) ميلان ‘ময়লান’ মাকলুকের মধ্যে যে ‘হুব্ব’ হয়ে থাকে, তার প্রথম স্তর হচ্ছে ميل ‘ময়ল’ বা মহব্বত করা। আর ময়লান হচ্ছে মতলব বা কাম্য বস্তুর প্রতি মনে আকর্ষণ।
(২.) رغبت ‘রগবত’ বা আকর্ষণ। এই আকর্ষণ যখনই বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে বলা হয় ‘রগবত’ বা আকৃষ্ট হওয়া।
(৩.) طلب ‘তলব’ রগবত বা আকৃষ্ট হওয়ার মাত্রা অধিক হলে তাকে বলা হয় ‘তলব’ বা তালাশ করা।
(৪.) ولع ‘ওলা’ তলব-এর মাত্রা অধিক হলে তাকে বলা হয় ‘ওলা’ বা হালকা পাতলা অবস্থায় অতিক্রম করা।
(৫.) صابه ‘সবা’ বা বুদ্ধিহীনতা। ‘ওলা’র মধ্যে যখন কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সে অবস্থা স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন তাকে বলা হয় صابه ‘সবা’ বা বুদ্ধিহীনতা।
(৬.) ہوا ‘হাওয়া’ বা শূন্যস্থান। এ অবস্থা যখন প্রবল হয় এবং অন্তরের গভীরে নেমে আসে এবং কাম্য বস্তুলাভে শান্তি পায় তখন বলে ‘হাওয়া’ বা শূন্যস্থান।
(৭.) شغف ‘শাগাফ’ বা হৈচৈ। হাওয়া যখন প্রবল আকার ধারণ করে এবং তা অন্তঃকরণে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ‘শাগাফ’ বা হৈচৈ।
(৮.) عزم ‘এযাম’ এই শাগাফ যখন প্রেমিককে ফানা করে দেয়, সেই ফানা এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, নিজের সত্তা থেকেও পৃথক হয়ে যায় এবং ফানা থেকেও ফানা হয়ে যায়, তখন তাকে ‘এযাম’ বা ফানার মাদ্দায় বা প্রাণপনে দৌঁড়ানোকে বলা হয় ‘এযাম’।
(৯.) এই ‘এযাম’ যখন সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বাহ্যিকতায় অবস্থান গ্রহণ করে, তখন ‘মুহিব’ ও ‘হাবিব’ ফানার মাধ্যমে দু’জনের দু’সত্তা থাকে না। অর্থাৎ, একজন ফানা হয়ে বিলীন হয়ে যায় এবং অপরজন আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব-ই একমাত্র বহাল থাকে তাকে حب مطلق হুব্বে মতলক বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আশিক আল্লাহতায়ালার প্রেমে বিলীন হয়ে যায়, এটি-ই ফানা ফিল্লাহ।
উপরোক্ত ‘হুব্ব’-এর নয়টি স্তর প্রকৃতপক্ষে মাখলুকের জন্যে খাস। আল্লাহতায়ালার শানে তা ব্যবহার করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, এ সমস্ত স্তরসমূহের সৃষ্টিকারী একমাত্র আল্লাহতায়ালা-ই।
حب ‘হুব্ব’ ও اراده ‘ইরাদা’ একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্যে খাস। এ ‘হুব্ব’-এর আরেকটি স্তর আছে, যা আল্লাহতায়ালা ও মাখলুকের মধ্যে প্রকাশ পায়; তাকে مرتبه جامعه ‘মুরাত্বাবায়ে জামিয়া’ বা সমন্বিত স্তর নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আবার দ্বিতীয় স্তরও বলা হয়।
আসমায়ে এলাহির মধ্যে একটি নাম আছে ودود ‘ওয়াদুদ’। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাঁকে চান, তাঁকে প্রেমদান করে থাকেন এবং বান্দাও তাঁর সাথে (আল্লাহর সাথে) প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। আল্লাহতা’য়ালা কালামে পাকে এরশাদ করেন -
فسوف يأتى الله بقوم يحبهم ويحبونه-
নিশ্চয়ই আল্লাহতা’য়ালা এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি (আল্লাহ) মহব্বত করবেন বা ভালোবাসবেন এবং তাঁরাও আল্লাহতা’য়ালাকে মহব্বত করবেন। এখানে উভয়েই মহব্বতের এ স্তরে পরস্পর শরিক। ভালোবাসার এ স্তরটি আলমে জহুরে (প্রকাশ্যজগতে) উভয় পক্ষ থেকে হওয়ার কারণে মহব্বতের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বশেষ মাকাম।
মাখলুকাতের জন্য ইশকে এলাহির স্তর থেকে অগ্রগামী কিছুই নেই -
اذ هو نار الله الموقدة التى تطلع على الافئدة-
যেহেতু এটি আল্লাহতা’য়ালার প্রজ্বলিত এশক্, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন قديم ‘কাদীম’ যার কোনো আরম্ভ নেই, শেষও নেই। যিনি ওয়াজিবুল ওয়াজুদ - الله موجود بالذات ।
আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন হেকমতে কামেলা দ্বারা এবং এ সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহতা’য়ালা ‘হুব্ব’ বা ইরাদা ছিল সরাসরি, যার মধ্যে কোনো ওয়াসেতা ব মাধ্যম ছিল না। আল্লাহ হচ্ছেন খালিক বা সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি, যাঁকে আল্লাহ মহব্বতের সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সৃষ্টির মধ্যে বে-নজির (অনুপম)।
আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর, আপাদমস্তক নূর যাঁর ছায়া ছিলনা; আইনী নূর কিন্তু جنس بشر জিনসে বশর বা জাতিতে মনুষ্য আকৃতির, কিন্তু সৃষ্টির মধ্যে তাঁর কোনো তুলনা নেই। তাঁকে আমাদের মতো মানুষ বা দশজনের মধ্যে একজন মানুষ বলা বা আকিদা রাখা কুফুরি। অপরদিকে, আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন جنس بشر জাতিতে মনুষ্য আকৃতির, اكمل بشر পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানব-সুরত, خير البشر সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-সুরত বা মহামানব-সুরতের।
[লেখাটি হালনাগাদ করা হবে]
নূর নবীর বেনজির বাশারিয়াত
নূরে মুজাসসাম রহমতে আলম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূরানীয়ত যেমন এক বিস্ময়কর ব্যাপার,যা ইতোপূর্বে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। তেমনিভাবে নবীজীর বাশারিয়াত বা মানবত্বও এক অলৌকিক বিস্ময়কর ব্যাপার।
নবীজীর আপাদমস্তক দেহ মোবারক ছিল নূর, যাকে বলা হয় নূরে মুজাসসাম। তিনি এক অলৌকিক মহামানব, যার কোন তুলনা হয় না। যার দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না।
নবীজীর বাশারিয়াতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামগণ লিখেছেন যে,তিনি হলেন-
خير البشر- اكمل بشر- نورانى بشر- افضل بشر- سيد البشر-
سيد ولد ادم- - جنس بشر- النوع الانسان ও سيد كل حادث
প্রভৃতি।
মূলকথা নবীজীর নূরানীয়ত আর বাশারিয়াত সর্বদিক দিয়ে তিনি এক স্বতন্ত্র বেনজির মহা সম্মাানিত মাখলুক সৃষ্টিজগতে যার কোন তুলনা নেই।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা আল্লাহর হাবিব সৃষ্টি নূর এবং জাতিতে মহামানব।
এ প্রসঙ্গে মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা সৈয়দ মাহমদু আলুছি বাগদাদী তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল মায়ানী’ নামক কিতাবের ২য় খণ্ড ৬ষ্ঠ পারা ৯৭ পৃষ্ঠায়- قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেন-
(قد جاء كم من الله نور) عظيم هو نور الانوار والنبى المختار صلى الله عليه وسلم والى هذا ذهب قتادة واختاره الزجاج وقال ابو على الجبائى عنى بالنور القران لكشفه واظهاره طرق الهدى واليقين واقتصر على ذلك الزمخشرى وعليه فالعطف فى قوله تعالى) كتاب مبين) لتنزيل المغائرة بالعنوان منزلة المغائرة بالذات واما على الاول فهو ظاهر
ভাবার্থ: আয়াত قد جاء كم من الله نور(নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে এক মহা সম্মানিত নূর এসেছে) সেই নূর হচ্ছে সকল নূরসমূহের নূর।সেই নূর দ্বারা মুরাদ হল,নবীয়ে মুখতার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।তাবেয়ী মুফাসসির হযরত কাতাদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অনুরুপ মতপোষণ করেছেন এবং জুজাজও এই অভিমত গ্রহণ করেছেন (মুতাজিলীদের নেতা) আবু আলী জুবাঈ বলেন- এখানে নূর দ্বারা মুরাদ হল কোরআন।কেননা কোরআনের দ্বারা হেদায়ত ও ইয়াকিনের পথসমূহ প্রকাশিত ও উম্মোচিত হয়ে থাকে। মু’তাজিলীপন্থি জমকশরীও অনুরূপ মত পোষণ করেছেন।
