লেখক: আলহাজ্জ্ব মুফতী এস, এম, সাকীউল কাউসার (কুমিল্লা)
২০ রাক’আত তারাবীহ’র ফয়সালা
প্রকাশ থাকে যে প্রতি রমজান মাসে এ’শার নামজের পর বিতির নামাজের পূর্বে ৪ রাকাত করে মোট ২০ রাকাত তারাবীহ’র নামাজ পড়া প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর ক্ষেত্রে সূন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অতএব, রমজান মাস ছাড়া তারাবীহ’র নামাজ নাই। তারাবীহ’র নামাজ পুরূষের জন্য জামাত সহকারে মসজিদে পড়া উত্তম। নামাজে পূর্ণ এক খতম কোরআন পড়া সূন্নাত। বেশি পড়া ভালো। ক্বদর রাত্রিতে এক খতম করা মুস্তাহাব। (সমূহ ফিকহা’র কিতাব)
কোরআন খতম করতে জামাতের লোকের কষ্ট হলে বা জামাতের লোক কমে গেলে ছোট ক্বেরাতে পড়া ভালো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাআত তারাবীহ জামাত সহকারে পুরো রামাদান মাসে পড়েন নি, কারণ হিসেবে বলেছেন পুরো রামাদান মাসে জামাতে আমি তারাবীহ পড়লে তা ওয়াজিব হয়ে যাবে, এতে আমার উম্মতের কষ্ট হবে। সুবহানাল্লাহ! খোলাফায়ে রাশেদীন তথা হযরত ওমর (রা:)-এর যুগে ২০ রাকাআত তারাবীহ জামাতে পড়া নির্ধারিত হয় এবং তা ইজমায়ে উম্মত হিসেবে স্বীকৃত। যেহেতু হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, ‘আ’লাইকুম বিস সূন্নাতি ওয়া সূন্নাতিল খোলাফায়ি রাশেদীনাল মাহদীয়ান’, অর্থাৎ, তোমরা আমার সূন্নাত ও আমার খোলাফায়ি রাশেদীনের সূন্নাত’কে আঁকড়ে ধরো।
তারাবীহ’র মর্মার্থ
তারাবীহ ২০ রাকাআত, ৮ রাকাআত নয়
তারাবীহ تراويح শব্দটি ترويح তারবীহা-এর বহুবচন, যার অর্থ হলো শরীরকে আরাম দেয়া। থেমে থেমে যে নামাজ তাকে তারাবীহ বলে। তারাবীহ’তে ৪ রাকাত পরপর থেমে তাসবীহ-দোয়া পড়া হয়। তারাবীহ’র নামাজে ৪ রাকাআত পরপর কিছু সময় বসে আরাম করা হয়। আর বসাটার নাম তারবীহা। এ জন্য এ নামাজকে তারাবীহ’র নামাজ বা আরামের সমষ্টি বলা হয়। আরবীতে বহুবচন হলো নিচে তিন উপরের কোনো সীমা নাই। যদি ৮ রাকাত তারাবীহ হয়, তাহলে তো এর মধ্যে মাত্র একবার তারবীহা পাওয়া যাচ্ছে এবং এর নাম তারাবীহ (বহুবচন) হতো না। তিন তারাবীহ’র জন্য কমপক্ষে ১৬ রাকাত তারাবীহ হওয়া দরকার; অর্থাৎ, প্রতি ৪ রাকআত পর এক তারবীহা। বিতিরের আগে কোনো তারবীহা বা বিশ্রাম নেই। অতএব, তারাবীহ-এর নামটি-ই প্রমাণ করে তারাবীহ ৮ রাকাআত নয়।
কোরআন শরীফ-ই প্রমাণ তারাবীহ ৮ রাকাআত নয়
পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা, আয়াত ও রুকু রয়েছে। কোরআন শরীফে যে সব বিষয়বস্তুর নাম রয়েছে, সেগুলোকে সূরা বলে, আর যে সব বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন নাম নেই, সেগুলোকে আয়াত বলা হয়। কিন্তু রূকু’কে রূকু কেন বলা হয় তা জানা দরকার। কেননা, সূরার অর্থ হলো কোনো বিষয়কে পরিবেষ্টন করা, আর আয়াত অর্থ হলো চিহ্ন, যেহেতু সূরা একটি বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন সূরা বাক্বারা, সূরা বালাদ ইত্যাদি। আর আয়াত আল্লাহ’র কুদরতের চিহ্ন হিসেবে বিবেচ্য, তাই এ নামকরণ যথার্থ হয়েছে। কিন্তু কোরআনের রূকুকে রূকু কেন বলা হয় তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। রূকু অর্থ নত হওয়া। তাজবীদের কিতাবসমূহ দ্বারা জানা যায় যে, সর্ব-হযরত ওমর ও উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তারাবীহ’র নামাজে যে পরিমাণ কোরআন পাঠ করে রূকু’তে যেতেন, সে অংশের নাম ‘রূকু’ রাখা হয়েছে। তারাবীহ’র নামাজ ২০ রাকাআত এবং রামাদানের ২৭ তারিখে কোরআনের খতম হিসেব ধরলে, কোরআন পাকে মোট ৫৫৭ টি রূকু হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু খতমের দিন কোনো কোনো রাকাআতে ছোট ছোট দু’তিন সূরা এক সাথে পড়ে ফেলা হতো, সে জন্য কোরআন শরীফে ৫৪০ টি রূকু রয়েছে। যদি ৮ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ হতো, তাহলে রূকুর সংখ্যা হতো ১১২ টি। সুতরাং কোরআনের রূকুর সংখ্যা-ই প্রমাণ করে তারাবীহ’র নামাজ ২০ রাকাত। কোনো আহলে হাদীস বা সালাফী-নজদী ৮ রাকাআত তারাবীহ’র সমর্থনে কোরআন শরীফের রূকুর কোনো ব্যাখ্যা কিয়ামত পর্যন্ত দিতে পারবে না। চ্যালেঞ্জ রইলো!!!
