মূল: শায়খা ফাতেমা ফ্লিয়র নাসেরী বন্নিন (অস্ট্রেলিয়া)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[আমার পীর ও মোর্শেদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী আলহাজ্জ্ব সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত]
মওলানা জালালউদ্দীন মৌলাভী, যাঁকে পশ্চিমা বিশ্ব ‘রূমী’ নামে চেনে, তিনি পরিচিত ঐশী প্রেমের দূত হিসেবেও - যে খোদায়ী এশক সমস্ত সৃষ্টিজগত ও জীবসত্তার ধমনীতে স্পন্দিত, আল্লাহতা’লার বাণী মোতাবেক যে প্রেমের কারণে এই সৃষ্টিজগতের উৎপত্তি। ‘গুপ্ত ভাণ্ডার’ নামে খ্যাত হাদীসে কুদসীতে হযরত দাউদ (আ:) মহান আল্লাহতা’লাকে এই বিশ্বজগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এমতাবস্থায় তিনি তা ব্যক্ত করেন, “আমি ছিলাম রহস্যের গুপ্ত ভাণ্ডার; অতঃপর আমি ভালোবাসলাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে। তাই আমি সৃষ্টি করলাম এই বিশ্বজগত, নিজেকে পরিচিত করানোর জন্যে।” অতএব, এই হাদীসে কুদসীর মর্ম অনুযায়ী জগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহকে জানা, আর মাধ্যম হলো মহব্বত।
আমরা খৃষ্টধর্মের শীর্ষ আজ্ঞানামা ‘গসপেল’-এর বিভিন্ন বর্ণনায়ও অনুরূপ একটি বার্তা দেখতে পাই, যা’তে যীশু খৃষ্ট (ঈসা মসীহ আলাইহিস্ সালাম) এই ঐশী প্রেমকে চূড়ান্ত খোদায়ী বিধান আখ্যায়িত করেছেন; তিনি বলেন: “তোমরা তোমাদের প্রভু, তোমাদেরই খোদাকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসবে, পুরো আত্মা এবং গোটা মস্তিষ্ক দিয়ে ভালোবাসবে ।” এই ঐশী প্রেমের অভিজ্ঞতা-ই সকল সূফী-গুরু সঞ্চয় করেন, এ ব্যাপারেই কখা বলেন এবং লেখালেখি করেন; যে বিষয়টিতে মওলানা রূমী (রহ:) সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন এবং এর মধ্যমণি ও তার প্রতিবিম্বতে পরিণত হয়েছিলেন।
মওলানা আবদুর রহমান জামী’ (রহ:), যিনি ১৫ শতকের পারসিক সূফী কবি, তিনি মওলানা সম্পর্কে বলেন:
ওই মহৎ গুণ
আমি কীভাবে করিবো বর্ণন
তিনি নন কোনো নবী
তবু তাঁর আছে একখানি বহি
অন্যত্র তিনি বলেন:
মওলানার ‘মসনবী’ কেতাব
যেন কুরআনের ফারসী অবয়ব
আল-কুরআন ও মসনবী শরীফের মধ্যে এ ধরনের অনেক উপমা দেয়া হয়েছে, যথা - অনেক অন্তর্নিহিত অর্থে পরিপূর্ণ ঘটনা ও সেগুলোর বিন্যাস সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি। এটিও একইভাবে বিশ্বাস করা হয়, আল-কুরআনের প্রারম্ভিক সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াত যেমন সমস্ত কুরআনের সার-সংক্ষেপ, তেমনি মসনবী শরীফের সূচনার ১৮টি পংক্তিও ওর আনুমানিক পঁচিশ হাজার পংক্তির সার-সংক্ষেপ। এ সব উপমা মওলানা রূমী (রহ:)-এর বাণী কতো উচ্চ মকামের তা ইঙ্গিত করে।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে আমি মওলানা রূমী (রহ:)-এর কথাবার্তা প্রায় হুবহু উদ্ধৃত করবো; তবে এখানে বলা দরকার যে নিকোলসনের পরলোক গমনের পর হতে এ যাবতকালে মওলানার বাণী খুঁজে পাওয়াটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকাল মওলানা রূমী (রহ:)-এর পদ্যে তাঁর বাণীর অংশ খুব কমই থাকে; পক্ষান্তরে, অনুবাদক ও লেখকদের সম্পর্কেই বিশদ বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। তাই আমি মনে করি সবার জন্যে সবচেয়ে ভাল হয় যদি মওলানার নিজস্ব বাণী নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়। আমি আরও যোগ করতে চাই, এ রকম যে ঘটবে তা মওলানা জানতেন, আর সে জন্যে তিনি ’মসনবী’র সূচনার ৬ষ্ঠ পংক্তিতে এ ব্যাপারে আগাম সতর্ক করেছিলেন।
মওলানা সূচনায় বলেন:
শোনো, এই বাঁশি কেমনে ব্যক্ত করে কাহিনী যতো
বিরহ-জ্বালায় এটি সদা বিলাপরত
এই সূচনা-পংক্তিতে মওলানা নিজেকে বাঁশির সাথে তুলনা করেছেন, যে বাঁশি ঐশী প্রেম-মুর্ছনা তথা ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম’-এর সুর বাজিয়ে আমাদেরকে বিরহ-বেদনার কাহিনী শোনাবে।
’আলাসতু বি রাব্বিকুম’ বাক্যটি বর্ণিত হয়েছে আল-কুরআনে (৭:১৭২), যার তাফসীরে বিবৃত হয়েছে যে সৃষ্টির প্রাকলগ্নে, মানে পৃথিবীতে জীবন শুরুর আগে আল্লাহ পাক সকল রূহ (আত্মা)-কে ডেকে পাঠান এবং সমগ্র মানব জাতিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম?’