(আল্লামা আলুছি বলেন) মুদ্দাকথা হলো আল্লাহতা’য়ালার বাণী- كتاب مبين (রৌশন কিতাব) অংশকে নূর এর عطف (আতফ) দ্বারা দুইটি বিষয়ের প্রোপট অবতরণ হওয়া বুঝানো হয়েছে। কেননা- معطوف و معطوف عليه (মা’তুফ ও মা’তুফ আলাইহি) দ্বারা مغايرة بالذات (মুগাইরাত বিজ্জাত) বুঝানো হয়ে থাকে।এই প্রথম ব্যাখ্যাই অধিক সুস্পষ্ট।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তাফসির দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আয়াতে কারীমায় نور ‘নূর’ দ্বারা মুরাদ হচ্ছেন নবীউল মুখতার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইহাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অভিমত যে, আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে নূরই এসেছেন।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মহিউস সুন্নাহ আবি মুহাম্মদ হুসাইন ইবনে মাসউদ বগবী আলাইহির রহমত (ওফাত ৫১৬ হিজরি) ‘তাফসিরে মুয়ালিমুত তানজিল’ ৩৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
قد جاء كم من الله نور يعنى محمد صلى الله عليه وسلم
উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় نور ‘নূরুন’ দ্বারা মুরাদ হচ্ছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মাদারিজুন নবুয়ত ১/২৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে-
آنحضرت راسایہ نہ در آفتاب ونہ در قمر رواہ الحکیم الترمذی عن ذکوان فی نوادر الاصول وعجب است ازیں بزرگان کہ ذکر نکردند چراغ را ونور یکی از اسماء آنحضرت ست ونور راسایہ نمی باشد-
নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না।রৌদ্রের প্রচন্ড কিরণে কিংবা চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোতে তাঁর পবিত্র নূরের কায়ার কোন ছায়া পরতো না। হাকিম ও তিরমিজি যাকওয়ান হতে নাওয়াদিরুল উসূলে ইহা বর্ণনা করেছেন।উল্লেখিত বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ কেবল মাত্র চন্দ্র এবং সূর্যের রশ্মির কথাই উল্লেখ করেছেন।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রদীপের কথা উল্লেখ করেন নাই। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার একটি নাম হল নূর বা আলো,নূরের কোন ছায়া হয় না।
দশম শতাব্দীর নবম মুজাদ্দিদ হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত (ওফাত ৯১১ হিজরি) الخصائص الكبرى নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
اخرج الحكيم الترمذى عن ذكوان ان رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يكن يرى له ظل فى شمس ولاقمر قال ابن سبع: من خصائصه ان ظله كان لا يقع على الارض وانه كان نورا فكان اذا مشى فى الشمس او القمر لا ينظر له ظل- قال بعضهم: ويشهد له حديث قوله صلى الله عليه فى دعائه- واجعلى نورا-
অর্থাৎ হাকিম তিরমিজি হযরত যাকওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছায়া- না সূর্যের আলোতে দেখা যেত, না চন্দ্রের আলোতে (দেখা যেত)। ইবনে সাবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বৈশিষ্ট্য যে, নিশ্চয় তাঁর ছায়া জমিনে পতিত হতো না, কেননা তিনি ছিলেন নূর। অতএব, তিনি যখন সূর্যের আলোতে অথবা চন্দ্রের আলোতে চলতেন, তখন তাঁর ছায়া দেখা যেত না। কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ছায়া না থাকার বিষয়টি হাদিসশরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার মাধ্যমে এরশাদ করেন, আয় আল্লাহ আমাকে নূর করে দাও।
তাফসিরে দুররে মানসুরে রয়েছে-
اخرج ابن ابى عمر العدنى عن ابن عباس ان قريشا كانت نورا بين يدى الله تعالى قبل ان يخلق الخلق بالفى عام يسبح ذلك النور وتسبح الملائكة بتسبيحه- فلما خلق الله ادم عليه السلام القى ذلك النور فى صلبه- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: فاهبطنى الله الى الارض فى صلب ادم عليه السلام وجعلنى فى صلب نوح وقذف بى فى صلب ابراهيم ثم لم يزل الله ينقلنى من الاصلاب الكريمة الى الارحام الطاهرة حتى اخرجنى من بين ابوى لم يلتقيا على سفاح قط- (الدر المنثور ص ٤/۳۲৯ لقد جاء كم رسول من انفسكم پاره ۱۱ توبه ۱۲٨ اية)
