রাসূল প্রেমিকদের হৃদয়ে চির অম্লান জশনে জুলুছে ঈদে মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
--কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম।
প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক যে, ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখকে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিবর্তে “নবী দিবস” বলার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এর অর্থের সাথে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত তথা ধারাধামে শুভাগমনের কোনো সম্পর্কই নেই। তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপনের অনুমতি তিনি স্বয়ং দিয়েছেন। যথা- মুসলিম শরীফ নামক হাদীস গ্রন্থ থেকে মেশকাত শরীফের রোযা অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার দিন রোজা রাখতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর তিনি এরশাদ ফরমান, ”ওই দিন (সোমবার) আমি জন্ম গ্রহণ করেছি এবং ওই দিন আমার কাছে ওহী এসেছে (আল হাদীস)। হাদীসটিতে প্রতিভাত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপন করতেন। তাই এ দিনটি উদযাপন করা সুন্নাতে রাসূল। যেহেতু তিনি বেলাদতের কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ‘উলিদতু’ শব্দটি ব্যবহার করে, সেহেতু “নবী দিবস” বা “সীরাতুন্নবী” (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে এ দিবসকে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করা তাঁর সুন্নাতের খেলাফ বা পরিপন্থী। এখানে উল্লেখ্য যে, আরবী শব্দ ‘উইলাদাত’ (জন্ম) থেকেই মীলাদ, মওলিদ, মওলুদ ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। মহানবী (দ:) ‘উলিদতু’ শব্দটি ব্যবহার করায় উৎপত্তি হওয়া উপরোক্ত শব্দগুলো সম্পূর্ণ বৈধ বলে সাব্যস্ত হয়। এগুলো বেদআত বা ধর্মের মধ্যে বর্জনীয় নতুন উদ্ভাবন নয়। আরও উল্লেখ্য যে, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরোধীরা প্রথমে এর উদযাপনকে ‘বর্জনীয় বেদআত’ বল্লেও উপরোল্লিখিত হাদীসখানি দেখানোর পর বলে যে শুধু সোমবার রোযা রেখে সুন্নাত অনুযায়ী হুযূর (দ:)-এর জন্মদিন পালন করা জায়েয! তাদের কথা পরস্পরবিরোধী। বস্তুতঃ হাদীসটিতে প্রতিভাত হয়, নেক আমল পালন করে জন্মদিন উদযাপন ছিল রাসূলে পাক (দ:)-এর উদ্দেশ্য, আর রোযা ছিল মাধ্যম। এর দ্বারা তিনি এই ধরায় তাঁকে রহমত হিসেবে প্রেরণের খোদায়ী ইচ্ছার প্রতি শোকরিয়া জ্ঞাপণ করেছিলেন। ওই একই উদ্দেশ্যে কেউ অন্যান্য নেক আমল পালন করলে তা হারাম ও বেদআত হবে কেন? প্রতি সোমবার কেউ রোযা ও অন্যান্য নেক আমল পালন করে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পারলে অতি উত্তম কাজ হবে। আমরা পাপী-তাপী বান্দা এটা পারি না বলেই বছরে অন্ততঃ একবার তাঁর বেলাদত দিবসে (১২ই রবিউল আউয়াল) বিভিন্ন নেক আমল পালন করে থাকি।
জশন্ শব্দের অর্থ খুশি (লোগাতে কিশওয়ারী)। জুলুস ‘জলসা’ শব্দের বহু বচন। জলসা অর্থ হলো বসা বা উপবেশন করা (গিয়াসুল লোগাত)। নামায হলো আল্লাহর যিকিরের জলসা যা একই স্থানে বসে সম্পন্ন করা হয়। হজ্ব হচ্ছে আল্লাহর যিকিরের জুলুস যা এক বৈঠকে সম্পন্ন করা যায় না, বরং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে সম্পন্ন করতে হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র বেলাদতের সময় কী ঘটেছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে মা আমেনা (রা:) বলেন- “রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতের সময় আমার ঘরে ফেরেশতাগণ মিছিল সহকারে অবতীর্ণ হন এবং তাঁরা উচ্চস্বরে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সালাত-সালাম পাঠ করছিলেন” (ইমাম সেহাবউদ্দীন আহমদ ইবনে হাজর হায়তামী শাফেয়ী আল মক্কী কৃত ”আন্ নে’মাতুল কুবরা আ’লাল আ’লম ফী মওলিদে সাইয়্যেদে ওয়ালাদে আদম”, ৬৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। উদ্ধৃতিটিতে পরিস্ফুট হয় যে, ফেরেশতাগণও জুলুস করেছিলেন।
ঈদ অর্থ খুশি এবং মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অর্থ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শুভাগমন উপলক্ষে মিছিল সহকারে খুশি প্রকাশ করা। এটা তাঁর প্রতি মুহাব্বত ও ভক্তি শ্রদ্ধার একটি সুন্দর বহিঃপ্রকাশ।
মহান আল্লাহ্তা’লা পবিত্র কুরআন মজিদে এরশাদ ফরমান-“আল্লাহর দিবসগুলো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন” (সুরা ইব্রাহীম, ৫ আয়াত)।
