কুরআন - হাদীসের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)
(আল্ হাশেমীয়া সোসাইটি কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়া)
প্রশ্ন: কুরআন মজীদ ও হাদীস্ শরীফের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বৈধতার প্রমাণ পেশ করুন।
জবাব: ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করার আগে আমরা ’মীলাদ’ শব্দটির আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ ব্যাখ্যা করতে চাই।
‘মীলাদ’ শব্দটির মূল ‘বেলাদত’, যার অর্থ হলো জন্ম। অতএব, আরবী ভাষায় ’মীলাদ’ শব্দটি জন্মের স্থান ও সময়কে বোঝায়। শরীয়তের আলোকে আমরা মীলাদ বলতে বুঝি সেই সব ঘটনা যা নবী করীম (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের সময় ঘটেছিল; আর এতে আমরা তাঁর সকল বিষয় বর্ণনা করার সুযোগ পেয়ে থাকি; তাঁর প্রতি দুরূদ-সালাম পেশ করার সুযোগও পেয়ে থাকি। মানুষের কাছে মহানবী (দ:)-এর অনন্য ও অনুপম গুণাবলী এবং প্রশংসা বর্ণনা করার সুযোগ আমরা মীলাদের মজলিসে পাই। মীলাদুন্নবী (দ:) হলো ধর্ম প্রচারের একটি বড় ধরনের উৎস। এই পবিত্র শুভক্ষণে আলেম সমাজের জন্যে মহানবী (দ:)-এর জীবন, আদর্শ, নৈতিকতা, ঐতিহ্য, ধর্ম বিষয়াদি প্রচার করা অবশ্য কর্তব্য।
আমরা এবার কুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ ও উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রমাণ পেশ করছি।
কুরআন মজীদ
কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মীলাদ উদযাপনের বৈধতাই শুধু প্রমাণ করে না, এগুলো এর মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়) হবার প্রমাণও বহন করে।
(১) আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-
“এবং শান্তি তাঁরই ওপর যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্ত) হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন” (সুরা মরঈয়ম, ১৫ আয়াত)। উপরোক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ:)-এর সম্পূর্ণ মীলাদ বর্ণনা করেছেন। আর এর আগে আল্লাহ্ পাক তাঁর বেলাদতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলীও বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই সুন্নী মুসলমানবৃন্দ সর্বশেষ নবী (দ:)-এর মীলাদ উদযাপন করাকে বৈধ জেনেছেন। আরেক কথায়, পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা (আ:)সহ অন্যান্যদের দ্বারা নিজ মীলাদ উদযাপনের বিশুদ্ধ বর্ণনা আমরা পেয়েছি।
(২) আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ:)-এর কথা উদ্বৃত করেন-
”এবং ওই শান্তি আমার প্রতি, যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, এবং যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আর যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো” (সুরা মরঈয়ম, ৩৩ আয়াত)।
এ আয়াতে করীমার আগে আল্লাহ্ তা’লা মরিয়াম (আ:)-এর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন; তাঁর গর্ভে হযরত ঈসা নবী (আ:)-এর জন্মের কথাও আল্লাহ্ তা’লা জানিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ:)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যা দ্বারা ঈসা (আ:) নিজের প্রশংসা করেছেন। এই বর্ণনা শৈলী হযরত ঈসা (আ:)-এর মীলাদ উদযাপন ছাড়া আর কিছু নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা সুন্নী মুসলাম সমাজও এই একই বর্ণনা শৈলী দ্বারা মহানবী (দ:)-এর মীলাদ উদযাপন করে থাকেন। হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:)-এর ক্ষেত্রে যেভাবে আল্লাহ্ তা’লা তাঁদের মীলাদের বর্ণনা দিয়েছেন, আমরাও একই ভঙ্গিতে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকি। অতএব, বিবেকবান সবাই এ ব্যাপারে স্বীকার করবেন যে মীলাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আল্লাহ্ তা’লারই রীতি। তাই এটা প্রমাণিত যে মীলাদের ভিত্তি কুরআন মজীদেই বিদ্যমান।
(৩) আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
”তাদেরকে (মানুষদেরকে) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন” (সুরা ইব্রাহীম, ৫ নং আয়াত)।
এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী হযরত মূসা (আ:)-এর প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছেন যেন তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। “আল্লাহর দিনগুলো” হলো সে সব দিন যা’তে বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল বা এমন সব দিন যেগুলোতে আল্লাহ্ পাক তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি তাঁরই বড় নেয়ামত তথা আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন। ‘আল্লাহর দিনগুলোর’ উপরোক্ত ব্যাখ্যার পক্ষে কুরআন মজীদ সাক্ষ্য দেয়, যেখানে হযরত মূসা (আ:)-কে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “আর যখন মূসা (আ:) আপন সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, স্মরণ করো তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ফিরআউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিতো এবং তোমাদের পুত্রদের যবেহ্ করতো ও তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের মহা অনুগ্রহ রয়েছে” (সুরা ইব্রাহীম, ৩ নং আয়াত)।
আল্লাহ্ তা’লার উপরোল্লিখিত আয়াতের সারমর্ম অনুযায়ী, হযরত মূসা (আ:)-এর জাতি যেদিন ফিরআউন হতে মুক্তি লাভ করে সেদিনটি “আল্লাহর দিন” হিসেবে পরিগণিত হয়েছে; অতএব মহানবী (দ:) যেদিন এ ধরাধামে শুভাগমন করেন, সেদিনও “আল্লাহর দিন” হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, মহানবী (দ:) অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সারা বিশ্ব-জগতকে মুক্ত করে হেদায়াত তথা সঠিক পথের আলোতে নিয়ে এসেছেন। তাই অন্যান্য ঘটনার দিন উদযাপনের চেয়ে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস উদযাপন অগ্রাধিকার পাবে। অন্যথায় আল্লাহ্ তা’লার রহমত (করুণা) ও আশীর্বাদ অর্থাৎ বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি শোকরিয়া আদায় করা হবে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে মহা শাস্তি দেবেন যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান-
”এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের প্রতিপালক শুনিয়ে দিলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আরও অধিক দেবো, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর (সুরা ইব্রাহীম, ৭ নং আয়াত)।
(৪) মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেন-
”সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না” (সুরা আ’রাফ, ৭৮ আয়াত)।
উপরোক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাঁর রহমত ও আশীর্বাদগুলো স্মরণ করার হুকুম দিয়েছেন। শেষ নবী (দ:) হলেন নিঃসন্দেহে সারা মানবকুলের জন্যে আল্লাহ্ তা’লার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একথা অন্যত্র জানিয়েছেন: ”নিশ্চেয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের ওপর যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল (সুরা আলে ইমরান, ১৬৪ নং আয়াত)।
অতএব, কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’লার হুকুম অনুযায়ী আমাদের প্রিয় নবী (দ:)-কে স্মরণ করতে হবে; আর মীলাদুন্নবী (দ:) হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (দ:)-কে স্মরণ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। অন্যত্র আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান-
”এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের বেশি বেশি আলোচনা তথা প্রচার প্রসার করুন (সুরা দোহা, ১১ আয়াত)।
রাসুলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা:) ‘নেয়ামত’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেন, “আয়াতোল্লিখিত ‘নেয়ামত’ শব্দটি দ্বারা নবুয়্যত ও দ্বীন ইসলামকে বোঝানো হয়েছে” (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, সুরা দোহা, ৬৫১ পৃষ্ঠা)।
অতএব, মহানবী (দ:)-এর চাচাতো ভাইয়ের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে মহা পরাক্রমশালী খোদা তা’লা আমাদেরকে আদেশ করেছেন এ মর্মে যেন আমরা তাঁরই প্রিয়নবীকে (দ:) আমাদের সমাজে, মসজিদে এবং পারিবারিক পরিমন্ডলে স্মরণ করি; আর এ ক্ষেত্রে কুরআনী উদ্দেশ্য পূরণে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পন্থা আর কী হতে পারে!