ভাবার্থ: ইবনে আবু উমর আদনী ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন নিশ্চয় তিনি কোরেশি বা কুরেশ বংশীয়। তিনি মাখলুক (আদম আলাইহি সালাম) সৃষ্টির দুইহাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহর দরবারে নূর ছিলেন।সেই নূর তাসবিহ পাঠ করতো এবং তাঁর তাসবির সাথে ফেরেশতাগণও তাসবিহ পাঠ করতো। অতঃপর যখন আল্লাহতা’য়ালা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন,তখন আদম আলাইহিস সালাম এর পৃষ্টদেশে সেই নূর মোবারক স্থাপন করলেন।রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- অতঃপর আল্লাহতা’য়ালা আমাকে হযরত আদম আলাইহিস সালামের পৃষ্টদেশে থাকা অবস্থায় জমিনে পাঠালেন। অতঃপর হযরত নূহ আলাইহিস সালাম এর পৃষ্টদেশে আমাকে স্থাপন করলেন। বংশ পরম্পরায় আমাকে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পৃষ্টে থাকাকালীন নমরূদের তৈরি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এভাবে স্থানান্তরিত হতে হতে পবিত্র পৃষ্টদেশে থেকে পবিত্র রেহেমে স্থানান্তরিত হতে থাকি এমনকি আমার পিতা-মাতা পর্যন্ত। আমার পূর্ব পুরুষের মধ্যে কখনো জিনা সংঘটিত হয়নি।’
উপরোক্ত হাদিসশরীফের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর হাবিবের নূর সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা সৃষ্টি করে আদম আলাইহিস সালামের পৃষ্ট হতে একের পর এক স্থানান্তরিত হতে হতে হযরত আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর রেহেম মোবারকে স্থির হয়ে এই নূর মোবারকই জমিনে অবতীর্ণ হয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর হাবিব সৃষ্টিতে নূর জাতিতে বশর।
মিশকাত শরীফ ৫১৩ পৃষ্ঠায় আছে-
عن العرباض بن ساريه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم انه قال انى عند الله مكتوب خاتم النبيين وان ادم لمنجدل فى طينته وساخبركم باول امرى دعوة ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امى التى رأت حين وضعتنى وقد خرج لها نور اضاءلها منه قصور الشام- رواه فى شرح السنة ورواه احمد عن ابى امامة من قوله ساخبركم الى اخره- (دلائل النبوة ومعرفة احوال صاحب الشريفة للبيهقى ص ۲/۱۳٠ (مشكوة شريف ص ۵۱۳(
অর্থাৎ ‘ইরবাজ বিন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন নিশ্চয় আমি আল্লাহর দরবারে খাতামুন নাবিয়ীন বা সর্বশেষ নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। ঐ সময় হযরত আদম আলাইহিস সালামের দেহ মোবারক মাটিতে মিশ্রিত ছিল। আর অচিরেই তোমাদেরকে আমার প্রথম অবস্থার সংবাদ দিব। আমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার আম্মার চাক্ষুস দর্শন, যা তিনি আমাকে আমার প্রসবকালীন সময়ে দেখেছিলেন।নিশ্চয়ই তাঁর থেকে এক নূর প্রকাশ হয়েছিল, যার দ্বারা শ্যাম বা সিরিয়ার দালানগুলো আলোকিত হয়ে ছিল।’
মিশকাত শরীফ ৫১৩ পৃষ্ঠায় আছে-
عن عرباض بن ساريا صاحب رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: انى عبد الله وخاتم النبيين وابى منجدل فى طينته وساخبركم عن ذلك: دعوة ابى ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امى التى رأت وكذلك امهات (النبيين) يرين وان ام رسول الله صلى الله عليه وسلم رأت حين وضعته نورا اضائت له قصور الشام ثم تلا يا ايها النبى انا ارسلناك شاهدا ومبشرا ونذيرا وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا) مشكوة ص ۵۱۳ اشعة لمعات ص ٤/٤۷٤ مرقاة ص ۳٦۷
ভাবার্থ: আল্লাহতা’য়ালার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাহাবি হযরত ইবরাদ বিন সারিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন- নিশ্চয়ই আমি আল্লাহতা’য়ালার বান্দা ও সর্বশেষ নবী ঐসময়ও ছিলাম যখন আমার পিতা (হযরত আদম আলাইহিস সালাম) এর দেহ মোবারক মাটি ও পানিতে ছিল। আমি অচিরেই তোমাদেরকে এ সম্পর্কে অর্থাৎ আমার প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিব, আমি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়ার ফসল, আমি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার মায়ের চাক্ষুস দর্শন। এভাবে সকল নবীগণের মাতাগণের দর্শন এবং নিশ্চয় আল্লাহর রাসূলের জননী এ ধরাতেই আগমনের সময়কালীন সময়ে দেখে ছিলেন যে, তার থেকে একটি নূর প্রকাশিত হয়েছিল, যদ্বারা সিরিয়া দেশের অট্টালিকাসমূহ আলোকিত হয়েছিল। অতঃপর পাঠ করলেন-
يا ايها النبى انا ارسلناك شاهدا ومبشرا ونذيرا وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا-
অর্থ: হে নবী (গায়েবের সংবাদদাতা) নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে হাজির নাজির, সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর আদেশ আহ্বানকারী এবং উজ্জ্বল সূর্য করে প্রেরণ করেছি।
(সূরা আহযাব, আয়াত- ৪৫)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৪র্থ জিলদ ১১ পারা ৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
(لقد جاء كم) الخطاب للعرب (رسول) اى رسول عظيم القدر (من انفسكم) اى من جنسكم ومن نسبكم عربى مثلكم ... وقيل: الخطاب للبشر على الاطلاق ومعنى كونه عليه الصلوة والسلام من انفسهم انه من جنس البشر الخ-
অর্থাৎ لقد جاء كم رسول নিশ্চয় তোমাদের নিকট এসেছেন অতি সম্মানিত একজন রাসূল তোমাদের থেকে অর্থাৎ তোমাদের جنس ‘জাত’ থেকে এবং তোমাদের আরবি সম্প্রদায় থেকে। ...
আরো বর্ণিত আছে, আয়াতে গোটা মানব সম্প্রদায়কে সম্বোধন করা হয়েছে।অর্থাৎ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে এসেছেন। নিশ্চয় তিনি جنس بشر ‘জিনসে বশর’ বা জাতিতে মানব। (কিন্তু সৃষ্টিতে নূর)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ২য় জিল্দ ৪ নং পারা ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
لقد من على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা সৈয়দ মাহমদু আলুছি বাগদাদী (ওফাত ১২৭০ হিজরি) উল্লেখ করেন-
(رسولا) عظيم القدر جليل الشان (من انفسهم) اى من نسبهم او من جنسهم عربيا مثلهم او من بنى ادم لاملكا ولا جنيا الخ-
অর্থাৎ رسولا من انفسهم অতি সম্মানিত ও মহান শানের অধিকারী রাসূল প্রেরিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে অর্থাৎ তাদের সম্প্রদায় থেকে অথবা তাদের স্বজাতি থেকে, তাদের ন্যায় আরবীয় সম্প্রদায় থেকে। অথবা বনি আদম থেকে। তিনি ফিরিশতা জাতি ও নন, জিন জাতিও নন।
আল্লামা আলুছি উক্ত তাফসিরের ১১৩ পৃষ্ঠায় আবার উল্লেখ করেন-
وقد سئل الشيخ ولى الدين العراقى هل العلم بكونه صلى الله عليه وسلم بشرا ومن العرب شرط فى صحة الايمان او من فروض الكفاية؟ فاجاب بانه شرط فى صحة الايمان- ثم قال: فلو قال شخص: او من برسالة محمد صلى الله عليه وسلم الى جميع الخلق لكن لا ادرى هل هو من البشر او من الملائكة او من الجن- اولا ادرى هل هو من العرب او العجم؟ فلا شك فى كفره لتكذيبه القران وجحده ما تلقته قرون الاسلام خلفا عن سلف وصار معلوما بالضرورة عند الخاص والعام-