অর্থাৎ, আমি কি তোমোদের প্রভু নই? সবাই উত্তর দেয়, ‘বালা শাহিদনা’, অর্থাৎ, জ্বি, আমরা তা সাক্ষ্য দিচ্ছি।
এটি প্রতীয়মান হয় যে মওলানার সমগ্র কাব্য ও মুর্ছনায় ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম’-এর মূল সুরের স্মৃতিচারণ ও উপলব্ধি অন্তর্নিহিত; যেমনটি তিনি বলেন:
যেহেতু তিনি আমার আত্মার কানে ‘আলাসতু’র গোপন রহস্য করেন ব্যক্ত
তাই আমার হৃদ-রাজ্য হতে তাঁর নৈকট্যের আকাঙ্ক্ষা হয় না তিরোহিত
কিন্তু এই উপলব্ধি যা আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তা কোনো সহজ কাজ নয়; আর তা সহজে প্রাপ্তিসাধ্যও নয়। ফলে আমরা একে আমাদের নিজস্ব বুঝ ও সমঝ অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করি। মসনবী শরীফের সূচনার ৬ষ্ঠ ছত্রে মওলানা এ ব্যাপারে বলেন:
সবাই আমার সাথী হয়েছে নিজস্ব সমঝ মোতাবেক
কেউই জানতে চায় নি আমার গোপন রহস্য ও নানা ভাবনার উদ্রেক
এর অব্যবহিত পরেই তিনি বলেন:
আমার এই সরব আর্তি থেকে নয়কো দূর আমারই গোপন রহস্য
কিন্তু তা দেখার বা শোনার মতো জ্যোতি কারো নেই অবশ্যঅবশ্য
এই ’নূর’ (জ্যোতি) কী জিনিস, রহস্য জানার ক্ষেত্রে সাধারণ চোখে যা দেখা যায় না এবং কানেও শোনা যায় না? এর উত্তর খুঁজতে চলুন স্বয়ং মওলানার দ্বারস্থ হই, যেহেতু তিনি বলেছেন তাঁর বইতে তিনি সব কিছু প্রকাশ করেছেন - কখনো ব্যাখ্যা দ্বারা, কখনো বা পরোক্ষ উল্লেখ করে, আবার কখনো ইশারায়। তা কেন? তাঁর ব্যাখ্যা শুনুন:
গোপন রহস্যগুলো ছত্রে ছত্রে লুক্কায়িত
যা আমি আরও স্পষ্ট বল্লে দুনিয়ার নিয়ম হবে ব্যাহত
আরেক কথায়, সবাই যদি সত্য/বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পারতো, তাহলে কেউই আর দুনিয়ার কাজ-কর্মে নিমগ্ন হতো না। এ কারণেই আলোকিত মানবের সংখ্যা সব সময়েই খুব কম হয় সর্বসাধারণের তুলনায়। আল-কুরআনও বার বার তাই এরশাদ ফরমায়, “স্বল্প সংখ্যক-ই জানবে”, অথবা “স্বল্প সংখ্যক-ই উপলব্ধি করবে”, কিংবা ”স্বল্প সংখ্যক-ই চিন্তা করবে” ইত্যাদি।
মওলানার পূর্ববর্তী শ্লোকে ফেরা যাক:
আমার এই সরব আর্তি থেকে নয়কো দূর আমারই গোপন রহস্য
কিন্তু তা দেখার বা শোনার মতো জ্যোতি কারো নেই অবশ্যঅবশ্য
এই নূর বা জ্যোতি দর্শন ও শ্রবণে আমাদেরকে কিসে বাধা দিচ্ছে সে সম্পর্কে জানার আগ্রহে চলুন আবারও মওলানার শরণাপন্ন হই; তিনি বলেন:
মানবচক্ষে বসানো ঠুলি গৌণ বিষয়ে রেখেছে তাদের আবদ্ধ
এই গৌণের উর্ধ্বে না উঠলে ’আসহাব’-বৃন্দের অন্তর্ভুক্ত হবার দ্বার রুদ্ধ
অতএব, মওলানা যে দর্শনক্ষমতার কথা বলেছেন, তা হলো বাস্তবতাকে দেখতে সক্ষম চোখ; আর তা মানুষ, বস্তুগত জগৎ, এবং সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বাধা নফস (নিজের একগুঁয়ে সত্তা) দ্বারা যেন পর্দায় আবৃত না হয়। আমাদের এমন দর্শনক্ষমতা প্রয়োজন যা গৌণ বিষয়ের উর্ধ্বে উঠে মুখ্য বিষয়টি অবলোকন করতে সক্ষম। মওলানা বলেন:
আমি এমন চক্ষু চাই যা রাজাধিরাজকে জানতে সক্ষম
যাতে তাঁর বিভিন্ন বেশভূষায় তাঁকে চেনার উপায় হয় মোক্ষম
কেউ এ চোখ কীভাবে লাভ করতে পারে? মওলানা সূফী-দরবেশদের পথে সফর করতে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন:
সূফী-দরবেশদের মালিকানায় যে সুরমা, তা করো অন্বেষণ
যাতে তোমাদের দৃষ্টিশক্তির সরু জলধারা হয় মহাসাগরে পরিবর্তন
আমাদের সাথে সর্বদা বিরাজমান এই পর্দাটি কী এবং কেনই বা তা আমাদের সামনে বাস্তবতা সম্পর্কে ভিন্ন বিবরণ তুলে ধরে? অথচ এই বিবরণকে আমরা সত্য বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। (একগুঁয়ে) সত্তা কী এবং কীভাবে তা আমাদেরকে সত্য ও বাস্তবতা উপলব্ধিতে বাধা দিয়ে থাকে?
সুফী মনঃস্তত্ত্ব আমাদেরকে এর গভীরে যেতে সহায়তা করতে পারে। মনোবিদ্যা আমাদেরকে বলে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা স্নায়ুচাপের কারণে স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা যারা হারিয়ে ফেলে, তারা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বাস্তবতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বা অবাস্তব চিন্তা পোষণ করে থাকে। কিন্তু মনোবিদ্যার দৌড় ওই পর্যন্তই। পক্ষান্তরে, সূফী-দরবেশদের মনঃস্তত্ত্ব আরও অগ্রসর হয় এবং এর ক্ষেত্র-ও সম্প্রসারিত হয়, যার ফলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের বাস্তবতাসম্পর্কিত ধারণা আধ্যাত্মিক জগতে যাত্রাকারী সূফী-দরবেশদের কাছে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও ভ্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
মওলানা যখন আমাদেরকে বলেন সূফী-দরবেশদের পথে যাত্রা করতে, যাতে আমাদের দৃষ্টি সুপ্রসারিত হয়, তখন তিনি দর্শনক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করেন। কেননা, আলোকিত মানব যা দেখতে পান এবং উপলব্ধি করেন, তা অধিকাংশ মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। আধ্যাত্মিকতার আলোয় উদ্ভাসিতজন তাঁদের প্রাপ্ত আলোকোচ্ছ্বটার অংশ অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রায় অদৃশ্য জ্ঞান পেয়ে থাকেন।
অতএব, আমাদেরকে বোঝতে হবে যে দৃষ্টিশক্তির প্রকারভেদ রয়েছে; আর এও অনুধাবন করতে হবে যে আমাদের অহংবোধ কতোটুকু সীমাবদ্ধ এবং তাই সেটিকে চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসেবে না মনে করা আমাদের কর্তব্য। আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা যা চিন্তা করি এবং দেখি তা চূড়ান্ত নয়, এর বাইরেও আরেকটি দৃষ্টিক্ষমতা আছে যার জন্যে প্রয়োজন সূফী পথে পরিভ্রমণ ও অহংবোধের চেতনার উর্ধ্বে ওঠা।
