অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
মীলাদ কী: মওলিদ বা মীলাদ একটি খুশির উৎসব যা’তে মুসলমান সমাজ সমবেত হন মহানবী (দ:)-কে আমাদের মাঝে প্রেরণের জন্যে আল্লাহতা’লার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। মুসলমানবৃন্দ এই উৎসব (ঈদে মীলাদুন্নবী) প্রতি বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে উদযাপন করেন, যে দিন মহানবী (দ:) এই বসুন্ধরায় আবির্ভূত হন। এই দিনটিতে মুসলমানগণ একত্রিত হন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা করেন, তাঁর পবিত্র জীবন ও জীবনাদর্শ এবং তাঁরই অনুপম গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন, ইসলাম সম্পর্কে জানেন এবং তবাররুক (খাদ্য) বিতরণ করেন।
মীলাদের মূল্যায়ন: মওলিদের যাবতীয় কার্যক্রম যা ওপরে বর্ণিত হয়েছে, তা ইসলামে বৈধ। মওলিদ উদযাপনের জন্যে মুসলমানদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। এর যাবতীয় কার্যক্রম কুরআন, হাদীস, এজমা কিংবা সাহাবা (রা:)-বৃন্দের আমল (অনুশীলিত প্রথা) অথবা আসার (বাণী)-এর সাথে অসামন্ঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি একটি বিশেষ দিন এবং মুসলমান সমাজ পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশজুড়ে এই উৎসব পালন করেন। সওয়াবদায়ক আমল পালন করে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবসকে উদযাপন করা সে সব মুসলমানের জন্যে প্রশংসনীয় আচার, যাঁরা এই সম্মানিত দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নেন এবং এর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
মওলিদের ইতিহাস: ইরবিলের সুলতান আবু সাঈদ আল-মুযাফফর বিন বাকতাকীন কাওকাবুরী সপ্তম হিজরী শতকে সর্বপ্রথম মওলিদ উৎসব চালু করেন। তিনি ছিলেন পরহেযগার, সাহসী বীর, উদার ও জ্ঞানী শাসক এবং ইসলাম ধর্মের খেদমতগার। তিনি ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন। মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের সময় তিনি হাদীসবেত্তা, তাফসীর বিশারদ, ফেকাহবিদ, একনিষ্ঠ সূফীবৃন্দসহ মুসলমান সর্বসাধারণকে এই উৎসবে আমন্ত্রণ করেন। ফেকাহবিদ আবুল খাত্তাব ইবনে দাহিয়া মীলাদ উৎসবের প্রশংসায় একটি বই লিখেন এবং তা সুলতানের কাছে পেশ করেন বিশেষভাবে ওই মাহফিলে পড়ার জন্যে। মীলাদুন্নবী (দ:)-এর এই প্রথা পূর্ব থেকে পশ্চিমে সকল উলামায়ে কেরামের কাছে জ্ঞাত হয়ে যায়, যাঁরা একে গ্রহণ করেন এবং এর বৈধতার পক্ষে ইসলামী দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মুহাদ্দীস ইমাম আহমদ ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:), ইমাম হাফেয সাখাভী (রহ:) ও ইমাম হাফেয সৈয়ুতী (রহ:)। এই আলেমগণসহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান বিশারদ মওলিদের প্রশংসাসূচক বইপত্র লিখেন এবং কোনো মুসলমান পণ্ডিত-ই এই উৎসবের বিরূপ সমালোচনা করেন নি।
মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বৈধতার পক্ষে উলামাদের পেশকৃত প্রামাণ্য দলিল
রাসূলুল্লাহ (দ:) সোমবার দিন উদযাপন করতেন এবং এর প্রশংসা করেছিলেন, কেননা ওই দিন তিনি ধরণীর বুকে আবির্ভূত হন এবং ওই দিন-ই তাঁর প্রতি ওহী (ঐশী বাণী) নাযেল তথা অবতীর্ণ হয়। তিনি এরশাদ ফরমান, ”সোমবার আমার বেলাদত হয়েছে।”
মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরতের পরে হুযূর পাক (দ:) ১০ই মহররম তারিখে রোযা রাখতেন। এর প্রেক্ষিত ছিল এই যে, তিনি মদীনায় দেখতে পান ইহুদীরা ওই দিনটিকে পালন করে থাকে, যেহেতু আল্লাহতা’লা হযরত মূসা (আ:) ও তাঁর জাতিকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করেছিলেন সেদিন। এ ব্যাপারে ইহুদীদের কথা যে সত্য তা ওহী মারফত জানার পর রাসূলুল্লাহ (দ:) আল-বুখারীর বর্ণনামতে এরশাদ ফরমান, ”মূসা (আ:)-এর ওপর আমাদের হক্ক সর্বাগ্রে।” অতঃপর তিনি ৯ ও ১০ই মহররম তারিখে নফল রোযা রাখতে মুসলমানদেরকে আদেশ করেন।
মহানবী (দ:) কি মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান পালন করেছিলেন?
বর্তমানের মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রচলন মহানবী (দ:)-এর সময় হয় নি, তবে তিনি মীলাদকে হারাম বা অবৈধ বলেন নি। ইসলামের বিধান মোতাবেক এটি একটি বেদআত তথা উদ্ভাবন যা উত্তম (হাসানাহ/সুন্দর ও কল্যাণকর)।
বেদআত কী?
বেদআত হলো কোনো নতুন প্রথার প্রচলন যা ইতিপূর্বে ছিল না।
আম বা সার্বিকভাবে বেদআতের ব্যাপারে হুকুম কী?
আহলুস্ সুন্নাত (সুন্নী মুসলমান সমাজ) একমত হয়েছেন যে কিছু বেদআত বৈধ (জায়েয), আবার কিছু না-জায়েয (অবৈধ)। তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেন যে প্রতিটি বেদআত-ই না-জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের সূরা হাদীদের ২৭ নং আয়াতে রাহবানিয়্যা তথা বৈরাগ্যের মতো বেদআতে হাসানা প্রচলনকারী হযরত ঈসা (আ:)-এর অনুসারীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অথচ আল্লাহ এটি তাদের প্রতি বাধ্যতামূলক করেন নি। তথাপিও তাঁরা আল্লাহর রহমত-বরকত অর্জন করেন। রাহবানিয়্যা হলো বৈরাগ্য তথা নিজের নফসানী কামনা-বাসনা ত্যাগ করা; এতে বৈবাহিক জীবন ত্যাগও অন্তর্ভুক্ত। ওই অনুসারীবৃন্দ লোকালয় থেকে দূরে মাটির ঘর নির্মাণ করে সেখানে আল্লাহর এবাদতে মশগুল হন।
মহানবী (দ:) বেদআতে হাসানা (কল্যাণময় নতুন প্রথা) ও বেদআতে সাইয়্যেয়াহ (অকল্যাণকর নতুন প্রথা)-এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। মুসলিম শরীফের বর্ণনানুযায়ী তিনি এরশাদ ফরমান, যে ব্যক্তি ধর্মের মধ্যে কল্যাণকর কোনো প্রথার প্রচলন করবেন তিনি তার সওয়াব পাবেন, এবং যারা এর ওপর আমল করবেন তাদের সওয়াবও তিনি পাবেন; আর এতে পরবর্তী আমলকারীদের সওয়াবেও কোনো স্বল্পতা হবে না। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি অকল্যাণকর প্রথার প্রচলন করবে, সে এর গুনাহের ভাগিদার হবে; আর যারা এই প্রথা পালন করবে তাদের গুনাহেরও অংশীদার হবে সে; এতে পরবর্তী গুনাহগারদের গুনাহে কোনো স্বল্পতা হবে না।
আল-বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, কেউ আমাদের ধর্মে নেই (মা লাইসা মিনহু) এমন কোনো নতুন বিষয় পরিবেশন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (দ:) সুস্পষ্টভাবে ধর্মের বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি নির্দেশ করেছেন, সেহেতু এর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে ইসলামে প্রতিটি বেদআত-ই প্রত্যাখ্যাত নয়। অতএব, কুরআন, হাদীস, এজমা এবং সাহাবা-এ-কেরামের বাণী ও আমলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নতুন প্রচলিত প্রথা প্রত্যাখ্যাত হবে না (অর্থাৎ, তা হেদায়াতমূলক নতুন প্রথা)।
ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেন, বেদআত দুই প্রকার; হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শনমূলক, এবং গোমরাহীমূলক মানে বিভ্রান্তিময়। তিনি আরও বলেন, কুরআন, হাদীস, এজমা এবং সাহাবা-এ-কেরামের বাণী ও আমলের সাথে সামন্ঞ্জস্যপূর্ণ নতুন প্রথা হেদায়াতমূলক; আর যেটি উক্ত ওই সব দলিলের পরিপন্থী তা গোমরাহীমূলক। ইমাম বায়হাকী (রহ:), ইমাম ইযয ইবনে আব্দিস্ সালাম (রহ:), ইমাম নববী (রহ:) ও ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)-ও এই দুই শ্রেণীর বেদআতের কথা উল্লেখ করেছেন। চার মযহাব (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী)-এর অনুসারীবৃন্দ এতে একমত হয়েছেন।
হেদায়াতমূলক কতিপয় বেদআত
অধিকাংশ বেদআত গোমরাহীমূলক হলেও ইসলামে গৃহীত অসংখ্য বেদআতের উদাহরণ বিদ্যমান। মহানবী (দ:)-এর সময়কাল থেকেই এ রকম বহু বেদআত গৃহীত হয়।
এক ব্যক্তি রাসূলে খোদা (দ:)-এর ইমামতিতে নামায পড়ছিলেন; তিনি প্রতি রুকু থেকে দাঁড়াবার সময় একটি উত্তম দোয়া পাঠ করছিলেন। নামাযশেষে হুযূর পূর নূর (দ:) ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। তিনি এরশাদ ফরমান, আমি দেখতে পাই অন্ততঃ ৪০ জন ফেরেশতা এই নেকী আগে লেখার চেষ্টায় রত। (আল-বুখারী)
সাহাবী হযরত খুবাইব ইবনে ‘আদী (রা:) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের আক্রমণ মোকাবেলার সময় সর্বপ্রথম দুই রাকআত নামায পড়ার প্রথা প্রবর্তন করেন। নবী করীম (দ:)-কে এ কথা জানানোর পরও তিনি তা নিষেধ করেন নি।
আল-বুখারী (ইমাম মালেক এবং মুসলিমও) বর্ণনা করেন যে খলীফা উমর (রা:) সকল মুসলমানকে সমবেত করে তাঁদের জন্যে একজন ইমাম নিয়োগ করেন, যাতে তাঁরা তারাবীহ’র নামায জামা’য়াতে আদায় করতে পারেন। পরের দিন তাঁদেরকে তা আদায় করতে দেখে তিনি বলেন, “কী উত্তম বেদআত এটি!” খলীফা উমর (রা:) সুস্পষ্টভাবে ‘বেদআত’ শব্দটি তাঁর এই প্রশংসাসূচক বাক্যে ব্যবহার করেন। যদি সকল বেদআত গোমরাহী হতো, তাহলে খলীফা উমর (রা:) এটি প্রবর্তন করতেন না, আর এর প্রশংসাও এভাবে করতেন না।
খলীফা উসমান (রা:) জুম’আর নামাযের আগে ইমাম সাহেব মিম্বরে আরোহণের সময়ে প্রদত্ত প্রথম আযানের প্রবর্তন করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মজীদ নিম্নবর্ণিত অক্ষরে লেখা ছিল - আলিফ, বে, তে, সে, ইয়ে ইত্যাদি; এর ওপরে অথবা নিচে কোনো ’নোকতা’ (জের, জবর, পেশ) ছিল না। এটির প্রচলন করেন হযরত হাসান বিসরী (রা:), যা মহানবী (দ:)-এর হায়াতে জিন্দেগীর পরবর্তীকালে হয়েছে।
সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগে হযরত এয়াহইয়া ইবনে এয়া’মুর (রা:) কুরআন মজীদের অক্ষরগুলোতে ‘তাশকীল’ ব্যবহার আরম্ভ করেন। অদ্যাবধি বিনা আপত্তিতে এই সকল চিহ্ন ব্যবহার করে কুরআন তেলাওয়াত করা হয়ে থাকে।
মদীনা শরীফে অবস্থিত মসজিদে নববীসহ সব মসজিদেই মুসলমানগণ মেহরাব সংযোজন করেন।
’সকল বেদআত গোমরাহী’ - হাদীসটির অর্থ
এই হাদীস রওয়ায়াত করেন ইমাম আবু দাউদ (রহ:); এর মানে অধিকাংশ (প্রত্যেকটি নয়) নতুন প্রথা গোমরাহীপূর্ণ। এর মানে প্রত্যেকটি বেদআত-ই গোমরাহী তথা বিচ্যুতি হতে পারে না, কেননা এই ব্যাখ্যা ওপরে উদ্ধৃত দলিলাদির পরিপন্থী; আর ইসলামী দলিল-আদিল্লা পরস্পরবিরোধী নয়।
আরবী ভাষায় ‘কুল’ শব্দটি একটি সার্বিক বাক্য যা একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে, কিন্তু তা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে বোঝায় না। এর ব্যবহার দেখা যায় আল-কুরআনের সূরা আহকাফ ২৫ আয়াতে যা বিবৃত করে যে ‘আদ গোত্রকে শাস্তি দেয়ার জন্যে আল্লাহতা’লা যে হাওয়া প্রেরণ করেন তা অধিকাংশ বস্তুকে ধ্বংস করলেও গাছ, আকাশমণ্ডল বা পাহাড়-পর্বতের মতো সকল বস্তুকে ধ্বংস করে নি।
অনুরূপভাবে, সহীহ মুসলিম শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা)-এ ইমাম নববী (রহ:) বলেন: ‘সকল চোখে যেনার (কামভাবযুক্ত) চাহনি’ মর্মে হাদীসটি একটি সার্বিক মন্তব্য যা’তে নির্দিষ্ট অর্থ নিহিত। এটি স্পষ্টভাবে প্রত্যেকটি চোখে কামভাবযুক্ত চাহনিকে নির্দেশ করে না। কেননা, মহানবী (দ:) [ও পুণ্যবান বান্দাগণ] নিশ্চয় এ রকম নিকৃষ্ট পাপ সংঘটন করেন না; আর জন্মান্ধ কোনো লোকের কামভাবযুক্ত চাহনি থাকতে পারে না।
*সমাপ্ত*
মীলাদ কী: মওলিদ বা মীলাদ একটি খুশির উৎসব যা’তে মুসলমান সমাজ সমবেত হন মহানবী (দ:)-কে আমাদের মাঝে প্রেরণের জন্যে আল্লাহতা’লার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। মুসলমানবৃন্দ এই উৎসব (ঈদে মীলাদুন্নবী) প্রতি বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে উদযাপন করেন, যে দিন মহানবী (দ:) এই বসুন্ধরায় আবির্ভূত হন। এই দিনটিতে মুসলমানগণ একত্রিত হন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা করেন, তাঁর পবিত্র জীবন ও জীবনাদর্শ এবং তাঁরই অনুপম গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন, ইসলাম সম্পর্কে জানেন এবং তবাররুক (খাদ্য) বিতরণ করেন।
মীলাদের মূল্যায়ন: মওলিদের যাবতীয় কার্যক্রম যা ওপরে বর্ণিত হয়েছে, তা ইসলামে বৈধ। মওলিদ উদযাপনের জন্যে মুসলমানদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। এর যাবতীয় কার্যক্রম কুরআন, হাদীস, এজমা কিংবা সাহাবা (রা:)-বৃন্দের আমল (অনুশীলিত প্রথা) অথবা আসার (বাণী)-এর সাথে অসামন্ঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি একটি বিশেষ দিন এবং মুসলমান সমাজ পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশজুড়ে এই উৎসব পালন করেন। সওয়াবদায়ক আমল পালন করে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবসকে উদযাপন করা সে সব মুসলমানের জন্যে প্রশংসনীয় আচার, যাঁরা এই সম্মানিত দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নেন এবং এর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