(৫) মহান আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রতি আদেশ করেন-
”আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া, এবং সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিৎ। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলতের চেয়েও শ্রেয় (সুরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)।
এ আয়াতে কারীমায় আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রতি আদেশ করেছেন যেন আমরা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা প্রাপ্তিতে খুশি প্রকাশ করি। আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে আল্লাহ্ তা’লার প্রতিটি নেয়ামত আমাদের জন্যে তাঁরই অসীম দয়াস্বরূপ বিরাজমান। এমনকি আমাদের অস্তিত্বও তাঁরই দয়ার বহিঃপ্রকাশমাত্র। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হলেন আমাদের মহানবী (দ:)। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক ফরমান-
”হে রাসূল (দ:)! আপনাকে আমি প্রেরণ করেছি জগতসমূহের জন্যে আমার রহমত করে (সুরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)।
সুতরাং কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী, মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবসে খুশি প্রকাশ ও শোকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করা আমাদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মহানবী (দ:)-এর প্রতি খুশি থাকে, সে সত্যি কুরআন মজীদের একজন খাঁটি অনুসারী। আর এটা নিশ্চিত যে, সারা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায় মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন; এবং তা বিশেষ করে এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা’লার অনুপম করুণা হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-এর প্রতি শোকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যেই মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন। অতএব, পবিত্র কুরআন মজীদ মীলাদুন্নবী (দ:)-কে সমর্থন করে বলে প্রমাণিত হলো।
(৬) মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সমাবেশ (জুলুস, মাহফিল ইত্যাদি) মুসলমানদেরকে বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি দুরূদ-সালাম পাঠে অনুপ্রাণিত করে যা আল্লাহর আদেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; এরশাদ হয়েছে-
”নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দুরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)-এর প্রতি। হে ঈমানদার মুসলমান সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো” (সুরা আহযাব, ৫৬ আয়াত)।
শরীয়ত অনুযায়ী, শরীয়তে কোনো কিছু কাম্য হলে তা মূলত শরীয়তের একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়। আর দুরূদ শরীফের ফযীলত সংখ্যায় এতো বেশি যে তা গুণে শেষ করা যাবে না। দুরূদ ও সালাম আল্লাহ্ তা’লার সাহায্যপ্রাপ্তিতে কারণস্বরূপ। দুনিয়া ও আখেরাতে তাই মীলাদুন্নবী (দ:) আল্লাহ্ তা’লার আজ্ঞা পালনের একটি উৎস, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
(৭) আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান- “এবং সব কিছু আমি আপনাকে রাসূলগণের সংবাদই শুনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করবো” (সুরা হুদ, ১২০ আয়াত)।
এ আয়াতে করীমায় প্রতিভাত হয় যে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী বর্ণনা করার মধ্যে হেকমত হলো, এতে করে মহানবী (দ:)-এর হৃদয় মোবারককে সুদৃঢ় করা হয়েছে। আর এটা নিশ্চিত, বর্তমানকালে আমাদের অন্তরের দৃঢ়তারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমাদের জানতে হবে কেমন করে মহানবী (দ:) তাঁর সময়কার সমস্যাবলী মোকাবেলা করেছিলেন, যাতে করে আমরাও সুন্নাহ্ অনুসারে আমাদের সময়কার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পারি। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:) হুজুর পূর নূর (দ:)-এর ঘটনাবলী সম্পর্কে জানবার একটি সুযোগ আমাদের করে দেয়।
হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণ
মহানবী (দ:) থেকে অনেকগুলো বর্ণনা আমরা পাই, যা’তে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রমাণ মেলে। আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃত করছি:
(১) নবী করীম (দ:) নিজেই সর্বপ্রথমে তাঁর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) শরীফ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান- “আমি পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভে প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়েছি। আমার বেলাদত হয়েছে বৈধ বিবাহের ফলে, অবৈধ যৌনাচার থেকে নয়। আল্লাহ্ পাক যখন (হযরত) আদম (আ:)-কে পৃথিবীতে পাঠালেন, তখন তিনি আমাকে আদম (দ:)-এর মেরুদন্ডে স্থাপন করেন; আর সেখান থেকে নূহ (আ:)-এর কাছে তাঁর নৌকায় স্থানান্তরিত হলাম; অতঃপর সেখান থেকে (হযরত) ইব্রাহীম (আ:) এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভ হয়ে আমার পবিত্র পিতা-মাতার ঔরসে স্থানান্তরিত হই, যাঁরা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেন নি’ (তাফসীরে রূহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা)।
আমরা প্রথমেই বলেছি মীলাদ অর্থ জন্মের সময় কিংবা স্থান। অতএব, মহানবী (দ:) স্বয়ং তাঁর মীলাদ উদযাপন করেছেন। এই রীতি অনুসরণ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’ত (সুন্নী মুসলমান সমাজ) বিশ্বনবী (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকেন। এ হাদীসটি মীলাদুন্নবী (দ:)-এর একটি সুস্পষ্ট দলিল এবং এটি আমাদের নিশ্চিত করে যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন কোনো বেদআত (মন্দ উদ্ভাবিত রীতি) নয়, বরং সুন্নতে নব্বী (দ:)। মহানবী (দ:) স্বয়ং মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেছেন। এমন অনেক রওয়ায়াত আছে যার কিছু কিছু মেশকাত শরীফ নামের হাদীস্ প্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
(২) যে ব্যক্তি মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস উদযাপন করেন তাঁকে চরম শাস্তি দেয়া হবে না; এবং এটা আশা করা হয়, যে মুসলমান ব্যক্তি মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেছেন তাঁকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে না। কেননা ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণনা করেছেন যে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের সুখবর দাসী সোয়াইবিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরে খুশি হয়ে আবু লাহাব আঙ্গুলের ইশারায় ওই দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিল, যার কারণে প্রতি সোমবার (হুজুর পাকের বেলাদত দিবস) জাহান্নামে তার শাস্তি লাঘব হয় এবং তার ওই আঙ্গুল থেকে পানি প্রবাহিত হয়, আর তা সে পান করে। মীলাদুন্নবী (দ:)-এর উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করায় সে এই পুরস্কার পেয়েছে (সহীহ্ বোখারী, ২য় খন্ড, ৭৬৪ পৃষ্ঠা)।
ইমাম শামসউদ্দীন নাসের আল্ দামেশ্কী এ হাদীসটি তাঁর কবিতায় বর্ণনা করেছেন। নিচে এর অনুবাদ দেয়া হলো:
যদি সেই কাফের যাকে (কুরআনে) অভিসম্পাত দেয়া হয়েছে, আর তার হাতগুলো ধ্বংস হয়েছে, আগুনে স্থায়ী আবাস হয়েছে; বর্ণিত আছে, আহমদ (দ:)-এর বেলাদতের খুশিতে প্রতি সোমবার তার শাস্তি লাঘব হয়; তবে সেই গোলাম কী আশা করতে পারেন, যিনি সারা জীবন আহমদ (দ:)-এর বেলাদতে খুশি হয়েছেন, আর আল্লাহ্ তা’লার একত্বে বিশ্বাস করে ইন্তেকাল করেছেন (হাওলুল আহতিফাল বিল্ মত্তলিদিন্ নব্বী আল্ শরীফ, ১১ পৃষ্ঠা)।
(২) প্রিয়নবী (দ:) নিজেই তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপন করেছেন রোযা রেখে। সহীহ্ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম (দ:)-কে সোমবার দিন তাঁর রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি উত্তর দেন-
”এ দিন (সোমবার) আমার বেলাদত (পৃথিবীতে শুভাগমন) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে (মেশকাত শরীফ, ১৭৯ পৃষ্ঠা)।
এই রওয়ায়াত (বর্ণনা) প্রমাণ করে যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করা মহানবী (দ:)-এর সুন্নাত। দ্বিতীয়তঃ মীলাদুন্নবী (দ:)-এর খুশিতে এবাদত করা সুন্নাহ্ সম্মত একটি আমল।
মুসলিম উম্মাহ্ ও উলামাবৃন্দের ঐকমত্য
(১) ইমাম হাফেয আল্ সৈয়ুতী (রহ:) তাঁর প্রসিদ্ধ “আল হাওউইয়ী লিল্ ফাতাওউইয়ী” গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি বিশেষ অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন যার শিরোনাম হলো “মওলিদ উদযাপন উদ্দেশ্যের শ্রেষ্ঠত্ব।” এ অধ্যায়ে তিনি লিখেন: “বিবেচনাধীন প্রশ্নটি হলো এই যে, রবিউল আউয়াল মাসে মহানবী (দ:)-এর পবিত্র বেলাদত দিবস উদযাপনের ব্যাপারে শরীয়তের রায় কী? শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি কি একটি প্রশংসনীয় কাজ, না দূষণীয় কাজ? আর যারা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তাঁরা কি আশীর্বাদ লাভ করেন, না কি করেন না”?
ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) অতঃপর লিখেন: “এ প্রশ্নের উত্তরে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মীলাদ শরীফ এমনই একটি খুশির অনুষ্ঠান যেখানে মানুষেরা সমবেত হন এবং কুরআন মজীদ সহজভাবে তেলাওয়াত করা হয়। অতঃপর নবী করীম (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমন বিষয়ক বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী যা হাদীস্ সমূহে ও বিভিন্ন লেখনীতে বিধৃত হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়; আর তাঁর বেলাদতের সময় যে সব অলৌকিক ঘটনা ও আলামত দেখা গিয়েছিল তাও বর্ণনা করা হয়। এরপর অনুষ্ঠানে আগত মানুষদের সামনে খাবার পরিবেশিত হয় এবং তাঁরা তা নিজ সন্তুষ্টি অনুযায়ী গ্রহণ করেন। মহাবনী (দ:)-এর বেলাদত দিবস পালনের এই উৎসব হলো বেদআতে হাসানা (উত্তম উদ্ভাবন), আর যারা এর আয়োজন করেন তাঁরা সওয়াব (আশীর্বাদ) পাবেন। কেননা, এ ধরনের উদযাপনের মধ্যে নিহিত রয়েছে মহানবী (দ:)-এর সুউচ্চ শান-মানের প্রতি এবং তাঁর বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।”
এমন কি (বিভ্রান্তদের গুরু) ইবনে তাইমিয়াও তার “সঠিক পথের প্রয়োজনীয়তা” শীর্ষক পুস্তকের ২৬৬ পৃষ্ঠায় (নিচের দিকের ৫ম লাইনে) লিখেছে: “খৃষ্টানদের যীশু খৃষ্টের জন্মদিন পালনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাস্বরূপ হোক কিংবা মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শনস্বরূপই হোক, মুসলমান সমাজ মীলাদ অনুষ্ঠানে যা আমল করেন তাঁদের এই ধরনের ইজতেহাদের জন্যে আল্লাহ্ পাক অবশ্যই তাঁদেরকে পুরস্কৃত করবেন।” ইবনে তাইমিয়া অতঃপর লিখেছে: “মীলাদ যদিও বা সালাফ (পূর্ববর্তী যমানার পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ) কর্তৃক অনুশীলিত হয় নি, তথাপি তাঁদের তা অনুশীলন করা উচিৎ ছিল। কেননা, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ছিল না।”
আর আমরা তো মীলাদ উদযাপন করি বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যেই।
(২) সহীহ্ বুখারী শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা) লেখক ইমাম হাফেয আল্ কস্তলানী (রহ:) বলেন: “আল্লাহ্ তা’লা এমন ব্যক্তির প্রতি তাঁর রহমত বর্ষণ করুন, যিনি মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের মাস রবিউল আউয়ালের দিনগুলোকে খুশি প্রকাশ ও উদযাপনের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন; কেননা এতে পীড়িত ব্যক্তির অন্তরের জন্যে সর্বোত্তম নিরাময় নিহিত রয়েছে।”
(৩) মীলাদ শরীফ সম্পর্কে ইমাম সৈয়ুতী (রহ:)-কে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হাফেয ইবনে হাজর (রহ:)-কেও করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন: “আল্লাহ্ তা’লার করুণা অবতীর্ণ হয়েছে কিংবা কোনো দুর্যোগ তিনি দূর করে দিয়েছেন এমন দিবসকে স্মরণ করার জন্যে কোনো নেক কাজ করা এবং তা প্রতি বছর উদযাপন করা হলো আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি পন্থামাত্র। মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিভিন্ন এবাদতের মাধ্যমে করা যায়- যেমন, সেজদা ও নামাযে দাঁড়ানো, দান সদকা ও কুরআন তেলাওয়াত। আর এই দিনে (১২ই রবিউল আউয়াল) দয়ার নবী (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমনের চেয়ে আল্লাহ্ তা’লার বড় নেয়ামত আর কী হতে পারে?”
কেউ কেউ শুধু ১২ই রবিউল আউয়ালে মীলাদুন্নবী উদযাপনকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং ওই মাসের পুরোটুকুই মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন। আর কেউ কেউ সারা বছরের যে কোনো দিন তা পালনে ব্রত হয়েছেন। তাঁদের মতে এটি বছরের যে কোনো সময় উদযাপন করা যায়। কেননা এর উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ, মহানবী (দ:) এর বেলাদতে খুশি প্রকাশ ও তা উদযাপন করা।
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
(আল্ হাশেমীয়া সোসাইটির ফতোয়া Questions regarding Meeladun-Nabi sallallaahu alaiyhi wa sallam - www.oocities.org/~abdulwahid/muslimarticles/milad_question.html ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)
মীলাদুন্নবী (দ:) - সকল ঈদের সেরা
মূল: অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ মাসূদ আহমদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
মহান আল্লাহ্ পাক সর্বপ্রথম মহানবী (দ:)-এর নূর (আলো) সৃষ্টি করেন (মাদারিজুন নুবুয়্যত, ১ম খন্ড, ২য় পৃষ্ঠা)। অতঃপর তিনি তাঁকে নুবুয়্যত দান করেন (আশয়াতুল লোমআত, ৪৭৪ পৃষ্ঠা)। এভাবেই দুরূদ শরীফের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। এরপর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয় যারা দুরূদ ও সালামে অংশগ্রহণ করেন (সুরা মায়েদাহ্, ১৫ নং আয়াত)। ওই নূর (হুজুর পাক) যখন এ ধরাধামে আবির্ভূত হলেন, তখন মানব জাতিও দুরূদ সালামের প্রক্রিয়ায় শরীক হলো (সূরা আহযাব, ৫৬-৫৭ আয়াতসমূহ)। আমরা এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি গভীর চিন্তা করি তবে আমরা উপলব্ধি করবো যে এটিও এই খুশির ঈদের ঘোষণা ও তা প্রতিষ্ঠার একটি শৈলীগত আকার ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহু আকবর!
সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বিশ্বনবী (দ:)-এর যিকর (স্মরণ) অব্যাহত রয়েছে এবং এ উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি অশেষ মহব্বত ও দয়া প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁদের চিহ্ন ও আলামত (স্মৃতিচিহ্ন)-কে নিজ নিদর্শন বলে সম্ভোধন করেছেন (সূরা বাকারাহ,৫৮ আয়াত) এবং এ মর্মে আদেশ করেছেন যেন তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মোন (তা’যিম) প্রদর্শন করা হয়। তাঁদের স্মৃতিবহ দিনগুলোকে তিনি তাঁর নিজের দিন (তাফসীরে খাযেন ও তাফসীরে মদারেক) বলে ঘোষণা দিয়েছেন:
“তাদেরকে (মানুষকে) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন” (সূরা ইব্রাহীম, ৫ নং আয়াত)। মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবস হলো আল্লাহ্ তা’লার উক্ত দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য কুরআন মজীদ থেকেই নিরূপণ করা যায়। হযরত ইয়াহইয়া (আ:)-এর প্রসঙ্গে এতে ঘোষিত হয়েছে:
“এবং শান্তি তাঁরই ওপর যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসাল (খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন” (সূরা মরঈয়ম, ১৫ নং আয়াত)।
মহানবী (দ:) এ ধরাধামে শুভাগমন করেন সোমবার দিন। এর শোকরিয়া আদায় তথা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে তিনি সোমবার রোযা রাখতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন,
অর্থাৎ, “এ দিন (সোমবার) আমার বেলাদত (পৃথিবীতে শুভাগমন) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে” (সহীহ্ মুসলিম, উসদুল গাবাহ্ ইবনে আসির, ১ম খন্ড, ২১-২২ পৃষ্ঠা)। কিছু কিছু বর্ণনা মতে হুজুর পূর নূর (দ:)-এর বেলাদতের তারিখ ৫৬৯ খৃষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল; যার ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় চার হাজার বছর আগের শাস্ত্রলিপিতে পাওয়া যায় (ভগবত পুরাণ, এস্কান্দ-১২, ২য় অধ্যায়, অশ্লোক নং ১৮)। তাই ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার মহানবী (দ:)-এর সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং এই সম্পর্কই এমন একটি মাধ্যম যা আধ্যাত্মিক উন্নতির চাবিকাঠি।
বিশ্বনবী (দ:)-কে প্রেরণ করে আল্লাহ্ পাক মুসলমানদের প্রতি অসীম, করুণা ও দয়া প্রদর্শন করেছেন (সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত)। করুণা ও দয়া নসীব করা হয় এ উদ্দেশ্যে যাতে তা স্মরণ রাখা হয় ও কখনো ভুলে না যাওয়া হয়। উপরন্তু, আল্লাহ্ তা’লা এই করুণা ও নেয়ামত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপনের জন্যে আমাদের প্রতি আদেশ করেছেন (সূরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)।
হযরত ঈসা (আ:) এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, “হে প্রতিপালক, আমার প্রতি আসমান থেকে একটা ‘খাদ্য-খাঞ্চা’ অবতারণ করুন যা আমাদের জন্যে ঈদ উৎসব হবে- আমাদের পূর্ববর্তি ও পরবর্তী সকলের জন্যেই” (সূরা মায়েদা, ১১৪ আয়াত)। এ আয়াতটির ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করুন: ‘খাদ্য-খাঞ্চা’র অবতরণকে কেন্দ্র করে হযরত ঈসা (আ:) যদি ঈদের দিন পালন করতে পারেন, তাহলে যেদিন আল্লাহ্ তা’লা তাঁর সমস্ত রহমতের আধার ও কেন্দ্রবিন্দু মহানবী (দ:)-কে এ ভুবনে আশীর্বাদস্বরূপ প্রেরণ করলেন, সেই দিনটি আমাদের ঈদ হিসেবে উদযাপন করা উচিৎ নয় কি? যে লাইলাতুল কদরের রাতে কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হয়েছিল তা হাজার মাসে রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা কদর, ৩ নং আয়াত); তাহলে সেই রাতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ভাবুন যখন জীবন্ত বা মূর্তমান কুরআন (মহানবী) আবির্ভূত হয়েছিলেন! লাইলাতুল কদর বাৎসরিকভাবে উদযাপিত হতে পারলে সৃষ্টিকুল শিরোমণি হুজুর পূর নূর (দ:)-এর বেলাদতের রাত ও দিবস কেন প্রতি বছর উদযাপন করা যাবে না?
আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেন-
“এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের বেশি বেশি আলোচনা তথা প্রচার প্রসার করুন” (সূরা দোহা, ১১ আয়াত)। ইমাম বুখারী (রহ) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) হলেন আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, ৫৬৬ পৃষ্ঠা); অতএব, তিনিই এই প্রচার-প্রসারের ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবেন। মিম্বর থেকে তিনি নিজেই তাঁর বেলাদত তথা মীলাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন (জামেউ তিরমিযী, ২য় খন্ড, ২০১ পৃষ্ঠা)। তাঁর নির্দেশক্রমে কতিপয় সাহাবী তাঁর অতুলনীয় ও অনুপম গুণাবলী ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছিলেন ও প্রচার করেছিলেন (যুরকানী মালেকী, ১ম খন্ড, ২৭ পৃষ্ঠা)। হিজরী ৯ম সালে তাবুকের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের শুভলগ্নে মহানবী (দ:)-এর শ্রদ্ধেয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:) তাঁর উপস্থিতিতে মীলাদুন্নবী (দ:) বিষয়ক একটি কবিতা পাঠ করে পেশ করেন (মীলাদে মোস্তফা: প্রণেতা ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা ২৯-৩০)। হুজুর পূর নূর (দ:) স্বয়ং একখানা চাদর একটি প্ল্যাটফরমের ওপর বিছিয়ে দিলে হযরত হাস্সান বিন সাবেত (রা:) তাতে দাঁড়িয়ে নবী করিম (দ:)-এর শানে একটি কসীদা (পদ্য) পেশ করেন। এতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে হযরত হাস্সানের (রা:) জন্যে বিশেষভাবে দোয়া করেন। এ সব সত্য ঘটনা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে সংকলিত হয়েছে।
হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) যখনই মহানবী (দ:) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কোনো কথা বলতেন, তখনি তিনি বিশেষ প্রস্তুতি নিতেন (একামতে কেয়ামাহ, পৃষ্ঠা ৪৪) - ঠিক যেমনিভাবে বর্তমানে দেখা যায় বুযূর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে হাক্কানী ধর্মীয় ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানাদি পালনকালে বিশেষ আয়োজন করে থাকেন। প্রতি মাসের ১১ম দিবসে হযরত শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) মহানবী (দ:)-এর নামে উপহার পেশ করতেন এবং এই প্রথা আজো বহাল আছে (কুর্রাতুল নাযির, ১১ পৃষ্ঠা)। ইবনে তাইমিয়াও মীলাদ শরীফ আয়োজনকারী ভক্তদের অশেষ সওসাব ও রহমত প্রাপ্তির খোশ খবরী দিয়েছে (একতেদায়ে সিরাতে মুস্তাকীম)।
মীলাদের মজলিস বা অনুষ্ঠান নতুন কোনো কিছু নয়; এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রবাহমান। এর মূল মহানবী (দ:)-এর সময়ে পাওয়া যায়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহেলভীর পিতা শাহ আব্দুর রহীম প্রতি বছর মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করতেন এবং এ উপলক্ষে গরীবদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেন (আদ্ দুরারুস্ সামীন, পৃষ্ঠা ৮)। শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর পুত্র শাহ্ আব্দুল আযীয মোহাদ্দেসে দেহেলভী উভয়েই প্রতি ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে মীলাদের মজলিশে মানুষদেরকে দাওয়াত করতেন এবং তাঁরা হুজুর পাক (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং খাবার ও মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে মীলাদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন (আদ্ দুররুল মোনাযযম, পৃষ্ঠা ৮৯)। মক্কাতুল মোকাররমাতে একবার শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ একটি মীলাদের মজলিসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান নূর (আলো) ঝর্ণার মতো ওপর থেকে নেমে আসছে (ফুয়ূযুল হারামাইন, পৃষ্ঠা ৮০-৮১)। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর পীর হাজী এমদাদউল্লাহ মুহাজিরে মককী প্রতি বছর মীলাদের আয়োজন করতেন নাজাতের ওসীলা হিসেবে এবং দাঁড়িয়ে (কেয়াম) সালাত-সালাম পড়তেন রাসূলে আকরাম (দ:)-এর প্রতি (ফয়সালায়ে হাফত্ মাসয়ালা, পৃষ্ঠা ১১১)। প্রতি বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে গ্র্যান্ড মুফতী শাহ মোহাম্মদ মাযহার উল্লাহ দেহেলভী জাঁকজমকের সাথে মীলাদ মাহফিল করতেন যা এশার নামাযের পরবর্তী সময়ে আরম্ভ হয়ে ফজর নামাযের আগ পর্যন্ত চলতো। এ সময় দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করা হতো এবং তার পর খাবার ও মিষ্টি বিতরণ করা হতো (তাযকেরায়ে মাযহারে মাসউদ, পৃষ্ঠা ১৭৬-১৭৭)। কতিপয় মনোনীত ফেরেশতা সব সময়ই দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করছেন (সুরা সাফফাত, ১ম আয়াত); এতে বোঝা যায়, এটি ফেরেশতাদের আমল ও আচার। মদীনা মনোওয়ারায় রাসূলে পাক (দ:)-এর বেসালের সময় ফেরেশতা, নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও দলে দলে তাঁর সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন। সাত’শ বছর আগে স্বনামখ্যাত আলেম ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী (রহ:) ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে যুগের ‘হাস্সান’ ইমাম সরসরী (রহ:) মহানবী (দ:)-এর শানে কসীদা পেশ করছিলেন, যার মধ্যে তিনি উপস্থিত সকলকে নবী করীম (দ:)-এর যিকর-এর সময় দাঁড়াবার জন্যে তাকিদ দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় সবাই সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ান (একামতে কেয়ামাহ্)। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে প্রতিভাত হয় যে সালাত ও সালাম পেশ করা হলো পুণ্যবান ফেরেশতাকুল, সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এবং মুসলিম উম্মাহর সমস্ত বুযূর্গানে দ্বীন, উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীর আচরিত রীতি। হযরত শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেসে দেহেলভী (রহ:) সর্বদা দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করতেন এবং একে তাঁর দোয়া ও আমল কবুলের ওসীলা তথা মাধ্যম মনে করতেন (আখবারুল আখইয়ার, পৃষ্ঠা ৬২৪)।
বিশ্বনবী (দ:) এরশাদ করেছেন-
“মু’মিন মুসলমানবৃন্দ যে জিনিসকে ভাল ও কল্যাণময় বিবেচনা করেন তা আল্লাহর কাছেও প্রশংসনীয়” (মোওয়াত্তায়ে ইমাম মোহাম্মদ, পৃষ্ঠা ১০৪)। প্রিয়নবী (দ:) আরও এরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের মধ্যে এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো ভাল রীতি প্রবর্তন করবে, সে শুধু এর সওয়াবই পাবে না, বরং যারা এর ওপর আমল করবে তাদের সওয়াবও সে পেতে থাকবে” (সহীহ্ মুসলিম, ৩য় খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা)। সাওয়াদুল আযম (মেশকাত ১ম খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা) -এর পতাকাতলে অবস্থান নেয়ার জন্যে এ ক্ষেত্রে আদেশও করা হয়েছে; এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাদের দল (মেশকাত, ১ম খন্ড, ৩১ পৃষ্ঠা)। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পবিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করা মহানবীর (দ:), তাঁর পুণ্যবান সাহাবীদের, তাবেয়ীনবৃন্দের ও বুযূর্গানে দ্বীনের আচরিত রীতি; এ যাবত যা আলোচনা করা হয়েছে তাতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
মহব্বত বা প্রেমের একটি সহজাত গুণ হলো প্রেমাস্পদের প্রশংসা শুনলে প্রেমিকের চিত্ত আনন্দে দুলে ওঠে। বরং তাঁর অন্তর এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে সর্বদা তাঁর প্রেমাস্পদের প্রশংসা ও স্মরণ জারি রাখা হবে। কেউ কখনো এমন প্রেমিক দেখবেন না যিনি তাঁর প্রেমাস্পদের স্মরণের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করবেন। এটি প্রেমের প্রকৃতি বিরোধী। সত্য কথা হলো, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর খুশি উদযাপনের প্রকৃত মর্ম নিহিত রয়েছে সদা-সর্বদা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হুজুর পূর নূর (দ:)-এর সুন্নাহর সঠিক প্রতিফলনের মধ্যে। অতঃপর ইসলামের পতাকা উড্ডীনকারী আমাদের পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের রীতির সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করা উচিৎ। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর শিক্ষক শাহ আব্দুল গণী মোহাদ্দেসে দেহেলভী কী সুন্দর বলেছেন- “মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে কোনো ব্যক্তির পূর্ণ পরিতৃপ্তি” (শেফা আল সা’য়েল)।
মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে রসূলপ্রেম নসীব করুন যা আপনাআপনি আমাদেরকে তাঁর সুন্নাহের সাথে ঢেলে সাজাবে এবং অন্যান্যদের কাছে আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রতীয়মান করবে। আমীন!