আমি এই চোখ, দৃষ্টিক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিষয়টিকে আরেকটি দৃষ্টিকোণ্ থেকে দেখতে চাই। কেননা, ’মসনবী’র মহাসাগরে যেদিকে তালাশ করি না কেন, সেখানেই বিভিন্ন ধরনের মুক্তা আমরা খুঁজে পাই। ওই মুক্তাগুলো একত্রিত করার পরই কেবল পুরো গলার হার আমরা দেখতে পাই।
এক্ষণে আমরা মওলানার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও পছন্দনীয় কবিতা তথা ’গযল’ তাঁর ‘দেওয়ানে শামসে তাবরিয’ থেকে বেছে নেবো। প্রথম পংক্তি নিম্নরূপ:
আমি ছিলাম মৃত, অতঃপর হলাম জীবন্ত
ছিলাম অশ্রুজল, হলাম হাসিতে পরিণত
ভালোবাসা বিস্তার করলো (আমা মাঝে) রাজত্ব
সম্রাট হিসেবে পেলাম আমি চির স্থায়িত্ব
এমনি এক সূচনা যা’তে মৃত অবস্থা থেকে জিন্দা হয়ে, কান্না থেকে হাসিতে রূপান্তরিত হয়ে, ভালোবাসার রাজত্বে পৌঁছে এবং তাকে স্থায়ী সাম্রাজ্যে পরিণত করে - সব একই ছত্রে প্রকাশ করে - মওলানা যেন আমাদের বলছেন: তোমরা কি এখন আমার সাথে এই সফরে শরীক হবে? আর যেহেতু এই আমন্ত্রণের আসল উৎস ’হু’ তথা হক্ক সোবহানাহু ওয়া তা’লা স্বয়ং, যিনি মওলানার পবিত্র জবান দ্বারা কথা বলছেন, সেহেতু আমরাও বলি, ‘জ্বি’। অতঃপর আমরা যখন জিজ্ঞেস করি, ’কীভাবে হবো এই সফরে শরীক’, তখন আমরা সেই একই জবাব শুনতে পাই যা শায়খ মহিউদ্দীন ইবনে আরবী (রহ:) শুনেছিলেন আল্লাহর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ আলাপের কোনো একটিতে, যেখানে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ’কেউ আপনার নৈকট্য কীভাবে পেতে পারে?’ আর আল্লাহ জবাব দিয়েছিলেন, ‘এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে যা আমার নেই।’ মানে ’উবুদিয়্যাত’ তথা গোলামি দ্বারা।
এই কারণেই মওলানা তাঁর কাব্যের পরবর্তী দশটি পংক্তি, যথা - ৩ থেকে ১২ পংক্তিতে, তাঁর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ উবূদিয়্যাত-এর পর্যায়গুলোর বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেন ও বিশদ চিত্র আঁকেন। তিনি সার্বিকভাবে সূফী পথের স্তরগুলো, এবং বিশেষভাবে নিজ পীর শামস তাবরিযী (রহ:)-এর সাথে তাঁর সোহবতের ধাপগুলোকে একই সূত্রে গেঁথেছেন, যা’তে পরিস্ফুট হয়েছে (খোদায়ী) আজ্ঞা পালনে সদিচ্ছা, (কোরবানির) বেদিতে নিজ শির উৎসর্গ, সেই উবূদিয়্যাত ও গোলামির বহিঃপ্রকাশ, যেটি অন্তরে (ঐশী) প্রেমের রাজসিকতা ও রাজত্বের প্রবেশপথের দ্বার উম্মুক্ত করে থাকে।
‘মসনবী শরীফ’-এর কবিতা পাঠকালে মনে রাখা জরুরি শায়খ শামস তাবরিযী (রহ:)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও এ পথে চলা শুরু করার সময় সমাজের কী উচ্চস্থানে মওলানা অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজে মহাসম্মানিত এক ইসলামী জ্ঞান বিশারদ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও ধর্মীয় আইনশাস্ত্রজ্ঞ, অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এগুলো কয়েকটিমাত্র; আর মানুষেরা দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর জ্ঞানগর্ভ ওয়ায শোনার জন্যে সফর করে তাঁর কাছে আসতেন। তাই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন এই পথে পা বাড়াতে গিয়ে তাঁর কতো কিছু হারাবার ছিল।
আমি এই পরিচ্ছেদের কয়েকটিমাত্র ছত্র উদ্ধৃত করবো যাতে আপনারা এর স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হন:
তিনি বলেন, তুমি নও এখনো প্রেমে বাতুল
নও কো এ ঘরানার ফুল
আমি সফর করে হলাম বাতুল
গোলামির বন্ধনে আমূল
তিনি বলেন, তুমি এখনো নও হত
নও কো উচ্ছ্বাসে আপ্লুত
সামনে রেখে তাঁর জীবনদানকারী চেহারা পুতঃ
আমি হলাম হত ও শির অবনত
তিনি বলেন, তুমি হলে শেখ ও সরদার
সমাজের নেতা ও আমীর-রাহবার
আমি রইলাম না আর শেখ ও সরদার
হলাম আপনার হুকুম বরদার
ওপরের ছত্রগুলো বহু ছত্রের কয়েকটিমাত্র, যেগুলোতে মওলানা তাঁর ‘উবূদিয়্যাত’ ও গোলামির বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন।
মওলানা তাঁর নিজের দৃষ্টান্ত থেকে আমাদেরকে কী শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, তা কেবল গভীর মনোযোগ দ্বারাই আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এই কাব্যের সৌন্দর্য উপভোগ করাই যথেষ্ট নয়, কেননা তা তাঁর কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয় এবং তাঁর এখানে অবস্থানেরও কারণ নয়। নফস (একগুঁয়ে সত্তা) দমনের এ সকল স্তর পেরিয়ে তিনি পরবর্তী স্তরে উপনীত হয়েছেন, আর তা তিনি ১৩ নং পংক্তিতে ব্যাখ্যা করেন এভাবে:
আমার অন্তর অনুভব করে আত্মার রক্তিমাভা
হৃদ-রাজ্য হয় উম্মুক্ত ও ভেঙ্গে টুকরা
আমার অন্তর বুনে এক নতুন রেশমের জামা
অতঃপর এই জীর্ণ পুরোনোটির সাথে আমার বৈরিতা
কাব্যের এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। একগুঁয়ে সত্তাকে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করার পর এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তিনি পৌঁছেন যখন রূহ তথা আত্মার আলো তাঁর অন্তরকে বিদীর্ণ করে এবং তিনি এক নতুন জামা বুনেন যা চকচকে মিহি রেশমের তৈরি। ঠিক এই পর্যায়েই তিনি তাঁর পুরোনো জামাটি কতোটুকু জীর্ণ-শীর্ণ তা উপলব্ধি বা অবলোকন করতে সক্ষম হন। আর তাই তিনি ওই জীর্ণ পোষাকের সাথে শত্রুতা পোষণ করেন।