মওলিদের ইতিহাস: ইরবিলের সুলতান আবু সাঈদ আল-মুযাফফর বিন বাকতাকীন কাওকাবুরী সপ্তম হিজরী শতকে সর্বপ্রথম মওলিদ উৎসব চালু করেন। তিনি ছিলেন পরহেযগার, সাহসী বীর, উদার ও জ্ঞানী শাসক এবং ইসলাম ধর্মের খেদমতগার। তিনি ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন। মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের সময় তিনি হাদীসবেত্তা, তাফসীর বিশারদ, ফেকাহবিদ, একনিষ্ঠ সূফীবৃন্দসহ মুসলমান সর্বসাধারণকে এই উৎসবে আমন্ত্রণ করেন। ফেকাহবিদ আবুল খাত্তাব ইবনে দাহিয়া মীলাদ উৎসবের প্রশংসায় একটি বই লিখেন এবং তা সুলতানের কাছে পেশ করেন বিশেষভাবে ওই মাহফিলে পড়ার জন্যে। মীলাদুন্নবী (দ:)-এর এই প্রথা পূর্ব থেকে পশ্চিমে সকল উলামায়ে কেরামের কাছে জ্ঞাত হয়ে যায়, যাঁরা একে গ্রহণ করেন এবং এর বৈধতার পক্ষে ইসলামী দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মুহাদ্দীস ইমাম আহমদ ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:), ইমাম হাফেয সাখাভী (রহ:) ও ইমাম হাফেয সৈয়ুতী (রহ:)। এই আলেমগণসহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান বিশারদ মওলিদের প্রশংসাসূচক বইপত্র লিখেন এবং কোনো মুসলমান পণ্ডিত-ই এই উৎসবের বিরূপ সমালোচনা করেন নি।
মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বৈধতার পক্ষে উলামাদের পেশকৃত প্রামাণ্য দলিল
রাসূলুল্লাহ (দ:) সোমবার দিন উদযাপন করতেন এবং এর প্রশংসা করেছিলেন, কেননা ওই দিন তিনি ধরণীর বুকে আবির্ভূত হন এবং ওই দিন-ই তাঁর প্রতি ওহী (ঐশী বাণী) নাযেল তথা অবতীর্ণ হয়। তিনি এরশাদ ফরমান, ”সোমবার আমার বেলাদত হয়েছে।”
মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরতের পরে হুযূর পাক (দ:) ১০ই মহররম তারিখে রোযা রাখতেন। এর প্রেক্ষিত ছিল এই যে, তিনি মদীনায় দেখতে পান ইহুদীরা ওই দিনটিকে পালন করে থাকে, যেহেতু আল্লাহতা’লা হযরত মূসা (আ:) ও তাঁর জাতিকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করেছিলেন সেদিন। এ ব্যাপারে ইহুদীদের কথা যে সত্য তা ওহী মারফত জানার পর রাসূলুল্লাহ (দ:) আল-বুখারীর বর্ণনামতে এরশাদ ফরমান, ”মূসা (আ:)-এর ওপর আমাদের হক্ক সর্বাগ্রে।” অতঃপর তিনি ৯ ও ১০ই মহররম তারিখে নফল রোযা রাখতে মুসলমানদেরকে আদেশ করেন।
মহানবী (দ:) কি মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান পালন করেছিলেন?
বর্তমানের মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রচলন মহানবী (দ:)-এর সময় হয় নি, তবে তিনি মীলাদকে হারাম বা অবৈধ বলেন নি। ইসলামের বিধান মোতাবেক এটি একটি বেদআত তথা উদ্ভাবন যা উত্তম (হাসানাহ/সুন্দর ও কল্যাণকর)।
বেদআত কী?
বেদআত হলো কোনো নতুন প্রথার প্রচলন যা ইতিপূর্বে ছিল না।
আম বা সার্বিকভাবে বেদআতের ব্যাপারে হুকুম কী?
আহলুস্ সুন্নাত (সুন্নী মুসলমান সমাজ) একমত হয়েছেন যে কিছু বেদআত বৈধ (জায়েয), আবার কিছু না-জায়েয (অবৈধ)। তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেন যে প্রতিটি বেদআত-ই না-জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের সূরা হাদীদের ২৭ নং আয়াতে রাহবানিয়্যা তথা বৈরাগ্যের মতো বেদআতে হাসানা প্রচলনকারী হযরত ঈসা (আ:)-এর অনুসারীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অথচ আল্লাহ এটি তাদের প্রতি বাধ্যতামূলক করেন নি। তথাপিও তাঁরা আল্লাহর রহমত-বরকত অর্জন করেন। রাহবানিয়্যা হলো বৈরাগ্য তথা নিজের নফসানী কামনা-বাসনা ত্যাগ করা; এতে বৈবাহিক জীবন ত্যাগও অন্তর্ভুক্ত। ওই অনুসারীবৃন্দ লোকালয় থেকে দূরে মাটির ঘর নির্মাণ করে সেখানে আল্লাহর এবাদতে মশগুল হন।
মহানবী (দ:) বেদআতে হাসানা (কল্যাণময় নতুন প্রথা) ও বেদআতে সাইয়্যেয়াহ (অকল্যাণকর নতুন প্রথা)-এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। মুসলিম শরীফের বর্ণনানুযায়ী তিনি এরশাদ ফরমান, যে ব্যক্তি ধর্মের মধ্যে কল্যাণকর কোনো প্রথার প্রচলন করবেন তিনি তার সওয়াব পাবেন, এবং যারা এর ওপর আমল করবেন তাদের সওয়াবও তিনি পাবেন; আর এতে পরবর্তী আমলকারীদের সওয়াবেও কোনো স্বল্পতা হবে না। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি অকল্যাণকর প্রথার প্রচলন করবে, সে এর গুনাহের ভাগিদার হবে; আর যারা এই প্রথা পালন করবে তাদের গুনাহেরও অংশীদার হবে সে; এতে পরবর্তী গুনাহগারদের গুনাহে কোনো স্বল্পতা হবে না।
আল-বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, কেউ আমাদের ধর্মে নেই (মা লাইসা মিনহু) এমন কোনো নতুন বিষয় পরিবেশন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (দ:) সুস্পষ্টভাবে ধর্মের বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি নির্দেশ করেছেন, সেহেতু এর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে ইসলামে প্রতিটি বেদআত-ই প্রত্যাখ্যাত নয়। অতএব, কুরআন, হাদীস, এজমা এবং সাহাবা-এ-কেরামের বাণী ও আমলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নতুন প্রচলিত প্রথা প্রত্যাখ্যাত হবে না (অর্থাৎ, তা হেদায়াতমূলক নতুন প্রথা)।
ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেন, বেদআত দুই প্রকার; হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শনমূলক, এবং গোমরাহীমূলক মানে বিভ্রান্তিময়। তিনি আরও বলেন, কুরআন, হাদীস, এজমা এবং সাহাবা-এ-কেরামের বাণী ও আমলের সাথে সামন্ঞ্জস্যপূর্ণ নতুন প্রথা হেদায়াতমূলক; আর যেটি উক্ত ওই সব দলিলের পরিপন্থী তা গোমরাহীমূলক। ইমাম বায়হাকী (রহ:), ইমাম ইযয ইবনে আব্দিস্ সালাম (রহ:), ইমাম নববী (রহ:) ও ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)-ও এই দুই শ্রেণীর বেদআতের কথা উল্লেখ করেছেন। চার মযহাব (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী)-এর অনুসারীবৃন্দ এতে একমত হয়েছেন।
হেদায়াতমূলক কতিপয় বেদআত
অধিকাংশ বেদআত গোমরাহীমূলক হলেও ইসলামে গৃহীত অসংখ্য বেদআতের উদাহরণ বিদ্যমান। মহানবী (দ:)-এর সময়কাল থেকেই এ রকম বহু বেদআত গৃহীত হয়।
এক ব্যক্তি রাসূলে খোদা (দ:)-এর ইমামতিতে নামায পড়ছিলেন; তিনি প্রতি রুকু থেকে দাঁড়াবার সময় একটি উত্তম দোয়া পাঠ করছিলেন। নামাযশেষে হুযূর পূর নূর (দ:) ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। তিনি এরশাদ ফরমান, আমি দেখতে পাই অন্ততঃ ৪০ জন ফেরেশতা এই নেকী আগে লেখার চেষ্টায় রত। (আল-বুখারী)
সাহাবী হযরত খুবাইব ইবনে ‘আদী (রা:) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের আক্রমণ মোকাবেলার সময় সর্বপ্রথম দুই রাকআত নামায পড়ার প্রথা প্রবর্তন করেন। নবী করীম (দ:)-কে এ কথা জানানোর পরও তিনি তা নিষেধ করেন নি।
আল-বুখারী (ইমাম মালেক এবং মুসলিমও) বর্ণনা করেন যে খলীফা উমর (রা:) সকল মুসলমানকে সমবেত করে তাঁদের জন্যে একজন ইমাম নিয়োগ করেন, যাতে তাঁরা তারাবীহ’র নামায জামা’য়াতে আদায় করতে পারেন। পরের দিন তাঁদেরকে তা আদায় করতে দেখে তিনি বলেন, “কী উত্তম বেদআত এটি!” খলীফা উমর (রা:) সুস্পষ্টভাবে ‘বেদআত’ শব্দটি তাঁর এই প্রশংসাসূচক বাক্যে ব্যবহার করেন। যদি সকল বেদআত গোমরাহী হতো, তাহলে খলীফা উমর (রা:) এটি প্রবর্তন করতেন না, আর এর প্রশংসাও এভাবে করতেন না।
খলীফা উসমান (রা:) জুম’আর নামাযের আগে ইমাম সাহেব মিম্বরে আরোহণের সময়ে প্রদত্ত প্রথম আযানের প্রবর্তন করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মজীদ নিম্নবর্ণিত অক্ষরে লেখা ছিল - আলিফ, বে, তে, সে, ইয়ে ইত্যাদি; এর ওপরে অথবা নিচে কোনো ’নোকতা’ (জের, জবর, পেশ) ছিল না। এটির প্রচলন করেন হযরত হাসান বিসরী (রা:), যা মহানবী (দ:)-এর হায়াতে জিন্দেগীর পরবর্তীকালে হয়েছে।
সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগে হযরত এয়াহইয়া ইবনে এয়া’মুর (রা:) কুরআন মজীদের অক্ষরগুলোতে ‘তাশকীল’ ব্যবহার আরম্ভ করেন। অদ্যাবধি বিনা আপত্তিতে এই সকল চিহ্ন ব্যবহার করে কুরআন তেলাওয়াত করা হয়ে থাকে।
মদীনা শরীফে অবস্থিত মসজিদে নববীসহ সব মসজিদেই মুসলমানগণ মেহরাব সংযোজন করেন।
’সকল বেদআত গোমরাহী’ - হাদীসটির অর্থ
এই হাদীস রওয়ায়াত করেন ইমাম আবু দাউদ (রহ:); এর মানে অধিকাংশ (প্রত্যেকটি নয়) নতুন প্রথা গোমরাহীপূর্ণ। এর মানে প্রত্যেকটি বেদআত-ই গোমরাহী তথা বিচ্যুতি হতে পারে না, কেননা এই ব্যাখ্যা ওপরে উদ্ধৃত দলিলাদির পরিপন্থী; আর ইসলামী দলিল-আদিল্লা পরস্পরবিরোধী নয়।
আরবী ভাষায় ‘কুল’ শব্দটি একটি সার্বিক বাক্য যা একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে, কিন্তু তা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে বোঝায় না। এর ব্যবহার দেখা যায় আল-কুরআনের সূরা আহকাফ ২৫ আয়াতে যা বিবৃত করে যে ‘আদ গোত্রকে শাস্তি দেয়ার জন্যে আল্লাহতা’লা যে হাওয়া প্রেরণ করেন তা অধিকাংশ বস্তুকে ধ্বংস করলেও গাছ, আকাশমণ্ডল বা পাহাড়-পর্বতের মতো সকল বস্তুকে ধ্বংস করে নি।
অনুরূপভাবে, সহীহ মুসলিম শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা)-এ ইমাম নববী (রহ:) বলেন: ‘সকল চোখে যেনার (কামভাবযুক্ত) চাহনি’ মর্মে হাদীসটি একটি সার্বিক মন্তব্য যা’তে নির্দিষ্ট অর্থ নিহিত। এটি স্পষ্টভাবে প্রত্যেকটি চোখে কামভাবযুক্ত চাহনিকে নির্দেশ করে না। কেননা, মহানবী (দ:) [ও পুণ্যবান বান্দাগণ] নিশ্চয় এ রকম নিকৃষ্ট পাপ সংঘটন করেন না; আর জন্মান্ধ কোনো লোকের কামভাবযুক্ত চাহনি থাকতে পারে না।
*সমাপ্ত*