[Eid of Eids শীর্ষক এ প্রবন্ধটি www.nfie.com/Eoe.html ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত]
(আল্ হাশেমীয়া সোসাইটি কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়া)
প্রশ্ন: কুরআন মজীদ ও হাদীস্ শরীফের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বৈধতার প্রমাণ পেশ করুন।
জবাব: ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করার আগে আমরা ’মীলাদ’ শব্দটির আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ ব্যাখ্যা করতে চাই।
‘মীলাদ’ শব্দটির মূল ‘বেলাদত’, যার অর্থ হলো জন্ম। অতএব, আরবী ভাষায় ’মীলাদ’ শব্দটি জন্মের স্থান ও সময়কে বোঝায়। শরীয়তের আলোকে আমরা মীলাদ বলতে বুঝি সেই সব ঘটনা যা নবী করীম (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের সময় ঘটেছিল; আর এতে আমরা তাঁর সকল বিষয় বর্ণনা করার সুযোগ পেয়ে থাকি; তাঁর প্রতি দুরূদ-সালাম পেশ করার সুযোগও পেয়ে থাকি। মানুষের কাছে মহানবী (দ:)-এর অনন্য ও অনুপম গুণাবলী এবং প্রশংসা বর্ণনা করার সুযোগ আমরা মীলাদের মজলিসে পাই। মীলাদুন্নবী (দ:) হলো ধর্ম প্রচারের একটি বড় ধরনের উৎস। এই পবিত্র শুভক্ষণে আলেম সমাজের জন্যে মহানবী (দ:)-এর জীবন, আদর্শ, নৈতিকতা, ঐতিহ্য, ধর্ম বিষয়াদি প্রচার করা অবশ্য কর্তব্য।
আমরা এবার কুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ ও উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রমাণ পেশ করছি।
কুরআন মজীদ
কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মীলাদ উদযাপনের বৈধতাই শুধু প্রমাণ করে না, এগুলো এর মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়) হবার প্রমাণও বহন করে।
(১) আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান-
“এবং শান্তি তাঁরই ওপর যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্ত) হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন” (সুরা মরঈয়ম, ১৫ আয়াত)। উপরোক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ:)-এর সম্পূর্ণ মীলাদ বর্ণনা করেছেন। আর এর আগে আল্লাহ্ পাক তাঁর বেলাদতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলীও বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই সুন্নী মুসলমানবৃন্দ সর্বশেষ নবী (দ:)-এর মীলাদ উদযাপন করাকে বৈধ জেনেছেন। আরেক কথায়, পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা (আ:)সহ অন্যান্যদের দ্বারা নিজ মীলাদ উদযাপনের বিশুদ্ধ বর্ণনা আমরা পেয়েছি।
(২) আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ:)-এর কথা উদ্বৃত করেন-
”এবং ওই শান্তি আমার প্রতি, যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, এবং যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আর যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো” (সুরা মরঈয়ম, ৩৩ আয়াত)।
এ আয়াতে করীমার আগে আল্লাহ্ তা’লা মরিয়াম (আ:)-এর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন; তাঁর গর্ভে হযরত ঈসা নবী (আ:)-এর জন্মের কথাও আল্লাহ্ তা’লা জানিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ:)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যা দ্বারা ঈসা (আ:) নিজের প্রশংসা করেছেন। এই বর্ণনা শৈলী হযরত ঈসা (আ:)-এর মীলাদ উদযাপন ছাড়া আর কিছু নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা সুন্নী মুসলাম সমাজও এই একই বর্ণনা শৈলী দ্বারা মহানবী (দ:)-এর মীলাদ উদযাপন করে থাকেন। হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:)-এর ক্ষেত্রে যেভাবে আল্লাহ্ তা’লা তাঁদের মীলাদের বর্ণনা দিয়েছেন, আমরাও একই ভঙ্গিতে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকি। অতএব, বিবেকবান সবাই এ ব্যাপারে স্বীকার করবেন যে মীলাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আল্লাহ্ তা’লারই রীতি। তাই এটা প্রমাণিত যে মীলাদের ভিত্তি কুরআন মজীদেই বিদ্যমান।
(৩) আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
”তাদেরকে (মানুষদেরকে) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন” (সুরা ইব্রাহীম, ৫ নং আয়াত)।
এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী হযরত মূসা (আ:)-এর প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছেন যেন তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। “আল্লাহর দিনগুলো” হলো সে সব দিন যা’তে বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল বা এমন সব দিন যেগুলোতে আল্লাহ্ পাক তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি তাঁরই বড় নেয়ামত তথা আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন। ‘আল্লাহর দিনগুলোর’ উপরোক্ত ব্যাখ্যার পক্ষে কুরআন মজীদ সাক্ষ্য দেয়, যেখানে হযরত মূসা (আ:)-কে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “আর যখন মূসা (আ:) আপন সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, স্মরণ করো তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ফিরআউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিতো এবং তোমাদের পুত্রদের যবেহ্ করতো ও তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের মহা অনুগ্রহ রয়েছে” (সুরা ইব্রাহীম, ৩ নং আয়াত)।
আল্লাহ্ তা’লার উপরোল্লিখিত আয়াতের সারমর্ম অনুযায়ী, হযরত মূসা (আ:)-এর জাতি যেদিন ফিরআউন হতে মুক্তি লাভ করে সেদিনটি “আল্লাহর দিন” হিসেবে পরিগণিত হয়েছে; অতএব মহানবী (দ:) যেদিন এ ধরাধামে শুভাগমন করেন, সেদিনও “আল্লাহর দিন” হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, মহানবী (দ:) অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সারা বিশ্ব-জগতকে মুক্ত করে হেদায়াত তথা সঠিক পথের আলোতে নিয়ে এসেছেন। তাই অন্যান্য ঘটনার দিন উদযাপনের চেয়ে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস উদযাপন অগ্রাধিকার পাবে। অন্যথায় আল্লাহ্ তা’লার রহমত (করুণা) ও আশীর্বাদ অর্থাৎ বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি শোকরিয়া আদায় করা হবে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে মহা শাস্তি দেবেন যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান-
”এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের প্রতিপালক শুনিয়ে দিলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আরও অধিক দেবো, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর (সুরা ইব্রাহীম, ৭ নং আয়াত)।
(৪) মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেন-
”সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না” (সুরা আ’রাফ, ৭৮ আয়াত)।
উপরোক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাঁর রহমত ও আশীর্বাদগুলো স্মরণ করার হুকুম দিয়েছেন। শেষ নবী (দ:) হলেন নিঃসন্দেহে সারা মানবকুলের জন্যে আল্লাহ্ তা’লার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একথা অন্যত্র জানিয়েছেন: ”নিশ্চেয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের ওপর যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল (সুরা আলে ইমরান, ১৬৪ নং আয়াত)।
অতএব, কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’লার হুকুম অনুযায়ী আমাদের প্রিয় নবী (দ:)-কে স্মরণ করতে হবে; আর মীলাদুন্নবী (দ:) হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (দ:)-কে স্মরণ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। অন্যত্র আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান-
”এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের বেশি বেশি আলোচনা তথা প্রচার প্রসার করুন (সুরা দোহা, ১১ আয়াত)।
রাসুলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা:) ‘নেয়ামত’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেন, “আয়াতোল্লিখিত ‘নেয়ামত’ শব্দটি দ্বারা নবুয়্যত ও দ্বীন ইসলামকে বোঝানো হয়েছে” (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, সুরা দোহা, ৬৫১ পৃষ্ঠা)।
অতএব, মহানবী (দ:)-এর চাচাতো ভাইয়ের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে মহা পরাক্রমশালী খোদা তা’লা আমাদেরকে আদেশ করেছেন এ মর্মে যেন আমরা তাঁরই প্রিয়নবীকে (দ:) আমাদের সমাজে, মসজিদে এবং পারিবারিক পরিমন্ডলে স্মরণ করি; আর এ ক্ষেত্রে কুরআনী উদ্দেশ্য পূরণে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পন্থা আর কী হতে পারে!