মওলানাকে যখন নতুন জামাটি পরানো হলো, তখনই তিনি উপলব্ধি করলেন তিনি যে জামাটি আঁকড়ে ধরেছিলেন তা কতো বাজে। এখানে তিনি উচ্চতম মকামে উন্নীত হবার পর্যায়গুলো সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন; কেননা উচ্চ মকামের সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পৌঁছার পরই কেবল কেউ খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানের আলো দ্বারা নিচের ধাপের বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, এটি-ই সেই আলো/জ্যোতি যা মওলানা অন্বেষণ করেছেন এবং সব কিছুই (খোদায়ী) এই নূরের ওপর নির্ভরশীল।
আধ্যাত্মিক জগতে সফরের ধাপগুলো আমাদেরকে এমন (মর্যাদাবান) হবার জন্যে প্রস্তুত করে থাকে যাকে মওলানা আখ্যা দিয়েছেন ’নূর পাযির’, অর্থাৎ, ঐশী জ্যোতি ধারণক্ষম। এই নূর অনুপস্থিত নয় যে বাস্তবতায় পৌঁছার জন্যে আমাদেরকে তা খুঁজতে হবে। এই বাস্তবতা, এই নূর সব সময়েই বর্তমান, কিন্তু আমাদের চোখ পর্দার কারণে তা দেখতে অক্ষম। এ কারণেই মওলানা ওই পর্যায়গুলো অতিক্রম করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জনকারী কেউ একজন হিসেবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন:
এ মুহূর্ত হতে আমরা আপনার দরবারে ওই চোখ যাচি
এ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু নাহি
যাতে খড়-কুটো ও কাঠি
সমুদ্রকে আমাদের থেকে আড়ালে না পায় কামিয়াবি
অতঃপর পরবর্তী পর্যায়ে ২০তম পংক্তিতে মওলানা আরও এক ধাপ এগোন এবং বলেন:
ওহে কীর্তিমান চন্দ্র, আমি তোমা হতে
দৃষ্টি ফেরাও আমাতে ও তোমাতে
তোমার-ই হাসির অসিলাতে
আমি পরিণত হাস্যোজ্জ্বল পুষ্পপূর্ণ বাগিচাতে
এই পংক্তিতে প্রতিফলিত হয় রূহ তথা আত্মার মাকাম যা খোদাতা’লার আয়নাসদৃশ; আর এ আয়না যতো স্বচ্ছ হবে, ততোই এতে চেহারা দর্শনকারীর মুখাবয়ব স্বচ্ছভাবে ফুটে উঠবে। আমরা জানি, নফস তথা একগুঁয়ে সত্তার সর্বোত্তম পরিশুদ্ধি হলো নিয়ন্ত্রণকারী সত্তা ও দোষারোপকারী সত্তার বিকৃতি থেকে মুক্তি লাভ এবং প্রশান্ত সত্তায় পরিণতি, আর আল্লাহর প্রতিফলনকারী আয়নায় রূপান্তরও। মওলানা ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী এখানে তুলে ধরেছেন। সূফীবাদের ভিত্তি-ই হলো নফসের পরিশুদ্ধি। তাই মওলানা এই ছত্রে বলেন:
আমাকে দেখা বাস্তবে আপনাকেই (খোদাকে) দেখা
কেননা আমি ওই আয়না
আপনার (সন্তুষ্টিসহ) আমাকে দেখে হাসা
আমাকে বানিয়েছে হাস্যোজ্জ্বল পুষ্পপূর্ণ বাগিচা
এই পংক্তিটি আল-কুরআনের একটি আয়াতের সার-সংক্ষেপ, যেখানে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার প্রতি খুশি হয়ে বলেন:
”হে শান্তিময় প্রাণ! নিজ প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাও এমনিভাবে যে, তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; অতঃপর আমার খাস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, এবং আমার জান্নাতে এসো।” [সূরা ফজর, ২৭-৩০ আয়াত]
আমরা এবার শুধু এই দর্শনে দীক্ষিত সমঝদার মানুষের কাছে বোধগম্য কাব্যিক বর্ণনাগুলোকে জোড়া দেবো। অন্তর বিদীর্ণ হয়ে উম্মুক্ত হওয়ার পর যখন রেশমের নতুন এই বস্ত্র পরিধান করানো হয় এবং ’সালেক’ (এই পথের পথিক) আয়নায় তাকান, তখন আসলে কে আয়নার দিকে তাকাচ্ছেন? এটি সে সময়, যখন আয়নায় চেহারা দর্শনকারী যা দেখেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে হাসেন, আর বলেন (কুরআনের ভাষায়) “আমার জান্নাতে এসো”; জান্নাত নয়, বরং ’আমার জান্নাত’ এবং ওই সন্তুষ্টির হাসি তাঁর সমগ্র সত্তায় প্রতিধ্বনিত হয়।
আমি মনে করি, মওলানা রূমী (রহ:)-এর বাণী ও কাব্য বিগত ৮০০ বছর যাবত - এবং এর আদি ও অকৃত্তিম রূপ বজায় রাখা সাপেক্ষে ভবিষ্যতেও - এমন জীবন্ত থাকার পেছনে একটি কারণ হলো, এগুলো ঐশী প্রেম ও উবূদিয়্যাত (গোলামি)-এর বাণী প্রচার করে, যে রজ্জুর অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ, স্পষ্ট ও গোপন বিষয়গুলো মানুষকে আল্লাহতা’লার সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
মওলানা ৮০০ বছর আগে এ ব্যাপারে আগাম বলেন:
আমার দেহের সমাধিস্থল কেন হয়েছে দুনিয়াবাসীর তীর্থস্থান?
কেননা দিবারাত্রি এ স্থানের সর্বত্র পূর্ণ করছে তাঁর (খোদার) অবস্থান
ঐশী প্রেম ও গোলামির এই বাণী দু’দিক ধারালো একখানা তরবারির মতো, যা নফস তথা একগুঁয়ে সত্তার বাধাকে কেটে এশী প্রেমের দ্বার খুলে দেয়; আর এর সমর্থনে রয়েছে আল্লাহ পাকের ক্ষমতা ও এরাদা (ইচ্ছে)। মহান প্রভু মওলানাকে এটি বলার ভাষা দিয়েছেন এবং তিনি বলেন:
আমি হলাম হক্ক (প্রভু)-এর বাণী এবং তাঁরই মাধ্যমে বিদ্যমান
আমি-ই আত্মার আত্মার খোরাক এবং পরিশুদ্ধির মানিকরতন
আমি হলাম সূর্যের কিরণ, তোমাদের প্রতি করি বিচ্ছুরণ
তবুও সূর্য হতে আমার নেই কোনো পৃথকীকরণ
মওলানার হায়াতে জিন্দেগীর শুরু থেকে শেষ অবধি, বিশেষ করে হযরত শামস তাবরিয়ী (রহ:)-এর সোহবত তথা সান্নিধ্যের দিকে তাকালে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে তাঁকে এই উদ্দেশ্যেই বেছে নেয়া, তৈরি ও নিযুক্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য সূফীগুরুও এই পথে হেঁটেছেন, কিন্তু মনে হয় আল্লাহতা’লা মওলানার ব্যক্তিগত সফরকে আমাদের সামনে এমনভাবে প্রদর্শন করেছেন যাতে আমরা এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি এবং যাতে স্বয়ং মওলানার কাছ থেকেই তা দেখতে ও শুনতে পারি। কেউ শরীয়ত ও তরীকতের পথে হেঁটে হাকীকতে পৌঁছুলে এবং নিজের নফসের জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করলে কী ঘটতে পারে?
মানুষকে বিমোহিতকারী ও অন্তরের গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া মওলানার এ বাণী তাঁর মাহবুব বা প্রেমাস্পদ খোদাতা’লার সুঘ্রাণ হতেই নিঃসৃত।
খোদার সুরা ঢালার ও সুরা পানের পাত্র আমি
আমি-ই তাঁর সুগন্ধি বণ্টনকারী
আমার দিকে এসো ত্বরা করি
যাতে তোমরা পেতে পারো তাঁর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সুগন্ধি
আমাদের কাছে তোমরা শুনেছ যে বাণী
জেনো সে বাণী ঐশী
কেননা, আমরা যা কিছু বলি
সবই তাঁর (খোদায়ী) বাণী
----সমাপ্ত----
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[আমার পীর ও মোর্শেদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী আলহাজ্জ্ব সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত]
মওলানা জালালউদ্দীন মৌলাভী, যাঁকে পশ্চিমা বিশ্ব ‘রূমী’ নামে চেনে, তিনি পরিচিত ঐশী প্রেমের দূত হিসেবেও - যে খোদায়ী এশক সমস্ত সৃষ্টিজগত ও জীবসত্তার ধমনীতে স্পন্দিত, আল্লাহতা’লার বাণী মোতাবেক যে প্রেমের কারণে এই সৃষ্টিজগতের উৎপত্তি। ‘গুপ্ত ভাণ্ডার’ নামে খ্যাত হাদীসে কুদসীতে হযরত দাউদ (আ:) মহান আল্লাহতা’লাকে এই বিশ্বজগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এমতাবস্থায় তিনি তা ব্যক্ত করেন, “আমি ছিলাম রহস্যের গুপ্ত ভাণ্ডার; অতঃপর আমি ভালোবাসলাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে। তাই আমি সৃষ্টি করলাম এই বিশ্বজগত, নিজেকে পরিচিত করানোর জন্যে।” অতএব, এই হাদীসে কুদসীর মর্ম অনুযায়ী জগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহকে জানা, আর মাধ্যম হলো মহব্বত।
আমরা খৃষ্টধর্মের শীর্ষ আজ্ঞানামা ‘গসপেল’-এর বিভিন্ন বর্ণনায়ও অনুরূপ একটি বার্তা দেখতে পাই, যা’তে যীশু খৃষ্ট (ঈসা মসীহ আলাইহিস্ সালাম) এই ঐশী প্রেমকে চূড়ান্ত খোদায়ী বিধান আখ্যায়িত করেছেন; তিনি বলেন: “তোমরা তোমাদের প্রভু, তোমাদেরই খোদাকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসবে, পুরো আত্মা এবং গোটা মস্তিষ্ক দিয়ে ভালোবাসবে ।” এই ঐশী প্রেমের অভিজ্ঞতা-ই সকল সূফী-গুরু সঞ্চয় করেন, এ ব্যাপারেই কখা বলেন এবং লেখালেখি করেন; যে বিষয়টিতে মওলানা রূমী (রহ:) সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন এবং এর মধ্যমণি ও তার প্রতিবিম্বতে পরিণত হয়েছিলেন।
মওলানা আবদুর রহমান জামী’ (রহ:), যিনি ১৫ শতকের পারসিক সূফী কবি, তিনি মওলানা সম্পর্কে বলেন:
ওই মহৎ গুণ
আমি কীভাবে করিবো বর্ণন
তিনি নন কোনো নবী
তবু তাঁর আছে একখানি বহি
অন্যত্র তিনি বলেন:
মওলানার ‘মসনবী’ কেতাব
যেন কুরআনের ফারসী অবয়ব
আল-কুরআন ও মসনবী শরীফের মধ্যে এ ধরনের অনেক উপমা দেয়া হয়েছে, যথা - অনেক অন্তর্নিহিত অর্থে পরিপূর্ণ ঘটনা ও সেগুলোর বিন্যাস সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি। এটিও একইভাবে বিশ্বাস করা হয়, আল-কুরআনের প্রারম্ভিক সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াত যেমন সমস্ত কুরআনের সার-সংক্ষেপ, তেমনি মসনবী শরীফের সূচনার ১৮টি পংক্তিও ওর আনুমানিক পঁচিশ হাজার পংক্তির সার-সংক্ষেপ। এ সব উপমা মওলানা রূমী (রহ:)-এর বাণী কতো উচ্চ মকামের তা ইঙ্গিত করে।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে আমি মওলানা রূমী (রহ:)-এর কথাবার্তা প্রায় হুবহু উদ্ধৃত করবো; তবে এখানে বলা দরকার যে নিকোলসনের পরলোক গমনের পর হতে এ যাবতকালে মওলানার বাণী খুঁজে পাওয়াটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকাল মওলানা রূমী (রহ:)-এর পদ্যে তাঁর বাণীর অংশ খুব কমই থাকে; পক্ষান্তরে, অনুবাদক ও লেখকদের সম্পর্কেই বিশদ বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। তাই আমি মনে করি সবার জন্যে সবচেয়ে ভাল হয় যদি মওলানার নিজস্ব বাণী নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়। আমি আরও যোগ করতে চাই, এ রকম যে ঘটবে তা মওলানা জানতেন, আর সে জন্যে তিনি ’মসনবী’র সূচনার ৬ষ্ঠ পংক্তিতে এ ব্যাপারে আগাম সতর্ক করেছিলেন।
মওলানা সূচনায় বলেন:
শোনো, এই বাঁশি কেমনে ব্যক্ত করে কাহিনী যতো
বিরহ-জ্বালায় এটি সদা বিলাপরত
এই সূচনা-পংক্তিতে মওলানা নিজেকে বাঁশির সাথে তুলনা করেছেন, যে বাঁশি ঐশী প্রেম-মুর্ছনা তথা ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম’-এর সুর বাজিয়ে আমাদেরকে বিরহ-বেদনার কাহিনী শোনাবে।
’আলাসতু বি রাব্বিকুম’ বাক্যটি বর্ণিত হয়েছে আল-কুরআনে (৭:১৭২), যার তাফসীরে বিবৃত হয়েছে যে সৃষ্টির প্রাকলগ্নে, মানে পৃথিবীতে জীবন শুরুর আগে আল্লাহ পাক সকল রূহ (আত্মা)-কে ডেকে পাঠান এবং সমগ্র মানব জাতিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম?’
অর্থাৎ, আমি কি তোমোদের প্রভু নই? সবাই উত্তর দেয়, ‘বালা শাহিদনা’, অর্থাৎ, জ্বি, আমরা তা সাক্ষ্য দিচ্ছি।
এটি প্রতীয়মান হয় যে মওলানার সমগ্র কাব্য ও মুর্ছনায় ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম’-এর মূল সুরের স্মৃতিচারণ ও উপলব্ধি অন্তর্নিহিত; যেমনটি তিনি বলেন:
যেহেতু তিনি আমার আত্মার কানে ‘আলাসতু’র গোপন রহস্য করেন ব্যক্ত
তাই আমার হৃদ-রাজ্য হতে তাঁর নৈকট্যের আকাঙ্ক্ষা হয় না তিরোহিত
কিন্তু এই উপলব্ধি যা আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তা কোনো সহজ কাজ নয়; আর তা সহজে প্রাপ্তিসাধ্যও নয়। ফলে আমরা একে আমাদের নিজস্ব বুঝ ও সমঝ অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করি। মসনবী শরীফের সূচনার ৬ষ্ঠ ছত্রে মওলানা এ ব্যাপারে বলেন:
সবাই আমার সাথী হয়েছে নিজস্ব সমঝ মোতাবেক
কেউই জানতে চায় নি আমার গোপন রহস্য ও নানা ভাবনার উদ্রেক
এর অব্যবহিত পরেই তিনি বলেন:
আমার এই সরব আর্তি থেকে নয়কো দূর আমারই গোপন রহস্য
কিন্তু তা দেখার বা শোনার মতো জ্যোতি কারো নেই অবশ্যঅবশ্য
এই ’নূর’ (জ্যোতি) কী জিনিস, রহস্য জানার ক্ষেত্রে সাধারণ চোখে যা দেখা যায় না এবং কানেও শোনা যায় না? এর উত্তর খুঁজতে চলুন স্বয়ং মওলানার দ্বারস্থ হই, যেহেতু তিনি বলেছেন তাঁর বইতে তিনি সব কিছু প্রকাশ করেছেন - কখনো ব্যাখ্যা দ্বারা, কখনো বা পরোক্ষ উল্লেখ করে, আবার কখনো ইশারায়। তা কেন? তাঁর ব্যাখ্যা শুনুন:
গোপন রহস্যগুলো ছত্রে ছত্রে লুক্কায়িত
যা আমি আরও স্পষ্ট বল্লে দুনিয়ার নিয়ম হবে ব্যাহত
আরেক কথায়, সবাই যদি সত্য/বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পারতো, তাহলে কেউই আর দুনিয়ার কাজ-কর্মে নিমগ্ন হতো না। এ কারণেই আলোকিত মানবের সংখ্যা সব সময়েই খুব কম হয় সর্বসাধারণের তুলনায়। আল-কুরআনও বার বার তাই এরশাদ ফরমায়, “স্বল্প সংখ্যক-ই জানবে”, অথবা “স্বল্প সংখ্যক-ই উপলব্ধি করবে”, কিংবা ”স্বল্প সংখ্যক-ই চিন্তা করবে” ইত্যাদি।
মওলানার পূর্ববর্তী শ্লোকে ফেরা যাক:
আমার এই সরব আর্তি থেকে নয়কো দূর আমারই গোপন রহস্য
কিন্তু তা দেখার বা শোনার মতো জ্যোতি কারো নেই অবশ্যঅবশ্য
এই নূর বা জ্যোতি দর্শন ও শ্রবণে আমাদেরকে কিসে বাধা দিচ্ছে সে সম্পর্কে জানার আগ্রহে চলুন আবারও মওলানার শরণাপন্ন হই; তিনি বলেন:
মানবচক্ষে বসানো ঠুলি গৌণ বিষয়ে রেখেছে তাদের আবদ্ধ
এই গৌণের উর্ধ্বে না উঠলে ’আসহাব’-বৃন্দের অন্তর্ভুক্ত হবার দ্বার রুদ্ধ
অতএব, মওলানা যে দর্শনক্ষমতার কথা বলেছেন, তা হলো বাস্তবতাকে দেখতে সক্ষম চোখ; আর তা মানুষ, বস্তুগত জগৎ, এবং সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বাধা নফস (নিজের একগুঁয়ে সত্তা) দ্বারা যেন পর্দায় আবৃত না হয়। আমাদের এমন দর্শনক্ষমতা প্রয়োজন যা গৌণ বিষয়ের উর্ধ্বে উঠে মুখ্য বিষয়টি অবলোকন করতে সক্ষম। মওলানা বলেন:
আমি এমন চক্ষু চাই যা রাজাধিরাজকে জানতে সক্ষম
যাতে তাঁর বিভিন্ন বেশভূষায় তাঁকে চেনার উপায় হয় মোক্ষম
কেউ এ চোখ কীভাবে লাভ করতে পারে? মওলানা সূফী-দরবেশদের পথে সফর করতে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন:
সূফী-দরবেশদের মালিকানায় যে সুরমা, তা করো অন্বেষণ
যাতে তোমাদের দৃষ্টিশক্তির সরু জলধারা হয় মহাসাগরে পরিবর্তন
আমাদের সাথে সর্বদা বিরাজমান এই পর্দাটি কী এবং কেনই বা তা আমাদের সামনে বাস্তবতা সম্পর্কে ভিন্ন বিবরণ তুলে ধরে? অথচ এই বিবরণকে আমরা সত্য বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। (একগুঁয়ে) সত্তা কী এবং কীভাবে তা আমাদেরকে সত্য ও বাস্তবতা উপলব্ধিতে বাধা দিয়ে থাকে?
সুফী মনঃস্তত্ত্ব আমাদেরকে এর গভীরে যেতে সহায়তা করতে পারে। মনোবিদ্যা আমাদেরকে বলে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা স্নায়ুচাপের কারণে স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা যারা হারিয়ে ফেলে, তারা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বাস্তবতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বা অবাস্তব চিন্তা পোষণ করে থাকে। কিন্তু মনোবিদ্যার দৌড় ওই পর্যন্তই। পক্ষান্তরে, সূফী-দরবেশদের মনঃস্তত্ত্ব আরও অগ্রসর হয় এবং এর ক্ষেত্র-ও সম্প্রসারিত হয়, যার ফলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের বাস্তবতাসম্পর্কিত ধারণা আধ্যাত্মিক জগতে যাত্রাকারী সূফী-দরবেশদের কাছে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও ভ্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
মওলানা যখন আমাদেরকে বলেন সূফী-দরবেশদের পথে যাত্রা করতে, যাতে আমাদের দৃষ্টি সুপ্রসারিত হয়, তখন তিনি দর্শনক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করেন। কেননা, আলোকিত মানব যা দেখতে পান এবং উপলব্ধি করেন, তা অধিকাংশ মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। আধ্যাত্মিকতার আলোয় উদ্ভাসিতজন তাঁদের প্রাপ্ত আলোকোচ্ছ্বটার অংশ অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রায় অদৃশ্য জ্ঞান পেয়ে থাকেন।
অতএব, আমাদেরকে বোঝতে হবে যে দৃষ্টিশক্তির প্রকারভেদ রয়েছে; আর এও অনুধাবন করতে হবে যে আমাদের অহংবোধ কতোটুকু সীমাবদ্ধ এবং তাই সেটিকে চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসেবে না মনে করা আমাদের কর্তব্য। আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা যা চিন্তা করি এবং দেখি তা চূড়ান্ত নয়, এর বাইরেও আরেকটি দৃষ্টিক্ষমতা আছে যার জন্যে প্রয়োজন সূফী পথে পরিভ্রমণ ও অহংবোধের চেতনার উর্ধ্বে ওঠা।
আমি এই চোখ, দৃষ্টিক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিষয়টিকে আরেকটি দৃষ্টিকোণ্ থেকে দেখতে চাই। কেননা, ’মসনবী’র মহাসাগরে যেদিকে তালাশ করি না কেন, সেখানেই বিভিন্ন ধরনের মুক্তা আমরা খুঁজে পাই। ওই মুক্তাগুলো একত্রিত করার পরই কেবল পুরো গলার হার আমরা দেখতে পাই।
এক্ষণে আমরা মওলানার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও পছন্দনীয় কবিতা তথা ’গযল’ তাঁর ‘দেওয়ানে শামসে তাবরিয’ থেকে বেছে নেবো। প্রথম পংক্তি নিম্নরূপ:
আমি ছিলাম মৃত, অতঃপর হলাম জীবন্ত
ছিলাম অশ্রুজল, হলাম হাসিতে পরিণত
ভালোবাসা বিস্তার করলো (আমা মাঝে) রাজত্ব
সম্রাট হিসেবে পেলাম আমি চির স্থায়িত্ব
এমনি এক সূচনা যা’তে মৃত অবস্থা থেকে জিন্দা হয়ে, কান্না থেকে হাসিতে রূপান্তরিত হয়ে, ভালোবাসার রাজত্বে পৌঁছে এবং তাকে স্থায়ী সাম্রাজ্যে পরিণত করে - সব একই ছত্রে প্রকাশ করে - মওলানা যেন আমাদের বলছেন: তোমরা কি এখন আমার সাথে এই সফরে শরীক হবে? আর যেহেতু এই আমন্ত্রণের আসল উৎস ’হু’ তথা হক্ক সোবহানাহু ওয়া তা’লা স্বয়ং, যিনি মওলানার পবিত্র জবান দ্বারা কথা বলছেন, সেহেতু আমরাও বলি, ‘জ্বি’। অতঃপর আমরা যখন জিজ্ঞেস করি, ’কীভাবে হবো এই সফরে শরীক’, তখন আমরা সেই একই জবাব শুনতে পাই যা শায়খ মহিউদ্দীন ইবনে আরবী (রহ:) শুনেছিলেন আল্লাহর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ আলাপের কোনো একটিতে, যেখানে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ’কেউ আপনার নৈকট্য কীভাবে পেতে পারে?’ আর আল্লাহ জবাব দিয়েছিলেন, ‘এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে যা আমার নেই।’ মানে ’উবুদিয়্যাত’ তথা গোলামি দ্বারা।
এই কারণেই মওলানা তাঁর কাব্যের পরবর্তী দশটি পংক্তি, যথা - ৩ থেকে ১২ পংক্তিতে, তাঁর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ উবূদিয়্যাত-এর পর্যায়গুলোর বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেন ও বিশদ চিত্র আঁকেন। তিনি সার্বিকভাবে সূফী পথের স্তরগুলো, এবং বিশেষভাবে নিজ পীর শামস তাবরিযী (রহ:)-এর সাথে তাঁর সোহবতের ধাপগুলোকে একই সূত্রে গেঁথেছেন, যা’তে পরিস্ফুট হয়েছে (খোদায়ী) আজ্ঞা পালনে সদিচ্ছা, (কোরবানির) বেদিতে নিজ শির উৎসর্গ, সেই উবূদিয়্যাত ও গোলামির বহিঃপ্রকাশ, যেটি অন্তরে (ঐশী) প্রেমের রাজসিকতা ও রাজত্বের প্রবেশপথের দ্বার উম্মুক্ত করে থাকে।
‘মসনবী শরীফ’-এর কবিতা পাঠকালে মনে রাখা জরুরি শায়খ শামস তাবরিযী (রহ:)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও এ পথে চলা শুরু করার সময় সমাজের কী উচ্চস্থানে মওলানা অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজে মহাসম্মানিত এক ইসলামী জ্ঞান বিশারদ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও ধর্মীয় আইনশাস্ত্রজ্ঞ, অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এগুলো কয়েকটিমাত্র; আর মানুষেরা দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর জ্ঞানগর্ভ ওয়ায শোনার জন্যে সফর করে তাঁর কাছে আসতেন। তাই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন এই পথে পা বাড়াতে গিয়ে তাঁর কতো কিছু হারাবার ছিল।
আমি এই পরিচ্ছেদের কয়েকটিমাত্র ছত্র উদ্ধৃত করবো যাতে আপনারা এর স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হন:
তিনি বলেন, তুমি নও এখনো প্রেমে বাতুল
নও কো এ ঘরানার ফুল
আমি সফর করে হলাম বাতুল
গোলামির বন্ধনে আমূল
তিনি বলেন, তুমি এখনো নও হত
নও কো উচ্ছ্বাসে আপ্লুত
সামনে রেখে তাঁর জীবনদানকারী চেহারা পুতঃ
আমি হলাম হত ও শির অবনত
তিনি বলেন, তুমি হলে শেখ ও সরদার
সমাজের নেতা ও আমীর-রাহবার
আমি রইলাম না আর শেখ ও সরদার
হলাম আপনার হুকুম বরদার
ওপরের ছত্রগুলো বহু ছত্রের কয়েকটিমাত্র, যেগুলোতে মওলানা তাঁর ‘উবূদিয়্যাত’ ও গোলামির বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন।
মওলানা তাঁর নিজের দৃষ্টান্ত থেকে আমাদেরকে কী শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, তা কেবল গভীর মনোযোগ দ্বারাই আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এই কাব্যের সৌন্দর্য উপভোগ করাই যথেষ্ট নয়, কেননা তা তাঁর কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয় এবং তাঁর এখানে অবস্থানেরও কারণ নয়। নফস (একগুঁয়ে সত্তা) দমনের এ সকল স্তর পেরিয়ে তিনি পরবর্তী স্তরে উপনীত হয়েছেন, আর তা তিনি ১৩ নং পংক্তিতে ব্যাখ্যা করেন এভাবে:
আমার অন্তর অনুভব করে আত্মার রক্তিমাভা
হৃদ-রাজ্য হয় উম্মুক্ত ও ভেঙ্গে টুকরা
আমার অন্তর বুনে এক নতুন রেশমের জামা
অতঃপর এই জীর্ণ পুরোনোটির সাথে আমার বৈরিতা
কাব্যের এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। একগুঁয়ে সত্তাকে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করার পর এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তিনি পৌঁছেন যখন রূহ তথা আত্মার আলো তাঁর অন্তরকে বিদীর্ণ করে এবং তিনি এক নতুন জামা বুনেন যা চকচকে মিহি রেশমের তৈরি। ঠিক এই পর্যায়েই তিনি তাঁর পুরোনো জামাটি কতোটুকু জীর্ণ-শীর্ণ তা উপলব্ধি বা অবলোকন করতে সক্ষম হন। আর তাই তিনি ওই জীর্ণ পোষাকের সাথে শত্রুতা পোষণ করেন।
মওলানাকে যখন নতুন জামাটি পরানো হলো, তখনই তিনি উপলব্ধি করলেন তিনি যে জামাটি আঁকড়ে ধরেছিলেন তা কতো বাজে। এখানে তিনি উচ্চতম মকামে উন্নীত হবার পর্যায়গুলো সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন; কেননা উচ্চ মকামের সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পৌঁছার পরই কেবল কেউ খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানের আলো দ্বারা নিচের ধাপের বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, এটি-ই সেই আলো/জ্যোতি যা মওলানা অন্বেষণ করেছেন এবং সব কিছুই (খোদায়ী) এই নূরের ওপর নির্ভরশীল।
আধ্যাত্মিক জগতে সফরের ধাপগুলো আমাদেরকে এমন (মর্যাদাবান) হবার জন্যে প্রস্তুত করে থাকে যাকে মওলানা আখ্যা দিয়েছেন ’নূর পাযির’, অর্থাৎ, ঐশী জ্যোতি ধারণক্ষম। এই নূর অনুপস্থিত নয় যে বাস্তবতায় পৌঁছার জন্যে আমাদেরকে তা খুঁজতে হবে। এই বাস্তবতা, এই নূর সব সময়েই বর্তমান, কিন্তু আমাদের চোখ পর্দার কারণে তা দেখতে অক্ষম। এ কারণেই মওলানা ওই পর্যায়গুলো অতিক্রম করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জনকারী কেউ একজন হিসেবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন:
এ মুহূর্ত হতে আমরা আপনার দরবারে ওই চোখ যাচি
এ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু নাহি
যাতে খড়-কুটো ও কাঠি
সমুদ্রকে আমাদের থেকে আড়ালে না পায় কামিয়াবি
অতঃপর পরবর্তী পর্যায়ে ২০তম পংক্তিতে মওলানা আরও এক ধাপ এগোন এবং বলেন:
ওহে কীর্তিমান চন্দ্র, আমি তোমা হতে
দৃষ্টি ফেরাও আমাতে ও তোমাতে
তোমার-ই হাসির অসিলাতে
আমি পরিণত হাস্যোজ্জ্বল পুষ্পপূর্ণ বাগিচাতে
এই পংক্তিতে প্রতিফলিত হয় রূহ তথা আত্মার মাকাম যা খোদাতা’লার আয়নাসদৃশ; আর এ আয়না যতো স্বচ্ছ হবে, ততোই এতে চেহারা দর্শনকারীর মুখাবয়ব স্বচ্ছভাবে ফুটে উঠবে। আমরা জানি, নফস তথা একগুঁয়ে সত্তার সর্বোত্তম পরিশুদ্ধি হলো নিয়ন্ত্রণকারী সত্তা ও দোষারোপকারী সত্তার বিকৃতি থেকে মুক্তি লাভ এবং প্রশান্ত সত্তায় পরিণতি, আর আল্লাহর প্রতিফলনকারী আয়নায় রূপান্তরও। মওলানা ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী এখানে তুলে ধরেছেন। সূফীবাদের ভিত্তি-ই হলো নফসের পরিশুদ্ধি। তাই মওলানা এই ছত্রে বলেন:
আমাকে দেখা বাস্তবে আপনাকেই (খোদাকে) দেখা
কেননা আমি ওই আয়না
আপনার (সন্তুষ্টিসহ) আমাকে দেখে হাসা
আমাকে বানিয়েছে হাস্যোজ্জ্বল পুষ্পপূর্ণ বাগিচা
এই পংক্তিটি আল-কুরআনের একটি আয়াতের সার-সংক্ষেপ, যেখানে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার প্রতি খুশি হয়ে বলেন:
”হে শান্তিময় প্রাণ! নিজ প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাও এমনিভাবে যে, তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; অতঃপর আমার খাস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, এবং আমার জান্নাতে এসো।” [সূরা ফজর, ২৭-৩০ আয়াত]
আমরা এবার শুধু এই দর্শনে দীক্ষিত সমঝদার মানুষের কাছে বোধগম্য কাব্যিক বর্ণনাগুলোকে জোড়া দেবো। অন্তর বিদীর্ণ হয়ে উম্মুক্ত হওয়ার পর যখন রেশমের নতুন এই বস্ত্র পরিধান করানো হয় এবং ’সালেক’ (এই পথের পথিক) আয়নায় তাকান, তখন আসলে কে আয়নার দিকে তাকাচ্ছেন? এটি সে সময়, যখন আয়নায় চেহারা দর্শনকারী যা দেখেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে হাসেন, আর বলেন (কুরআনের ভাষায়) “আমার জান্নাতে এসো”; জান্নাত নয়, বরং ’আমার জান্নাত’ এবং ওই সন্তুষ্টির হাসি তাঁর সমগ্র সত্তায় প্রতিধ্বনিত হয়।
আমি মনে করি, মওলানা রূমী (রহ:)-এর বাণী ও কাব্য বিগত ৮০০ বছর যাবত - এবং এর আদি ও অকৃত্তিম রূপ বজায় রাখা সাপেক্ষে ভবিষ্যতেও - এমন জীবন্ত থাকার পেছনে একটি কারণ হলো, এগুলো ঐশী প্রেম ও উবূদিয়্যাত (গোলামি)-এর বাণী প্রচার করে, যে রজ্জুর অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ, স্পষ্ট ও গোপন বিষয়গুলো মানুষকে আল্লাহতা’লার সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
মওলানা ৮০০ বছর আগে এ ব্যাপারে আগাম বলেন:
আমার দেহের সমাধিস্থল কেন হয়েছে দুনিয়াবাসীর তীর্থস্থান?
কেননা দিবারাত্রি এ স্থানের সর্বত্র পূর্ণ করছে তাঁর (খোদার) অবস্থান
ঐশী প্রেম ও গোলামির এই বাণী দু’দিক ধারালো একখানা তরবারির মতো, যা নফস তথা একগুঁয়ে সত্তার বাধাকে কেটে এশী প্রেমের দ্বার খুলে দেয়; আর এর সমর্থনে রয়েছে আল্লাহ পাকের ক্ষমতা ও এরাদা (ইচ্ছে)। মহান প্রভু মওলানাকে এটি বলার ভাষা দিয়েছেন এবং তিনি বলেন:
আমি হলাম হক্ক (প্রভু)-এর বাণী এবং তাঁরই মাধ্যমে বিদ্যমান
আমি-ই আত্মার আত্মার খোরাক এবং পরিশুদ্ধির মানিকরতন
আমি হলাম সূর্যের কিরণ, তোমাদের প্রতি করি বিচ্ছুরণ
তবুও সূর্য হতে আমার নেই কোনো পৃথকীকরণ
মওলানার হায়াতে জিন্দেগীর শুরু থেকে শেষ অবধি, বিশেষ করে হযরত শামস তাবরিয়ী (রহ:)-এর সোহবত তথা সান্নিধ্যের দিকে তাকালে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে তাঁকে এই উদ্দেশ্যেই বেছে নেয়া, তৈরি ও নিযুক্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য সূফীগুরুও এই পথে হেঁটেছেন, কিন্তু মনে হয় আল্লাহতা’লা মওলানার ব্যক্তিগত সফরকে আমাদের সামনে এমনভাবে প্রদর্শন করেছেন যাতে আমরা এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি এবং যাতে স্বয়ং মওলানার কাছ থেকেই তা দেখতে ও শুনতে পারি। কেউ শরীয়ত ও তরীকতের পথে হেঁটে হাকীকতে পৌঁছুলে এবং নিজের নফসের জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করলে কী ঘটতে পারে?
মানুষকে বিমোহিতকারী ও অন্তরের গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া মওলানার এ বাণী তাঁর মাহবুব বা প্রেমাস্পদ খোদাতা’লার সুঘ্রাণ হতেই নিঃসৃত।
খোদার সুরা ঢালার ও সুরা পানের পাত্র আমি
আমি-ই তাঁর সুগন্ধি বণ্টনকারী
আমার দিকে এসো ত্বরা করি
যাতে তোমরা পেতে পারো তাঁর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সুগন্ধি
আমাদের কাছে তোমরা শুনেছ যে বাণী
জেনো সে বাণী ঐশী
কেননা, আমরা যা কিছু বলি
সবই তাঁর (খোদায়ী) বাণী
----সমাপ্ত----