হাদীস শরীফের আলোকে
খোলাফায়ি রাশেদীনের ২য় খলীফা হযরত ওমর (রা:)-এর শাসনামলে তিনি বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাত-সহ আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম একমত ছিলেন।
১) ‘মুয়াত্তা ইমাম মালেক’ কিতাবে হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন -
قال سنا نقوم فى عهد عمر بعشرين ركعةً ( رواه البيهقى فى الفرقة باسناد صحيح) অর্থাৎ, হযরত ওমর (রা:)-এর যুগে লোকেরা ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ আরম্ভ করে, সহীহ সনদে বায়হাকী শরীফে তা বর্ণিত হয়েছে।
২) হযরত ইবনে মনি হযরত আবি ইবনে কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন- فصلِىٍ بهم عشرين ركعة অর্থাৎ, তাঁরা (সাহাবাগণ) ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ পড়তেন।
৩) বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে- عن ابى الحسنات انً علىِ ابن ابى طالب امر رجلآ يصلىٍ بالناس خمس ترويخات عشرين ركعةً অর্থাৎ, আবিল হাসনাত হতে বর্ণিত আলী ইবনে আবি তালিব (রা:) বলেন, মানুষের জন্য ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও ২০ রাকাআত তারাবীহ।
৪) ইবনে আবি শিবা, তিবরানী, কবীর, বায়হাকী, আবদ ইবনে হামিদ ও বগবী বর্ণনা করেছেন - عن ابى عباس انً النبىً صلى الله عليه وسلم كان يصلى فى رمضان عشرين ركعة سوى الوتر অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে বিতির ছাড়া ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ আদায় করেছেন।
এ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে স্বয়ং হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ পড়তেন।
ওলামায়ে উম্মতের অভিমত
(১) তিরমীজি শরীফের ‘সওমের’ আলোচনায়- ما جاء فى قيام شهر رمضان নামক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে -
و اكثر اهل العلم على ماروىَ عن علىٍ و عمر و غيرهما من اصحاب النبى صلى الله عليه وسلم عشرين ركعة و هو قول سفيان رالثورى وابن المبارك و الشافعى وقال الشافعى هكذا ادركت ببلد مكة يصلون عشرين ركعة –
অর্থাৎ, আহলে ইলমের আমল এটার উপর, যা সর্ব-হযরত আলী, ওমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে; অর্থাৎ, ২০ রাকাআত। এটাই সর্ব-হযরত সুফীয়ান ছাওরী (রহ:), ইবনে মুবারক (রহ:), ইমাম শাফেঈ (রহ:) প্রমুখের অভিমত। ইমাম শাফেঈ (রহ:) স্বীয় শহর পবিত্র মক্কায় এই অনুশীলন দেখতে পান, অর্থাৎ, মুসলমানেরা ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়তেন।
ওলামায়ে উম্মতের অভিমত
(২) روى محمد ابن نصر من طريق عطاء قال ادركتهم يصلون عشرين ركعة ؤثلث ركعات الوتر وفى الباب اثار كثيرة اخرجها ابن ابى شيبة وغيره وقال ابن قدامة وهذا كالاجماع – এতে বোঝা গেল বিশ রাকাআতের উপর মুসলমানদের ঐকমত্য হয়েছে।
(৩) উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী ৫ম খণ্ডের ৩০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, وروى الحارث ابن عبيد الرحمن ابن ابى ذياد عن السائب هلبن يزيد قال كان القيام على عهد عمر بثلثٍ و عشرين ركعة قال ابن عبد الله هذا محمول على ان الثلث للوتر - অতএব, এর থেকে জানা গেলো যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা:)-এর যুগে ২০ রাকাআত তারাবীহ ও ৩ রাকাআত বিতির পড়া হতো।
(৪) উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী’র ৫ম খণ্ডের ৩৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, قال ابن عبد البار وهو قول جمهور العلماء وهو الصحيح اعن أبى ابن كعب من غير خلاف من الصحبة - অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্দুল বির বলেছেন যে, ২০ রাকাআত তারাবীহের নামাজ হচ্ছে সাধারণ ওলামায়ে কেরামের অভিমত। কুফা’বাসী, ইমাম শাফেঈ (রহ:) ও অধিকাংশ ফকহীগণ এর সমর্থক এবং হযরত আবি ইবনে কা’ব (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে এ ব্যাপারে কোনো সাহাবীরই দ্বিমত নেই।
লা-মাযহাবী, আহলে হাদীস-সালাফীরা ৮ রাকাত তারাবী’র নামাজ জামাতে পড়ে এবং ২০ রাকাআতের বিরোধিতা করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই পুরো রামাদান মাসে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়েননি, কারণ উম্মতের উপর তা ওয়াজিব হয়ে যেতে পারে। আমরা হযরত উমর (রা:) ও ইজমায়ে সাহাবা বা উম্মতের উপর আমল করে ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ জামাতে পড়ি। কিন্তু আহলে খবিশ লা-মাযহাবীরা কোন্ হাদীছের ওপর ভিত্তি করে পুরো রমাদান মাসে ৮ রাকাআত তারাবীহ জামাতে পড়ে?
যে হাদীছের ওপর ভিত্তি করে তারা ৮ রাকাআত তারাবীহ দাবি করে, সেটা ছিল ‘তাহাজ্জুদের’ নামাজ। তারাবীহ’র নামাজ মূলতঃ সূন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তা জামাতে পড়া ও ২০ রাকাআত পড়া, এই তিনটি সূন্নাত হযরত উমর ফারুক (রা:)-এর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় ২০ রাকাআত পড়েন নি এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা:)-কে জামাত সহকারে পড়ার নির্দেশও দেন নি। তারাবীহ যদি ৮ রাকাআত পড়া হয়, তাহলে সূন্নাতে ফারুকী ও সাহাবাদের ইজমা ২০ রাকাআত বাদ পড়ে যায়। আর যদি ২০ রাকাআত পড়া হয়, তাহলে সবার উপর আমল হয়ে যায়। কেননা ২০-এর মধ্যে ৮ আছে, কিন্তু ৮-এর মধে ২০ নাই। এতদসংক্রান্ত হাদীস আগেই পেশ করেছি, ‘আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সূন্নাতের উপর আমল করো’। সালাফীরাও সব সময় জামাত সহকারে তারাবীহ’র নামাজ পড়ে থাকে। অথচ এ দু’টি বিষয় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণ নেই, এ গুলো হচ্ছে সূন্নাতে ফারুকী, তাই একটি বাদ দিচ্ছে কেন ? ২০ রাকাআত-ই পড়ো।
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু সালমা হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানের রাতে কত রাকাআত নামাজ পড়তেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, (হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রামাদান ও রামাদান ছাড়া অন্যান্য মাসে ৮ রাকাআতের বেশি নামাজ পড়তেন না। এটাই আহলে খবিশদের দলীল। এবার উত্তর শুনুন, উপরোক্ত হাদীসে তারাবীহ’র নামাজ নয়, তাহাজ্জুদের নামাজের কথা বলা হয়েছে। কেননা, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) বলেছেন যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানে ও গায়রে রামাদানে ৮ রাকাআতের অতিরিক্ত পড়তেন না। এতে বোঝা গেলো এটা সেই নামাজ, যা সব সময় পড়া হয়। তাই এটা তারাবীহ হতে পারে না, কারণ তারাবীহ কেবল রামাদান মাসেই পড়া হয়।
-- সমাপ্ত --
২০ রাক’আত তারাবীহ’র ফয়সালা
প্রকাশ থাকে যে প্রতি রমজান মাসে এ’শার নামজের পর বিতির নামাজের পূর্বে ৪ রাকাত করে মোট ২০ রাকাত তারাবীহ’র নামাজ পড়া প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর ক্ষেত্রে সূন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অতএব, রমজান মাস ছাড়া তারাবীহ’র নামাজ নাই। তারাবীহ’র নামাজ পুরূষের জন্য জামাত সহকারে মসজিদে পড়া উত্তম। নামাজে পূর্ণ এক খতম কোরআন পড়া সূন্নাত। বেশি পড়া ভালো। ক্বদর রাত্রিতে এক খতম করা মুস্তাহাব। (সমূহ ফিকহা’র কিতাব)
কোরআন খতম করতে জামাতের লোকের কষ্ট হলে বা জামাতের লোক কমে গেলে ছোট ক্বেরাতে পড়া ভালো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাআত তারাবীহ জামাত সহকারে পুরো রামাদান মাসে পড়েন নি, কারণ হিসেবে বলেছেন পুরো রামাদান মাসে জামাতে আমি তারাবীহ পড়লে তা ওয়াজিব হয়ে যাবে, এতে আমার উম্মতের কষ্ট হবে। সুবহানাল্লাহ! খোলাফায়ে রাশেদীন তথা হযরত ওমর (রা:)-এর যুগে ২০ রাকাআত তারাবীহ জামাতে পড়া নির্ধারিত হয় এবং তা ইজমায়ে উম্মত হিসেবে স্বীকৃত। যেহেতু হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, ‘আ’লাইকুম বিস সূন্নাতি ওয়া সূন্নাতিল খোলাফায়ি রাশেদীনাল মাহদীয়ান’, অর্থাৎ, তোমরা আমার সূন্নাত ও আমার খোলাফায়ি রাশেদীনের সূন্নাত’কে আঁকড়ে ধরো।
তারাবীহ’র মর্মার্থ
তারাবীহ ২০ রাকাআত, ৮ রাকাআত নয়
তারাবীহ تراويح শব্দটি ترويح তারবীহা-এর বহুবচন, যার অর্থ হলো শরীরকে আরাম দেয়া। থেমে থেমে যে নামাজ তাকে তারাবীহ বলে। তারাবীহ’তে ৪ রাকাত পরপর থেমে তাসবীহ-দোয়া পড়া হয়। তারাবীহ’র নামাজে ৪ রাকাআত পরপর কিছু সময় বসে আরাম করা হয়। আর বসাটার নাম তারবীহা। এ জন্য এ নামাজকে তারাবীহ’র নামাজ বা আরামের সমষ্টি বলা হয়। আরবীতে বহুবচন হলো নিচে তিন উপরের কোনো সীমা নাই। যদি ৮ রাকাত তারাবীহ হয়, তাহলে তো এর মধ্যে মাত্র একবার তারবীহা পাওয়া যাচ্ছে এবং এর নাম তারাবীহ (বহুবচন) হতো না। তিন তারাবীহ’র জন্য কমপক্ষে ১৬ রাকাত তারাবীহ হওয়া দরকার; অর্থাৎ, প্রতি ৪ রাকআত পর এক তারবীহা। বিতিরের আগে কোনো তারবীহা বা বিশ্রাম নেই। অতএব, তারাবীহ-এর নামটি-ই প্রমাণ করে তারাবীহ ৮ রাকাআত নয়।
কোরআন শরীফ-ই প্রমাণ তারাবীহ ৮ রাকাআত নয়
পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা, আয়াত ও রুকু রয়েছে। কোরআন শরীফে যে সব বিষয়বস্তুর নাম রয়েছে, সেগুলোকে সূরা বলে, আর যে সব বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন নাম নেই, সেগুলোকে আয়াত বলা হয়। কিন্তু রূকু’কে রূকু কেন বলা হয় তা জানা দরকার। কেননা, সূরার অর্থ হলো কোনো বিষয়কে পরিবেষ্টন করা, আর আয়াত অর্থ হলো চিহ্ন, যেহেতু সূরা একটি বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন সূরা বাক্বারা, সূরা বালাদ ইত্যাদি। আর আয়াত আল্লাহ’র কুদরতের চিহ্ন হিসেবে বিবেচ্য, তাই এ নামকরণ যথার্থ হয়েছে। কিন্তু কোরআনের রূকুকে রূকু কেন বলা হয় তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। রূকু অর্থ নত হওয়া। তাজবীদের কিতাবসমূহ দ্বারা জানা যায় যে, সর্ব-হযরত ওমর ও উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তারাবীহ’র নামাজে যে পরিমাণ কোরআন পাঠ করে রূকু’তে যেতেন, সে অংশের নাম ‘রূকু’ রাখা হয়েছে। তারাবীহ’র নামাজ ২০ রাকাআত এবং রামাদানের ২৭ তারিখে কোরআনের খতম হিসেব ধরলে, কোরআন পাকে মোট ৫৫৭ টি রূকু হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু খতমের দিন কোনো কোনো রাকাআতে ছোট ছোট দু’তিন সূরা এক সাথে পড়ে ফেলা হতো, সে জন্য কোরআন শরীফে ৫৪০ টি রূকু রয়েছে। যদি ৮ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ হতো, তাহলে রূকুর সংখ্যা হতো ১১২ টি। সুতরাং কোরআনের রূকুর সংখ্যা-ই প্রমাণ করে তারাবীহ’র নামাজ ২০ রাকাত। কোনো আহলে হাদীস বা সালাফী-নজদী ৮ রাকাআত তারাবীহ’র সমর্থনে কোরআন শরীফের রূকুর কোনো ব্যাখ্যা কিয়ামত পর্যন্ত দিতে পারবে না। চ্যালেঞ্জ রইলো!!!
হাদীস শরীফের আলোকে
খোলাফায়ি রাশেদীনের ২য় খলীফা হযরত ওমর (রা:)-এর শাসনামলে তিনি বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাত-সহ আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম একমত ছিলেন।
১) ‘মুয়াত্তা ইমাম মালেক’ কিতাবে হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন -
قال سنا نقوم فى عهد عمر بعشرين ركعةً ( رواه البيهقى فى الفرقة باسناد صحيح) অর্থাৎ, হযরত ওমর (রা:)-এর যুগে লোকেরা ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ আরম্ভ করে, সহীহ সনদে বায়হাকী শরীফে তা বর্ণিত হয়েছে।
২) হযরত ইবনে মনি হযরত আবি ইবনে কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন- فصلِىٍ بهم عشرين ركعة অর্থাৎ, তাঁরা (সাহাবাগণ) ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ পড়তেন।
৩) বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে- عن ابى الحسنات انً علىِ ابن ابى طالب امر رجلآ يصلىٍ بالناس خمس ترويخات عشرين ركعةً অর্থাৎ, আবিল হাসনাত হতে বর্ণিত আলী ইবনে আবি তালিব (রা:) বলেন, মানুষের জন্য ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও ২০ রাকাআত তারাবীহ।
৪) ইবনে আবি শিবা, তিবরানী, কবীর, বায়হাকী, আবদ ইবনে হামিদ ও বগবী বর্ণনা করেছেন - عن ابى عباس انً النبىً صلى الله عليه وسلم كان يصلى فى رمضان عشرين ركعة سوى الوتر অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে বিতির ছাড়া ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ আদায় করেছেন।
এ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে স্বয়ং হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ পড়তেন।
ওলামায়ে উম্মতের অভিমত
(১) তিরমীজি শরীফের ‘সওমের’ আলোচনায়- ما جاء فى قيام شهر رمضان নামক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে -
و اكثر اهل العلم على ماروىَ عن علىٍ و عمر و غيرهما من اصحاب النبى صلى الله عليه وسلم عشرين ركعة و هو قول سفيان رالثورى وابن المبارك و الشافعى وقال الشافعى هكذا ادركت ببلد مكة يصلون عشرين ركعة –
অর্থাৎ, আহলে ইলমের আমল এটার উপর, যা সর্ব-হযরত আলী, ওমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে; অর্থাৎ, ২০ রাকাআত। এটাই সর্ব-হযরত সুফীয়ান ছাওরী (রহ:), ইবনে মুবারক (রহ:), ইমাম শাফেঈ (রহ:) প্রমুখের অভিমত। ইমাম শাফেঈ (রহ:) স্বীয় শহর পবিত্র মক্কায় এই অনুশীলন দেখতে পান, অর্থাৎ, মুসলমানেরা ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়তেন।
ওলামায়ে উম্মতের অভিমত
(২) روى محمد ابن نصر من طريق عطاء قال ادركتهم يصلون عشرين ركعة ؤثلث ركعات الوتر وفى الباب اثار كثيرة اخرجها ابن ابى شيبة وغيره وقال ابن قدامة وهذا كالاجماع – এতে বোঝা গেল বিশ রাকাআতের উপর মুসলমানদের ঐকমত্য হয়েছে।
(৩) উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী ৫ম খণ্ডের ৩০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, وروى الحارث ابن عبيد الرحمن ابن ابى ذياد عن السائب هلبن يزيد قال كان القيام على عهد عمر بثلثٍ و عشرين ركعة قال ابن عبد الله هذا محمول على ان الثلث للوتر - অতএব, এর থেকে জানা গেলো যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা:)-এর যুগে ২০ রাকাআত তারাবীহ ও ৩ রাকাআত বিতির পড়া হতো।
(৪) উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী’র ৫ম খণ্ডের ৩৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, قال ابن عبد البار وهو قول جمهور العلماء وهو الصحيح اعن أبى ابن كعب من غير خلاف من الصحبة - অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্দুল বির বলেছেন যে, ২০ রাকাআত তারাবীহের নামাজ হচ্ছে সাধারণ ওলামায়ে কেরামের অভিমত। কুফা’বাসী, ইমাম শাফেঈ (রহ:) ও অধিকাংশ ফকহীগণ এর সমর্থক এবং হযরত আবি ইবনে কা’ব (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে এ ব্যাপারে কোনো সাহাবীরই দ্বিমত নেই।
লা-মাযহাবী, আহলে হাদীস-সালাফীরা ৮ রাকাত তারাবী’র নামাজ জামাতে পড়ে এবং ২০ রাকাআতের বিরোধিতা করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই পুরো রামাদান মাসে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়েননি, কারণ উম্মতের উপর তা ওয়াজিব হয়ে যেতে পারে। আমরা হযরত উমর (রা:) ও ইজমায়ে সাহাবা বা উম্মতের উপর আমল করে ২০ রাকাআত তারাবীহ’র নামাজ জামাতে পড়ি। কিন্তু আহলে খবিশ লা-মাযহাবীরা কোন্ হাদীছের ওপর ভিত্তি করে পুরো রমাদান মাসে ৮ রাকাআত তারাবীহ জামাতে পড়ে?
যে হাদীছের ওপর ভিত্তি করে তারা ৮ রাকাআত তারাবীহ দাবি করে, সেটা ছিল ‘তাহাজ্জুদের’ নামাজ। তারাবীহ’র নামাজ মূলতঃ সূন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তা জামাতে পড়া ও ২০ রাকাআত পড়া, এই তিনটি সূন্নাত হযরত উমর ফারুক (রা:)-এর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় ২০ রাকাআত পড়েন নি এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা:)-কে জামাত সহকারে পড়ার নির্দেশও দেন নি। তারাবীহ যদি ৮ রাকাআত পড়া হয়, তাহলে সূন্নাতে ফারুকী ও সাহাবাদের ইজমা ২০ রাকাআত বাদ পড়ে যায়। আর যদি ২০ রাকাআত পড়া হয়, তাহলে সবার উপর আমল হয়ে যায়। কেননা ২০-এর মধ্যে ৮ আছে, কিন্তু ৮-এর মধে ২০ নাই। এতদসংক্রান্ত হাদীস আগেই পেশ করেছি, ‘আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সূন্নাতের উপর আমল করো’। সালাফীরাও সব সময় জামাত সহকারে তারাবীহ’র নামাজ পড়ে থাকে। অথচ এ দু’টি বিষয় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণ নেই, এ গুলো হচ্ছে সূন্নাতে ফারুকী, তাই একটি বাদ দিচ্ছে কেন ? ২০ রাকাআত-ই পড়ো।
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু সালমা হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানের রাতে কত রাকাআত নামাজ পড়তেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, (হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রামাদান ও রামাদান ছাড়া অন্যান্য মাসে ৮ রাকাআতের বেশি নামাজ পড়তেন না। এটাই আহলে খবিশদের দলীল। এবার উত্তর শুনুন, উপরোক্ত হাদীসে তারাবীহ’র নামাজ নয়, তাহাজ্জুদের নামাজের কথা বলা হয়েছে। কেননা, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) বলেছেন যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানে ও গায়রে রামাদানে ৮ রাকাআতের অতিরিক্ত পড়তেন না। এতে বোঝা গেলো এটা সেই নামাজ, যা সব সময় পড়া হয়। তাই এটা তারাবীহ হতে পারে না, কারণ তারাবীহ কেবল রামাদান মাসেই পড়া হয়।
-- সমাপ্ত --