আমরা জানি যে, সমস্ত দিন-রাত্রির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ্ তা’লাই। তাহলে এখানে স্মরণ করার জন্যে কোন্ বিশেষ দিনসমূহের কথা বলা হয়েছে? অতএব, এ আয়াতটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাফছীরকারদের শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), হযরত উবাই ইবনে কায়াব (রা:), হযরত মোজাহিদ (রা:), হযরদ কাতাদা (রা:) প্রমুখ বুযূর্গানে দ্বীন অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে আয়াতোক্ত “আল্লাহর দিবসসমূহ” বলতে সেই সব দিবসকে বোঝায়, যে সব দিবসে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছে (তাফসীরে ইবনে জরির তাবারী, তাফসীরে খাযায়ীন ও তাফসীরে মাদারেক)। যেহেতু আল্লাহ তা’লা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন যে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন বিশ্ব-জগতের জন্যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা, সেহেতু তাঁর বেলাদত দিবস নিঃসন্দেহে আয়াতোক্ত একটি স্মরণীয় আল্লাহর দিবস। সুতরাং এ দিবসটি ঈদ হিসেবে উদযাপন করা আল্লাহ্ তা’লার বিধানের সাথে সঙ্গতি পূর্ণ।
মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান- “হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করুনঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণাপ্রাপ্তিতে মানব জাতির উচিৎ খুশি উদযাপন করা” (সুরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)। এ আয়াতে “ফাল্ ইয়াফরাহু” (খুশি উদযাপন করা উচিৎ) শব্দটি একটি আদেশ সূচক ক্রিয়া এবং এর অর্থ হলো মানব জাতির খুশি উদযাপন করা উচিৎ। এটা খোদায়ী আদেশ। আর “বি ফাদলিহী” ও “বি রাহমাতিহী” শব্দগুলোর অর্থ হলো আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা হলেন তাঁরই প্রিয় হাবীব (বন্ধু) হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পবিত্র বেলাদত বা ধরাধামে শুভাগমন দিবস। আল্লাহ্ তা’লা কুরআন মজীদে উপরোক্ত অনুগ্রহের ঘোষণা দিয়েছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহতা’লা মোমেন বান্দাদের প্রতি এক মহা অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কল্যাণের জন্যে একজন রাসূল (হুজূর পাক-দ:)-কে প্রেরণ করেছেন” (সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত)। সুরা আম্বিয়ার মধ্যে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর করুণার ঘোষণা দিয়েছেন- “হে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনাকের সমগ্র বিশ্ব-জগত তথা সৃষ্টিকুলের জন্যে আমার করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি” (১০৭ আয়াত)। তাই যে দিনটিতে রাব্বুল আলামীনের এ সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত আমাদের প্রতি বর্ষিত হলো, সেই ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিনটি উদযাপন করা এবং তাতে খুশি প্রকাশ করা আল্লাহ্ তা’লার বিধানের আলোকে সিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমন-“হে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনারই খাতিরে আপনার যিকির তথা স্মরণকে আমি উচ্চ মর্যাদা দিয়েছি” (সূরা এনশারাআ)। এ আয়াতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা’লা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁরই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির করতে দেখতে চান। এটা তাঁর ঐশী বিধান যে বান্দাগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির করবেন। তাই বান্দাগণের উচিৎ ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিনদিতে তাঁর স্মরণার্থে মীলাদ কেয়াম, জশনে জুলুছ ইত্যাদি যিকির পালন করে তাঁকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে তোলা।