ভাবার্থ: শায়খ ওলিউদ্দিন ইরাকী আলাইহির রহমতকে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ছিল যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে بشرا ومن العرب জাতিতে মানব এবং তিনি আরবি এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা কি ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত অথবা তা কি ফরজে কিফায়া? তদোত্তরে তিনি বলেন- নিশ্চয় আল্লাহর হাবিবকে জাতিতে মানব এবং তিনি আরবীয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখা বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শর্ত। অতঃপর তিনি বলেন- যদি কোন ব্যক্তি বলেন যে, আমি বিশ্বাস করি বা ঈমান রাখি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাসূল হয়ে প্রেরিত হয়েছেন কিন্তু আমি জানি না যে, তিনি কি মানব জাতি না ফেরেশতা জাতীয়, না জ্বিন জাতীয় অথবা আমি জানি না তিনি কি আরবীয় না অনারবীয়? (উত্তরে তিনি ফতওয়া প্রদান করে বলেন) فلا شك فى كفره لتكذيبه القران ঐ ব্যক্তির কুফরি সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই কেননা সে কোরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বাদশ মুজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত (ওফাত ১২৩৯ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে আজিজি ফার্সী’ ২১৪ পৃষ্ঠা ২৯ পারা الا من ارتضى من رسول আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেন-
(ক)
یعنی مگر کسے کہ پسند میکند وآں کس رسول میبا شد خواہ ازجنس ملک باشد مثل حضرت جبریل علیہ السلام وخواہ ازجنس بشر مثل حضرت محمد صلی اللہ علیہ وسلم وموسی وعیسی علیہم الصلوات والتسلیمات کہ اورا اظھار بر بعضے از غیوب خاصۂ خود می فرماید تا آں غیوب را مکلفین برسا ند الج-
অর্থাৎ আল্লাহর পছন্দনীয় রাসূল ব্যতিত কারো নিকট সেই খাস গায়েব প্রকাশ করেন না। যাদের কাছে প্রকাশ করেন, তারা হচ্ছেন রাসূল, সেই রাসূল হয়তো জিনসে মালাক বা ফেরেশতা জাতীয়, যেমন হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অথবা জিনসে বশর বা মানব জাতীয় যেমন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হযরত মুসা ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালাম তাঁদের নিকট আল্লাহ কতক খাস গায়েব সম্পর্কে অবহিত করান।
উপরোক্ত এবারত দ্বারা প্রমাণিত হলো আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর হাবিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিনসে বাশার ও মানব জাতীয়। হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর ও বশর উভয়েই।পরকালে তাঁর নূরানীয়তের প্রাধান্য সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। বাশারিয়াতের অস্তিত্বের প্রাধান্য থাকবে না। শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত এর নিম্নে এবারত তা প্রমাণ করে।
(খ)
তাফসিরে আজিজি ফার্সি (২৭১ পৃষ্ঠা আম পারা) وللاخرة خير لك من الاولى এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত উল্লেখ করেন-
یعنی والبتہ ہر حالت آخر بہتر باشد ترا از معاملت اول تا آنکہ بشریت ترا اصلا وجود نماند وغلبۂ نور حق برتو علی سبیل الدوام-
অর্থাৎ আপনার জন্য ইহকাল থেকে পরকাল উত্তম। যেন আপনার বাশারিয়াত বা মনবত্বের অস্তিত্ব পরকালে থাকবে না। সর্বদা নূরানীয়তের প্রাধান্য আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন-
آنحضرت بتمام از فرق تا قدم ہمہ نور بود کہ دیدۂ حیرت در جمال باکمال وی خیرہ میشد مثل ماہ وآفتاب تابان وروشن بود واگر نہ نقاب بشریت پوشیدہ بودی ہیچکس را مجال نظر وادراک حسن او ممکن نبودی وہمیشہ جوہروی نوری بود کہ انتقال کرد از اصلاب آباوا رحام امھات اززمن آدم تا انتقال بصلب عبد اللہ ورحم آمنہ سلام اللہ عليهم اجمعين- مدارج النبوة فارسى ص ۱/۱۳۷ اردو ص ۱/۲۱۳
ভাবার্থ: আমাদের নবী সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপদমস্তক ছিলেন নূর। তাঁর নূর বা সৌন্দর্য প্রভায় দৃষ্টিশক্তি উল্টা যেন ফিরে আসত। তিনি যদি মানবীয় পোশাক পরিধান না করতেন, তবে কারো জন্য তাঁর সৌন্দর্য প্রভা উপলব্ধি করা সম্ভব হত না। তাঁর جوهر نورى ‘জাওহারে নূরী’ বা নূরানী জাওহার হযরত আদম আলাইহিস সালাম হতে শুরু করে হযরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত পবিত্র ঔরসে ও পবিত্র রেহেমে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসছিল।
چنانچہ فرمودوی سبحانب ( ما زاغ البصر وما طغی) چنانچہ بندگان خاص در حضرت ملوک میکنند واین کمال ست کہ جز اکمل بشر وسید رسل را صلوات اللہ وسلامہ میسر نیست ( مدارج النبوة فارسى ۱/ص ۲٠٤)
ভাবার্থ: আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন ما زاع البصر وما طفى যেরূপভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিগণ বাদশাহ এর দরবারে উপস্থিত হয়ে থাকেন। ইহা এমন পূর্ণত্ব যা পূর্ণত্ব মানব اكمل بشر মহামানব ও সকল রাসূলের সরদার আলাইহিস সালাম ব্যতিত আর কেউই লাভ করতে পারেনি।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতের ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ এর উপরোক্ত দু’টি এবারত থেকে স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হল তার তাহকিক মতে আল্লাহর হাবিব আপাদমস্তক নূর এবং তিনি আকমলে বশর বা পরিপূর্ণ মানব (মহামানব)।
উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষায় জাত বা জাতি শব্দটি বংশ, গোত্র ও সম্প্রদায় ইত্যাদি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে আরবি ذات জাত শব্দটি সত্বা বা অস্তিত্ব বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এর সাথে নিসবত বা সম্পর্কিত বুঝানোর ক্ষেত্রে ذاتى (জাতি) শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
সহজ কথায় جنس بشر বা ‘মানব জাতি’ বলতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর আওলাদ বা বংধরগণকে বুঝানো হয়ে থাকে। যেহেতু রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন انا سيد ولد ادم অর্থাৎ আমি আদম সন্তানের সরদার। (মুসলিম শরীফ ২/২৪৫ পৃষ্ঠা) এ হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
আরো প্রমাণিত হলো রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যিক আদম আলাইহিস সালামের সন্তান হিসেবে মানব কিন্তু তিনি হচ্ছেন বনী আদমের সরদার। এজন্য তিনি বেনজির ও বেমিসাল বশর বা মানব। নূরানী মানুষ যার কোন তুলনা সৃষ্টির মধ্যে নেই।
তাফসিরে রুহুল বয়ানে রয়েছে-
(لقد جاء كم من انفسكم) (من انفسكم) اى من جنسكم ادمى مثلكم لا من الملائكة ولا من غيرهم- (تفسير روح البيان ص ۳/۵٤۲)
ভাবার্থ: নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্যে থেকে একজন সম্মানিত রাসূল আগমন করেছেন। এখানে من انفسكم (তোমাদের মধ্য থেকে) এর তাফসির হচ্ছে اى من جنسكم অর্থাৎ তোমাদের স্বজাত থেকে। বাহ্যত তোমাদের ন্যায় মানব, তিনি ফিরিশতা জাতিও নন। মানব ছাড়া অন্য কোন জাতিও নন।
(قل انما انا بشر مثلكم) قل يا محمد ما انا الا ادمى مثلكم فى الصورة ومساويكم فى بعض البشرية (يوحى الى) من ربى (انما الهمكم اله واحد) ما هو الا متفرد فى الا لوهية لا تظيرله فى ذاته ولا شريك له فى صفاته يعنى انا معترف ببشريتى ولكن الله من على من بينكم بالنبوة والرسالة- (تفسير روح البيان ص ۵/۳٠৯)
(হে হাবিব! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমি তোমাদের ন্যায় মানব।) হে মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন, আমি মানব ছাড়া অন্য কিছুই নই। সুরত বা আকৃতিগত দিক থেকে তোমাদের ন্যায় এবং মানবীয় কতিপয় গুণ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তোমাদের সাথে আমার মিল রয়েছে। আমার প্রতি ওহি আসে আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে (নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ বা মা’বুদ এক অভিন্ন) উলুহিয়ত বা উপাস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক ও অভিন্ন। তার জাত বা স্বত্ত্বার কোন মিসাল বা উপমা নেই। তাঁর গুণাবলী থেকেও কোন অংশিদার নেই। আমি মানব জাতি তার স্বীকৃতি আমি দিচ্ছি কিন্তু আল্লাহতা’য়ালা তোমাদের মধ্যে আমাকে নবুয়ত ও রিসালাত দিয়ে বড়ই অনুগ্রহ করেছেন।
‘তাফসিরে রুহুল’ বয়ান নামক কতিাবের প্রথম জিলদের ৩৯৫ পৃষ্ঠায় والذين اوتوا العلم درجات (১৫পারা সূরা বনি ইসরাঈল) আয়াতের ব্যাখ্যা রয়েছে, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত উল্লেখ করেন-
فانه صلى الله عليه وسلم ما بقى مكان ولا فى الامكان لانه كان فانيا عن ظلمة وجوده باقيا بنور وجوده لهذا سماه الله نورا فى قوله تعالى قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين فالنور هو محمد عليه السلام والكتاب هو القران-
অর্থাৎ ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মে’রাজের রজনীতে) কোন স্থানে বা সৃষ্টিজগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার অতিক্রম করে তাঁর নূরের অস্তিত্বে বিদ্যমান থাকলেন। এ কারণেই কোরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা তাঁকে নূর বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন- قد جاء كم من الله نور وكتاب مبين (নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান নূর ও একটি সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে)
অতএব উক্ত আয়াতে কারীমায় নূর দ্বারা মুরাদ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং কিতাব দ্বারা মুরাদ হচ্ছে কোরআনুল করিম।’
উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো মেরাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত ফানা হয়ে নূরের ওজুদ বিদ্যমান ছিল।
হুজুরকে আমাদের মতো মানুষ বলা কুফুরি।কেননা হুজুর হচ্ছেন সৃষ্টিতে নূর আপাদমস্তক নূর তাঁর ছায়া ছিল না। কিন্তু তিনি জাতিতে মানুষ।
একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ আল্লামা মুল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০১৪ হিজরি) তদীয়- المورد الروى فى المولد النبوى ‘আল মাওরিদুর রাউয়ী ফি মাওলিদিন নববী’ নামক কিতাবের ৫৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
الحاصل ان مجئ الرسول نعمة جسيمة- وكونه من جنس البشر منحة عظيمة وقال بعضهم قوله من انفسكم اى جنس العرب- وهو لا ينافى ما سبق-
সারকথা নিশ্চয় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন এক মহান নিয়ামত বা বড় অনুগ্রহ। অথচ তিনি হচ্ছেন جنس البشر বা জাতিতে মানব। অনেকেই বলেন- আল্লাহর বাণী- من انفسكم এর তাফসির جنس العرب আরব দেশীয়। ইতোপূর্বে যা আলোচনা হয়েছিল ইহা এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ جنس البشر ও جنس العرب উভয় তাফসিরে কোন বৈপিরিত্ব নেই।
মিশকাত শরীফ ৫২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخصف نعله ويخيط ثوبه ويعمل فى بيته كما يعمل احدكم فى بيته وقالت كان بشرا من البشر يغلى ثوبه ويحلب شاته ويخدم نفسه- رواه الترمذى-
ভাবার্থ: হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জুতা মোবারকের ফিতা লাগাতেন, নিজের কাপড় সেলাই করতেন, নিজ গৃহের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন। যেমন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ করে থাক। তিনি আরো বলেন- তিনি মানুষ জাতীর মধ্য থেকে একজন মহামানব ছিলেন। নিজ কাপড় পরিচ্ছন্ন রাখতেন, নিজ হাতে দুধ দোহন করতেন, নিজে নিজের কাজ আঞ্জাম দিতেন। (তিরমিজি)