(৫) মহান আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রতি আদেশ করেন-
”আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া, এবং সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিৎ। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলতের চেয়েও শ্রেয় (সুরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)।
এ আয়াতে কারীমায় আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রতি আদেশ করেছেন যেন আমরা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা প্রাপ্তিতে খুশি প্রকাশ করি। আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে আল্লাহ্ তা’লার প্রতিটি নেয়ামত আমাদের জন্যে তাঁরই অসীম দয়াস্বরূপ বিরাজমান। এমনকি আমাদের অস্তিত্বও তাঁরই দয়ার বহিঃপ্রকাশমাত্র। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হলেন আমাদের মহানবী (দ:)। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক ফরমান-
”হে রাসূল (দ:)! আপনাকে আমি প্রেরণ করেছি জগতসমূহের জন্যে আমার রহমত করে (সুরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)।
সুতরাং কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী, মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবসে খুশি প্রকাশ ও শোকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করা আমাদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মহানবী (দ:)-এর প্রতি খুশি থাকে, সে সত্যি কুরআন মজীদের একজন খাঁটি অনুসারী। আর এটা নিশ্চিত যে, সারা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায় মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন; এবং তা বিশেষ করে এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা’লার অনুপম করুণা হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-এর প্রতি শোকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যেই মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন। অতএব, পবিত্র কুরআন মজীদ মীলাদুন্নবী (দ:)-কে সমর্থন করে বলে প্রমাণিত হলো।
(৬) মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সমাবেশ (জুলুস, মাহফিল ইত্যাদি) মুসলমানদেরকে বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি দুরূদ-সালাম পাঠে অনুপ্রাণিত করে যা আল্লাহর আদেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; এরশাদ হয়েছে-
”নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দুরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)-এর প্রতি। হে ঈমানদার মুসলমান সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো” (সুরা আহযাব, ৫৬ আয়াত)।
শরীয়ত অনুযায়ী, শরীয়তে কোনো কিছু কাম্য হলে তা মূলত শরীয়তের একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়। আর দুরূদ শরীফের ফযীলত সংখ্যায় এতো বেশি যে তা গুণে শেষ করা যাবে না। দুরূদ ও সালাম আল্লাহ্ তা’লার সাহায্যপ্রাপ্তিতে কারণস্বরূপ। দুনিয়া ও আখেরাতে তাই মীলাদুন্নবী (দ:) আল্লাহ্ তা’লার আজ্ঞা পালনের একটি উৎস, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
(৭) আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান- “এবং সব কিছু আমি আপনাকে রাসূলগণের সংবাদই শুনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করবো” (সুরা হুদ, ১২০ আয়াত)।
এ আয়াতে করীমায় প্রতিভাত হয় যে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী বর্ণনা করার মধ্যে হেকমত হলো, এতে করে মহানবী (দ:)-এর হৃদয় মোবারককে সুদৃঢ় করা হয়েছে। আর এটা নিশ্চিত, বর্তমানকালে আমাদের অন্তরের দৃঢ়তারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমাদের জানতে হবে কেমন করে মহানবী (দ:) তাঁর সময়কার সমস্যাবলী মোকাবেলা করেছিলেন, যাতে করে আমরাও সুন্নাহ্ অনুসারে আমাদের সময়কার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পারি। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:) হুজুর পূর নূর (দ:)-এর ঘটনাবলী সম্পর্কে জানবার একটি সুযোগ আমাদের করে দেয়।
হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণ
মহানবী (দ:) থেকে অনেকগুলো বর্ণনা আমরা পাই, যা’তে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রমাণ মেলে। আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃত করছি:
(১) নবী করীম (দ:) নিজেই সর্বপ্রথমে তাঁর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) শরীফ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান- “আমি পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভে প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়েছি। আমার বেলাদত হয়েছে বৈধ বিবাহের ফলে, অবৈধ যৌনাচার থেকে নয়। আল্লাহ্ পাক যখন (হযরত) আদম (আ:)-কে পৃথিবীতে পাঠালেন, তখন তিনি আমাকে আদম (দ:)-এর মেরুদন্ডে স্থাপন করেন; আর সেখান থেকে নূহ (আ:)-এর কাছে তাঁর নৌকায় স্থানান্তরিত হলাম; অতঃপর সেখান থেকে (হযরত) ইব্রাহীম (আ:) এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভ হয়ে আমার পবিত্র পিতা-মাতার ঔরসে স্থানান্তরিত হই, যাঁরা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেন নি’ (তাফসীরে রূহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা)।
আমরা প্রথমেই বলেছি মীলাদ অর্থ জন্মের সময় কিংবা স্থান। অতএব, মহানবী (দ:) স্বয়ং তাঁর মীলাদ উদযাপন করেছেন। এই রীতি অনুসরণ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’ত (সুন্নী মুসলমান সমাজ) বিশ্বনবী (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে থাকেন। এ হাদীসটি মীলাদুন্নবী (দ:)-এর একটি সুস্পষ্ট দলিল এবং এটি আমাদের নিশ্চিত করে যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন কোনো বেদআত (মন্দ উদ্ভাবিত রীতি) নয়, বরং সুন্নতে নব্বী (দ:)। মহানবী (দ:) স্বয়ং মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেছেন। এমন অনেক রওয়ায়াত আছে যার কিছু কিছু মেশকাত শরীফ নামের হাদীস্ প্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
(২) যে ব্যক্তি মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস উদযাপন করেন তাঁকে চরম শাস্তি দেয়া হবে না; এবং এটা আশা করা হয়, যে মুসলমান ব্যক্তি মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেছেন তাঁকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে না। কেননা ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণনা করেছেন যে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের সুখবর দাসী সোয়াইবিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরে খুশি হয়ে আবু লাহাব আঙ্গুলের ইশারায় ওই দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিল, যার কারণে প্রতি সোমবার (হুজুর পাকের বেলাদত দিবস) জাহান্নামে তার শাস্তি লাঘব হয় এবং তার ওই আঙ্গুল থেকে পানি প্রবাহিত হয়, আর তা সে পান করে। মীলাদুন্নবী (দ:)-এর উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করায় সে এই পুরস্কার পেয়েছে (সহীহ্ বোখারী, ২য় খন্ড, ৭৬৪ পৃষ্ঠা)।
ইমাম শামসউদ্দীন নাসের আল্ দামেশ্কী এ হাদীসটি তাঁর কবিতায় বর্ণনা করেছেন। নিচে এর অনুবাদ দেয়া হলো:
যদি সেই কাফের যাকে (কুরআনে) অভিসম্পাত দেয়া হয়েছে, আর তার হাতগুলো ধ্বংস হয়েছে, আগুনে স্থায়ী আবাস হয়েছে; বর্ণিত আছে, আহমদ (দ:)-এর বেলাদতের খুশিতে প্রতি সোমবার তার শাস্তি লাঘব হয়; তবে সেই গোলাম কী আশা করতে পারেন, যিনি সারা জীবন আহমদ (দ:)-এর বেলাদতে খুশি হয়েছেন, আর আল্লাহ্ তা’লার একত্বে বিশ্বাস করে ইন্তেকাল করেছেন (হাওলুল আহতিফাল বিল্ মত্তলিদিন্ নব্বী আল্ শরীফ, ১১ পৃষ্ঠা)।
(২) প্রিয়নবী (দ:) নিজেই তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপন করেছেন রোযা রেখে। সহীহ্ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম (দ:)-কে সোমবার দিন তাঁর রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি উত্তর দেন-
”এ দিন (সোমবার) আমার বেলাদত (পৃথিবীতে শুভাগমন) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে (মেশকাত শরীফ, ১৭৯ পৃষ্ঠা)।
এই রওয়ায়াত (বর্ণনা) প্রমাণ করে যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করা মহানবী (দ:)-এর সুন্নাত। দ্বিতীয়তঃ মীলাদুন্নবী (দ:)-এর খুশিতে এবাদত করা সুন্নাহ্ সম্মত একটি আমল।
মুসলিম উম্মাহ্ ও উলামাবৃন্দের ঐকমত্য
(১) ইমাম হাফেয আল্ সৈয়ুতী (রহ:) তাঁর প্রসিদ্ধ “আল হাওউইয়ী লিল্ ফাতাওউইয়ী” গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি বিশেষ অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন যার শিরোনাম হলো “মওলিদ উদযাপন উদ্দেশ্যের শ্রেষ্ঠত্ব।” এ অধ্যায়ে তিনি লিখেন: “বিবেচনাধীন প্রশ্নটি হলো এই যে, রবিউল আউয়াল মাসে মহানবী (দ:)-এর পবিত্র বেলাদত দিবস উদযাপনের ব্যাপারে শরীয়তের রায় কী? শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি কি একটি প্রশংসনীয় কাজ, না দূষণীয় কাজ? আর যারা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তাঁরা কি আশীর্বাদ লাভ করেন, না কি করেন না”?
ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) অতঃপর লিখেন: “এ প্রশ্নের উত্তরে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মীলাদ শরীফ এমনই একটি খুশির অনুষ্ঠান যেখানে মানুষেরা সমবেত হন এবং কুরআন মজীদ সহজভাবে তেলাওয়াত করা হয়। অতঃপর নবী করীম (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমন বিষয়ক বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী যা হাদীস্ সমূহে ও বিভিন্ন লেখনীতে বিধৃত হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়; আর তাঁর বেলাদতের সময় যে সব অলৌকিক ঘটনা ও আলামত দেখা গিয়েছিল তাও বর্ণনা করা হয়। এরপর অনুষ্ঠানে আগত মানুষদের সামনে খাবার পরিবেশিত হয় এবং তাঁরা তা নিজ সন্তুষ্টি অনুযায়ী গ্রহণ করেন। মহাবনী (দ:)-এর বেলাদত দিবস পালনের এই উৎসব হলো বেদআতে হাসানা (উত্তম উদ্ভাবন), আর যারা এর আয়োজন করেন তাঁরা সওয়াব (আশীর্বাদ) পাবেন। কেননা, এ ধরনের উদযাপনের মধ্যে নিহিত রয়েছে মহানবী (দ:)-এর সুউচ্চ শান-মানের প্রতি এবং তাঁর বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।”
এমন কি (বিভ্রান্তদের গুরু) ইবনে তাইমিয়াও তার “সঠিক পথের প্রয়োজনীয়তা” শীর্ষক পুস্তকের ২৬৬ পৃষ্ঠায় (নিচের দিকের ৫ম লাইনে) লিখেছে: “খৃষ্টানদের যীশু খৃষ্টের জন্মদিন পালনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাস্বরূপ হোক কিংবা মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শনস্বরূপই হোক, মুসলমান সমাজ মীলাদ অনুষ্ঠানে যা আমল করেন তাঁদের এই ধরনের ইজতেহাদের জন্যে আল্লাহ্ পাক অবশ্যই তাঁদেরকে পুরস্কৃত করবেন।” ইবনে তাইমিয়া অতঃপর লিখেছে: “মীলাদ যদিও বা সালাফ (পূর্ববর্তী যমানার পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ) কর্তৃক অনুশীলিত হয় নি, তথাপি তাঁদের তা অনুশীলন করা উচিৎ ছিল। কেননা, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ছিল না।”
আর আমরা তো মীলাদ উদযাপন করি বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যেই।
(২) সহীহ্ বুখারী শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা) লেখক ইমাম হাফেয আল্ কস্তলানী (রহ:) বলেন: “আল্লাহ্ তা’লা এমন ব্যক্তির প্রতি তাঁর রহমত বর্ষণ করুন, যিনি মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের মাস রবিউল আউয়ালের দিনগুলোকে খুশি প্রকাশ ও উদযাপনের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন; কেননা এতে পীড়িত ব্যক্তির অন্তরের জন্যে সর্বোত্তম নিরাময় নিহিত রয়েছে।”
(৩) মীলাদ শরীফ সম্পর্কে ইমাম সৈয়ুতী (রহ:)-কে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হাফেয ইবনে হাজর (রহ:)-কেও করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন: “আল্লাহ্ তা’লার করুণা অবতীর্ণ হয়েছে কিংবা কোনো দুর্যোগ তিনি দূর করে দিয়েছেন এমন দিবসকে স্মরণ করার জন্যে কোনো নেক কাজ করা এবং তা প্রতি বছর উদযাপন করা হলো আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি পন্থামাত্র। মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিভিন্ন এবাদতের মাধ্যমে করা যায়- যেমন, সেজদা ও নামাযে দাঁড়ানো, দান সদকা ও কুরআন তেলাওয়াত। আর এই দিনে (১২ই রবিউল আউয়াল) দয়ার নবী (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমনের চেয়ে আল্লাহ্ তা’লার বড় নেয়ামত আর কী হতে পারে?”
কেউ কেউ শুধু ১২ই রবিউল আউয়ালে মীলাদুন্নবী উদযাপনকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং ওই মাসের পুরোটুকুই মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকেন। আর কেউ কেউ সারা বছরের যে কোনো দিন তা পালনে ব্রত হয়েছেন। তাঁদের মতে এটি বছরের যে কোনো সময় উদযাপন করা যায়। কেননা এর উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ, মহানবী (দ:) এর বেলাদতে খুশি প্রকাশ ও তা উদযাপন করা।
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
(আল্ হাশেমীয়া সোসাইটির ফতোয়া Questions regarding Meeladun-Nabi sallallaahu alaiyhi wa sallam - www.oocities.org/~abdulwahid/muslimarticles/milad_question.html ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)
মীলাদুন্নবী (দ:) - সকল ঈদের সেরা
মূল: অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ মাসূদ আহমদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
মহান আল্লাহ্ পাক সর্বপ্রথম মহানবী (দ:)-এর নূর (আলো) সৃষ্টি করেন (মাদারিজুন নুবুয়্যত, ১ম খন্ড, ২য় পৃষ্ঠা)। অতঃপর তিনি তাঁকে নুবুয়্যত দান করেন (আশয়াতুল লোমআত, ৪৭৪ পৃষ্ঠা)। এভাবেই দুরূদ শরীফের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। এরপর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয় যারা দুরূদ ও সালামে অংশগ্রহণ করেন (সুরা মায়েদাহ্, ১৫ নং আয়াত)। ওই নূর (হুজুর পাক) যখন এ ধরাধামে আবির্ভূত হলেন, তখন মানব জাতিও দুরূদ সালামের প্রক্রিয়ায় শরীক হলো (সূরা আহযাব, ৫৬-৫৭ আয়াতসমূহ)। আমরা এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি গভীর চিন্তা করি তবে আমরা উপলব্ধি করবো যে এটিও এই খুশির ঈদের ঘোষণা ও তা প্রতিষ্ঠার একটি শৈলীগত আকার ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহু আকবর!
সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বিশ্বনবী (দ:)-এর যিকর (স্মরণ) অব্যাহত রয়েছে এবং এ উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি অশেষ মহব্বত ও দয়া প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁদের চিহ্ন ও আলামত (স্মৃতিচিহ্ন)-কে নিজ নিদর্শন বলে সম্ভোধন করেছেন (সূরা বাকারাহ,৫৮ আয়াত) এবং এ মর্মে আদেশ করেছেন যেন তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মোন (তা’যিম) প্রদর্শন করা হয়। তাঁদের স্মৃতিবহ দিনগুলোকে তিনি তাঁর নিজের দিন (তাফসীরে খাযেন ও তাফসীরে মদারেক) বলে ঘোষণা দিয়েছেন:
“তাদেরকে (মানুষকে) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন” (সূরা ইব্রাহীম, ৫ নং আয়াত)। মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবস হলো আল্লাহ্ তা’লার উক্ত দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য কুরআন মজীদ থেকেই নিরূপণ করা যায়। হযরত ইয়াহইয়া (আ:)-এর প্রসঙ্গে এতে ঘোষিত হয়েছে:
“এবং শান্তি তাঁরই ওপর যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসাল (খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন” (সূরা মরঈয়ম, ১৫ নং আয়াত)।
মহানবী (দ:) এ ধরাধামে শুভাগমন করেন সোমবার দিন। এর শোকরিয়া আদায় তথা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে তিনি সোমবার রোযা রাখতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন,
অর্থাৎ, “এ দিন (সোমবার) আমার বেলাদত (পৃথিবীতে শুভাগমন) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে” (সহীহ্ মুসলিম, উসদুল গাবাহ্ ইবনে আসির, ১ম খন্ড, ২১-২২ পৃষ্ঠা)। কিছু কিছু বর্ণনা মতে হুজুর পূর নূর (দ:)-এর বেলাদতের তারিখ ৫৬৯ খৃষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল; যার ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় চার হাজার বছর আগের শাস্ত্রলিপিতে পাওয়া যায় (ভগবত পুরাণ, এস্কান্দ-১২, ২য় অধ্যায়, অশ্লোক নং ১৮)। তাই ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার মহানবী (দ:)-এর সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং এই সম্পর্কই এমন একটি মাধ্যম যা আধ্যাত্মিক উন্নতির চাবিকাঠি।
বিশ্বনবী (দ:)-কে প্রেরণ করে আল্লাহ্ পাক মুসলমানদের প্রতি অসীম, করুণা ও দয়া প্রদর্শন করেছেন (সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত)। করুণা ও দয়া নসীব করা হয় এ উদ্দেশ্যে যাতে তা স্মরণ রাখা হয় ও কখনো ভুলে না যাওয়া হয়। উপরন্তু, আল্লাহ্ তা’লা এই করুণা ও নেয়ামত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপনের জন্যে আমাদের প্রতি আদেশ করেছেন (সূরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)।
হযরত ঈসা (আ:) এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, “হে প্রতিপালক, আমার প্রতি আসমান থেকে একটা ‘খাদ্য-খাঞ্চা’ অবতারণ করুন যা আমাদের জন্যে ঈদ উৎসব হবে- আমাদের পূর্ববর্তি ও পরবর্তী সকলের জন্যেই” (সূরা মায়েদা, ১১৪ আয়াত)। এ আয়াতটির ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করুন: ‘খাদ্য-খাঞ্চা’র অবতরণকে কেন্দ্র করে হযরত ঈসা (আ:) যদি ঈদের দিন পালন করতে পারেন, তাহলে যেদিন আল্লাহ্ তা’লা তাঁর সমস্ত রহমতের আধার ও কেন্দ্রবিন্দু মহানবী (দ:)-কে এ ভুবনে আশীর্বাদস্বরূপ প্রেরণ করলেন, সেই দিনটি আমাদের ঈদ হিসেবে উদযাপন করা উচিৎ নয় কি? যে লাইলাতুল কদরের রাতে কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হয়েছিল তা হাজার মাসে রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা কদর, ৩ নং আয়াত); তাহলে সেই রাতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ভাবুন যখন জীবন্ত বা মূর্তমান কুরআন (মহানবী) আবির্ভূত হয়েছিলেন! লাইলাতুল কদর বাৎসরিকভাবে উদযাপিত হতে পারলে সৃষ্টিকুল শিরোমণি হুজুর পূর নূর (দ:)-এর বেলাদতের রাত ও দিবস কেন প্রতি বছর উদযাপন করা যাবে না?
আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেন-
“এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের বেশি বেশি আলোচনা তথা প্রচার প্রসার করুন” (সূরা দোহা, ১১ আয়াত)। ইমাম বুখারী (রহ) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) হলেন আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, ৫৬৬ পৃষ্ঠা); অতএব, তিনিই এই প্রচার-প্রসারের ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবেন। মিম্বর থেকে তিনি নিজেই তাঁর বেলাদত তথা মীলাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন (জামেউ তিরমিযী, ২য় খন্ড, ২০১ পৃষ্ঠা)। তাঁর নির্দেশক্রমে কতিপয় সাহাবী তাঁর অতুলনীয় ও অনুপম গুণাবলী ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছিলেন ও প্রচার করেছিলেন (যুরকানী মালেকী, ১ম খন্ড, ২৭ পৃষ্ঠা)। হিজরী ৯ম সালে তাবুকের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের শুভলগ্নে মহানবী (দ:)-এর শ্রদ্ধেয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:) তাঁর উপস্থিতিতে মীলাদুন্নবী (দ:) বিষয়ক একটি কবিতা পাঠ করে পেশ করেন (মীলাদে মোস্তফা: প্রণেতা ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা ২৯-৩০)। হুজুর পূর নূর (দ:) স্বয়ং একখানা চাদর একটি প্ল্যাটফরমের ওপর বিছিয়ে দিলে হযরত হাস্সান বিন সাবেত (রা:) তাতে দাঁড়িয়ে নবী করিম (দ:)-এর শানে একটি কসীদা (পদ্য) পেশ করেন। এতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে হযরত হাস্সানের (রা:) জন্যে বিশেষভাবে দোয়া করেন। এ সব সত্য ঘটনা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে সংকলিত হয়েছে।
হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) যখনই মহানবী (দ:) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কোনো কথা বলতেন, তখনি তিনি বিশেষ প্রস্তুতি নিতেন (একামতে কেয়ামাহ, পৃষ্ঠা ৪৪) - ঠিক যেমনিভাবে বর্তমানে দেখা যায় বুযূর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে হাক্কানী ধর্মীয় ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানাদি পালনকালে বিশেষ আয়োজন করে থাকেন। প্রতি মাসের ১১ম দিবসে হযরত শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) মহানবী (দ:)-এর নামে উপহার পেশ করতেন এবং এই প্রথা আজো বহাল আছে (কুর্রাতুল নাযির, ১১ পৃষ্ঠা)। ইবনে তাইমিয়াও মীলাদ শরীফ আয়োজনকারী ভক্তদের অশেষ সওসাব ও রহমত প্রাপ্তির খোশ খবরী দিয়েছে (একতেদায়ে সিরাতে মুস্তাকীম)।
মীলাদের মজলিস বা অনুষ্ঠান নতুন কোনো কিছু নয়; এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রবাহমান। এর মূল মহানবী (দ:)-এর সময়ে পাওয়া যায়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহেলভীর পিতা শাহ আব্দুর রহীম প্রতি বছর মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করতেন এবং এ উপলক্ষে গরীবদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেন (আদ্ দুরারুস্ সামীন, পৃষ্ঠা ৮)। শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর পুত্র শাহ্ আব্দুল আযীয মোহাদ্দেসে দেহেলভী উভয়েই প্রতি ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে মীলাদের মজলিশে মানুষদেরকে দাওয়াত করতেন এবং তাঁরা হুজুর পাক (দ:)-এর বেলাদতের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং খাবার ও মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে মীলাদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন (আদ্ দুররুল মোনাযযম, পৃষ্ঠা ৮৯)। মক্কাতুল মোকাররমাতে একবার শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ একটি মীলাদের মজলিসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান নূর (আলো) ঝর্ণার মতো ওপর থেকে নেমে আসছে (ফুয়ূযুল হারামাইন, পৃষ্ঠা ৮০-৮১)। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর পীর হাজী এমদাদউল্লাহ মুহাজিরে মককী প্রতি বছর মীলাদের আয়োজন করতেন নাজাতের ওসীলা হিসেবে এবং দাঁড়িয়ে (কেয়াম) সালাত-সালাম পড়তেন রাসূলে আকরাম (দ:)-এর প্রতি (ফয়সালায়ে হাফত্ মাসয়ালা, পৃষ্ঠা ১১১)। প্রতি বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে গ্র্যান্ড মুফতী শাহ মোহাম্মদ মাযহার উল্লাহ দেহেলভী জাঁকজমকের সাথে মীলাদ মাহফিল করতেন যা এশার নামাযের পরবর্তী সময়ে আরম্ভ হয়ে ফজর নামাযের আগ পর্যন্ত চলতো। এ সময় দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করা হতো এবং তার পর খাবার ও মিষ্টি বিতরণ করা হতো (তাযকেরায়ে মাযহারে মাসউদ, পৃষ্ঠা ১৭৬-১৭৭)। কতিপয় মনোনীত ফেরেশতা সব সময়ই দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করছেন (সুরা সাফফাত, ১ম আয়াত); এতে বোঝা যায়, এটি ফেরেশতাদের আমল ও আচার। মদীনা মনোওয়ারায় রাসূলে পাক (দ:)-এর বেসালের সময় ফেরেশতা, নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও দলে দলে তাঁর সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন। সাত’শ বছর আগে স্বনামখ্যাত আলেম ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী (রহ:) ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে যুগের ‘হাস্সান’ ইমাম সরসরী (রহ:) মহানবী (দ:)-এর শানে কসীদা পেশ করছিলেন, যার মধ্যে তিনি উপস্থিত সকলকে নবী করীম (দ:)-এর যিকর-এর সময় দাঁড়াবার জন্যে তাকিদ দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় সবাই সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ান (একামতে কেয়ামাহ্)। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে প্রতিভাত হয় যে সালাত ও সালাম পেশ করা হলো পুণ্যবান ফেরেশতাকুল, সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এবং মুসলিম উম্মাহর সমস্ত বুযূর্গানে দ্বীন, উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীর আচরিত রীতি। হযরত শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেসে দেহেলভী (রহ:) সর্বদা দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করতেন এবং একে তাঁর দোয়া ও আমল কবুলের ওসীলা তথা মাধ্যম মনে করতেন (আখবারুল আখইয়ার, পৃষ্ঠা ৬২৪)।
বিশ্বনবী (দ:) এরশাদ করেছেন-
“মু’মিন মুসলমানবৃন্দ যে জিনিসকে ভাল ও কল্যাণময় বিবেচনা করেন তা আল্লাহর কাছেও প্রশংসনীয়” (মোওয়াত্তায়ে ইমাম মোহাম্মদ, পৃষ্ঠা ১০৪)। প্রিয়নবী (দ:) আরও এরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের মধ্যে এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো ভাল রীতি প্রবর্তন করবে, সে শুধু এর সওয়াবই পাবে না, বরং যারা এর ওপর আমল করবে তাদের সওয়াবও সে পেতে থাকবে” (সহীহ্ মুসলিম, ৩য় খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা)। সাওয়াদুল আযম (মেশকাত ১ম খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা) -এর পতাকাতলে অবস্থান নেয়ার জন্যে এ ক্ষেত্রে আদেশও করা হয়েছে; এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাদের দল (মেশকাত, ১ম খন্ড, ৩১ পৃষ্ঠা)। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পবিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করা মহানবীর (দ:), তাঁর পুণ্যবান সাহাবীদের, তাবেয়ীনবৃন্দের ও বুযূর্গানে দ্বীনের আচরিত রীতি; এ যাবত যা আলোচনা করা হয়েছে তাতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
মহব্বত বা প্রেমের একটি সহজাত গুণ হলো প্রেমাস্পদের প্রশংসা শুনলে প্রেমিকের চিত্ত আনন্দে দুলে ওঠে। বরং তাঁর অন্তর এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে সর্বদা তাঁর প্রেমাস্পদের প্রশংসা ও স্মরণ জারি রাখা হবে। কেউ কখনো এমন প্রেমিক দেখবেন না যিনি তাঁর প্রেমাস্পদের স্মরণের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করবেন। এটি প্রেমের প্রকৃতি বিরোধী। সত্য কথা হলো, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর খুশি উদযাপনের প্রকৃত মর্ম নিহিত রয়েছে সদা-সর্বদা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হুজুর পূর নূর (দ:)-এর সুন্নাহর সঠিক প্রতিফলনের মধ্যে। অতঃপর ইসলামের পতাকা উড্ডীনকারী আমাদের পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের রীতির সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করা উচিৎ। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর শিক্ষক শাহ আব্দুল গণী মোহাদ্দেসে দেহেলভী কী সুন্দর বলেছেন- “মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে কোনো ব্যক্তির পূর্ণ পরিতৃপ্তি” (শেফা আল সা’য়েল)।
মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে রসূলপ্রেম নসীব করুন যা আপনাআপনি আমাদেরকে তাঁর সুন্নাহের সাথে ঢেলে সাজাবে এবং অন্যান্যদের কাছে আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রতীয়মান করবে। আমীন!
[Eid of Eids শীর্ষক এ প্রবন্ধটি www.nfie.com/Eoe.html ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত]