মূল: আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ্ তা’লার প্রাপ্য যিনি তাঁর অনুপম করুণাস্বরূপ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। হুজূর পূর নূর (দ:)-এর প্রতি নিবেদন করি অসংখ্য দুরুদ-সালাম। অতঃপর সালাম জানাই তাঁর খাঁটি আহলে বায়ত (পরিবার-পরিজন), আসহাবে কেরাম (সাথীবৃন্দ), আয্ওয়াজে মোতাহহারাত (পবিত্র বিবি সাহেবাবর্গ) ও আউলিয়ায়ে কেরাম (খোদার প্রিয় বান্দা)-বৃন্দের প্রতি। বিশেষ করে আমার পীর ও মুরশিদ চট্টগ্রাম বোয়ালখালীস্থ আহলা দরবার শরীফের পীরে তরীকত সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পাক দরবারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি যাঁর আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি ছাড়া আমি এই অনুবাদ কাজ করতে সক্ষম হতাম না।
তুরস্কের বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহ:) সমসাময়িক কালের তথাকথিত প্রগতিবাদী কিন্তু দ্বীন ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণকারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন আপত্তির জবাব এ প্রবন্ধটিতে উপস্থাপন করেছেন। অল্প কথায় এতো সুন্দর জবাব সত্যি দুর্লভ! আশা করি, পাঠকবৃন্দের কাছে এটি সুখপাঠ্য হবে। অনুবাদে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সর্বান্তকরণে আমি পাঠকমণ্ডলীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহ পাক সকলকে উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন, আমীন! আমার পীর ও মুরশিদ কেবলার ওসীলায় আল্লাহ্ তা’লা এ লেখাটি কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন, সুম্মা আমীন!
দ্বীন জ্ঞানে অজ্ঞ এক ব্যক্তির প্রতি জবাব
রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ করেছেন - “প্রত্যেক শিশুই পৃথিবীতে একটি নিষ্পাপ আত্মা নিয়ে মুসলমান হওয়ার অভিপ্রায়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার পিতা-মাতা পরবর্তী পর্যায়ে তাকে ধর্মহীনতার দিকে টেনে নিয়ে যায়” (আল্ হাদীস)। হাদীসটি পরিস্ফুট করে যে শিশুদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেয়া অত্যাবশ্যক। তাদের খাঁটি ও নির্মল আত্মা ইসলামের জন্যে উৎসর্গিত। ইসলামী শিক্ষাপ্রাপ্ত নয় এমন একজন শিশু ইসলামের শত্রুদের মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসায় বিশ্বাস করে ইসলামকে ভুল বুঝতে পারে। সে ইসলামকে পশ্চাদগতিশীল ও বদ মনে করতে পারে। ইসলামী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তি, যে নাকি ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে নি, সে যদি ইসলামের শত্রুদের ফাঁদে পা দেয়, তবে সে ইসলাম হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন বরং উল্টো বিষয়ই শিক্ষা করবে। তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা শরমহীন মিথ্যা লেখনী এবং বিষাক্ত ধ্যান-ধারণার শিকারে সে পরিণত হবে। সে পৃথিবীতে শান্তি খুঁজে পাবে না। আর পরবর্তী জগতে সে অন্তহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হবে।
যুব সম্প্রদায়কে ধোকা দেয়ার জন্যে দ্বীন ইসলামের শত্রুদের বানানো এ সকল কুৎসা কতো জঘন্য ও হীন তা প্রত্যেক মুসলমান, এমন কি প্রত্যেক ব্যক্তিরই জানা আবশ্যক। এ সব মিথ্যায় বিশ্বাস করে আযাবের মধ্যে ডুবে না যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে হবে এবং এটা যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও নৈতিকতাকে সমর্থন করে এবং অগ্রগতি-প্রগতি, সহযোগিতা, কর্ম উদ্যোগ ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যকে আদেশ করে, তা আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে। ইসলামকে ভালোভাবে এবং সঠিকভাবে অনুধাবনকারী একজন বুদ্ধিমান, সচেতন ও সভ্য ব্যক্তি ইসলামের শত্রুদের তৈরি করা বানোয়াট ও মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করবেন না। তাদেরকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও ধোকাপ্রাপ্ত হীন প্রকৃতির লোক হিসেবে দেখে তিনি তাদের প্রতি করুণা করবেন। তিনি তাদেরকে এই অধঃপতিত অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেয়ে সঠিক পথে ফেরার জন্যে তাদের শুভ কামনা করতে থাকবেন।
আমরা এ রকম দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ এক ব্যক্তির লজ্জাহীনভাবে রচিত কিছু পাতার একটি ছোট পুস্তিকা পেয়েছি, যার মধ্যে সে তার লেখা বিষাক্ত ও অনন্ত দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর মিথ্যাসমূহ সন্নিবেশিত করেছে সৎ ও পবিত্র আত্মাগুলোকে নিজের পরিণতি বরণ করানোর অসৎ উদ্দেশ্যে। লেখকের খেতাব দেখে কর্তৃত্বসম্পন্ন মনে করে যারা ভুল বুঝে, তারা সত্য, সততা ও নৈতিকতাকে কুৎসা রটনাকারী লেখনীটি দেখে হয়তো মনে করতে পারে যে সেটা জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই বুঝি রচিত। লেখনীটির সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও ক্ষতি দূর করার মহৎ লক্ষ্যে আমরা ১২টি অনুচ্ছেদ এই ঘৃণ্য মিথ্যাচারকে জবাব দেয়ার জন্যে উৎসর্গিত করেছি। নির্মল আত্মার যুব সম্প্রদায় এর দ্বারা সত্য উপলব্ধি করে অতি সহজেই ইসলামের শত্রুদের কূট-কৌশল সম্পর্কে অবগত হতে পারবে এবং নিজেদেরকে প্রগতিবাদী দাবিদার সেই সব বুদ্ধিহীন, দুরাত্মা অবিশ্বাসীদেরকে কাছে থেকে চেনতে পারবে।
আপত্তি-১
সে বলেছে, “সামাজিক জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ধর্মীয় দর্শন ও নিয়ম হচ্ছে সামাজিক প্রগতির প্রতিবন্ধক শেকলস্বরূপ।”
জবাব
রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “তোমরা দুনিয়াদারী এমনভাবে সম্পন্ন করতে থাকো যেন তোমাদের মৃত্যু-ই হবে না” (আল্ হাদীস)। ইমাম মানাবী (রহ:) কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস শরীফে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো ঈমানদার ব্যক্তির হারানো সম্পত্তি” (আল্ হাদীস)। তাই মোমেন ব্যক্তির উচিৎ এর সন্ধান পাওয়ামাত্রই তা হস্তগত করা। শত্রু হোক কিংবা মিত্র হোক, বিজ্ঞানের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিত্বই সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেন যে দ্বীন ইসলাম সমাজের প্রগতিকে সমর্থন করে এবং সভ্যতার পথে আলোর মশাল জ্বালায় । উদাহরণস্বরূপ, বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “মুসলমানদের মতো আর কোনো (পৃথিবীতে আগত) জাতি-ই জ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে এতো সম্মান প্রদর্শন করেন নি” (হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও কুরআন মজীদ - Hadrat Muhammad and the Quran শীর্ষক গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১ম অধ্যায়, লন্ডন হতে প্রকাশিত)। তিনি উদাহরণ ও দলিল সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন যে ইসলাম ধর্ম সমাজসমূহকে প্রগতি ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেছে।
১৯৭২ সালে টেক্সাস্ টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ডঃ ক্রিস্ ট্র্যাগ্লোর সাহেব এক বিশাল শ্রোতামণ্ডলীর মাঝে ভাষণদানকালে বলেন যে ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রেরণা ও বিকাশের উৎস ছিল দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানগণ স্পেন ও সিসিলি এসে আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রগতির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁরা শিক্ষা দেন যে রসায়ন, চিকিৎসা, সৌরবিদ্যা, নৌ-বিদ্যা, ভূগোল, মানচিত্র অংকন বিদ্যা, গণিত ইত্যাদি শাস্ত্রে উন্নতি সাধনের মাধ্যমেই প্রগতি অর্জন সম্ভব। অধ্যাপক ট্র্যাগ্লোর সাহেব আরো বলেন যে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে এ সকল জ্ঞানের শাখা মুসলমানগণই নিয়ে এসেছিলেন। তিনি আরো অভিমত প্রকাশ করেন যে আধুনিক প্রকাশনার উন্নতির ক্ষেত্রে প্যাপিরাস পাতা ও জন্তুর মূল্যবান চামড়ার ওপর লিখিত ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ অবদান রেখেছিল। (সাপ্তাহিক মুসলিম বিশ্ব - The Muslim World, পাকিস্তান ২৬ শে আগষ্ট ১৯৭২ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। অতএব, টাইটেল বা খেতাবসম্পন্ন একদম অজ্ঞ ও দুর্নীতিপরায়ণ ইসলামের কোনো শত্রুর মিথ্যা কাহিনীসমূহ এ তথ্যটিকে ধামাচাপা দিতে পারবে না। কেননা, কাদা দিয়ে কখনোই সূর্যকে ঢেকে দেয়া সম্ভব নয়।
আপত্তি-২
সে বলেছে, “ধর্মের শেকল থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা আবশ্যক। সমসাময়িক পশ্চিমা সভ্যতার সমপর্যায়ে যেতে হলে একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা অর্জন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।”
জবাব
দ্বীন ইসলামে ইতিপূর্বে জ্ঞান, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে সম্পূর্ণভাবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইসলাম রাষ্ট্রকে ভাঁওতাবাজ রাজনীতিবিদদের হাতে ক্রীড়নক হওয়া থেকে রক্ষা করে। পুঁজিবাদী গোষ্ঠী, একনায়কতন্ত্রী চক্র এবং সমাজতন্ত্রের সেবাদাস গং এ ধরনের একটি স্বাধীন প্রশাসনকে নিজেদের নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার-অবিচার ও দুর্নীতির জন্যে শেকলস্বরূপ দেখে থাকে। খুনী, চোর ও অসৎ লোকেরা ন্যায়বিচার ও আইনকে নিজেদের জন্যে শৃংখল হিসেবে গণ্য করে থাকে। ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়ে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ এবং ধর্মের ধ্বংস সাধন করার পেছনে এই অবিশ্বাসী লোকটির অজ্ঞতা ও আহাম্মকী সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। এ লোকটি যা চাচ্ছে তা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথকীকরণ নয়, বরং ধর্মের ধ্বংস সাধন। এটা বোধগম্য যে, রাষ্ট্র ও জাতির প্রগতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, কর্ম উদ্যোগ ও নৈতিকতা হতে যে আহাম্মক ব্যক্তিটি আশা করে না, বরং ইসলামের ধ্বংস সাধন করতে চায় যা ওই সকল মাহাত্ম্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং যে নাকি পশ্চিমা দুর্নীতি, অশ্লীলতা ও অহমিকা বোধকে কামনা করে, সে শুধুমাত্র জ্ঞান ও বুদ্ধিশূন্যই নয়, সে নৈতিকতাশূন্যও।
আপত্তি-৩
সে বলেছে, “তুষ্ট থাকার ইসলামী দর্শন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা আশা করে যে মানুষেরা নিজেদের অধিকার আদায় সম্পর্কে সচেতন থাকবে না। সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার অজুহাতে তারা মানুষের ধারণকৃত দাসত্ব ও পরকালের ধ্যান-ধারণাগুলো সমর্থন করে। তুষ্ট থাকা শোষণের একটি বাহন ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামের অনুসারীরা এ শোষণকে প্রচার-প্রসার করছে।”
জবাব
“তুষ্ট থাকার ইসলামী দর্শন” - বাক্যটির মতো এমন উদ্ভট বাক্য খুব কম-ই আছে। আমরা Endless Bliss (অনন্ত কল্যাণ) গ্রন্থে দর্শনের মানে কী তা ব্যাখ্যা করেছি এবং সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি যে দ্বীন ইসলামে কোনো দর্শন থাকতে পারে না। এ ধরনের একটি ভুল বাক্য প্রতিভাত করে, যে ব্যক্তি তা ব্যবহার করে সে ইসলাম ধর্ম অথবা দর্শন সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং সে ব্যক্তি অর্থ না জেনেই বহু বাক্য মুখস্থ করে বাক্যসমূহের পাহাড় গড়ে তুলেছে, যাতে করে সে ইসলামের প্রতি নিজের শত্রুতা বিস্তৃত করতে পারে। বহু শতাব্দী যাবত ইসলামের শত্রুরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের ছদ্মবেশ ধারণ করে সেই মুখোশের অন্তরালে থেকে ক্ষতি সাধন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা উচ্চপদের সনদ লাভ করে বিভিন্ন পেশা ও শিল্পকলার ছদ্মাবরণে ইসলামকে আক্রমণ করছে। সেই মিথ্যুক লোকেরা যারা মুসলমানদেরকে ধোকা দেয়ার জন্যে নিজেদেরকে বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দেয় এবং নিজেদের অবৈজ্ঞানিক কথাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান হিসেবে পেশ করে, তাদেরকে বলা হয় “বিজ্ঞানী ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ।” শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক জাতির নীতিগ্রন্থেই তুষ্ট থাকাকে প্রশংসা করা হয়েছে। এই বিজ্ঞানী ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ লোকটি যা বানিয়ে নিয়েছে তার ঠিক বিপরীত অর্থে, তুষ্ট থাকা হচ্ছে নিজ অধিকার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, নিজ আয়ের ওপর রাজি থাকা এবং অন্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। এটা মানুষদেরকে অলস বানিয়ে দেয় না, বরং কাজ করে প্রগতি অর্জনে উৎসাহ যোগায়। এই ধোকাবাজের মিথ্যাচারের ঠিক বিপরীত অর্থে, দ্বীন ইসলাম দাসত্বকে সমর্থন করে না, বরং দাসদের মুক্তির আদেশ দেয়। দাসত্ব ইসলামে নয়, বরং একনায়কতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিরাজমান। আসমানী কেতাবসমূহ এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ:) যাঁদের অলৌকিক ক্রিয়া (মা’জেযা) পরিদৃষ্ট হয়েছে, তাঁরা পরবর্তী জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর দিয়েছেন; জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিজ্ঞান তা অস্বীকার করতে পারবে না। এই বিচ্যুত অজ্ঞ লোকটির কথাবার্তা একদম একগুঁয়ে ও আবেগ-তাড়িত। সে কোনো কিছুর উদ্ধৃতিও দিচ্ছে না, আবার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিরও শরণাপন্ন হচ্ছে না। পরকালে বিশ্বাস সমাজ ও রাষ্ট্রে নিয়ম, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। এতে অবিশ্বাস আলস্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অহংবোধ, উচ্ছৃংখলতা, ফিতনা ও শত্রুতার দ্বার উন্মোচিত করে। উপকারী কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করা সব সময়ই ভালো। ভিত্তিহীন ও ব্যর্থ কোনো জিনিসকে বর্জন করা যুক্তিসঙ্গত এবং প্রয়োজনীয়। ইসলাম শোষণ ও ব্যক্তি অধিকার খর্ব করাকে সমর্থন করে না। যেহেতু শোষণ একটি পাপ, সেহেতু কারো ক্ষতি সাধনকে অনুমোদন করার কোনো অনুমতি-ই নেই। ইসলামে অজ্ঞতা, আলস্য, ব্যক্তি অধিকারকে অবহেলা ও ধোকাপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো ওজর নেই; এগুলো দূষণীয় অপরাধ। একটি প্রখ্যাত প্রবাদ বাক্য বিবৃত করে - “যে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তাকে করুণা করা যায় না।” শোষণ কীভাবে ইসলামে বিরাজ করতে পারে? জ্ঞানী ও বিবেচনাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি কীভাবে এ কথা বলতে পারে? যে অজ্ঞ লোকটি এ কথা বলে, সে কি ব্যক্তি অধিকারকে সমর্থনকারী আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফগুলো শোনে নি? সেগুলো না জানা কিংবা না শোনা তার জন্যে তো ওজর হতে পারে না!
আপত্তি-৪
সে বলেছে, “প্রাচ্য দেশগুলো ধর্ম দ্বারা মাদকাসক্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঈমান রাখা হলো দাসত্ব।”
জবাব
ইতিহাসের যে কোনো পাঠকই সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর মাহাত্ম্য এবং এই তথ্যটি উপলদ্ধি করতে পারবেন যে ইসলাম সক্রিয়, জ্ঞানান্বেষী, ন্যায় ও ইনসাফ-সম্পন্ন এবং সাহসী জাতিসমূহ গঠন করেছে। এর সহস্র উদাহরণ এবং এ বিষয়টি প্রতীয়মানকারী শত-সহস্র বইপত্র প্রকাশ্যে বিদ্যমান। অন্ধ ব্যক্তি সূর্যকে দেখতে না পেলে আফসোস! এটা কি সূর্যের দোষ? শত্রু-মিত্র সকল জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি-ই যেখানে এই মহান ধর্মকে, সভ্যতা ও সুখ-শান্তির এই উৎসকে পুলকিত নেত্রে অবলোকন করছেন, সেখানে একজন অজ্ঞ ও ধোকাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কুৎসা রটনার কী-ই বা মূল্য আছে? কথা ও লেখনী সব সময় ওর কর্তাকে প্রতিফলন করে। বহু মানুষ আছে যারা নিজেদের শত্রুদের ওপর ক্ষেপে গেলে তাদের প্রতি নিজেদের দোষগুলোই চাপিয়ে দেয়। অতএব, একজন হীন প্রকৃতির ব্যক্তির কথাবার্তা তার বক্র চিন্তাধারাকেই প্রতিফলন করে। তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলো সেই হীরকখণ্ডের মতো যেটা ধূলোয় পড়ে গিয়েছে। একজন বদমায়েশ লোকের দ্বীন ইসলামকে আক্রমণ করা কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। যা আশ্চর্যজনক তা হলো কিছু লোক এ সব ভিত্তিহীন, উদ্ভট কুৎসাকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ সকল কুৎসা জবাব পাওয়ার যোগ্যতাও রাখে না। কোনো অন্ধ লোককে সূর্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা কিংবা কোনো অসুস্থ লিভার-সম্পন্ন লোককে চিনির মিষ্টি স্বাদ সম্পর্কে বলা একেবারেই অর্থহীন। শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যকে অসুস্থ ও ময়লা আত্মাসমূহের কাছে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এগুলোকে জবাব দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদেরকে এ সব কুৎসায় বিশ্বাস করা হতে রক্ষা করা। ওষুধ ব্যবহৃত হয় রোগীকে মৃত্যু হতে রক্ষা করার জন্যে, মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে নয়।
বিশ্ব সভ্যতাকে আলোকোজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে দ্বীন ইসলামকে প্রশংসাকারী শত-সহস্র উদ্ধৃতির মাত্র দুইটি আমরা এখানে উদ্ধৃত করবো। আমরা সেগুলো প্রাচ্য হতে উদ্ধৃত করবো না যাকে সেই অজ্ঞ ব্যক্তিটি ঘৃণা করে, বরং পাশ্চাত্য হতে উদ্ধৃত করবো যার সে গুণকীর্তন করে।
জার্মানীর ধর্মতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ জিন ম্যাখাইম (মৃত্যু: ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন, “এটা ঐতিহাসিক সত্য যে দশম শতাব্দী হতে ইউরোপে বিস্তার লাভকারী জ্ঞান-বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, সৌরবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্র সবই ইসলামী বিদ্যাপীঠ হতে প্রাপ্ত ছিল। বিশেষ করে আন্দালুসিয়া (স্পেন)-এর মুসলমান সমাজ ছিলেন ইউরোপের শিক্ষক। আন্দালুসিয়াকে দখল করার জন্যে রোমান ও গথ (ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি এলাকার আদিবাসী)-রা দুইটি শতাব্দী যাবত চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মুসলমানগণ মাত্র বিশ বছরে তা দখল করে নিয়েছিলেন। পীরানিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে তাঁরা ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলেন। জ্ঞান, বুদ্ধি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁদের বাহুবলের চেয়ে কম ছিল না।”
লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “আজকের ইউরোপ মুসলমানদের কাছে ঋণী। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন - ঐকান্তিকতা, সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব ধন-সম্পদ দ্বারা পরিমাপ করা হয় না, বরং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারাই বিচার করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ শাসিত হয়েছে সবচেয়ে দৃঢ় হস্তে। তিনটি মহাদেশ জুড়ে মুসলমানদের বিস্তৃতি ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত বিজয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।”
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তিটি যখন তার মানসিক বিকৃতির কারণে লিখেছে যে প্রাচ্য মাদকাসক্ত হয়ে ধর্মের মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে, ঠিক তারই বিপরীতে বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্টের মতো নিরপেক্ষ লেখকবৃন্দ তখন তাঁদের বিবেক সহকারে লিখেছেন: “আন্দালুসিয়ার মুসলমান সমাজ যখন পশ্চিমে (পাশ্চাত্যে) জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো বিচ্ছুরণ করছিলেন, তখন প্রাচ্যে মাহমুদ গযনবী জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রসার করছিলেন এবং তাঁর দেশটি বিজ্ঞানীদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। উক্ত ইসলামী শাসক উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিলেন এবং তাঁর আহরিত সম্পদসমূহ ভালো কাজ ও দেশের অগ্রগতি-প্রগতি ও উন্নতির জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। প্রাচ্যে যখন এ রকম কল্যাণ ও সভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, ঠিক তখনি ফ্রান্সের লুই-৭ ‘ভিত্রি’ নামের শহরটি দখল করে নেন এবং তা জ্বালিয়ে দেন, আর তেরো’শ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারেন। সেই দিনগুলোতে গৃহযুদ্ধসমূহ ইংল্যান্ডে হত্যাযজ্ঞের দ্বার উন্মোচিত করতো; ইংল্যান্ড তখনো চাষাবাদযোগ্য ছিল না, ফলে সব উন্নতি ব্যাহত হয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব-সংঘাত এতো বেদনাক্লিষ্ট, এতো প্রলয়ংকরী ছিল যে ইতিহাস অনুরূপ কোনো কিছু আর প্রত্যক্ষ করে নি। কিন্তু প্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোতে ফিরোজ শাহ্ তুঘলক যিনি ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর মসনদে আরোহণ করেন, তিনি ৭৯০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকালের সময় অবধি পঞ্চাশটি খাল ও বাঁধ, চল্লিশটি মসজিদ, ত্রিশটি স্কুল, এক’শটি গণ-আবাস, এক’শটি হাসপাতাল, এক’শটি গণ-স্নানাগার এবং এক’শ পঞ্চাশটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। ভারতের শাহ্ জাহানের শাসনামলে কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল। আলী মুরাদ খাঁন নামের একজন প্রকৌশলীর মাধ্যমে তিনি দিল্লীর খাল নির্মাণ করেছিলেন। শহরের সকল অংশেই মার্বেল পাথরের ফোয়ারা ও মার্বেলের গণ-স্নানাগার নির্মিত হয়েছিল। প্রত্যেকটি ঘরেই পানির সরবরাহ ছিল। রাষ্ট্রটি নিরাপদ ছিল।” (লর্ড ড্যাভেনপোর্ট)
আপত্তি-৫
সে বলেছে, “ধর্ম হলো অদৃষ্টবাদ ও তুষ্ট থাকার একটি প্রকাশ মাধ্যম। এটা পরবর্তী জগতের একটি ধ্যান-ধারণা যা নির্যাতিত ও ক্ষুধার্তদের অবশ করে দেয়। এটা শিক্ষা দেয় যে পরবর্তী জগতে পরিত্রাণ লাভ করার জন্যে এ পৃথিবীতে কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। বেঁচে থাকার আনন্দ ও প্রয়োজনীয়তা অদৃষ্টবাদ ও তুষ্ট থাকার মতবাদকে চুরমার করে দিয়েছে এবং ভালোভাবে ও বেশি পরিমাণে আয়-রোজগার করার সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। জীর্ণ-শীর্ণ প্রথা ও সংস্কারের ওপর নির্ভরশীল নিয়ম-বিধানের বিরোধিতা যারা করে, তাদেরকে ধর্ম ভয় পায়। ধর্মের মাদক মানুষকে গুরুত্বহীন, দাস ও নিষ্প্রাণ করে দেয়।”
জবাব
এ ধরনের মিথ্যা ও জঘণ্য কুৎসা জবাব পাওয়ার যোগ্যতাও রাখে না। কেননা, কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি সত্য সম্পর্কে জ্ঞাত, তিনি এতে বিশ্বাসই করবেন না। যদিও ইসলামের শত্রুরা জ্ঞানী নয়, তবু তারা চালাক; আর যুব সম্প্রদায়কে ধোকা দেয়ার জন্যে তারা অর্থহীন বিষয়গুলোতে অপতৎপর হয়ে পড়ে এবং যুব সম্প্রদায়কে নফস্ তথা প্রবৃত্তির জন্যে আনন্দদায়ক মাদক সরবরাহ করে, যার দরুণ যুব সম্প্রদায় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা হতে বঞ্চিত হয়। নিরীহ, নিরপরাধ যুব সম্প্রদায়কে এ সকল মিথ্যায় বিশ্বাস করে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষাকল্পে এখানে সংক্ষেপে সত্য কথাগুলো লিপিবদ্ধ করা সঙ্গতিপূর্ণ। যে সৌভাগ্যবান যুবক আমাদের প্রকাশিত “অনন্ত কল্যাণ” (Endless Bliss) গ্রন্থটি পাঠ করেছেন, তিনি সঠিক ও যথাযথভাবে ইসলাম শিক্ষা করতে পারবেন। তিনি কোনো কুৎসায় বিশ্বাস করবেন না। কেননা, রাসূলে করীম (দ:) আমাদেরকে শিক্ষিত ও জ্ঞানী হতে বলেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান - “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে, সে মুসলমান হয়ে যায়। যে ব্যক্তি অজ্ঞ থাকে, সে দ্বীনের শত্রুদের ধোকায় পড়ে যায়” (আল্ হাদীস)।
এ কথা সত্য যে দ্বীন হলো তাকদীর (অদৃষ্ট) ও তুষ্ট থাকায় দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু তাকদীর মানে কর্মবিমুখ হওয়া কিংবা উন্নতি কামনা না করা নয়, যা এ অজ্ঞ লোকটি ধারণা করে নিয়েছে। “কদর” (অদৃষ্ট) মানে হলো আল্লাহতা’লা পূর্বাহ্নেই মানুষেরা কী করবে না করবে তা জানেন। আল্লাহ্ তা’লা মানুষদেরকে কাজ করতে আদেশ করেছেন। তিনি কর্ম সংঘটনকারীদের প্রশংসাও করেছেন। সুরা নিসার ৯৪ আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান - “যারা জেহাদ, কর্ম সংঘটন ও সংগ্রাম করে তারা সেই সব বসে থাকা এবাদতকারী হতে বহু উত্তম ও মূল্যবান যারা জেহাদ পালন করে না” (আল্ কুরআন)। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “আল্লাহ্ তা’লা খেটে খাওয়া উপার্জনকারীদেরকে পছন্দ করেন” (আল্ হাদীস)। ইতিহাসের শিক্ষা ও “অনন্ত কল্যাণ” (Endless Bliss) গ্রন্থের “উপার্জন ও ব্যবসা” শীর্ষক অধ্যায় হতে এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে দ্বীন ইসলাম কাজ করে উপার্জন করার ধর্ম। প্রত্যেক দিন কাজ করে উন্নতি ও অগ্রগতি-প্রগতি অর্জনের জন্যে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - “যে ব্যক্তি পরপর দুই দিন একই অবস্থায় থেকে যায় কিংবা প্রগতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, সে নিজেকেই ধোকা দেয়” (আল্ হাদীস)। তিনি অন্যত্র এরশাদ করেন - “তোমরা আগামীদিনের জন্যে তোমাদের কাজকে ফেলে রেখো না, তাহলে তোমরা বিলুপ্ত হবে” (আল্ হাদীস)। হুজূর সৈয়্যদে আলম (দ:) আরো এরশাদ ফরমান - “বিদেশী ভাষা শিক্ষা করো। এতে তোমরা শত্রুদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে” (আল্ হাদীস)।
পরবর্তী জগতে সুখ-শান্তির চিন্তা কর্ম উদ্যোগকে বাধা দেয় বলাটা অন্যায় ও নিচু মানসিকতা। “যে ব্যক্তি কাজ করে উপার্জন করে, সে পুনরুত্থান দিবসে পূর্ণ চন্দ্রের মতো জ্যোতির্ময় হবে;” “আলেমের ঘুম এবাদত;” “যা হালাল (বৈধ) তা উপার্জন করো এবং তা উপকারার্থে ব্যয় করো;” “দ্বীনী ভাইকে অর্থ কর্জ দানকারী মুসলমানের গুণাহ্সমূহ মাফ করা হবে;” “প্রত্যেক বস্তু অর্জনের একেকটি পদ্ধতি বা পন্থা বিরাজমান, বেহেস্তের পন্থা হলো জ্ঞান”- এই হাদীসগুলো আমাদেরকে কাজ করে উপার্জন করতে আদেশ দেয় এবং ব্যক্ত করে যে পৃথিবীতে যারা তা ব্যয় করে, তারা পরকালে সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে। অথচ অজ্ঞ ব্যক্তিটি বলেছে, “ধর্ম মানুষকে বিদ্রোহ করা হতে বিরত রাখে; অতএব তা মাদক।” তার এ আহাম্মকীপূর্ণ কথাটি প্রতিভাত করে যে সে দ্বীন ও সভ্যতা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এটা নিশ্চিত যে এ কথাটি জ্ঞান কিংবা গবেষণার ফসল নয়। বস্তুতঃ এ ধরনের কথাবার্তাই হলো শোষণ যা সমাজতন্ত্রীমনা প্রভুদের তুষ্টি অর্জনের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে একটা রাষ্ট্রীয় পদ অজর্ন করা সম্ভব হয়। যারা পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ঈমান বিসর্জন দেয় এবং ভ্রান্তি ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তাদেরকে “ধর্মের প্রতারক” বলা হয়। তাদের প্রভুরা, যাদেরকে তারা তোয়াজ করছে, তারা অন্যান্য নশ্বর জীবের মতোই উচ্চপদ হতে পতিত হয়েছে। এ সকল ‘প্রভু’ মহান আল্লাহতা’লার ন্যায়বিচার ও ইনসাফপূর্ণ সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হয়ে চির আযাবের মধ্যে পতিত হয়েছে। অথচ তারা আল্লাহতা’লাকেই অবিশ্বাস ও তাঁর প্রতি একগুঁয়ে বিরোধিতা করেছিল। তাদের চামচা গং তাদেরকে ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্যান্য দলে ভিড়ে গিয়েছে এবং অন্যান্য নশ্বর জীবের মোসাহেবী আরম্ভ করেছে।
আপত্তি-৬
সে বলেছে, “আরব দেশগুলো - যেখানে মরুভূমির আইন–কানুন প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী, সেখানেই তারা বস্তুবাদ ও বস্তুবাদী দর্শনকে আক্রমণ তথা বিষোদগার করছে।”
জবাব
ইতিপূবে ইসলামের শত্রুরা তাসাউফের মহান ইমামদের কিছু কথা তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে সেগুলোর অর্থ না বুঝেই যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে আহলে তরীকত (তরীকাপন্থী) হওয়ার ভান করতো এবং যুব সম্প্রদায়কে ফাঁদে ফেলতো। কিন্তু ইদানীং তারা পশ্চিমা বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের কিছু কথা মুখস্থ করে নিজেদের প্রভুদের ওভারকোট বহন ও মদের পাত্র পূর্ণ করে দিয়ে সার্টিফিকেট এবং উচ্চপদ হাসিল করছে। জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হওয়ার ভান করে তারা তাদের মুখস্থ কথাগুলোর মধ্যে ইসলামের প্রতি দুষমনীমূলক কথাবার্তা সন্নিবেশিত করছে এবং তা যুব সম্প্রদায়ের কাছে পেশ করছে। এভাবে তারা ম্যাসন (মোনাফেক) ও সমাজতন্ত্রীদের আকর্ষণীয় খাদ্য মুসলমান ঘরের সন্তানদেরকে প্রদর্শন করে তাদেরকে ধোকা দেয়ার অপচেষ্টায় রত।
জ্ঞান-বিজ্ঞানশূন্য যে সব নিকৃষ্ট লোক অবৈধ পন্থায় সার্টিফিকেট হাতিয়ে নিয়েছে এবং “বিজ্ঞানীর মুখোশ” পরে দ্বীন ইসলামকে আক্রমণ করছে তাদেরকে “বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ” বলা হয়। একবার এ ধরনের এক ভুয়া বিজ্ঞানী তার সন্দেহজনক সনদের জোরে একটি জেলার কর্তাব্যক্তি হয়ে গিয়েছিল। সে যখন দেখতে পেল যে মানুষরা তাকে কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করছে না, তখন সে একটি সভার আয়োজন করে গ্রামবাসী ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরকে জড়ো করে “বস্তুবাদী দর্শন,” “আধুনিক,” “সভ্য-সংস্কৃতিবান ব্যক্তিবর্গ” ইত্যাদি ধরনের কথা উদগীরণ করতে থাকে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতি সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করতে দেখে এবং তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করতে দেখে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে তার বদ চরিত্র ও বদ চিন্তাধারাকে প্রতিফলনকারী অনেক জঘন্য বাক্য উচ্চারণ করে। ইত্যবসরে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরকে ইশারা করে সে বলে, “যে ব্যক্তি ইউরোপে যায় নি, সে একটা গাধা”। মুফতী আফেন্দী অতঃপর বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার শ্রদ্ধেয় পিতা কি তাঁর উপস্থিতি দ্বারা কখনো ইউরোপকে ধন্য করেছেন?” যখন সেই ভুয়া বিজ্ঞানী ঝাঁঝালো কণ্ঠে “না” বলতে বাধ্য হলো, তখন মুফতী আফেন্দী সমাপ্তি টানলেন - “তাহলে আপনার মতো মহান ব্যক্তিত্বও গাধা আপনার-ই পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে”। ফলে ভুয়া বিজ্ঞানী নিজের ফাঁদে নিজেই পতিত হলো। নিজেদেরকে “প্রগতিবাদী,” “সভ্য ও সংস্কৃতিবান” দাবিদার অজ্ঞ-মূর্খ ও বেওকুফ ব্যক্তিবর্গ যারা ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে কিংবা বিশ্বব্যাপী গ্রন্থাগারসমূহকে পূর্ণতা দানকারী ইসলামী সভ্যতার খ্যাতি ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নয়, তারা ইসলামের সুরক্ষিত দুর্গে এভাবে যুগে যুগে খেলনা পিস্তল নিয়ে আক্রমণ করেছে এবং ফলশ্রুতিতে নিজেরাই অপদস্থ হয়েছে।
আপত্তি-৭
সে বলেছে, “যারা অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তারা এক মুঠো ভাত ও একটি মোটা কাপড়ের অদৃষ্টবাদে তুষ্ট থাকার কথাটির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছে, যার দরুন প্রতিভাত হয়েছে যে ধর্মের প্রভাব মাদকের মতোই। অথচ সভ্যতার মানে হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষী হওয়া এবং এরই জন্যে সংগ্রাম করা। কিন্তু সমাজের উন্নতি ও প্রগতির জন্যে এ সব আন্দোলনকে ধর্ম স্তব্ধ ও অবশ করে দিয়েছে তার অদৃষ্টে তুষ্ট থাকা, পরবর্তী জগত এবং আধ্যাত্মিকতার ধ্যান-ধারণা পেশ করে।”
জবাব
আমাদের পূর্ববর্তী জবাবে চিত্রিত চামচাগিরির আরেকটি উজ্জ্বল চিত্র হলো উপরোক্ত কথাগুলো! এটা বলা কতো বড় মিথ্যা যে ইসলামের যোদ্ধাগণ যাঁরা মাত্র বিশ বছরে তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত হয়েছিলেন, যাঁরা পারস্য ও রোমের বিশাল সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং যাঁরা নিজেদের ন্যায়পরায়ণতা ও উন্নত নৈতিকতার সৌন্দর্য দ্বারা প্রত্যেক জাতিরই মন জয় করেছিলেন, তাঁরা নাকি মাদকাসক্ত ও অথর্ব জাতি ছিলেন! যাঁরা ইতিহাসের ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন, তাঁরা এই জঘন্য কুৎসা রটনায় বিরক্ত হতে বাধ্য হবেন। ইসলাম মানুষদেরকে কাজ করে উন্নতি করতে আদেশ করে এবং সেই সব ব্যক্তিদের প্রতি জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয় যারা উপার্জন করে গরিবদেরকে সাহায্য করেন। যদি এই লেখক ইসলামী শিল্পকলা দেখতে পেতো যা দেখে ইউরোপীয় ও মার্কিনীরা মুগ্ধ হয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের সাফল্য ও কৃতিত্ব দেখে প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখে, তাহলে সে হয়তো এ সব কথা লিখতে লজ্জা বোধ করতো। আমরা “হয়তো” লিখছি এ কারণে যে লজ্জাবোধ একট সৎগুণ। একজন অসৎ ব্যক্তির কাছ থেকে লজ্জাবোধ আশা করা অযৌক্তিক বৈ কী! ইসলাম মুসলমানদেরকে কাজ করে উপার্জন করতে আদেশ করে। তুষ্ট থাকার মানে এই নয় যে একটি মোটা কাপড়ে তুষ্ট থাকতে হবে এবং অলস বসে থাকতে হবে। মুসলমানরা মোটেও এ রকম নয়। তুষ্ট থাকার অর্থ হলো নিজের উপার্জনের প্রতি তুষ্ট থাকা এবং অন্যদের আয়-উপার্জনের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিবদ্ধ না করা। ইসলামই ইউরোপে সভ্যতাকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল, কেননা ইসলাম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক-নির্দেশনা দেয় এবং মানুষদেরকে তা অর্জন করার জন্যে আদেশ করে। নিম্নোক্ত হাদীসগুলো এবং আরো বহু হাদীস শরীফ পরিস্ফুট করে যে উপরোক্ত আপত্তিটি জঘন্য বানোয়াট কুৎসা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারাই যারা মানুষের জন্যে উপকারী (অর্থাৎ কল্যাণকারী)”; “সেরা দান হলো সাদাকা;” “তোমাদের মধ্যে সেরা হলো সেই ব্যক্তি, যিনি মানুষদেরকে খাদ্য সরবরাহ করেন” এবং “তোমাদের মধ্যে সেরা সেই ব্যক্তি যিনি অন্যদের কাছ থেকে আশা না করে নিজে কাজ করে উপার্জন করে থাকেন।” (সংকলিত)
আপত্তি-৮
সে বলেছে, “ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে একটি সার্বিক (common) সভ্যতায় পৌঁছানোর সকল প্রচেষ্টা বিঘ্নিত হয়েছে ধর্মের সর্বগ্রাসী শক্তি দ্বারা। ধর্মের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব যা বিপ্লবের প্রতিবন্ধক, তাকে ধ্বংস করতে হবে।”
জবাব
এই ভুয়া বিজ্ঞানী বার বার ”সভ্যতা” শব্দটি উচ্চারণ করছে এবং এই যাদুকরী শব্দটি দ্বারা তরুণ মস্তিষ্ককে মোহাবিষ্ট করতে চাচ্ছে। সে মনে করছে যে ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপন করা ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং পরমাণু-চালিত কারখানা তৈরি করা এবং এগুলোকে অবৈধ যৌনাচার, নারী-সম্ভোগ, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের মাধ্যমে আভিজাত্য অর্জন, মিথ্যা কথন, প্রতারণা, শ্রমজীবী শ্রেণীর ঘাড়ে ভর করে ইদ্রিয় কামনাসমূহকে চরিতার্থকরণ ইত্যাদি অপকর্মে ব্যবহার করাই বুঝি সভ্যতা। ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণ যে সভ্যতা অর্জনের জন্যে আদেশ করেছেন তা হলো “তা’মির-এ বিলাদ ওয়া তারফিহ-এ এ’বাদ।” অর্থাৎ, দেশগুলোকে ইমারত নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও কারখানা তৈরি করে উন্নত করা এবং প্রযুক্তি ও সকল প্রকার রাজস্বকে মানুষের মুক্তি, কল্যাণ ও সুখ-শান্তির জন্যে ব্যবহার করা। বিংশ শতাব্দীর এ সন্ধিক্ষণে সভ্যতার এই দুইটি দিকের মাত্র একটাই বর্তমানে বিরাজ করছে। যদিও প্রযুক্তির উন্নতি এক্ষণে চোখ ধাঁধাঁনো, তবুও অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিকে আজকাল মানুষকে দাস বানানোর এবং অত্যাচার-নিপীড়ন করার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিংশ শতাব্দী হলো প্রযুক্তির শতাব্দী। কিন্তু এটা সভ্যতার শতাব্দী হওয়া থেকে যোজন যোজন দূরে।
সমাজতন্ত্রী লেখকটি ধর্মকে বিলোপ সাধনের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে বেশ বাস্তবপন্থী। কেননা, দ্বীন-ইসলাম দুর্নীতি, অসততা, শোষণ, কপটতা, একনায়কতন্ত্র, গীবত (পরচর্চা)-সহ সকল মানবতা-বিধ্বংসী বদ-আচরণকে নিষেধ করে । একজন অসৎ চরিত্রের ব্যক্তি কখনোই ভাল কোনো কিছুকে সাদরে গ্রহণ করে না। ইসলামের গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিচু মনের বদমায়েশ লোকেরা তাই ভয় করে থাকে। ইসলামকে সভ্যতার জন্যে কয়েদখানাস্বরূপ হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে এই পাপাত্মা ব্যক্তিটি ইতিহাসকে মিথ্যা সাক্ষী হিসেবে পেশ করেছে। যদি ইতিহাস সম্পর্কে তার ন্যূনতম জ্ঞান থাকতো, তাহলেও সে এমনটি করতে কুণ্ঠিত হতো। এমন কি অমুসলিম ইতিহাসবিদরাও এ সত্যটি স্বীকার করেন যে দ্বীন ইসলাম সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে এবং ইউরোপ ও আমেরিকায় অগ্রগতি-প্রগতি ও উন্নতি সাধন করেছে।
এটা উপলব্ধি করা যায় যে এই অজ্ঞ ও ভুয়া বিজ্ঞানী নিজে থেকে এ সব মিথ্যা বানিয়ে নেয়ার মতো চালাক অথবা বুদ্ধিমান নয়। ইউরোপে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ন্যায্য আক্রমণসমূহ উদ্ধৃত করে সে দ্বীন ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। কিন্তু যেহেতু সে ভ্রান্ত এবং যেহেতু তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি ক্ষমতা কম, সেহেতু সে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
খৃষ্টবাদ সম্পর্কে যারা বিরূপ, তাদের দ্বারা খৃষ্ট মতবাদকে আক্রমণ করার হেতু সবার কাছে জ্ঞাত করা এ প্রসঙ্গে যথাযথ হবে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ওই সব অভিযোগ যে অন্তঃসারশূন্য তা ব্যাখ্যা করাও প্রাসঙ্গিক হবে।
রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের রাজত্বকালে ঐশীমূল্য হারানো খৃষ্টধর্ম পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। অ-খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পাদ্রী-পুরোহিতবর্গ অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত করেন। তারা সবাইকে জোর করে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন। মার্টিন লুথার এই ধর্মান্ধ অভিযানে মাত্রা ছাড়িয়ে যান। তিনি প্রটেস্টান্ট নয় এমন ধর্ম ও জাতির প্রতি চরম বৈরী-ভাবাপন্ন ছিলেন। অপর পক্ষে, মিশনারী সংস্থাগুলো চিন্তা-চেতনাকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে, বিবেকসমূহকে বিপথগামী করে এবং প্রতি দিন নিত্যনতুন প্রবন্ধ লিখে খৃষ্ট মতবাদ প্রচার করতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এ সব খৃষ্টান আক্রমণ, যা কখনো রক্তে রঞ্জিত, কখনো বা প্রতারণায় পরিপূর্ণ ছিল, তা অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে খৃষ্টান মতবাদ বিরোধী একটি বিদ্বেষের জন্ম দেয়। ব্যাপক লেখনীর মাধ্যমে প্রচার শুরু হয় এ মর্মে যে পাদ্রী-পুরোহিতবর্গ মানুষদেরকে ধোকা দিচ্ছেন, কুসংস্কার ও নিজেদের ধ্যান-ধারণায় পিঞ্জরাবদ্ধ করতে তাদেরকে বাধ্য করছেন। কিন্তু এ শত্রুতা কেবলমাত্র খৃষ্টবাদের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ রইলো না। এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো যারা সকল ধর্মকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলো। পাদ্রী-পুরোহিতদের বদমায়েশীর উৎস যে ধর্মের বিকৃতি ও পরিবর্তন, তা না দেখেই তারা ধারণা করে নিয়েছিল যে এগুলো বুঝি ধর্ম হতেই নিঃসৃত। ধর্মসমূহ সম্পর্কে অধ্যয়ন না করেই খৃষ্টবাদের অপকারিতাসমূহকে তারা ধর্মের প্রতি আরোপ করে এবং ধর্মসমূহকে আক্রমণ করতে শুরু করে দেয়। ধর্মের প্রতি শত্রুতা পোষণকারীদের মধ্যে সীমা লংঘনকারীদের একজন হলেন ভলটেয়ার (ফরাসী দার্শনিক)। লুথারের মতো তিনিও দ্বীন ইসলামের কুৎসা রটনা করেন এবং লুথার যেভাবে রাসূলে আকরাম (দ:) সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, তিনিও রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে সে রকম মনে করে তাঁর কুৎসা রটনা করেন। ইসলামকে অধ্যয়ন না করেই এঁরা খৃষ্টানদের মতো ধর্মকে আক্রমণ করেন।
ঊনিশ শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো জার্মান চিন্তাবিদ ভন হার্ডার বলেন যে ধর্মসমূহের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ হলো জোরপূর্বক খৃষ্টান বানানোর মতোই মস্ত বড় ভুল। তিনি ধর্মসমূহ, বিশেষ করে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অতঃপর ইউরোপবাসী জনগণ হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কে বুঝতে আরম্ভ করেন, দ্বীন ইসলাম প্রদর্শিত আলোকোজ্জ্বল পথের মাহাত্ম্য দর্শন করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যান। বৃটিশ চিন্তাবিদদের অন্যতম থমাস্ কারলাইল তাঁর প্রণীত The Heroes (মহানায়কবৃন্দ) গ্রন্থের A Hero Who is the Prophet শীর্ষক অধ্যায়ে হুজূর পূর নূর (দ:)-এর জীবন, নৈতিক গুণাবলী ও সাফল্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এ গ্রন্থটি তিনি ১৮৪১ সালে রচনা করেন। এতে তিনি লিখেছেন, “বারোটি শতাব্দী যাবত যে মহান ব্যক্তিত্ব লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছেন এবং যিনি প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে সভ্যতার রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি লুথার ও ভলটেয়ারের অভিযোগকৃত ভণ্ড হতে পারেন না। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অর্জিত সাফল্য ও কৃতিত্ব একজন নিচু প্রকৃতির লোক কখনোই অর্জন করতে সক্ষম হবে না। কেবলমাত্র একজন পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব যিনি বিশ্বাস ও নৈতিকতার অধিকারী, তিনি-ই অন্যদের বিশ্বাস দান করতে পারেন। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান জাতিসমূহের জন্যে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। যদি তা না হতো, তবে কেউই তাঁকে অনুসরণ করতো না। হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাবার্তা সত্য, কেননা একজন মিথ্যুক কখনোই একটি ঘর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়, ধর্ম তো দূরে থাক!” (কারলাইল)
থমাস কারলাইলের জমানায় ইউরোপে কোনো সঠিক ও নির্ভুল ইসলামী গ্রন্থ বিরাজমান ছিল না। কিন্তু তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টি ও বহু বছরের অধ্যয়নের সাহায্যে তিনি খৃষ্টান ও দ্বীনের শত্রুদের বানানো মিথ্যাসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেন নি এবং ঐতিহাসিক সত্যকে দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজকে ইউরোপীয় ও আমেরিকান ভাষাসমূহে বহু ইসলামী বইপত্র অনূদিত হওয়ায় কারলাইলের ঐতিহাসিক লেখনীসমূহের প্রতি যে সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল তা কেটে যাচ্ছে।
যদি লুথারের রচিত কুরআন মজীদ-বিরোধী প্রবন্ধাবলী ও হযরত রাসূলে খোদা (দ:)-এর বিরুদ্ধে বানানো ভলটেয়ারের কল্পকাহিনীকে কারলাইল কৃত A Hero Who is the Prophet (মহানায়ক যিনি নবী) শীর্ষক প্রবন্ধের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সবার কাছে ভালভাবে জ্ঞাত হবে যে ধর্মান্ধ খৃষ্টান ও দ্বীনের শত্রুদের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যক্তিবর্গ কতোটুকু ভিন্ন দৃষ্টিতে দ্বীন ইসলামকে মূল্যায়ন করে থাকেন। কারলাইলের পরে বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-এর জীবন ও নৈতিকতার মাধূর্য সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ব্যক্ত করেছেন যে কুরআন মজীদই মানুষদেরকে সুখ-শান্তির পথ-প্রদর্শনকারী জ্ঞানের উৎস। তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর ও কুরআন মজীদের কুৎসা রটনাকারীদের প্রতি উপযুক্ত জবাবও লিপিবদ্ধ করেছেন।
এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে ইসলামের শত্রুরা আজকাল দ্বীনের প্রতি কুৎসার দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে তিনটি উৎস হতে সাহায্য পাচ্ছে: (১) খৃষ্টান মিশনারী, (২) ভলটেয়ারের মতো লোকেরা যারা ধর্মকে অন্ধভাবে আক্রমণ করে থাকে এবং (৩) সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী যারা সকল ধরনের সত্য ও সততাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গণমানুষকে জন্তু-জানোয়ারের মতো এবং যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে থাকে।
আপত্তি-৯
সে বলেছে, “ধর্ম মানুষকে বুঝ দেবার জন্যে; অর্থাৎ, তুষ্ট থেকে দুঃখ-কষ্ট ও বৈষম্যকে স্বীকার করে নেয় ধর্ম। এটা সমাজে বিদ্যমান সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এটা সেই উন্নত জীবন অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যা শ্রেণী বৈষম্য ও শোষণ নির্মূল করে। এ সকল নিপীড়ন দোযখের ভয় দেখিয়ে করা হয়েছে। যারা এর শিকার হয়েছে, তাদেরকে বেহেস্তের শান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। এটা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়।
জবাব
সে মুসলমান সন্তানদেরকে সেই বিষ দ্বারা ধ্বংস করতে চাচ্ছে যা সে ওই তিনটি উৎস হতে প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। আজকাল যুব সম্প্রদায় ইসলামী বইপত্র পাঠ করে নিজেদের ঈমান-আকিদা সঠিকভাবে শিক্ষা করছে। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) ঘোষণা করেছেন - “যে মুসলমান ব্যক্তি পরপর দুই দিন একই রুজীতে সীমাবদ্ধ থাকে, সে নিশ্চয় ক্ষতিগ্রস্ত। একজন মুসলমানকে প্রতিদিনই উন্নতি করতে হবে” (আল্ হাদীস)। যে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী যুবকটি হযরত রাসূলে পাক (দ:)-এর “অগ্রসর হও” শীর্ষক আদেশটি এবং উপরোক্ত হাদীসের আদেশটি যত্ন সহকারে পাঠ করেছে, সে কখনোই “প্রগতিবাদী” দাবিদার অজ্ঞ ব্যক্তিটির মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করবে না। দ্বীন ইসলাম বৈষম্য ও বে-ইনসাফী অনুমোদন করে না, বরং ন্যায়বিচার ও বৈষম্যের মূলোৎপাটনকে আদেশ করে। “আমি একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের সময় এসেছি”- হাদীসটি ঐশী গ্রন্থবিহীন অবিশ্বাসীদের ন্যায়বিচারকেরও প্রশংসা করেছে। ইমাম মানাবী ও ইমাম দায়লামী বর্ণিত একটি হাদীস শরীফে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান - “বেহেস্তে সর্বপ্রথম প্রবেশ করবে ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও শাসকবৃন্দ” (আল্ হাদীস)। এ হাদীসটি কি দুঃখ-কষ্ট, বৈষম্য ও বে-ইনসাফী মেনে নিতে আদেশ করেছে? নাকি এটা এগুলোকে পরিহার করতে পরামর্শ দিয়েছে? আমাদের পাঠকমণ্ডলীর বিবেকের কাছে এর সঠিক উত্তর অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে এতে পরিস্ফুট হচ্ছে কতটুকু বিচ্যুত হয়েছে এই অজ্ঞ লেখকটি এবং তারই সেবাপ্রাপ্ত চক্রটি।
দ্বীন ইসলাম যাকাত ও ধার দেয়াকে এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতাকে আদেশ করেছে। এটা জ্ঞাত করেছে, যারা এ সব আদেশ মান্য করবে যা সমাজে শ্রেণী বৈষম্য দূর করে, তারাই বেহেস্তী হবে। যারা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে তারা নয়, বরং যারা দুঃখ-কষ্টের বিধায়ক খোদা তা’লার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারাই বেহেস্তী হবে। ইসলাম হলো একটি প্রগতিশীল, গঠনতান্ত্রিক ধর্ম। ইসলাম “বিদ্যমান সীমা” নির্ধারণ করে দেয় নি, বরং রাষ্ট্রবিদদেরকে সমসাময়িক কালের বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, কৃষি, সমর প্রযুক্তি এবং প্রগতি অর্জনকারী সকল ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ব্যবহার করতে স্বাধীনতা দিয়েছে। আল্লাহতা’লা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জ্ঞানী সৃষ্টি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কেও বলেছেন - “সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করুন!” ইসলামের প্রত্যেক খলীফা-ই জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত পরামর্শক সভার শরণাপন্ন হতেন। পরামর্শ ছাড়া কোনো কিছু করাই তাঁদের অনুসৃত পন্থা ছিল না।
এবাদতের ক্ষেত্রে কোনো সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রযুক্তি ও পার্থিব উন্নতি, অগ্রগতি-প্রগতি অর্জনের জন্যে আদেশ করা হয়েছে। এই কারণেই প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে যে সব ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলো সকল ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছিল। ইসলাম ব্যক্তিত্ব ও চিন্তার স্বাধীনতাকে লালনকারী ধর্ম। প্রত্যেক মুসলমানই সারা পৃথিবী হতে অধিক মূল্যবান।
আপত্তি-১০
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তিটি বলেছে, “ধর্মের ফলশ্রুতিতে এসেছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শোষণ। তুষ্ট থাকা ও ভাগ্যে সমর্পিত হওয়ার দরুণ শোষণ ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু হাতের মুঠোয় উৎপাদনের সকল সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। গণমানুষ পার্থিব সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্যে বিবেচিত হয় নি। এক মুঠো খাবার ও একটি মোটা কাপড়ের দর্শন বেঁচে থাকার এবং সংগ্রাম করার শক্তিকে বিতাড়িত করেছে। পরবর্তী জগতের আশা-আকাঙ্ক্ষা দুঃখ-কষ্টের ও অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জবাব
ধর্ম বিষয়ে কথা বলতে হলে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামকে বর্তমানকালের পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী শোষকদের সাথে তুলনা দিয়ে ধর্মকে আক্রমণ করায় প্রতিভাত হয় যে সে ইসলামের প্রতি এমনই বৈরীভাব পোষণ করে যার দরুণ তার দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি অন্ধ ক্রোধ দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও নিষ্ঠুর সমাজতন্ত্রী যারা উৎপাদনের সরঞ্জামগুলোকে কুক্ষিগত করে এবং মানুষদেরকে শোষণ করে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলেই এই অজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা সামাজিক সাম্য বিধানকারী দ্বীন-ইসলামকে আক্রমণ করাটা নিছক শত্রুতা ছাড়া আর কিছু নয়। যেহেতু ইসলামী জ্ঞানে সে সমৃদ্ধ নয়, সেহেতু বার বার সে তুষ্ট থাকা ও তকদীরে (নিয়তিতে) বিশ্বাসকে আক্রমণ করেছে।
সভ্যতার দোহাই পেড়ে অজ্ঞ ব্যক্তিটি শুধুমাত্র অর্থনীতি ও আয়-উপার্জন নিয়েই কথা বলেছে। সে বুঝতে পারছে না যে তুষ্ট থাকা এমনই এক গুণ যা মানসিক রোগসমূহ প্রতিরোধ করে, অসঙ্গতি ও হানাহানি অপসারণ করে এবং সমাজসমূহে নিয়ম-শৃংখলা নিশ্চিত করে। এই তুষ্ট থাকাই সারা বিশ্বে ইসলামের বিস্তৃতি সাধন করেছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৌধ নির্মাণ করেছে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে - “যে ব্যক্তি কাজ করে সে-ই উপার্জন করবে” (আল্ আয়াত)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “প্রত্যেকেই যা করে তার প্রতিদান সে পায়” (আল্ হাদীস)। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ্ তা’লা সেই সকল যুবককে পছন্দ করেন না, যারা কাজ করে না” (ইমাম মানাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস)। এই সকল আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফ কি মুসলমানদেরকে কাজ করতে আদেশ দেয়? নাকি অলস বসে থাকতে বলে? উমাইয়া, আব্বাসীয়া, গযনবী, ভারতীয় তৈমুরগণ, আন্দলুসীয় ও উসমানীয় সভ্যতা যেগুলো মুসলমানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো কি কঠোর পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহন করে? নাকি অথর্বতার? একজন দরবেশ কর্তৃক উচ্চারিত “এক মুঠো ভাত ও একটা মোটা কাপড়” কথাটি কি কুরআন মজীদ ও হাদীস্ শরীফের আদেশকে পরিবর্তন করতে সক্ষম? একজন দরবেশের কথাবার্তা যা তিনি জযবার হালতে (ভাবের সাগরে তন্ময় অবস্থায়) উচ্চারণ করেন, তা তাঁর নিজের জন্যেই প্রযোজ্য। কিন্তু তা তো সর্বসাধারণের জন্যে ইসলামী বিধান নয়। পরবর্তী জগতে বিশ্বাস দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি করে না, বরং ব্যক্তিবর্গ, পরিবারবর্গ ও সমাজের জন্যে নিয়ম-শৃংখলা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে। ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে তা-ই ব্যক্ত করে। ইসলাম আত্মহনন নয়, বরং বস্তুগত ও আত্মিক দুঃখ-কষ্ট এবং অসুবিধা রহিতকরণকে আদেশ করে।
আপত্তি-১১
সে বলে, “এ সকল রাষ্ট্রকে এখনো মরুভূমির আইন দ্বারা শাসন করা হচ্ছে।”
জবাব
আল্লাহ্ তা’লা কর্তৃক উম্মোচিত কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে এবং শত-সহস্র হাদীসমূহে বর্ণিত শিক্ষা ও আজ্ঞাবলী সারা বিশ্বের জ্ঞানী মানুষদের শ্রদ্ধা কেড়েছে। এ সকল শিক্ষা ও আজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব ও মূল্য ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণ সহস্র সহস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন যার মধ্যে কিছু গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানে প্রদান করা হয়েছে। এমন কি অমুসলমান পণ্ডিতবৃন্দও এ সত্যটি ব্যক্ত করছেন। জার্মান লেখক গোথে বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রথমবার কুরআন মজীদ পাঠ করেন তিনি এর স্বাদ পান না; কিন্তু পরবর্তীতে এটা পাঠককে নিজের প্রতি আকর্ষণ করে এবং নিজ সৌন্দর্য দ্বারা পাঠককে জয় করে নেয়।” গিবন (ইংরেজ ইতিহাসবিদ) বলেন, ”কুরআন মজীদ শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’লার অপরিবর্তনীয় আদেশ ও আইন-কানুনই নিয়ে এসেছে যা মানবকুলের সকল বিষয়ের এবং অবস্থার ব্যবস্থাপক।”
বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “কুরআন মজীদ ধর্মীয় কর্তব্য-কর্ম, দৈনন্দিন বিষয়াবলী, আত্মিক পরিশুদ্ধি, দৈহিক স্বাস্থ্য, মানুষের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকার, মানুষ ও সমাজের জন্যে উপকারী বস্তুসমূহ এবং নৈতিকতা ও শাস্তির জ্ঞানসমূহকে নিয়মবদ্ধ করে। কুরআন মজীদ হলো একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা (Political system)। জীবিত ও জড় প্রত্যেকটি অবস্থাই এতে নিয়মতান্ত্রিক করা হয়েছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কুরআন মজীদ অত্যন্ত শক্তিশালী ও নির্মল। এটা সব সময়ই উপকার করার জন্যে আদেশ করে থাকে। সামাজিক সাম্যকে এটা জোরদার করে। এটা সভ্যতার ওপরও একটা অনুকূল প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একগুঁয়েমি ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কুরআন মজীদের প্রতি সবচেয়ে মারাত্মক অজ্ঞতাপূর্ণ সমালোচনা দ্বারা ওর বিরোধিতা করার মতো উদ্ভট ও অন্যায় আচরণ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। কেননা, এটা মানব জাতির উপকার ও সুখ-শান্তির জন্যে প্রেরিত খোদাতা’লার সবচেয়ে মূল্যবান ঐশীগ্রন্থ।” (লর্ড ড্যাভেনপোর্ট)
অতএব, এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেচনাশীল ব্যক্তি-ই কুরআন মজীদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং নিজ উপলব্ধি অনুযায়ী একে সম্মান করেন। এই পবিত্র গ্রন্থটি সম্পর্কে ‘মরুভূমির আইন-কানুন’ বলার মতো আর কোনো দুর্নীতি, নিচুতা ও আহাম্মকী হতে পারেন না।
আপত্তি-১২
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ওই ব্যক্তি বলেছে, “প্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো একটি জাতীয় ও পশ্চিমা আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে মরুভূমির আইন-কানুনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবং তারা ধর্মের মাদক ত্যাগ করে সচেতন হয়ে উঠছে।”
জবাব
এই অজ্ঞ, সীমা লংঘনকারী লেখক যাকে ‘মাদক’ বলছে, সেই দ্বীন-ইসলামের সামনে অমুসলমান পণ্ডিতগণও শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন। মখাইম (জার্মান ইতিহাসবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ) বলেন, “দশম শতাব্দীতে ইউরোপকে গ্রাসকারী সেই সব কালো দিনের মতো খারাপ আর কোনো সময়ই হতে পারে না। এমন কি ল্যাটিন জাতিগুলো (গ্রীক/রোমান) যারা যুগের সবচেয়ে প্রগতিশীল ছিল, তারাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিরোনামে যুক্তিবিদ্যা ছাড়া আর কিছুই জানতো না। যুক্তিবিদ্যাকে সকল জ্ঞানের শাখা হতে শ্রেষ্ঠ ধারণা করা হতো। সেই সময় মুসলমান জাতি-ই স্পেন ও ইতালিতে বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন খৃষ্টানগণ এই সকল স্থানে জ্ঞান শেখার জন্যে সমবেত হতেন। ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি শিক্ষা করেই তাঁরা খৃষ্টান বিদ্যাপীঠ চালু করেন।” (মখাইম)
আলোকোজ্জ্বল ইসলামী সভ্যতা যাকে সারা বিশ্নের ইতিহাসবিদগণ সর্বসম্মতভাবে প্রশংসা করেছেন, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সকল গুণীজন দ্বারা, যাঁরা কুরআন মজীদকে অনুসরণ করতেন। আজকে বিজ্ঞান অগ্রগতি-প্রগতি সাধন করেছে এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় বিশাল আকৃতির শিল্প-কারখানাসমূহ স্থাপন করা হয়েছে। মহাশূন্য ভ্রমণও সূচিত হয়েছে। কিন্তু এ সব দেশের কোনোটাতেই মানসিক শান্তি বিধান করা সম্ভব হয় নি। শিল্প-কারখানার মালিকদের অপব্যয় ও ভোগ-বিলাস এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের দারিদ্র্য আজো দূর হয় নি। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্র জনগণকে শোষণ করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় শুধুমাত্র তাদের খাদ্যের জন্যে কাজ করছে; আর একটি নিষ্ঠুর, রক্ত-পিপাসু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ওই সব ক্ষুধার্ত জনগণের ওপর ভর করে বিলাসী জীবন যাপন করছে। এরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে সব ধরনের বদ কাজ সংঘটন করছে। যেহেতু তারা কুরআন মজীদকে মান্য করে নি, সেহেতু তারা সুখ-শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সভ্য হতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এবং কাজ করে উপার্জন করার ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুকরণ করা জরুরি, কেননা কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ বিজ্ঞান ও কলাসমূহের প্রগতি হাসিল করার জন্যে আদেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আদী ও ইমাম মানাবী বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর প্রগতি অর্জনকারী ও কর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী বান্দাকে ভালোবাসেন” (আল্ হাদীস)। হাকিম, তিরমিযী ও ইমাম মানাবী বর্ণিত অপর এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন - “নিশ্চয় আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাকে কোনো একটি কর্ম-বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত দেখতে চান” (আল্ হাদীস)। তবে কেবলমাত্র এই যোগ্যতা অর্জন করাই সভ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। উপার্জনের মাধ্যমে যে রহমত অর্জিত হয়, তা ইনসাফের ভিত্তিতে ভাগ করে নিতে হবে এবং শ্রমিককে তার শ্রমের সমপরিমাণ প্রাপ্য প্রদান করতে হবে। আর এ ন্যায়বিচার ও ইনসাফ একমাত্র কুরআন মজীদকে অনুসরণ করেই হাসিল করা সম্ভব। আজকে ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়া সেই সব কাজেই সাফল্য লাভ করছে যেগুলোতে তারা দ্বীন ইসলামের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখছে। কিন্তু যেহেতু সুবিধাগুলো কুরআন মজীদের মধ্যে অবস্থিত ন্যায়ের নীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে বণ্টন করা হচ্ছে না, সেহেতু জনগণ সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে না, শ্রেণী সংঘাতও এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যারা কুরআন মজীদকে মান্য করে না, তারা কোনোক্রমেই সুখি হতে পারে না। যারা ওতে বিশ্বাস রেখে কিংবা না রেখে মান্য করে, হোক তারা মুসলিম কিংবা অমুসলিম, তারা এই পৃথিবীতে ততোটুকু সুবিধাই হাসিল করতে সক্ষম হয় যতোটুকু তারা মান্য করে। যারা ওতে বিশ্বাস রাখে এবং মান্য করে তারা এ পৃথিবীতে এবং পরবর্তী জগতে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়। তারা এ পৃথিবীতে সুখ-শান্তিতে বসবাস করে এবং পরবর্তী জগতে অনন্ত কল্যাণ ও অশেষ নেয়ামতের শরীকদার হয়। ইতিহাস এবং দৈনন্দিন ঘটনাবলী পরিস্ফুট করে যে এ কথাটি সত্য। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যারা কুরআন মজীদ কর্তৃক প্রদর্শিত পথটি অনুসরণ করে না, তারা মুসলিম হোক কিংবা না হোক, তারা প্রদর্শিত পথটি হতে যতোই দূরে সরে যাবে, ততোই ক্ষতি ও দুর্দশাগ্রস্ত হবে।
প্রখ্যাত তুর্কী ব্যবসায়ী জনাব সাকিপ সাবানজী বর্ণনা করেছেন যে যখন তিনি তাঁর হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন, তখন হাসপাতালে কর্মরত জনৈক প্রটেস্টান্ট পাদ্রী অস্ত্র্রোপচারের আগে তাঁর দর্শনার্থী হন এবং তাঁকে বলেন, “আগামীকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার আপনার ওপর করা হবে। আপনি আমার ধর্মাবলম্বী নন, আপনি একজন মুসলমান। কিন্তু আমরা সবাই তাঁরই বান্দা। এ রকম একটি নাজুক সময়ে স্রষ্টার সকল বান্দারই উচিৎ স্রষ্টার মাঝে আশ্রয় নেয়া। অতএব, আমি আপনার জন্যে আজ রাতে প্রার্থনা করবো।” এ ঘটনার ব্যাপারে সাকিপ সাবানজীর মন্তব্য হলো: “পাদ্রীর এই কথাগুলো আমাকে কতোটুকু অভিভূত ও অনুপ্রাণিত করেছিল তা ব্যক্ত করার ভাষা আমার জানা নেই।”
সাকিপ সাবানজীর কৃত “আত্মিক মূল্যবোধের দিকে প্রত্যাবর্তন ” (Turning Towards the Spiritual Values) প্রবন্ধটি, যা ১৯৮১ সালের ৮ই মার্চের একটি তুর্কী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তা নিম্নে বিধৃত হলো:
এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তবে আরেকটি দৃশ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি, বস্তুগত ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানের উন্নতি সাধন মানুষকে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে না। সর্বোপরি, একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উপনীত হবার পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং বস্তুগত সম্পদ বৃদ্ধিতে সাফল্য পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় কেবলমাত্র ‘আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ’ অর্জনের দ্বারাই।
জাপানী মডেল নামের উন্নতি-ই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আজকাল তুরস্কে ‘জাপানী ধাঁচের রফতানী’ ও ‘জাপানী ধাঁচের শিল্প-কারখানা’ শীর্ষক অনুপ্রেরণাদায়ক বাক্যগুলো অহরহ-ই উচ্চারিত হয়ে থাকে প্রাত্যহিক জীবনে।
জাপানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কারখানাতেই কার (মটর গাড়ি) নির্মাণ শিখেছিল। অল্প সময়েই কিন্তু তারা ওই সকল বড় বড় কোম্পানীর সাথে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারেই নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। তারা আরো অধিক সাফল্যের সাথে প্রস্তুতকৃত সামগ্রী বিক্রি করতে আরম্ভ করে।
আমার বিশ্বাস, জাপানীদের এই কৃতিত্বের জন্যে তিনটি কারণ রয়েছে: (১) প্রযুক্তি, (২) শৃংখলা বজায় রেখে কর্ম উদ্যোগ এবং (৩) ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ।
এক দেশ হতে আরেক দেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর সম্ভব, যদিও এর একটি নির্দিষ্ট ব্যয়ভার ও পরিশ্রম আছে। কিন্তু সুশৃংখল কর্ম উদ্যোগ, ঐতিহ্যের সুষ্ঠু ধারণ ও নৈতিক মূল্যবোধ ক্রয়ের টাকা পরিশোধ করার সাথে সাথেই স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ সকল বিষয় এ দেশে (তুরস্কে) বর্তমানে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হচ্ছে।
যখন আমরা মনোযোগ সহকারে আমাদের অতীতকে পর্যবেক্ষণ করি এবং জাপানের সাথে তুলনা করি, তখন আমরা দেখতে পাই যে তুর্কীরা ছিলেন সেই সব বিরল জাতির মধ্যে একটি যাঁরা ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিলেন, কর্ম উদ্যোগে শৃংখলা বজায় রেখেছিলেন এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
তুর্কীদের একটি শক্তিশালী পারিবারিক কাঠামো বিরাজমান। পরিবারের বয়োবৃদ্ধকে ঘিরে অন্যান্য সদস্যরা জড়ো হন। তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ও শ্রদ্ধা বিদ্যমান। তিনিই কনিষ্ঠদেরকে রক্ষা করার দায়-দায়িত্ব বহন করে থাকেন।
একজন তুর্কী তাঁর দেশ, পতাকা, ধর্ম ও সততার খাতিরে সংগ্রামরত। এটা তাঁর একটা পবিত্র সংগ্রাম । যুদ্ধের ময়দানে একজন তুর্কী ‘আল্লাহর নামে’ লড়াই করেন। কোনো নতুন কাজ আরম্ভ করার সময়ও তিনি তাঁরই নামে আরম্ভ করেন। তিনি প্রিয়জনদেরকে আল্লাহতা’লার হেফাযতে সমর্পণ করেন।
তুর্কীদের মধ্যে সৃষ্টিশীল কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিয়মবদ্ধকারী আচার ও ঐতিহ্যসমূহের একটা পদ্ধতি আছে। এ সকল ক্ষেত্রে তুর্কীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শৃংখলার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ব্যবসায়ীদের পুরোনো সমাজগুলো, সমবায় সমিতিগুলো, প্রতিটি সৃষ্টিশীল কর্মের রক্ষাকারী মালিক কর্তৃপক্ষ এবং মালিক, সহকারী মালিক ও শিক্ষানবীশদের মধ্যে সুসম্পর্ক।
দ্বীন ইসলামই হচ্ছে বহু শতাব্দী যাবত সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ তুর্কীর বন্ধন স্থাপনকারী মৌলিক আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উৎস।
১৯৮১ সালের এই দ্বিতীয়ার্ধে তুরস্কের ইতিবৃত্ত মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ সকল “নৈতিক মূল্যবোধ” যেগুলোকে অতীতে ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু সাম্প্রতিককালে অবহেলা করা হয়েছে, সেগুলোকে স্মরণ করার মধ্যে বহু উপকার নিহিত রয়েছে। আমরা যে সিরিয়াস সামাজিক ও রাজনৈতিক অনিয়ম হতে মুক্তি পেতে চেষ্টা করছি, সেই অনিয়মের দোষ-ত্রুটি আমরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণসমূহের ওপর আরোপ করতে পারি না।
আমাদের (তুর্কীদের) জনসংখ্যা, যা পাঁচ কোটিরও অধিক এবং প্রতি বছরই যা দশ লাখ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার আবাসস্থল তুরস্ককে ‘সমসাময়িক সভ্যতার সমপর্যায়ে’ এবং ‘মানব মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি জীবনযাত্রার মান’ প্রদান করতে আমরা দায়বদ্ধ। তবে আমরা যতোটুকু সাফল্যই অর্জন করি না কেন, এটা পরিস্ফুট যে শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নতি সাধন করেই ৫ কোটি মানুষের সামগ্রিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আমাদের সার্বিক আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোকে সবার সামনে পেশ করা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। এগুলোই ৫ কোটি মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে আরো কাজ করার প্রেরণা যোগাবে। যারা বৈষয়িক সমস্যাসমূহের কাছে অসহায় তাদেরকে আশা ও কাজ করার প্রেরণা যোগাবে আল্লাহতা’লায় বিশ্বাস, আল্লাহ-ভীতি (তাক্ওয়া বা পরহেযগারী) ও দ্বীন ইসলাম। এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উপকারী হতে হলে আত্মিক উন্নতি অত্যাবশ্যক। দয়া করে মনে রাখবেন যে, চাঁদে অবতরণকারী (প্রথম) নভোচারীর পকেটে ধর্মের বই ছিল।
অতএব, আমাদের লক্ষ্য হবে চাঁদে গমনের প্রযুক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করা . . . . কিন্তু এই প্রযুক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের পরও আল্লাহতা’লার সাহায্য ও সমর্থন অন্বেষণ করা।
আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আত্মিক মূল্যবোধ অর্জনে অনুপ্রেরণা যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বীন ইসলামের সুমহান আদর্শ হতে মদদ অন্বেষণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভ্যতার দিক-নির্দেশনা হিসেবে আত্মিক সমর্থনের জন্যে আমরা ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। আরো কাল ক্ষেপণের আগেই আমাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা চালু করা উচিৎ।
ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকার ফলে চিন্তা-চেতনা ও কর্মের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা বোধ জাগ্রত হবে যা আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। এটা পারস্পরিক বিরোধিতাকে ন্যূনতম ও শান্তিপূর্ণ করবে এবং অভ্যন্তরীণ শান্তির ভিত্তি রচনা করবে। ফলে আরো মৌলিক ও আরো শক্তিশালী একটা সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটবে।
নতুবা আত্মিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যশূন্য মানুষের বিশাল জনস্রোতকে শাসন ও সুখী করা একেবারেই অসম্ভব। এই ধরনের একটা সমাজে সহজে সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে - “তোমরা বিষন্ন হয়ো না, দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয়ো না। যদি তোমাদের ঈমান দৃঢ় হয়, তবে নিশ্চয় তোমরা কামিয়াব বা সফলকাম হবে” (আল্ আয়াত)।
আমরা শুনি এবং পড়ি যে, আজকাল সারা বিশ্বের মানুষেরা একে অপরকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানতে চেষ্টা করছে এবং ইতিপূর্বে তারা যে সব জিনিসকে প্রত্যাখ্যান করতো সেগুলোর প্রতি তারা বর্তমানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আমি শুধু একটা সহজ উদাহরণ দেবো: মার্কিনীরা বিশেষ করে দাবি করতো যে দ্বীন ইসলামের মধ্যে বহু নিষ্ঠুর আইন রয়েছে এবং তারা এ দাবির সমর্থনে চোরের হাত কাটার বিধানকে দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করতো। আমরা বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছি এবং না হেসে পারি নি যখন দেখেছি যে, ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর ডগ্লাস হাফ্ সম্প্রতি তাঁর রাজ্যে চুরি-ডাকাতির হার বৃদ্ধিতে মুসলমান দেশগুলোর মতো চোরের হাত কাটার আইন পাশ করার সুপারিশ করেছেন। সিনেটর তাঁর সুপারিশপত্রে লিখেছেন, ‘এটা আপনাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কিন্তু আমি আর কোনো সমাধান দেখছি না। আমি মনে করি, খোদা তা’লা তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ করেন যে এই শাস্তিটি যথাযথ। যারা অপরাধ সংঘটিত করে তাদের উচিৎ খোদা তা’লাকে ভয় করা।’ অতএব দেখতেই পাচ্ছেন যে, মানুষেরা দিনকে দিন ইসলামের আইন কানুনের নিকটবর্তী হচ্ছে। এক স্রষ্টার দিকে আহ্বানকারী সর্বাধুনিক ধর্ম ইসলামের মধ্যে সমগ্র জগতের ধর্ম হওয়ার সকল কারণই বিদ্যমান।
আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি যে, ধর্ম হলো সেই শক্তির উৎস যেটা আমাদেরকে ক্ষতিকর বদ কর্মসমূহ সংঘটন করা হতে রক্ষা করছে; আমাদের উচ্চাভিলাষকে রহিত করছে; আমাদের আত্মাগুলোকে সজীব ও পরিশুদ্ধ করছে; আমাদের সদ-অভ্যাসগুলো বিকশিত করে নম্র, ভদ্র ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ বানাচ্ছে; গুরুজন এবং আইন-কানুন মান্য করতে শিক্ষা দিচ্ছে; বিদ্রোহী হতে নিষেধ করছে; আমাদের বিষয়সমূহে সাফল্য অর্জনে আশার সঞ্চার করছে; ব্যর্থতায় শান্ত্বনা যোগাচ্ছে; আমাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করছে; জীবনী শক্তি ও বেঁচে থাকার আশা যোগাচ্ছে; পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানব বানিয়ে আল্লাহতা’লার পথে পরিচালিত করছে। সংক্ষেপে, এ পৃথিবীতে এবং পরবর্তী জগতে আমাদেরকে সুখ-শান্তি অর্জনের দিকে নির্দেশনা দিচ্ছে।
আমাদেরকে আমাদের ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে হবে, এর আদেশ-নিষেধ মান্য করতে হবে এবং এর মূল্য অনুধাবন করতে হবে। শুধুমাত্র নগণ্য পার্থিব স্বার্থে কিংবা হীন ব্যক্তিগত স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার করা হতে আমাদের বিরত থাকা উচিৎ। এই আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ এবং এই পবিত্র ধর্ম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সব ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দ্বারা, যারা ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ ও কদর্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে মানুষকে ধোকা দিয়েছে এবং ‘দ্বীন গেল, দ্বীন গেল’ বলে মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। [বাংলাদেশেও ওহাবীপন্থী ও মওদূদীবাদী চক্র অনুরূপ ধর্ম ব্যবসা চালু করেছে - অনুবাদক]
ধর্ম ব্যবসায়ীরা এবং ভুয়া বিজ্ঞানীরা এই দেশ ও জাতির সুখ-শান্তি বিঘ্নিত করেছে। ধর্ম-ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করে অনৈসলামী বহু বিষয়কে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে। পক্ষান্তরে, ভুয়া বিজ্ঞানীরাও নিজেদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে যুব সম্প্রদায়কে ধর্মে অবিশ্বাসী বানাতে নিজেদের অবৈজ্ঞানিক, ধ্বংসাত্মক ও বিভক্তি সৃষ্টিকারক কথাবর্তাকে যুব সম্প্রদায়ের কাছে বিজ্ঞান হিসেবে পেশ করতে তৎপর হয়েছে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধার্মিক লোক সেজে ধর্মপ্রাণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে। পক্ষান্তরে, ভুয়া বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত হওয়ার ভান করে এবং নিজেদের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিজ্ঞানের ওপর মানুষের আস্থাকে ব্যবহার করেছে। আমাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী ও ভুয়া বিজ্ঞানী উভয়ের ধোকাবাজী সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
সাম্প্রতিককালেও এমন কিছু কপট লোকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে বেশির ভাগ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও ডাকাত যাদেরকে বোমা, দূরবীণসম্পন্ন বন্দুক, ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান, রকেট ও বেতারযন্ত্রসহ আটক করা হয়েছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া বিজ্ঞানী। বাকিরা শ্রমিক, নয়তো তাদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত শিক্ষানবীশ নর-নারী।
দ্বীন ও বিজ্ঞান মানুষের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী দুইটি সহায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান শান্তি, কল্যাণ ও সভ্যতার জন্যে প্রয়োজনীয় মাধ্যম ও কারণসমূহ সৃষ্টি করে থাকে। দ্বীন এ সকল মাধ্যমকে শান্তি, কল্যাণ ও সভ্যতার জন্যে ব্যবহার করতে প্রেরণা যোগায়। সমাজতন্ত্রীরা বিশাল আকৃতির শিল্প-কারখানা ও চোখ ধাঁধাঁনো রকেট ও উপগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছে জার্মানী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে চুরি করা প্রযুক্তি দ্বারা। তবুও তাদের মধ্যে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই বিরাজমান, কোনো ধর্মীয় চেতনা বিরাজমান নেই। এ কারণেই তারা তাদের জনগণকে নিষ্পেষণ করতে এবং অন্য জাতিগুলোকে আক্রমণ করতে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে গণ্ডগোল-হট্টগোল বাঁধিয়ে রাখতে বৈজ্ঞানিক উপকরণসমূহ ব্যবহার করছে। তারা বহু জায়গাকে ইতোমধ্যেই কয়েদখানা বানিয়ে ফেলেছে। বিজ্ঞানে তাদের অগ্রগতি সভ্যতার বিকাশ আনে নি, বরং নির্মম বর্বরতা এনেছে। শান্তি, কল্যাণ ও মানবাধিকার হয়েছে পদদলিত। সংখ্যালঘুর বিনোদনের খাতিরে লক্ষ-কোটি মানুষকে দরিদ্র করা হয়েছে। এ কারণেই আমাদেরকে প্রকৃত দ্বীন শিক্ষা করতে হবে এবং প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। কুরআন মজীদ প্রকৃত মুসলমানদের সম্পর্কে কী ঘোষণা দিয়েছে তা লক্ষ্য করুন - ‘সাবধান! আল্লাহতা’লার বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, তাঁরা সন্তাপগ্রস্তও হবেন না” (সুরা ইউনুস, ৬২ আয়াত)।
আসুন, আমরা দ্বীন ইসলামের আইন-কানুন তথা আল্লাহতা’লার আদেশ-নিষেধে বিশ্বাস স্থাপন করি। প্রিয় পাঠক, এ সকল আইন-কানুন মান্য করেই আমরা পরস্পরের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি উপকারী হতে পারবো এবং শান্তি, কল্যাণ ও সুখ অর্জন করতে সক্ষম হবো”। (জনাব সাকিপ সাবানজীর কৃত “আত্মিক মূল্যবোধগুলোর দিকে প্রত্যাবর্তন” প্রবন্ধটির দীর্ঘ উদ্ধৃতি এখানেই শেষ হলো)
*** সমাপ্ত***
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ্ তা’লার প্রাপ্য যিনি তাঁর অনুপম করুণাস্বরূপ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। হুজূর পূর নূর (দ:)-এর প্রতি নিবেদন করি অসংখ্য দুরুদ-সালাম। অতঃপর সালাম জানাই তাঁর খাঁটি আহলে বায়ত (পরিবার-পরিজন), আসহাবে কেরাম (সাথীবৃন্দ), আয্ওয়াজে মোতাহহারাত (পবিত্র বিবি সাহেবাবর্গ) ও আউলিয়ায়ে কেরাম (খোদার প্রিয় বান্দা)-বৃন্দের প্রতি। বিশেষ করে আমার পীর ও মুরশিদ চট্টগ্রাম বোয়ালখালীস্থ আহলা দরবার শরীফের পীরে তরীকত সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পাক দরবারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি যাঁর আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি ছাড়া আমি এই অনুবাদ কাজ করতে সক্ষম হতাম না।
তুরস্কের বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহ:) সমসাময়িক কালের তথাকথিত প্রগতিবাদী কিন্তু দ্বীন ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণকারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন আপত্তির জবাব এ প্রবন্ধটিতে উপস্থাপন করেছেন। অল্প কথায় এতো সুন্দর জবাব সত্যি দুর্লভ! আশা করি, পাঠকবৃন্দের কাছে এটি সুখপাঠ্য হবে। অনুবাদে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সর্বান্তকরণে আমি পাঠকমণ্ডলীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহ পাক সকলকে উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন, আমীন! আমার পীর ও মুরশিদ কেবলার ওসীলায় আল্লাহ্ তা’লা এ লেখাটি কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন, সুম্মা আমীন!
দ্বীন জ্ঞানে অজ্ঞ এক ব্যক্তির প্রতি জবাব
রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ করেছেন - “প্রত্যেক শিশুই পৃথিবীতে একটি নিষ্পাপ আত্মা নিয়ে মুসলমান হওয়ার অভিপ্রায়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার পিতা-মাতা পরবর্তী পর্যায়ে তাকে ধর্মহীনতার দিকে টেনে নিয়ে যায়” (আল্ হাদীস)। হাদীসটি পরিস্ফুট করে যে শিশুদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেয়া অত্যাবশ্যক। তাদের খাঁটি ও নির্মল আত্মা ইসলামের জন্যে উৎসর্গিত। ইসলামী শিক্ষাপ্রাপ্ত নয় এমন একজন শিশু ইসলামের শত্রুদের মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসায় বিশ্বাস করে ইসলামকে ভুল বুঝতে পারে। সে ইসলামকে পশ্চাদগতিশীল ও বদ মনে করতে পারে। ইসলামী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তি, যে নাকি ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে নি, সে যদি ইসলামের শত্রুদের ফাঁদে পা দেয়, তবে সে ইসলাম হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন বরং উল্টো বিষয়ই শিক্ষা করবে। তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা শরমহীন মিথ্যা লেখনী এবং বিষাক্ত ধ্যান-ধারণার শিকারে সে পরিণত হবে। সে পৃথিবীতে শান্তি খুঁজে পাবে না। আর পরবর্তী জগতে সে অন্তহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হবে।
যুব সম্প্রদায়কে ধোকা দেয়ার জন্যে দ্বীন ইসলামের শত্রুদের বানানো এ সকল কুৎসা কতো জঘন্য ও হীন তা প্রত্যেক মুসলমান, এমন কি প্রত্যেক ব্যক্তিরই জানা আবশ্যক। এ সব মিথ্যায় বিশ্বাস করে আযাবের মধ্যে ডুবে না যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে হবে এবং এটা যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও নৈতিকতাকে সমর্থন করে এবং অগ্রগতি-প্রগতি, সহযোগিতা, কর্ম উদ্যোগ ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যকে আদেশ করে, তা আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে। ইসলামকে ভালোভাবে এবং সঠিকভাবে অনুধাবনকারী একজন বুদ্ধিমান, সচেতন ও সভ্য ব্যক্তি ইসলামের শত্রুদের তৈরি করা বানোয়াট ও মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করবেন না। তাদেরকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও ধোকাপ্রাপ্ত হীন প্রকৃতির লোক হিসেবে দেখে তিনি তাদের প্রতি করুণা করবেন। তিনি তাদেরকে এই অধঃপতিত অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেয়ে সঠিক পথে ফেরার জন্যে তাদের শুভ কামনা করতে থাকবেন।
আমরা এ রকম দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ এক ব্যক্তির লজ্জাহীনভাবে রচিত কিছু পাতার একটি ছোট পুস্তিকা পেয়েছি, যার মধ্যে সে তার লেখা বিষাক্ত ও অনন্ত দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর মিথ্যাসমূহ সন্নিবেশিত করেছে সৎ ও পবিত্র আত্মাগুলোকে নিজের পরিণতি বরণ করানোর অসৎ উদ্দেশ্যে। লেখকের খেতাব দেখে কর্তৃত্বসম্পন্ন মনে করে যারা ভুল বুঝে, তারা সত্য, সততা ও নৈতিকতাকে কুৎসা রটনাকারী লেখনীটি দেখে হয়তো মনে করতে পারে যে সেটা জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই বুঝি রচিত। লেখনীটির সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও ক্ষতি দূর করার মহৎ লক্ষ্যে আমরা ১২টি অনুচ্ছেদ এই ঘৃণ্য মিথ্যাচারকে জবাব দেয়ার জন্যে উৎসর্গিত করেছি। নির্মল আত্মার যুব সম্প্রদায় এর দ্বারা সত্য উপলব্ধি করে অতি সহজেই ইসলামের শত্রুদের কূট-কৌশল সম্পর্কে অবগত হতে পারবে এবং নিজেদেরকে প্রগতিবাদী দাবিদার সেই সব বুদ্ধিহীন, দুরাত্মা অবিশ্বাসীদেরকে কাছে থেকে চেনতে পারবে।
আপত্তি-১
সে বলেছে, “সামাজিক জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ধর্মীয় দর্শন ও নিয়ম হচ্ছে সামাজিক প্রগতির প্রতিবন্ধক শেকলস্বরূপ।”
জবাব
রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “তোমরা দুনিয়াদারী এমনভাবে সম্পন্ন করতে থাকো যেন তোমাদের মৃত্যু-ই হবে না” (আল্ হাদীস)। ইমাম মানাবী (রহ:) কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস শরীফে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো ঈমানদার ব্যক্তির হারানো সম্পত্তি” (আল্ হাদীস)। তাই মোমেন ব্যক্তির উচিৎ এর সন্ধান পাওয়ামাত্রই তা হস্তগত করা। শত্রু হোক কিংবা মিত্র হোক, বিজ্ঞানের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিত্বই সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেন যে দ্বীন ইসলাম সমাজের প্রগতিকে সমর্থন করে এবং সভ্যতার পথে আলোর মশাল জ্বালায় । উদাহরণস্বরূপ, বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “মুসলমানদের মতো আর কোনো (পৃথিবীতে আগত) জাতি-ই জ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে এতো সম্মান প্রদর্শন করেন নি” (হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও কুরআন মজীদ - Hadrat Muhammad and the Quran শীর্ষক গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১ম অধ্যায়, লন্ডন হতে প্রকাশিত)। তিনি উদাহরণ ও দলিল সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন যে ইসলাম ধর্ম সমাজসমূহকে প্রগতি ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেছে।
১৯৭২ সালে টেক্সাস্ টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ডঃ ক্রিস্ ট্র্যাগ্লোর সাহেব এক বিশাল শ্রোতামণ্ডলীর মাঝে ভাষণদানকালে বলেন যে ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রেরণা ও বিকাশের উৎস ছিল দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানগণ স্পেন ও সিসিলি এসে আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রগতির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁরা শিক্ষা দেন যে রসায়ন, চিকিৎসা, সৌরবিদ্যা, নৌ-বিদ্যা, ভূগোল, মানচিত্র অংকন বিদ্যা, গণিত ইত্যাদি শাস্ত্রে উন্নতি সাধনের মাধ্যমেই প্রগতি অর্জন সম্ভব। অধ্যাপক ট্র্যাগ্লোর সাহেব আরো বলেন যে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে এ সকল জ্ঞানের শাখা মুসলমানগণই নিয়ে এসেছিলেন। তিনি আরো অভিমত প্রকাশ করেন যে আধুনিক প্রকাশনার উন্নতির ক্ষেত্রে প্যাপিরাস পাতা ও জন্তুর মূল্যবান চামড়ার ওপর লিখিত ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ অবদান রেখেছিল। (সাপ্তাহিক মুসলিম বিশ্ব - The Muslim World, পাকিস্তান ২৬ শে আগষ্ট ১৯৭২ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। অতএব, টাইটেল বা খেতাবসম্পন্ন একদম অজ্ঞ ও দুর্নীতিপরায়ণ ইসলামের কোনো শত্রুর মিথ্যা কাহিনীসমূহ এ তথ্যটিকে ধামাচাপা দিতে পারবে না। কেননা, কাদা দিয়ে কখনোই সূর্যকে ঢেকে দেয়া সম্ভব নয়।
আপত্তি-২
সে বলেছে, “ধর্মের শেকল থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা আবশ্যক। সমসাময়িক পশ্চিমা সভ্যতার সমপর্যায়ে যেতে হলে একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা অর্জন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।”
জবাব
দ্বীন ইসলামে ইতিপূর্বে জ্ঞান, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে সম্পূর্ণভাবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইসলাম রাষ্ট্রকে ভাঁওতাবাজ রাজনীতিবিদদের হাতে ক্রীড়নক হওয়া থেকে রক্ষা করে। পুঁজিবাদী গোষ্ঠী, একনায়কতন্ত্রী চক্র এবং সমাজতন্ত্রের সেবাদাস গং এ ধরনের একটি স্বাধীন প্রশাসনকে নিজেদের নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার-অবিচার ও দুর্নীতির জন্যে শেকলস্বরূপ দেখে থাকে। খুনী, চোর ও অসৎ লোকেরা ন্যায়বিচার ও আইনকে নিজেদের জন্যে শৃংখল হিসেবে গণ্য করে থাকে। ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়ে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ এবং ধর্মের ধ্বংস সাধন করার পেছনে এই অবিশ্বাসী লোকটির অজ্ঞতা ও আহাম্মকী সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। এ লোকটি যা চাচ্ছে তা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথকীকরণ নয়, বরং ধর্মের ধ্বংস সাধন। এটা বোধগম্য যে, রাষ্ট্র ও জাতির প্রগতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, কর্ম উদ্যোগ ও নৈতিকতা হতে যে আহাম্মক ব্যক্তিটি আশা করে না, বরং ইসলামের ধ্বংস সাধন করতে চায় যা ওই সকল মাহাত্ম্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং যে নাকি পশ্চিমা দুর্নীতি, অশ্লীলতা ও অহমিকা বোধকে কামনা করে, সে শুধুমাত্র জ্ঞান ও বুদ্ধিশূন্যই নয়, সে নৈতিকতাশূন্যও।
আপত্তি-৩
সে বলেছে, “তুষ্ট থাকার ইসলামী দর্শন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা আশা করে যে মানুষেরা নিজেদের অধিকার আদায় সম্পর্কে সচেতন থাকবে না। সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার অজুহাতে তারা মানুষের ধারণকৃত দাসত্ব ও পরকালের ধ্যান-ধারণাগুলো সমর্থন করে। তুষ্ট থাকা শোষণের একটি বাহন ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামের অনুসারীরা এ শোষণকে প্রচার-প্রসার করছে।”
জবাব
“তুষ্ট থাকার ইসলামী দর্শন” - বাক্যটির মতো এমন উদ্ভট বাক্য খুব কম-ই আছে। আমরা Endless Bliss (অনন্ত কল্যাণ) গ্রন্থে দর্শনের মানে কী তা ব্যাখ্যা করেছি এবং সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি যে দ্বীন ইসলামে কোনো দর্শন থাকতে পারে না। এ ধরনের একটি ভুল বাক্য প্রতিভাত করে, যে ব্যক্তি তা ব্যবহার করে সে ইসলাম ধর্ম অথবা দর্শন সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং সে ব্যক্তি অর্থ না জেনেই বহু বাক্য মুখস্থ করে বাক্যসমূহের পাহাড় গড়ে তুলেছে, যাতে করে সে ইসলামের প্রতি নিজের শত্রুতা বিস্তৃত করতে পারে। বহু শতাব্দী যাবত ইসলামের শত্রুরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের ছদ্মবেশ ধারণ করে সেই মুখোশের অন্তরালে থেকে ক্ষতি সাধন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা উচ্চপদের সনদ লাভ করে বিভিন্ন পেশা ও শিল্পকলার ছদ্মাবরণে ইসলামকে আক্রমণ করছে। সেই মিথ্যুক লোকেরা যারা মুসলমানদেরকে ধোকা দেয়ার জন্যে নিজেদেরকে বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দেয় এবং নিজেদের অবৈজ্ঞানিক কথাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান হিসেবে পেশ করে, তাদেরকে বলা হয় “বিজ্ঞানী ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ।” শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক জাতির নীতিগ্রন্থেই তুষ্ট থাকাকে প্রশংসা করা হয়েছে। এই বিজ্ঞানী ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ লোকটি যা বানিয়ে নিয়েছে তার ঠিক বিপরীত অর্থে, তুষ্ট থাকা হচ্ছে নিজ অধিকার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, নিজ আয়ের ওপর রাজি থাকা এবং অন্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। এটা মানুষদেরকে অলস বানিয়ে দেয় না, বরং কাজ করে প্রগতি অর্জনে উৎসাহ যোগায়। এই ধোকাবাজের মিথ্যাচারের ঠিক বিপরীত অর্থে, দ্বীন ইসলাম দাসত্বকে সমর্থন করে না, বরং দাসদের মুক্তির আদেশ দেয়। দাসত্ব ইসলামে নয়, বরং একনায়কতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিরাজমান। আসমানী কেতাবসমূহ এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ:) যাঁদের অলৌকিক ক্রিয়া (মা’জেযা) পরিদৃষ্ট হয়েছে, তাঁরা পরবর্তী জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর দিয়েছেন; জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিজ্ঞান তা অস্বীকার করতে পারবে না। এই বিচ্যুত অজ্ঞ লোকটির কথাবার্তা একদম একগুঁয়ে ও আবেগ-তাড়িত। সে কোনো কিছুর উদ্ধৃতিও দিচ্ছে না, আবার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিরও শরণাপন্ন হচ্ছে না। পরকালে বিশ্বাস সমাজ ও রাষ্ট্রে নিয়ম, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। এতে অবিশ্বাস আলস্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অহংবোধ, উচ্ছৃংখলতা, ফিতনা ও শত্রুতার দ্বার উন্মোচিত করে। উপকারী কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করা সব সময়ই ভালো। ভিত্তিহীন ও ব্যর্থ কোনো জিনিসকে বর্জন করা যুক্তিসঙ্গত এবং প্রয়োজনীয়। ইসলাম শোষণ ও ব্যক্তি অধিকার খর্ব করাকে সমর্থন করে না। যেহেতু শোষণ একটি পাপ, সেহেতু কারো ক্ষতি সাধনকে অনুমোদন করার কোনো অনুমতি-ই নেই। ইসলামে অজ্ঞতা, আলস্য, ব্যক্তি অধিকারকে অবহেলা ও ধোকাপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো ওজর নেই; এগুলো দূষণীয় অপরাধ। একটি প্রখ্যাত প্রবাদ বাক্য বিবৃত করে - “যে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তাকে করুণা করা যায় না।” শোষণ কীভাবে ইসলামে বিরাজ করতে পারে? জ্ঞানী ও বিবেচনাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি কীভাবে এ কথা বলতে পারে? যে অজ্ঞ লোকটি এ কথা বলে, সে কি ব্যক্তি অধিকারকে সমর্থনকারী আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফগুলো শোনে নি? সেগুলো না জানা কিংবা না শোনা তার জন্যে তো ওজর হতে পারে না!
আপত্তি-৪
সে বলেছে, “প্রাচ্য দেশগুলো ধর্ম দ্বারা মাদকাসক্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঈমান রাখা হলো দাসত্ব।”
জবাব
ইতিহাসের যে কোনো পাঠকই সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর মাহাত্ম্য এবং এই তথ্যটি উপলদ্ধি করতে পারবেন যে ইসলাম সক্রিয়, জ্ঞানান্বেষী, ন্যায় ও ইনসাফ-সম্পন্ন এবং সাহসী জাতিসমূহ গঠন করেছে। এর সহস্র উদাহরণ এবং এ বিষয়টি প্রতীয়মানকারী শত-সহস্র বইপত্র প্রকাশ্যে বিদ্যমান। অন্ধ ব্যক্তি সূর্যকে দেখতে না পেলে আফসোস! এটা কি সূর্যের দোষ? শত্রু-মিত্র সকল জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি-ই যেখানে এই মহান ধর্মকে, সভ্যতা ও সুখ-শান্তির এই উৎসকে পুলকিত নেত্রে অবলোকন করছেন, সেখানে একজন অজ্ঞ ও ধোকাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কুৎসা রটনার কী-ই বা মূল্য আছে? কথা ও লেখনী সব সময় ওর কর্তাকে প্রতিফলন করে। বহু মানুষ আছে যারা নিজেদের শত্রুদের ওপর ক্ষেপে গেলে তাদের প্রতি নিজেদের দোষগুলোই চাপিয়ে দেয়। অতএব, একজন হীন প্রকৃতির ব্যক্তির কথাবার্তা তার বক্র চিন্তাধারাকেই প্রতিফলন করে। তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলো সেই হীরকখণ্ডের মতো যেটা ধূলোয় পড়ে গিয়েছে। একজন বদমায়েশ লোকের দ্বীন ইসলামকে আক্রমণ করা কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। যা আশ্চর্যজনক তা হলো কিছু লোক এ সব ভিত্তিহীন, উদ্ভট কুৎসাকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ সকল কুৎসা জবাব পাওয়ার যোগ্যতাও রাখে না। কোনো অন্ধ লোককে সূর্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা কিংবা কোনো অসুস্থ লিভার-সম্পন্ন লোককে চিনির মিষ্টি স্বাদ সম্পর্কে বলা একেবারেই অর্থহীন। শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যকে অসুস্থ ও ময়লা আত্মাসমূহের কাছে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এগুলোকে জবাব দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদেরকে এ সব কুৎসায় বিশ্বাস করা হতে রক্ষা করা। ওষুধ ব্যবহৃত হয় রোগীকে মৃত্যু হতে রক্ষা করার জন্যে, মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে নয়।
বিশ্ব সভ্যতাকে আলোকোজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে দ্বীন ইসলামকে প্রশংসাকারী শত-সহস্র উদ্ধৃতির মাত্র দুইটি আমরা এখানে উদ্ধৃত করবো। আমরা সেগুলো প্রাচ্য হতে উদ্ধৃত করবো না যাকে সেই অজ্ঞ ব্যক্তিটি ঘৃণা করে, বরং পাশ্চাত্য হতে উদ্ধৃত করবো যার সে গুণকীর্তন করে।
জার্মানীর ধর্মতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ জিন ম্যাখাইম (মৃত্যু: ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন, “এটা ঐতিহাসিক সত্য যে দশম শতাব্দী হতে ইউরোপে বিস্তার লাভকারী জ্ঞান-বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, সৌরবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্র সবই ইসলামী বিদ্যাপীঠ হতে প্রাপ্ত ছিল। বিশেষ করে আন্দালুসিয়া (স্পেন)-এর মুসলমান সমাজ ছিলেন ইউরোপের শিক্ষক। আন্দালুসিয়াকে দখল করার জন্যে রোমান ও গথ (ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি এলাকার আদিবাসী)-রা দুইটি শতাব্দী যাবত চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মুসলমানগণ মাত্র বিশ বছরে তা দখল করে নিয়েছিলেন। পীরানিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে তাঁরা ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলেন। জ্ঞান, বুদ্ধি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁদের বাহুবলের চেয়ে কম ছিল না।”
লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “আজকের ইউরোপ মুসলমানদের কাছে ঋণী। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন - ঐকান্তিকতা, সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব ধন-সম্পদ দ্বারা পরিমাপ করা হয় না, বরং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারাই বিচার করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ শাসিত হয়েছে সবচেয়ে দৃঢ় হস্তে। তিনটি মহাদেশ জুড়ে মুসলমানদের বিস্তৃতি ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত বিজয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।”
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তিটি যখন তার মানসিক বিকৃতির কারণে লিখেছে যে প্রাচ্য মাদকাসক্ত হয়ে ধর্মের মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে, ঠিক তারই বিপরীতে বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্টের মতো নিরপেক্ষ লেখকবৃন্দ তখন তাঁদের বিবেক সহকারে লিখেছেন: “আন্দালুসিয়ার মুসলমান সমাজ যখন পশ্চিমে (পাশ্চাত্যে) জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো বিচ্ছুরণ করছিলেন, তখন প্রাচ্যে মাহমুদ গযনবী জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রসার করছিলেন এবং তাঁর দেশটি বিজ্ঞানীদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। উক্ত ইসলামী শাসক উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিলেন এবং তাঁর আহরিত সম্পদসমূহ ভালো কাজ ও দেশের অগ্রগতি-প্রগতি ও উন্নতির জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। প্রাচ্যে যখন এ রকম কল্যাণ ও সভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, ঠিক তখনি ফ্রান্সের লুই-৭ ‘ভিত্রি’ নামের শহরটি দখল করে নেন এবং তা জ্বালিয়ে দেন, আর তেরো’শ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারেন। সেই দিনগুলোতে গৃহযুদ্ধসমূহ ইংল্যান্ডে হত্যাযজ্ঞের দ্বার উন্মোচিত করতো; ইংল্যান্ড তখনো চাষাবাদযোগ্য ছিল না, ফলে সব উন্নতি ব্যাহত হয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব-সংঘাত এতো বেদনাক্লিষ্ট, এতো প্রলয়ংকরী ছিল যে ইতিহাস অনুরূপ কোনো কিছু আর প্রত্যক্ষ করে নি। কিন্তু প্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোতে ফিরোজ শাহ্ তুঘলক যিনি ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর মসনদে আরোহণ করেন, তিনি ৭৯০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকালের সময় অবধি পঞ্চাশটি খাল ও বাঁধ, চল্লিশটি মসজিদ, ত্রিশটি স্কুল, এক’শটি গণ-আবাস, এক’শটি হাসপাতাল, এক’শটি গণ-স্নানাগার এবং এক’শ পঞ্চাশটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। ভারতের শাহ্ জাহানের শাসনামলে কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল। আলী মুরাদ খাঁন নামের একজন প্রকৌশলীর মাধ্যমে তিনি দিল্লীর খাল নির্মাণ করেছিলেন। শহরের সকল অংশেই মার্বেল পাথরের ফোয়ারা ও মার্বেলের গণ-স্নানাগার নির্মিত হয়েছিল। প্রত্যেকটি ঘরেই পানির সরবরাহ ছিল। রাষ্ট্রটি নিরাপদ ছিল।” (লর্ড ড্যাভেনপোর্ট)
আপত্তি-৫
সে বলেছে, “ধর্ম হলো অদৃষ্টবাদ ও তুষ্ট থাকার একটি প্রকাশ মাধ্যম। এটা পরবর্তী জগতের একটি ধ্যান-ধারণা যা নির্যাতিত ও ক্ষুধার্তদের অবশ করে দেয়। এটা শিক্ষা দেয় যে পরবর্তী জগতে পরিত্রাণ লাভ করার জন্যে এ পৃথিবীতে কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। বেঁচে থাকার আনন্দ ও প্রয়োজনীয়তা অদৃষ্টবাদ ও তুষ্ট থাকার মতবাদকে চুরমার করে দিয়েছে এবং ভালোভাবে ও বেশি পরিমাণে আয়-রোজগার করার সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। জীর্ণ-শীর্ণ প্রথা ও সংস্কারের ওপর নির্ভরশীল নিয়ম-বিধানের বিরোধিতা যারা করে, তাদেরকে ধর্ম ভয় পায়। ধর্মের মাদক মানুষকে গুরুত্বহীন, দাস ও নিষ্প্রাণ করে দেয়।”
জবাব
এ ধরনের মিথ্যা ও জঘণ্য কুৎসা জবাব পাওয়ার যোগ্যতাও রাখে না। কেননা, কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি সত্য সম্পর্কে জ্ঞাত, তিনি এতে বিশ্বাসই করবেন না। যদিও ইসলামের শত্রুরা জ্ঞানী নয়, তবু তারা চালাক; আর যুব সম্প্রদায়কে ধোকা দেয়ার জন্যে তারা অর্থহীন বিষয়গুলোতে অপতৎপর হয়ে পড়ে এবং যুব সম্প্রদায়কে নফস্ তথা প্রবৃত্তির জন্যে আনন্দদায়ক মাদক সরবরাহ করে, যার দরুণ যুব সম্প্রদায় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা হতে বঞ্চিত হয়। নিরীহ, নিরপরাধ যুব সম্প্রদায়কে এ সকল মিথ্যায় বিশ্বাস করে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষাকল্পে এখানে সংক্ষেপে সত্য কথাগুলো লিপিবদ্ধ করা সঙ্গতিপূর্ণ। যে সৌভাগ্যবান যুবক আমাদের প্রকাশিত “অনন্ত কল্যাণ” (Endless Bliss) গ্রন্থটি পাঠ করেছেন, তিনি সঠিক ও যথাযথভাবে ইসলাম শিক্ষা করতে পারবেন। তিনি কোনো কুৎসায় বিশ্বাস করবেন না। কেননা, রাসূলে করীম (দ:) আমাদেরকে শিক্ষিত ও জ্ঞানী হতে বলেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান - “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে, সে মুসলমান হয়ে যায়। যে ব্যক্তি অজ্ঞ থাকে, সে দ্বীনের শত্রুদের ধোকায় পড়ে যায়” (আল্ হাদীস)।
এ কথা সত্য যে দ্বীন হলো তাকদীর (অদৃষ্ট) ও তুষ্ট থাকায় দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু তাকদীর মানে কর্মবিমুখ হওয়া কিংবা উন্নতি কামনা না করা নয়, যা এ অজ্ঞ লোকটি ধারণা করে নিয়েছে। “কদর” (অদৃষ্ট) মানে হলো আল্লাহতা’লা পূর্বাহ্নেই মানুষেরা কী করবে না করবে তা জানেন। আল্লাহ্ তা’লা মানুষদেরকে কাজ করতে আদেশ করেছেন। তিনি কর্ম সংঘটনকারীদের প্রশংসাও করেছেন। সুরা নিসার ৯৪ আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান - “যারা জেহাদ, কর্ম সংঘটন ও সংগ্রাম করে তারা সেই সব বসে থাকা এবাদতকারী হতে বহু উত্তম ও মূল্যবান যারা জেহাদ পালন করে না” (আল্ কুরআন)। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “আল্লাহ্ তা’লা খেটে খাওয়া উপার্জনকারীদেরকে পছন্দ করেন” (আল্ হাদীস)। ইতিহাসের শিক্ষা ও “অনন্ত কল্যাণ” (Endless Bliss) গ্রন্থের “উপার্জন ও ব্যবসা” শীর্ষক অধ্যায় হতে এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে দ্বীন ইসলাম কাজ করে উপার্জন করার ধর্ম। প্রত্যেক দিন কাজ করে উন্নতি ও অগ্রগতি-প্রগতি অর্জনের জন্যে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - “যে ব্যক্তি পরপর দুই দিন একই অবস্থায় থেকে যায় কিংবা প্রগতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, সে নিজেকেই ধোকা দেয়” (আল্ হাদীস)। তিনি অন্যত্র এরশাদ করেন - “তোমরা আগামীদিনের জন্যে তোমাদের কাজকে ফেলে রেখো না, তাহলে তোমরা বিলুপ্ত হবে” (আল্ হাদীস)। হুজূর সৈয়্যদে আলম (দ:) আরো এরশাদ ফরমান - “বিদেশী ভাষা শিক্ষা করো। এতে তোমরা শত্রুদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে” (আল্ হাদীস)।
পরবর্তী জগতে সুখ-শান্তির চিন্তা কর্ম উদ্যোগকে বাধা দেয় বলাটা অন্যায় ও নিচু মানসিকতা। “যে ব্যক্তি কাজ করে উপার্জন করে, সে পুনরুত্থান দিবসে পূর্ণ চন্দ্রের মতো জ্যোতির্ময় হবে;” “আলেমের ঘুম এবাদত;” “যা হালাল (বৈধ) তা উপার্জন করো এবং তা উপকারার্থে ব্যয় করো;” “দ্বীনী ভাইকে অর্থ কর্জ দানকারী মুসলমানের গুণাহ্সমূহ মাফ করা হবে;” “প্রত্যেক বস্তু অর্জনের একেকটি পদ্ধতি বা পন্থা বিরাজমান, বেহেস্তের পন্থা হলো জ্ঞান”- এই হাদীসগুলো আমাদেরকে কাজ করে উপার্জন করতে আদেশ দেয় এবং ব্যক্ত করে যে পৃথিবীতে যারা তা ব্যয় করে, তারা পরকালে সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে। অথচ অজ্ঞ ব্যক্তিটি বলেছে, “ধর্ম মানুষকে বিদ্রোহ করা হতে বিরত রাখে; অতএব তা মাদক।” তার এ আহাম্মকীপূর্ণ কথাটি প্রতিভাত করে যে সে দ্বীন ও সভ্যতা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এটা নিশ্চিত যে এ কথাটি জ্ঞান কিংবা গবেষণার ফসল নয়। বস্তুতঃ এ ধরনের কথাবার্তাই হলো শোষণ যা সমাজতন্ত্রীমনা প্রভুদের তুষ্টি অর্জনের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে একটা রাষ্ট্রীয় পদ অজর্ন করা সম্ভব হয়। যারা পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ঈমান বিসর্জন দেয় এবং ভ্রান্তি ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তাদেরকে “ধর্মের প্রতারক” বলা হয়। তাদের প্রভুরা, যাদেরকে তারা তোয়াজ করছে, তারা অন্যান্য নশ্বর জীবের মতোই উচ্চপদ হতে পতিত হয়েছে। এ সকল ‘প্রভু’ মহান আল্লাহতা’লার ন্যায়বিচার ও ইনসাফপূর্ণ সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হয়ে চির আযাবের মধ্যে পতিত হয়েছে। অথচ তারা আল্লাহতা’লাকেই অবিশ্বাস ও তাঁর প্রতি একগুঁয়ে বিরোধিতা করেছিল। তাদের চামচা গং তাদেরকে ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্যান্য দলে ভিড়ে গিয়েছে এবং অন্যান্য নশ্বর জীবের মোসাহেবী আরম্ভ করেছে।
আপত্তি-৬
সে বলেছে, “আরব দেশগুলো - যেখানে মরুভূমির আইন–কানুন প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী, সেখানেই তারা বস্তুবাদ ও বস্তুবাদী দর্শনকে আক্রমণ তথা বিষোদগার করছে।”
জবাব
ইতিপূবে ইসলামের শত্রুরা তাসাউফের মহান ইমামদের কিছু কথা তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে সেগুলোর অর্থ না বুঝেই যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে আহলে তরীকত (তরীকাপন্থী) হওয়ার ভান করতো এবং যুব সম্প্রদায়কে ফাঁদে ফেলতো। কিন্তু ইদানীং তারা পশ্চিমা বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের কিছু কথা মুখস্থ করে নিজেদের প্রভুদের ওভারকোট বহন ও মদের পাত্র পূর্ণ করে দিয়ে সার্টিফিকেট এবং উচ্চপদ হাসিল করছে। জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হওয়ার ভান করে তারা তাদের মুখস্থ কথাগুলোর মধ্যে ইসলামের প্রতি দুষমনীমূলক কথাবার্তা সন্নিবেশিত করছে এবং তা যুব সম্প্রদায়ের কাছে পেশ করছে। এভাবে তারা ম্যাসন (মোনাফেক) ও সমাজতন্ত্রীদের আকর্ষণীয় খাদ্য মুসলমান ঘরের সন্তানদেরকে প্রদর্শন করে তাদেরকে ধোকা দেয়ার অপচেষ্টায় রত।
জ্ঞান-বিজ্ঞানশূন্য যে সব নিকৃষ্ট লোক অবৈধ পন্থায় সার্টিফিকেট হাতিয়ে নিয়েছে এবং “বিজ্ঞানীর মুখোশ” পরে দ্বীন ইসলামকে আক্রমণ করছে তাদেরকে “বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশধারী ধোকাবাজ” বলা হয়। একবার এ ধরনের এক ভুয়া বিজ্ঞানী তার সন্দেহজনক সনদের জোরে একটি জেলার কর্তাব্যক্তি হয়ে গিয়েছিল। সে যখন দেখতে পেল যে মানুষরা তাকে কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করছে না, তখন সে একটি সভার আয়োজন করে গ্রামবাসী ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরকে জড়ো করে “বস্তুবাদী দর্শন,” “আধুনিক,” “সভ্য-সংস্কৃতিবান ব্যক্তিবর্গ” ইত্যাদি ধরনের কথা উদগীরণ করতে থাকে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতি সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করতে দেখে এবং তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করতে দেখে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে তার বদ চরিত্র ও বদ চিন্তাধারাকে প্রতিফলনকারী অনেক জঘন্য বাক্য উচ্চারণ করে। ইত্যবসরে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরকে ইশারা করে সে বলে, “যে ব্যক্তি ইউরোপে যায় নি, সে একটা গাধা”। মুফতী আফেন্দী অতঃপর বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার শ্রদ্ধেয় পিতা কি তাঁর উপস্থিতি দ্বারা কখনো ইউরোপকে ধন্য করেছেন?” যখন সেই ভুয়া বিজ্ঞানী ঝাঁঝালো কণ্ঠে “না” বলতে বাধ্য হলো, তখন মুফতী আফেন্দী সমাপ্তি টানলেন - “তাহলে আপনার মতো মহান ব্যক্তিত্বও গাধা আপনার-ই পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে”। ফলে ভুয়া বিজ্ঞানী নিজের ফাঁদে নিজেই পতিত হলো। নিজেদেরকে “প্রগতিবাদী,” “সভ্য ও সংস্কৃতিবান” দাবিদার অজ্ঞ-মূর্খ ও বেওকুফ ব্যক্তিবর্গ যারা ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে কিংবা বিশ্বব্যাপী গ্রন্থাগারসমূহকে পূর্ণতা দানকারী ইসলামী সভ্যতার খ্যাতি ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নয়, তারা ইসলামের সুরক্ষিত দুর্গে এভাবে যুগে যুগে খেলনা পিস্তল নিয়ে আক্রমণ করেছে এবং ফলশ্রুতিতে নিজেরাই অপদস্থ হয়েছে।
আপত্তি-৭
সে বলেছে, “যারা অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তারা এক মুঠো ভাত ও একটি মোটা কাপড়ের অদৃষ্টবাদে তুষ্ট থাকার কথাটির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছে, যার দরুন প্রতিভাত হয়েছে যে ধর্মের প্রভাব মাদকের মতোই। অথচ সভ্যতার মানে হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষী হওয়া এবং এরই জন্যে সংগ্রাম করা। কিন্তু সমাজের উন্নতি ও প্রগতির জন্যে এ সব আন্দোলনকে ধর্ম স্তব্ধ ও অবশ করে দিয়েছে তার অদৃষ্টে তুষ্ট থাকা, পরবর্তী জগত এবং আধ্যাত্মিকতার ধ্যান-ধারণা পেশ করে।”
জবাব
আমাদের পূর্ববর্তী জবাবে চিত্রিত চামচাগিরির আরেকটি উজ্জ্বল চিত্র হলো উপরোক্ত কথাগুলো! এটা বলা কতো বড় মিথ্যা যে ইসলামের যোদ্ধাগণ যাঁরা মাত্র বিশ বছরে তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত হয়েছিলেন, যাঁরা পারস্য ও রোমের বিশাল সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং যাঁরা নিজেদের ন্যায়পরায়ণতা ও উন্নত নৈতিকতার সৌন্দর্য দ্বারা প্রত্যেক জাতিরই মন জয় করেছিলেন, তাঁরা নাকি মাদকাসক্ত ও অথর্ব জাতি ছিলেন! যাঁরা ইতিহাসের ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন, তাঁরা এই জঘন্য কুৎসা রটনায় বিরক্ত হতে বাধ্য হবেন। ইসলাম মানুষদেরকে কাজ করে উন্নতি করতে আদেশ করে এবং সেই সব ব্যক্তিদের প্রতি জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয় যারা উপার্জন করে গরিবদেরকে সাহায্য করেন। যদি এই লেখক ইসলামী শিল্পকলা দেখতে পেতো যা দেখে ইউরোপীয় ও মার্কিনীরা মুগ্ধ হয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের সাফল্য ও কৃতিত্ব দেখে প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখে, তাহলে সে হয়তো এ সব কথা লিখতে লজ্জা বোধ করতো। আমরা “হয়তো” লিখছি এ কারণে যে লজ্জাবোধ একট সৎগুণ। একজন অসৎ ব্যক্তির কাছ থেকে লজ্জাবোধ আশা করা অযৌক্তিক বৈ কী! ইসলাম মুসলমানদেরকে কাজ করে উপার্জন করতে আদেশ করে। তুষ্ট থাকার মানে এই নয় যে একটি মোটা কাপড়ে তুষ্ট থাকতে হবে এবং অলস বসে থাকতে হবে। মুসলমানরা মোটেও এ রকম নয়। তুষ্ট থাকার অর্থ হলো নিজের উপার্জনের প্রতি তুষ্ট থাকা এবং অন্যদের আয়-উপার্জনের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিবদ্ধ না করা। ইসলামই ইউরোপে সভ্যতাকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল, কেননা ইসলাম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক-নির্দেশনা দেয় এবং মানুষদেরকে তা অর্জন করার জন্যে আদেশ করে। নিম্নোক্ত হাদীসগুলো এবং আরো বহু হাদীস শরীফ পরিস্ফুট করে যে উপরোক্ত আপত্তিটি জঘন্য বানোয়াট কুৎসা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান - “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারাই যারা মানুষের জন্যে উপকারী (অর্থাৎ কল্যাণকারী)”; “সেরা দান হলো সাদাকা;” “তোমাদের মধ্যে সেরা হলো সেই ব্যক্তি, যিনি মানুষদেরকে খাদ্য সরবরাহ করেন” এবং “তোমাদের মধ্যে সেরা সেই ব্যক্তি যিনি অন্যদের কাছ থেকে আশা না করে নিজে কাজ করে উপার্জন করে থাকেন।” (সংকলিত)
আপত্তি-৮
সে বলেছে, “ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে একটি সার্বিক (common) সভ্যতায় পৌঁছানোর সকল প্রচেষ্টা বিঘ্নিত হয়েছে ধর্মের সর্বগ্রাসী শক্তি দ্বারা। ধর্মের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব যা বিপ্লবের প্রতিবন্ধক, তাকে ধ্বংস করতে হবে।”
জবাব
এই ভুয়া বিজ্ঞানী বার বার ”সভ্যতা” শব্দটি উচ্চারণ করছে এবং এই যাদুকরী শব্দটি দ্বারা তরুণ মস্তিষ্ককে মোহাবিষ্ট করতে চাচ্ছে। সে মনে করছে যে ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপন করা ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং পরমাণু-চালিত কারখানা তৈরি করা এবং এগুলোকে অবৈধ যৌনাচার, নারী-সম্ভোগ, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের মাধ্যমে আভিজাত্য অর্জন, মিথ্যা কথন, প্রতারণা, শ্রমজীবী শ্রেণীর ঘাড়ে ভর করে ইদ্রিয় কামনাসমূহকে চরিতার্থকরণ ইত্যাদি অপকর্মে ব্যবহার করাই বুঝি সভ্যতা। ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণ যে সভ্যতা অর্জনের জন্যে আদেশ করেছেন তা হলো “তা’মির-এ বিলাদ ওয়া তারফিহ-এ এ’বাদ।” অর্থাৎ, দেশগুলোকে ইমারত নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও কারখানা তৈরি করে উন্নত করা এবং প্রযুক্তি ও সকল প্রকার রাজস্বকে মানুষের মুক্তি, কল্যাণ ও সুখ-শান্তির জন্যে ব্যবহার করা। বিংশ শতাব্দীর এ সন্ধিক্ষণে সভ্যতার এই দুইটি দিকের মাত্র একটাই বর্তমানে বিরাজ করছে। যদিও প্রযুক্তির উন্নতি এক্ষণে চোখ ধাঁধাঁনো, তবুও অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিকে আজকাল মানুষকে দাস বানানোর এবং অত্যাচার-নিপীড়ন করার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিংশ শতাব্দী হলো প্রযুক্তির শতাব্দী। কিন্তু এটা সভ্যতার শতাব্দী হওয়া থেকে যোজন যোজন দূরে।
সমাজতন্ত্রী লেখকটি ধর্মকে বিলোপ সাধনের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে বেশ বাস্তবপন্থী। কেননা, দ্বীন-ইসলাম দুর্নীতি, অসততা, শোষণ, কপটতা, একনায়কতন্ত্র, গীবত (পরচর্চা)-সহ সকল মানবতা-বিধ্বংসী বদ-আচরণকে নিষেধ করে । একজন অসৎ চরিত্রের ব্যক্তি কখনোই ভাল কোনো কিছুকে সাদরে গ্রহণ করে না। ইসলামের গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিচু মনের বদমায়েশ লোকেরা তাই ভয় করে থাকে। ইসলামকে সভ্যতার জন্যে কয়েদখানাস্বরূপ হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে এই পাপাত্মা ব্যক্তিটি ইতিহাসকে মিথ্যা সাক্ষী হিসেবে পেশ করেছে। যদি ইতিহাস সম্পর্কে তার ন্যূনতম জ্ঞান থাকতো, তাহলেও সে এমনটি করতে কুণ্ঠিত হতো। এমন কি অমুসলিম ইতিহাসবিদরাও এ সত্যটি স্বীকার করেন যে দ্বীন ইসলাম সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে এবং ইউরোপ ও আমেরিকায় অগ্রগতি-প্রগতি ও উন্নতি সাধন করেছে।
এটা উপলব্ধি করা যায় যে এই অজ্ঞ ও ভুয়া বিজ্ঞানী নিজে থেকে এ সব মিথ্যা বানিয়ে নেয়ার মতো চালাক অথবা বুদ্ধিমান নয়। ইউরোপে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ন্যায্য আক্রমণসমূহ উদ্ধৃত করে সে দ্বীন ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। কিন্তু যেহেতু সে ভ্রান্ত এবং যেহেতু তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি ক্ষমতা কম, সেহেতু সে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
খৃষ্টবাদ সম্পর্কে যারা বিরূপ, তাদের দ্বারা খৃষ্ট মতবাদকে আক্রমণ করার হেতু সবার কাছে জ্ঞাত করা এ প্রসঙ্গে যথাযথ হবে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ওই সব অভিযোগ যে অন্তঃসারশূন্য তা ব্যাখ্যা করাও প্রাসঙ্গিক হবে।
রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের রাজত্বকালে ঐশীমূল্য হারানো খৃষ্টধর্ম পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। অ-খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পাদ্রী-পুরোহিতবর্গ অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত করেন। তারা সবাইকে জোর করে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন। মার্টিন লুথার এই ধর্মান্ধ অভিযানে মাত্রা ছাড়িয়ে যান। তিনি প্রটেস্টান্ট নয় এমন ধর্ম ও জাতির প্রতি চরম বৈরী-ভাবাপন্ন ছিলেন। অপর পক্ষে, মিশনারী সংস্থাগুলো চিন্তা-চেতনাকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে, বিবেকসমূহকে বিপথগামী করে এবং প্রতি দিন নিত্যনতুন প্রবন্ধ লিখে খৃষ্ট মতবাদ প্রচার করতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এ সব খৃষ্টান আক্রমণ, যা কখনো রক্তে রঞ্জিত, কখনো বা প্রতারণায় পরিপূর্ণ ছিল, তা অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে খৃষ্টান মতবাদ বিরোধী একটি বিদ্বেষের জন্ম দেয়। ব্যাপক লেখনীর মাধ্যমে প্রচার শুরু হয় এ মর্মে যে পাদ্রী-পুরোহিতবর্গ মানুষদেরকে ধোকা দিচ্ছেন, কুসংস্কার ও নিজেদের ধ্যান-ধারণায় পিঞ্জরাবদ্ধ করতে তাদেরকে বাধ্য করছেন। কিন্তু এ শত্রুতা কেবলমাত্র খৃষ্টবাদের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ রইলো না। এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো যারা সকল ধর্মকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলো। পাদ্রী-পুরোহিতদের বদমায়েশীর উৎস যে ধর্মের বিকৃতি ও পরিবর্তন, তা না দেখেই তারা ধারণা করে নিয়েছিল যে এগুলো বুঝি ধর্ম হতেই নিঃসৃত। ধর্মসমূহ সম্পর্কে অধ্যয়ন না করেই খৃষ্টবাদের অপকারিতাসমূহকে তারা ধর্মের প্রতি আরোপ করে এবং ধর্মসমূহকে আক্রমণ করতে শুরু করে দেয়। ধর্মের প্রতি শত্রুতা পোষণকারীদের মধ্যে সীমা লংঘনকারীদের একজন হলেন ভলটেয়ার (ফরাসী দার্শনিক)। লুথারের মতো তিনিও দ্বীন ইসলামের কুৎসা রটনা করেন এবং লুথার যেভাবে রাসূলে আকরাম (দ:) সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, তিনিও রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে সে রকম মনে করে তাঁর কুৎসা রটনা করেন। ইসলামকে অধ্যয়ন না করেই এঁরা খৃষ্টানদের মতো ধর্মকে আক্রমণ করেন।
ঊনিশ শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো জার্মান চিন্তাবিদ ভন হার্ডার বলেন যে ধর্মসমূহের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ হলো জোরপূর্বক খৃষ্টান বানানোর মতোই মস্ত বড় ভুল। তিনি ধর্মসমূহ, বিশেষ করে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অতঃপর ইউরোপবাসী জনগণ হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কে বুঝতে আরম্ভ করেন, দ্বীন ইসলাম প্রদর্শিত আলোকোজ্জ্বল পথের মাহাত্ম্য দর্শন করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যান। বৃটিশ চিন্তাবিদদের অন্যতম থমাস্ কারলাইল তাঁর প্রণীত The Heroes (মহানায়কবৃন্দ) গ্রন্থের A Hero Who is the Prophet শীর্ষক অধ্যায়ে হুজূর পূর নূর (দ:)-এর জীবন, নৈতিক গুণাবলী ও সাফল্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এ গ্রন্থটি তিনি ১৮৪১ সালে রচনা করেন। এতে তিনি লিখেছেন, “বারোটি শতাব্দী যাবত যে মহান ব্যক্তিত্ব লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছেন এবং যিনি প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে সভ্যতার রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি লুথার ও ভলটেয়ারের অভিযোগকৃত ভণ্ড হতে পারেন না। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অর্জিত সাফল্য ও কৃতিত্ব একজন নিচু প্রকৃতির লোক কখনোই অর্জন করতে সক্ষম হবে না। কেবলমাত্র একজন পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব যিনি বিশ্বাস ও নৈতিকতার অধিকারী, তিনি-ই অন্যদের বিশ্বাস দান করতে পারেন। হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান জাতিসমূহের জন্যে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। যদি তা না হতো, তবে কেউই তাঁকে অনুসরণ করতো না। হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাবার্তা সত্য, কেননা একজন মিথ্যুক কখনোই একটি ঘর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়, ধর্ম তো দূরে থাক!” (কারলাইল)
থমাস কারলাইলের জমানায় ইউরোপে কোনো সঠিক ও নির্ভুল ইসলামী গ্রন্থ বিরাজমান ছিল না। কিন্তু তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টি ও বহু বছরের অধ্যয়নের সাহায্যে তিনি খৃষ্টান ও দ্বীনের শত্রুদের বানানো মিথ্যাসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেন নি এবং ঐতিহাসিক সত্যকে দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজকে ইউরোপীয় ও আমেরিকান ভাষাসমূহে বহু ইসলামী বইপত্র অনূদিত হওয়ায় কারলাইলের ঐতিহাসিক লেখনীসমূহের প্রতি যে সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল তা কেটে যাচ্ছে।
যদি লুথারের রচিত কুরআন মজীদ-বিরোধী প্রবন্ধাবলী ও হযরত রাসূলে খোদা (দ:)-এর বিরুদ্ধে বানানো ভলটেয়ারের কল্পকাহিনীকে কারলাইল কৃত A Hero Who is the Prophet (মহানায়ক যিনি নবী) শীর্ষক প্রবন্ধের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সবার কাছে ভালভাবে জ্ঞাত হবে যে ধর্মান্ধ খৃষ্টান ও দ্বীনের শত্রুদের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যক্তিবর্গ কতোটুকু ভিন্ন দৃষ্টিতে দ্বীন ইসলামকে মূল্যায়ন করে থাকেন। কারলাইলের পরে বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-এর জীবন ও নৈতিকতার মাধূর্য সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ব্যক্ত করেছেন যে কুরআন মজীদই মানুষদেরকে সুখ-শান্তির পথ-প্রদর্শনকারী জ্ঞানের উৎস। তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর ও কুরআন মজীদের কুৎসা রটনাকারীদের প্রতি উপযুক্ত জবাবও লিপিবদ্ধ করেছেন।
এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে ইসলামের শত্রুরা আজকাল দ্বীনের প্রতি কুৎসার দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে তিনটি উৎস হতে সাহায্য পাচ্ছে: (১) খৃষ্টান মিশনারী, (২) ভলটেয়ারের মতো লোকেরা যারা ধর্মকে অন্ধভাবে আক্রমণ করে থাকে এবং (৩) সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী যারা সকল ধরনের সত্য ও সততাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গণমানুষকে জন্তু-জানোয়ারের মতো এবং যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে থাকে।
আপত্তি-৯
সে বলেছে, “ধর্ম মানুষকে বুঝ দেবার জন্যে; অর্থাৎ, তুষ্ট থেকে দুঃখ-কষ্ট ও বৈষম্যকে স্বীকার করে নেয় ধর্ম। এটা সমাজে বিদ্যমান সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এটা সেই উন্নত জীবন অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যা শ্রেণী বৈষম্য ও শোষণ নির্মূল করে। এ সকল নিপীড়ন দোযখের ভয় দেখিয়ে করা হয়েছে। যারা এর শিকার হয়েছে, তাদেরকে বেহেস্তের শান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। এটা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়।
জবাব
সে মুসলমান সন্তানদেরকে সেই বিষ দ্বারা ধ্বংস করতে চাচ্ছে যা সে ওই তিনটি উৎস হতে প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। আজকাল যুব সম্প্রদায় ইসলামী বইপত্র পাঠ করে নিজেদের ঈমান-আকিদা সঠিকভাবে শিক্ষা করছে। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) ঘোষণা করেছেন - “যে মুসলমান ব্যক্তি পরপর দুই দিন একই রুজীতে সীমাবদ্ধ থাকে, সে নিশ্চয় ক্ষতিগ্রস্ত। একজন মুসলমানকে প্রতিদিনই উন্নতি করতে হবে” (আল্ হাদীস)। যে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী যুবকটি হযরত রাসূলে পাক (দ:)-এর “অগ্রসর হও” শীর্ষক আদেশটি এবং উপরোক্ত হাদীসের আদেশটি যত্ন সহকারে পাঠ করেছে, সে কখনোই “প্রগতিবাদী” দাবিদার অজ্ঞ ব্যক্তিটির মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করবে না। দ্বীন ইসলাম বৈষম্য ও বে-ইনসাফী অনুমোদন করে না, বরং ন্যায়বিচার ও বৈষম্যের মূলোৎপাটনকে আদেশ করে। “আমি একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের সময় এসেছি”- হাদীসটি ঐশী গ্রন্থবিহীন অবিশ্বাসীদের ন্যায়বিচারকেরও প্রশংসা করেছে। ইমাম মানাবী ও ইমাম দায়লামী বর্ণিত একটি হাদীস শরীফে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান - “বেহেস্তে সর্বপ্রথম প্রবেশ করবে ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও শাসকবৃন্দ” (আল্ হাদীস)। এ হাদীসটি কি দুঃখ-কষ্ট, বৈষম্য ও বে-ইনসাফী মেনে নিতে আদেশ করেছে? নাকি এটা এগুলোকে পরিহার করতে পরামর্শ দিয়েছে? আমাদের পাঠকমণ্ডলীর বিবেকের কাছে এর সঠিক উত্তর অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে এতে পরিস্ফুট হচ্ছে কতটুকু বিচ্যুত হয়েছে এই অজ্ঞ লেখকটি এবং তারই সেবাপ্রাপ্ত চক্রটি।
দ্বীন ইসলাম যাকাত ও ধার দেয়াকে এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতাকে আদেশ করেছে। এটা জ্ঞাত করেছে, যারা এ সব আদেশ মান্য করবে যা সমাজে শ্রেণী বৈষম্য দূর করে, তারাই বেহেস্তী হবে। যারা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে তারা নয়, বরং যারা দুঃখ-কষ্টের বিধায়ক খোদা তা’লার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারাই বেহেস্তী হবে। ইসলাম হলো একটি প্রগতিশীল, গঠনতান্ত্রিক ধর্ম। ইসলাম “বিদ্যমান সীমা” নির্ধারণ করে দেয় নি, বরং রাষ্ট্রবিদদেরকে সমসাময়িক কালের বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, কৃষি, সমর প্রযুক্তি এবং প্রগতি অর্জনকারী সকল ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ব্যবহার করতে স্বাধীনতা দিয়েছে। আল্লাহতা’লা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জ্ঞানী সৃষ্টি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কেও বলেছেন - “সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করুন!” ইসলামের প্রত্যেক খলীফা-ই জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত পরামর্শক সভার শরণাপন্ন হতেন। পরামর্শ ছাড়া কোনো কিছু করাই তাঁদের অনুসৃত পন্থা ছিল না।
এবাদতের ক্ষেত্রে কোনো সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রযুক্তি ও পার্থিব উন্নতি, অগ্রগতি-প্রগতি অর্জনের জন্যে আদেশ করা হয়েছে। এই কারণেই প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে যে সব ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলো সকল ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছিল। ইসলাম ব্যক্তিত্ব ও চিন্তার স্বাধীনতাকে লালনকারী ধর্ম। প্রত্যেক মুসলমানই সারা পৃথিবী হতে অধিক মূল্যবান।
আপত্তি-১০
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তিটি বলেছে, “ধর্মের ফলশ্রুতিতে এসেছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শোষণ। তুষ্ট থাকা ও ভাগ্যে সমর্পিত হওয়ার দরুণ শোষণ ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু হাতের মুঠোয় উৎপাদনের সকল সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। গণমানুষ পার্থিব সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্যে বিবেচিত হয় নি। এক মুঠো খাবার ও একটি মোটা কাপড়ের দর্শন বেঁচে থাকার এবং সংগ্রাম করার শক্তিকে বিতাড়িত করেছে। পরবর্তী জগতের আশা-আকাঙ্ক্ষা দুঃখ-কষ্টের ও অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জবাব
ধর্ম বিষয়ে কথা বলতে হলে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামকে বর্তমানকালের পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী শোষকদের সাথে তুলনা দিয়ে ধর্মকে আক্রমণ করায় প্রতিভাত হয় যে সে ইসলামের প্রতি এমনই বৈরীভাব পোষণ করে যার দরুণ তার দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি অন্ধ ক্রোধ দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও নিষ্ঠুর সমাজতন্ত্রী যারা উৎপাদনের সরঞ্জামগুলোকে কুক্ষিগত করে এবং মানুষদেরকে শোষণ করে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলেই এই অজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা সামাজিক সাম্য বিধানকারী দ্বীন-ইসলামকে আক্রমণ করাটা নিছক শত্রুতা ছাড়া আর কিছু নয়। যেহেতু ইসলামী জ্ঞানে সে সমৃদ্ধ নয়, সেহেতু বার বার সে তুষ্ট থাকা ও তকদীরে (নিয়তিতে) বিশ্বাসকে আক্রমণ করেছে।
সভ্যতার দোহাই পেড়ে অজ্ঞ ব্যক্তিটি শুধুমাত্র অর্থনীতি ও আয়-উপার্জন নিয়েই কথা বলেছে। সে বুঝতে পারছে না যে তুষ্ট থাকা এমনই এক গুণ যা মানসিক রোগসমূহ প্রতিরোধ করে, অসঙ্গতি ও হানাহানি অপসারণ করে এবং সমাজসমূহে নিয়ম-শৃংখলা নিশ্চিত করে। এই তুষ্ট থাকাই সারা বিশ্বে ইসলামের বিস্তৃতি সাধন করেছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৌধ নির্মাণ করেছে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে - “যে ব্যক্তি কাজ করে সে-ই উপার্জন করবে” (আল্ আয়াত)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “প্রত্যেকেই যা করে তার প্রতিদান সে পায়” (আল্ হাদীস)। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ্ তা’লা সেই সকল যুবককে পছন্দ করেন না, যারা কাজ করে না” (ইমাম মানাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস)। এই সকল আয়াতে করীমা ও হাদীস শরীফ কি মুসলমানদেরকে কাজ করতে আদেশ দেয়? নাকি অলস বসে থাকতে বলে? উমাইয়া, আব্বাসীয়া, গযনবী, ভারতীয় তৈমুরগণ, আন্দলুসীয় ও উসমানীয় সভ্যতা যেগুলো মুসলমানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো কি কঠোর পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহন করে? নাকি অথর্বতার? একজন দরবেশ কর্তৃক উচ্চারিত “এক মুঠো ভাত ও একটা মোটা কাপড়” কথাটি কি কুরআন মজীদ ও হাদীস্ শরীফের আদেশকে পরিবর্তন করতে সক্ষম? একজন দরবেশের কথাবার্তা যা তিনি জযবার হালতে (ভাবের সাগরে তন্ময় অবস্থায়) উচ্চারণ করেন, তা তাঁর নিজের জন্যেই প্রযোজ্য। কিন্তু তা তো সর্বসাধারণের জন্যে ইসলামী বিধান নয়। পরবর্তী জগতে বিশ্বাস দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি করে না, বরং ব্যক্তিবর্গ, পরিবারবর্গ ও সমাজের জন্যে নিয়ম-শৃংখলা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে। ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে তা-ই ব্যক্ত করে। ইসলাম আত্মহনন নয়, বরং বস্তুগত ও আত্মিক দুঃখ-কষ্ট এবং অসুবিধা রহিতকরণকে আদেশ করে।
আপত্তি-১১
সে বলে, “এ সকল রাষ্ট্রকে এখনো মরুভূমির আইন দ্বারা শাসন করা হচ্ছে।”
জবাব
আল্লাহ্ তা’লা কর্তৃক উম্মোচিত কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে এবং শত-সহস্র হাদীসমূহে বর্ণিত শিক্ষা ও আজ্ঞাবলী সারা বিশ্বের জ্ঞানী মানুষদের শ্রদ্ধা কেড়েছে। এ সকল শিক্ষা ও আজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব ও মূল্য ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণ সহস্র সহস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন যার মধ্যে কিছু গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানে প্রদান করা হয়েছে। এমন কি অমুসলমান পণ্ডিতবৃন্দও এ সত্যটি ব্যক্ত করছেন। জার্মান লেখক গোথে বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রথমবার কুরআন মজীদ পাঠ করেন তিনি এর স্বাদ পান না; কিন্তু পরবর্তীতে এটা পাঠককে নিজের প্রতি আকর্ষণ করে এবং নিজ সৌন্দর্য দ্বারা পাঠককে জয় করে নেয়।” গিবন (ইংরেজ ইতিহাসবিদ) বলেন, ”কুরআন মজীদ শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’লার অপরিবর্তনীয় আদেশ ও আইন-কানুনই নিয়ে এসেছে যা মানবকুলের সকল বিষয়ের এবং অবস্থার ব্যবস্থাপক।”
বৃটিশ লর্ড ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “কুরআন মজীদ ধর্মীয় কর্তব্য-কর্ম, দৈনন্দিন বিষয়াবলী, আত্মিক পরিশুদ্ধি, দৈহিক স্বাস্থ্য, মানুষের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকার, মানুষ ও সমাজের জন্যে উপকারী বস্তুসমূহ এবং নৈতিকতা ও শাস্তির জ্ঞানসমূহকে নিয়মবদ্ধ করে। কুরআন মজীদ হলো একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা (Political system)। জীবিত ও জড় প্রত্যেকটি অবস্থাই এতে নিয়মতান্ত্রিক করা হয়েছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কুরআন মজীদ অত্যন্ত শক্তিশালী ও নির্মল। এটা সব সময়ই উপকার করার জন্যে আদেশ করে থাকে। সামাজিক সাম্যকে এটা জোরদার করে। এটা সভ্যতার ওপরও একটা অনুকূল প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একগুঁয়েমি ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কুরআন মজীদের প্রতি সবচেয়ে মারাত্মক অজ্ঞতাপূর্ণ সমালোচনা দ্বারা ওর বিরোধিতা করার মতো উদ্ভট ও অন্যায় আচরণ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। কেননা, এটা মানব জাতির উপকার ও সুখ-শান্তির জন্যে প্রেরিত খোদাতা’লার সবচেয়ে মূল্যবান ঐশীগ্রন্থ।” (লর্ড ড্যাভেনপোর্ট)
অতএব, এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেচনাশীল ব্যক্তি-ই কুরআন মজীদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং নিজ উপলব্ধি অনুযায়ী একে সম্মান করেন। এই পবিত্র গ্রন্থটি সম্পর্কে ‘মরুভূমির আইন-কানুন’ বলার মতো আর কোনো দুর্নীতি, নিচুতা ও আহাম্মকী হতে পারেন না।
আপত্তি-১২
দ্বীনী জ্ঞানে অজ্ঞ ওই ব্যক্তি বলেছে, “প্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো একটি জাতীয় ও পশ্চিমা আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে মরুভূমির আইন-কানুনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবং তারা ধর্মের মাদক ত্যাগ করে সচেতন হয়ে উঠছে।”
জবাব
এই অজ্ঞ, সীমা লংঘনকারী লেখক যাকে ‘মাদক’ বলছে, সেই দ্বীন-ইসলামের সামনে অমুসলমান পণ্ডিতগণও শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন। মখাইম (জার্মান ইতিহাসবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ) বলেন, “দশম শতাব্দীতে ইউরোপকে গ্রাসকারী সেই সব কালো দিনের মতো খারাপ আর কোনো সময়ই হতে পারে না। এমন কি ল্যাটিন জাতিগুলো (গ্রীক/রোমান) যারা যুগের সবচেয়ে প্রগতিশীল ছিল, তারাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিরোনামে যুক্তিবিদ্যা ছাড়া আর কিছুই জানতো না। যুক্তিবিদ্যাকে সকল জ্ঞানের শাখা হতে শ্রেষ্ঠ ধারণা করা হতো। সেই সময় মুসলমান জাতি-ই স্পেন ও ইতালিতে বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন খৃষ্টানগণ এই সকল স্থানে জ্ঞান শেখার জন্যে সমবেত হতেন। ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি শিক্ষা করেই তাঁরা খৃষ্টান বিদ্যাপীঠ চালু করেন।” (মখাইম)
আলোকোজ্জ্বল ইসলামী সভ্যতা যাকে সারা বিশ্নের ইতিহাসবিদগণ সর্বসম্মতভাবে প্রশংসা করেছেন, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সকল গুণীজন দ্বারা, যাঁরা কুরআন মজীদকে অনুসরণ করতেন। আজকে বিজ্ঞান অগ্রগতি-প্রগতি সাধন করেছে এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় বিশাল আকৃতির শিল্প-কারখানাসমূহ স্থাপন করা হয়েছে। মহাশূন্য ভ্রমণও সূচিত হয়েছে। কিন্তু এ সব দেশের কোনোটাতেই মানসিক শান্তি বিধান করা সম্ভব হয় নি। শিল্প-কারখানার মালিকদের অপব্যয় ও ভোগ-বিলাস এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের দারিদ্র্য আজো দূর হয় নি। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্র জনগণকে শোষণ করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় শুধুমাত্র তাদের খাদ্যের জন্যে কাজ করছে; আর একটি নিষ্ঠুর, রক্ত-পিপাসু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ওই সব ক্ষুধার্ত জনগণের ওপর ভর করে বিলাসী জীবন যাপন করছে। এরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে সব ধরনের বদ কাজ সংঘটন করছে। যেহেতু তারা কুরআন মজীদকে মান্য করে নি, সেহেতু তারা সুখ-শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সভ্য হতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এবং কাজ করে উপার্জন করার ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুকরণ করা জরুরি, কেননা কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ বিজ্ঞান ও কলাসমূহের প্রগতি হাসিল করার জন্যে আদেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আদী ও ইমাম মানাবী বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান - “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর প্রগতি অর্জনকারী ও কর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী বান্দাকে ভালোবাসেন” (আল্ হাদীস)। হাকিম, তিরমিযী ও ইমাম মানাবী বর্ণিত অপর এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন - “নিশ্চয় আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাকে কোনো একটি কর্ম-বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত দেখতে চান” (আল্ হাদীস)। তবে কেবলমাত্র এই যোগ্যতা অর্জন করাই সভ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। উপার্জনের মাধ্যমে যে রহমত অর্জিত হয়, তা ইনসাফের ভিত্তিতে ভাগ করে নিতে হবে এবং শ্রমিককে তার শ্রমের সমপরিমাণ প্রাপ্য প্রদান করতে হবে। আর এ ন্যায়বিচার ও ইনসাফ একমাত্র কুরআন মজীদকে অনুসরণ করেই হাসিল করা সম্ভব। আজকে ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়া সেই সব কাজেই সাফল্য লাভ করছে যেগুলোতে তারা দ্বীন ইসলামের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখছে। কিন্তু যেহেতু সুবিধাগুলো কুরআন মজীদের মধ্যে অবস্থিত ন্যায়ের নীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে বণ্টন করা হচ্ছে না, সেহেতু জনগণ সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে না, শ্রেণী সংঘাতও এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যারা কুরআন মজীদকে মান্য করে না, তারা কোনোক্রমেই সুখি হতে পারে না। যারা ওতে বিশ্বাস রেখে কিংবা না রেখে মান্য করে, হোক তারা মুসলিম কিংবা অমুসলিম, তারা এই পৃথিবীতে ততোটুকু সুবিধাই হাসিল করতে সক্ষম হয় যতোটুকু তারা মান্য করে। যারা ওতে বিশ্বাস রাখে এবং মান্য করে তারা এ পৃথিবীতে এবং পরবর্তী জগতে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়। তারা এ পৃথিবীতে সুখ-শান্তিতে বসবাস করে এবং পরবর্তী জগতে অনন্ত কল্যাণ ও অশেষ নেয়ামতের শরীকদার হয়। ইতিহাস এবং দৈনন্দিন ঘটনাবলী পরিস্ফুট করে যে এ কথাটি সত্য। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যারা কুরআন মজীদ কর্তৃক প্রদর্শিত পথটি অনুসরণ করে না, তারা মুসলিম হোক কিংবা না হোক, তারা প্রদর্শিত পথটি হতে যতোই দূরে সরে যাবে, ততোই ক্ষতি ও দুর্দশাগ্রস্ত হবে।
প্রখ্যাত তুর্কী ব্যবসায়ী জনাব সাকিপ সাবানজী বর্ণনা করেছেন যে যখন তিনি তাঁর হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন, তখন হাসপাতালে কর্মরত জনৈক প্রটেস্টান্ট পাদ্রী অস্ত্র্রোপচারের আগে তাঁর দর্শনার্থী হন এবং তাঁকে বলেন, “আগামীকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার আপনার ওপর করা হবে। আপনি আমার ধর্মাবলম্বী নন, আপনি একজন মুসলমান। কিন্তু আমরা সবাই তাঁরই বান্দা। এ রকম একটি নাজুক সময়ে স্রষ্টার সকল বান্দারই উচিৎ স্রষ্টার মাঝে আশ্রয় নেয়া। অতএব, আমি আপনার জন্যে আজ রাতে প্রার্থনা করবো।” এ ঘটনার ব্যাপারে সাকিপ সাবানজীর মন্তব্য হলো: “পাদ্রীর এই কথাগুলো আমাকে কতোটুকু অভিভূত ও অনুপ্রাণিত করেছিল তা ব্যক্ত করার ভাষা আমার জানা নেই।”
সাকিপ সাবানজীর কৃত “আত্মিক মূল্যবোধের দিকে প্রত্যাবর্তন ” (Turning Towards the Spiritual Values) প্রবন্ধটি, যা ১৯৮১ সালের ৮ই মার্চের একটি তুর্কী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তা নিম্নে বিধৃত হলো:
এটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তবে আরেকটি দৃশ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি, বস্তুগত ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানের উন্নতি সাধন মানুষকে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে না। সর্বোপরি, একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উপনীত হবার পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং বস্তুগত সম্পদ বৃদ্ধিতে সাফল্য পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় কেবলমাত্র ‘আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ’ অর্জনের দ্বারাই।
জাপানী মডেল নামের উন্নতি-ই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আজকাল তুরস্কে ‘জাপানী ধাঁচের রফতানী’ ও ‘জাপানী ধাঁচের শিল্প-কারখানা’ শীর্ষক অনুপ্রেরণাদায়ক বাক্যগুলো অহরহ-ই উচ্চারিত হয়ে থাকে প্রাত্যহিক জীবনে।
জাপানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কারখানাতেই কার (মটর গাড়ি) নির্মাণ শিখেছিল। অল্প সময়েই কিন্তু তারা ওই সকল বড় বড় কোম্পানীর সাথে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারেই নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। তারা আরো অধিক সাফল্যের সাথে প্রস্তুতকৃত সামগ্রী বিক্রি করতে আরম্ভ করে।
আমার বিশ্বাস, জাপানীদের এই কৃতিত্বের জন্যে তিনটি কারণ রয়েছে: (১) প্রযুক্তি, (২) শৃংখলা বজায় রেখে কর্ম উদ্যোগ এবং (৩) ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ।
এক দেশ হতে আরেক দেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর সম্ভব, যদিও এর একটি নির্দিষ্ট ব্যয়ভার ও পরিশ্রম আছে। কিন্তু সুশৃংখল কর্ম উদ্যোগ, ঐতিহ্যের সুষ্ঠু ধারণ ও নৈতিক মূল্যবোধ ক্রয়ের টাকা পরিশোধ করার সাথে সাথেই স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ সকল বিষয় এ দেশে (তুরস্কে) বর্তমানে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হচ্ছে।
যখন আমরা মনোযোগ সহকারে আমাদের অতীতকে পর্যবেক্ষণ করি এবং জাপানের সাথে তুলনা করি, তখন আমরা দেখতে পাই যে তুর্কীরা ছিলেন সেই সব বিরল জাতির মধ্যে একটি যাঁরা ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিলেন, কর্ম উদ্যোগে শৃংখলা বজায় রেখেছিলেন এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
তুর্কীদের একটি শক্তিশালী পারিবারিক কাঠামো বিরাজমান। পরিবারের বয়োবৃদ্ধকে ঘিরে অন্যান্য সদস্যরা জড়ো হন। তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ও শ্রদ্ধা বিদ্যমান। তিনিই কনিষ্ঠদেরকে রক্ষা করার দায়-দায়িত্ব বহন করে থাকেন।
একজন তুর্কী তাঁর দেশ, পতাকা, ধর্ম ও সততার খাতিরে সংগ্রামরত। এটা তাঁর একটা পবিত্র সংগ্রাম । যুদ্ধের ময়দানে একজন তুর্কী ‘আল্লাহর নামে’ লড়াই করেন। কোনো নতুন কাজ আরম্ভ করার সময়ও তিনি তাঁরই নামে আরম্ভ করেন। তিনি প্রিয়জনদেরকে আল্লাহতা’লার হেফাযতে সমর্পণ করেন।
তুর্কীদের মধ্যে সৃষ্টিশীল কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিয়মবদ্ধকারী আচার ও ঐতিহ্যসমূহের একটা পদ্ধতি আছে। এ সকল ক্ষেত্রে তুর্কীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শৃংখলার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ব্যবসায়ীদের পুরোনো সমাজগুলো, সমবায় সমিতিগুলো, প্রতিটি সৃষ্টিশীল কর্মের রক্ষাকারী মালিক কর্তৃপক্ষ এবং মালিক, সহকারী মালিক ও শিক্ষানবীশদের মধ্যে সুসম্পর্ক।
দ্বীন ইসলামই হচ্ছে বহু শতাব্দী যাবত সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ তুর্কীর বন্ধন স্থাপনকারী মৌলিক আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উৎস।
১৯৮১ সালের এই দ্বিতীয়ার্ধে তুরস্কের ইতিবৃত্ত মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ সকল “নৈতিক মূল্যবোধ” যেগুলোকে অতীতে ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু সাম্প্রতিককালে অবহেলা করা হয়েছে, সেগুলোকে স্মরণ করার মধ্যে বহু উপকার নিহিত রয়েছে। আমরা যে সিরিয়াস সামাজিক ও রাজনৈতিক অনিয়ম হতে মুক্তি পেতে চেষ্টা করছি, সেই অনিয়মের দোষ-ত্রুটি আমরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণসমূহের ওপর আরোপ করতে পারি না।
আমাদের (তুর্কীদের) জনসংখ্যা, যা পাঁচ কোটিরও অধিক এবং প্রতি বছরই যা দশ লাখ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার আবাসস্থল তুরস্ককে ‘সমসাময়িক সভ্যতার সমপর্যায়ে’ এবং ‘মানব মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি জীবনযাত্রার মান’ প্রদান করতে আমরা দায়বদ্ধ। তবে আমরা যতোটুকু সাফল্যই অর্জন করি না কেন, এটা পরিস্ফুট যে শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নতি সাধন করেই ৫ কোটি মানুষের সামগ্রিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আমাদের সার্বিক আত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোকে সবার সামনে পেশ করা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। এগুলোই ৫ কোটি মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে আরো কাজ করার প্রেরণা যোগাবে। যারা বৈষয়িক সমস্যাসমূহের কাছে অসহায় তাদেরকে আশা ও কাজ করার প্রেরণা যোগাবে আল্লাহতা’লায় বিশ্বাস, আল্লাহ-ভীতি (তাক্ওয়া বা পরহেযগারী) ও দ্বীন ইসলাম। এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উপকারী হতে হলে আত্মিক উন্নতি অত্যাবশ্যক। দয়া করে মনে রাখবেন যে, চাঁদে অবতরণকারী (প্রথম) নভোচারীর পকেটে ধর্মের বই ছিল।
অতএব, আমাদের লক্ষ্য হবে চাঁদে গমনের প্রযুক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করা . . . . কিন্তু এই প্রযুক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের পরও আল্লাহতা’লার সাহায্য ও সমর্থন অন্বেষণ করা।
আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আত্মিক মূল্যবোধ অর্জনে অনুপ্রেরণা যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বীন ইসলামের সুমহান আদর্শ হতে মদদ অন্বেষণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভ্যতার দিক-নির্দেশনা হিসেবে আত্মিক সমর্থনের জন্যে আমরা ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। আরো কাল ক্ষেপণের আগেই আমাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা চালু করা উচিৎ।
ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকার ফলে চিন্তা-চেতনা ও কর্মের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা বোধ জাগ্রত হবে যা আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। এটা পারস্পরিক বিরোধিতাকে ন্যূনতম ও শান্তিপূর্ণ করবে এবং অভ্যন্তরীণ শান্তির ভিত্তি রচনা করবে। ফলে আরো মৌলিক ও আরো শক্তিশালী একটা সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটবে।
নতুবা আত্মিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যশূন্য মানুষের বিশাল জনস্রোতকে শাসন ও সুখী করা একেবারেই অসম্ভব। এই ধরনের একটা সমাজে সহজে সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে - “তোমরা বিষন্ন হয়ো না, দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয়ো না। যদি তোমাদের ঈমান দৃঢ় হয়, তবে নিশ্চয় তোমরা কামিয়াব বা সফলকাম হবে” (আল্ আয়াত)।
আমরা শুনি এবং পড়ি যে, আজকাল সারা বিশ্বের মানুষেরা একে অপরকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানতে চেষ্টা করছে এবং ইতিপূর্বে তারা যে সব জিনিসকে প্রত্যাখ্যান করতো সেগুলোর প্রতি তারা বর্তমানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আমি শুধু একটা সহজ উদাহরণ দেবো: মার্কিনীরা বিশেষ করে দাবি করতো যে দ্বীন ইসলামের মধ্যে বহু নিষ্ঠুর আইন রয়েছে এবং তারা এ দাবির সমর্থনে চোরের হাত কাটার বিধানকে দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করতো। আমরা বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছি এবং না হেসে পারি নি যখন দেখেছি যে, ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর ডগ্লাস হাফ্ সম্প্রতি তাঁর রাজ্যে চুরি-ডাকাতির হার বৃদ্ধিতে মুসলমান দেশগুলোর মতো চোরের হাত কাটার আইন পাশ করার সুপারিশ করেছেন। সিনেটর তাঁর সুপারিশপত্রে লিখেছেন, ‘এটা আপনাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কিন্তু আমি আর কোনো সমাধান দেখছি না। আমি মনে করি, খোদা তা’লা তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ করেন যে এই শাস্তিটি যথাযথ। যারা অপরাধ সংঘটিত করে তাদের উচিৎ খোদা তা’লাকে ভয় করা।’ অতএব দেখতেই পাচ্ছেন যে, মানুষেরা দিনকে দিন ইসলামের আইন কানুনের নিকটবর্তী হচ্ছে। এক স্রষ্টার দিকে আহ্বানকারী সর্বাধুনিক ধর্ম ইসলামের মধ্যে সমগ্র জগতের ধর্ম হওয়ার সকল কারণই বিদ্যমান।
আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি যে, ধর্ম হলো সেই শক্তির উৎস যেটা আমাদেরকে ক্ষতিকর বদ কর্মসমূহ সংঘটন করা হতে রক্ষা করছে; আমাদের উচ্চাভিলাষকে রহিত করছে; আমাদের আত্মাগুলোকে সজীব ও পরিশুদ্ধ করছে; আমাদের সদ-অভ্যাসগুলো বিকশিত করে নম্র, ভদ্র ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ বানাচ্ছে; গুরুজন এবং আইন-কানুন মান্য করতে শিক্ষা দিচ্ছে; বিদ্রোহী হতে নিষেধ করছে; আমাদের বিষয়সমূহে সাফল্য অর্জনে আশার সঞ্চার করছে; ব্যর্থতায় শান্ত্বনা যোগাচ্ছে; আমাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করছে; জীবনী শক্তি ও বেঁচে থাকার আশা যোগাচ্ছে; পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানব বানিয়ে আল্লাহতা’লার পথে পরিচালিত করছে। সংক্ষেপে, এ পৃথিবীতে এবং পরবর্তী জগতে আমাদেরকে সুখ-শান্তি অর্জনের দিকে নির্দেশনা দিচ্ছে।
আমাদেরকে আমাদের ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে হবে, এর আদেশ-নিষেধ মান্য করতে হবে এবং এর মূল্য অনুধাবন করতে হবে। শুধুমাত্র নগণ্য পার্থিব স্বার্থে কিংবা হীন ব্যক্তিগত স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার করা হতে আমাদের বিরত থাকা উচিৎ। এই আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ এবং এই পবিত্র ধর্ম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সব ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দ্বারা, যারা ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ ও কদর্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে মানুষকে ধোকা দিয়েছে এবং ‘দ্বীন গেল, দ্বীন গেল’ বলে মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। [বাংলাদেশেও ওহাবীপন্থী ও মওদূদীবাদী চক্র অনুরূপ ধর্ম ব্যবসা চালু করেছে - অনুবাদক]
ধর্ম ব্যবসায়ীরা এবং ভুয়া বিজ্ঞানীরা এই দেশ ও জাতির সুখ-শান্তি বিঘ্নিত করেছে। ধর্ম-ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করে অনৈসলামী বহু বিষয়কে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে। পক্ষান্তরে, ভুয়া বিজ্ঞানীরাও নিজেদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে যুব সম্প্রদায়কে ধর্মে অবিশ্বাসী বানাতে নিজেদের অবৈজ্ঞানিক, ধ্বংসাত্মক ও বিভক্তি সৃষ্টিকারক কথাবর্তাকে যুব সম্প্রদায়ের কাছে বিজ্ঞান হিসেবে পেশ করতে তৎপর হয়েছে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধার্মিক লোক সেজে ধর্মপ্রাণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে। পক্ষান্তরে, ভুয়া বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত হওয়ার ভান করে এবং নিজেদের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিজ্ঞানের ওপর মানুষের আস্থাকে ব্যবহার করেছে। আমাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী ও ভুয়া বিজ্ঞানী উভয়ের ধোকাবাজী সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
সাম্প্রতিককালেও এমন কিছু কপট লোকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে বেশির ভাগ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও ডাকাত যাদেরকে বোমা, দূরবীণসম্পন্ন বন্দুক, ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান, রকেট ও বেতারযন্ত্রসহ আটক করা হয়েছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া বিজ্ঞানী। বাকিরা শ্রমিক, নয়তো তাদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত শিক্ষানবীশ নর-নারী।
দ্বীন ও বিজ্ঞান মানুষের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী দুইটি সহায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান শান্তি, কল্যাণ ও সভ্যতার জন্যে প্রয়োজনীয় মাধ্যম ও কারণসমূহ সৃষ্টি করে থাকে। দ্বীন এ সকল মাধ্যমকে শান্তি, কল্যাণ ও সভ্যতার জন্যে ব্যবহার করতে প্রেরণা যোগায়। সমাজতন্ত্রীরা বিশাল আকৃতির শিল্প-কারখানা ও চোখ ধাঁধাঁনো রকেট ও উপগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছে জার্মানী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে চুরি করা প্রযুক্তি দ্বারা। তবুও তাদের মধ্যে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই বিরাজমান, কোনো ধর্মীয় চেতনা বিরাজমান নেই। এ কারণেই তারা তাদের জনগণকে নিষ্পেষণ করতে এবং অন্য জাতিগুলোকে আক্রমণ করতে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে গণ্ডগোল-হট্টগোল বাঁধিয়ে রাখতে বৈজ্ঞানিক উপকরণসমূহ ব্যবহার করছে। তারা বহু জায়গাকে ইতোমধ্যেই কয়েদখানা বানিয়ে ফেলেছে। বিজ্ঞানে তাদের অগ্রগতি সভ্যতার বিকাশ আনে নি, বরং নির্মম বর্বরতা এনেছে। শান্তি, কল্যাণ ও মানবাধিকার হয়েছে পদদলিত। সংখ্যালঘুর বিনোদনের খাতিরে লক্ষ-কোটি মানুষকে দরিদ্র করা হয়েছে। এ কারণেই আমাদেরকে প্রকৃত দ্বীন শিক্ষা করতে হবে এবং প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। কুরআন মজীদ প্রকৃত মুসলমানদের সম্পর্কে কী ঘোষণা দিয়েছে তা লক্ষ্য করুন - ‘সাবধান! আল্লাহতা’লার বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, তাঁরা সন্তাপগ্রস্তও হবেন না” (সুরা ইউনুস, ৬২ আয়াত)।
আসুন, আমরা দ্বীন ইসলামের আইন-কানুন তথা আল্লাহতা’লার আদেশ-নিষেধে বিশ্বাস স্থাপন করি। প্রিয় পাঠক, এ সকল আইন-কানুন মান্য করেই আমরা পরস্পরের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি উপকারী হতে পারবো এবং শান্তি, কল্যাণ ও সুখ অর্জন করতে সক্ষম হবো”। (জনাব সাকিপ সাবানজীর কৃত “আত্মিক মূল্যবোধগুলোর দিকে প্রত্যাবর্তন” প্রবন্ধটির দীর্ঘ উদ্ধৃতি এখানেই শেষ হলো)
*** সমাপ্ত***