মুসলমানগণ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফযল (অনুগ্রহ) ও রহমতপ্রাপ্তির ফলে তাঁর শান-মান প্রকাশার্থে ও তাঁর স্মরণে যে খুশিসূচক জুলুছ বা মিছিলের আয়োজন করেন তা অত্যন্ত বরকতময়। এ আমল সাহাবায়ে কেরাম হতে প্রাপ্ত। যথা-বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে, হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করেন, তখন মদীনাবাসী আনসার সাহাবীগণ তাঁকে ইসতেকবাল (অভ্যর্থনা) জানাতে মদীনার উপকণ্ঠে সানিয়াতুল বিদা নামক স্থানে জুলুস (মিছিল) করে গিয়েছিলেন। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত বরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত- হিজরতের সময় মদীনা নগরীর নারী পুরুষগণ ঘরের ছাদগুলোতে আরোহণ করেন। ছোট ছোট ছেলে ও গোলামগণ মদীনা শরীফের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েন এবং সকলেই স্লোগান দিতে থাকেন-“হে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” (মুসলিম শরীফ ২য় জিলদের হাদীসুল হিজরত অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। সাহাবায়ে কেরাম হিজরতের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তাঁদের মাঝে পাওয়ার খুশিতে জুলুছ করেছিলেন, আর আমরা তাঁকে আমাদের মাঝে আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হিসাবে পাওয়ার খুশিতে জুলুস করছি। যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে জুলুছ প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু এটা মন্দ হতে পারে না।
ঈদে মীলাদুন্নবী (দঃ) উদযাপন সম্পর্কে ইসলামের চার খলিফার বাণীও আমরা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করবো। এই খলিফাদের সম্পর্কে হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের প্রতি পালনীয় কর্তব্য করা হলো আমার খলিফাগণের সুন্নাত (রীতি-নীতি)” (বোখারী শরীফ)। অতএব, তাঁদের বাণী আমাদের জন্যে শরীয়তের দলিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ তথা যিকির পালনে একটি দিরহাম ব্যয় করেন, তিনি বেহেস্তে আমার বন্ধু হবেন” (ইমাম সেহাবউদ্দীন আহমদ ইবনে হাজর হায়তামী শাফেয়ী আল মক্কী কৃত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭ম পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
হযরত উমর ফারুক (রা:) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্মান করেন, নিশ্চয় তিনি দ্বীন ইসলামকে হায়াত দান করেন” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭ম পৃষ্ঠা)।
হযরত উসমান যিন্নুরাইন (রা:) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকিরে এক দিরহাম ব্যয় করেন, তিনি বদর ও হুনাইনের জেহাদে শরীক হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭/৮ পৃষ্ঠা)।
হযরত আলী (রা:) “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর জন্যে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির পৃথিবী হতে ঈমান সহকারে প্রাণ ত্যাগ ও বিনা জবাবদিহিতায় বেহেশতে প্রবেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৮ পৃষ্ঠা)।
আমরা আগেই বলেছি যে, ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তে পালিত ’যিকরে রাসুল’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তথা জশনে জুলুছ, মীলাদ-কেরাম ইত্যাদি দেখে এক শ্রেণীর বদ আকিদাসম্পন্ন মওলবীর গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। তারা অপযুক্তি খাড়া করছে এই মর্মে যে, ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিবসটি শুধুমাত্র নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতেরই নয়, এই দিনে তো তাঁর বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তি) শরীফও সংঘটিত হয়। তাহলে শোক পালন করা হচ্ছে না কেন? জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো ওই সকল ওহাবী-মওদুদী-’সালাফী’পন্থী মওলবীর কথানুযায়ী প্রচার করছে যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেসালের স্মৃতি বিজড়িত দিবস পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শব্দটির সাথে কী অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য! আমরা সকলের জাতার্থে জানতে চাই যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন হায়াতুন্নবী। অর্থাৎ, তাঁর যাহেরী (প্রকাশ্য) জিন্দেগী ও বেসাল শরীফের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি এরশাদ করেছেন-“আমার যাহেরী জিন্দেগী তোমাদের জন্যে উপকারী এবং আমার বেসালপ্রাপ্তিও তদনুরূপ” (হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বাযযায কৃত ফতোওয়া গ্রন্থ)। হাদীসটি অপযুক্তি পেশকারীদের বক্তব্যকে সমূলে উৎপাটিত করেছে এবং প্রতিভাত করেছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেসালপ্রাপ্তিতে শোক পালনের কোনো অবকাশই নেই।
নবীদ্রোহী ওহাবীরা বলে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানের সুন্নীরা তাঁর বেলাদত দিবসে জৌলুসপূর্ণ তোরণ নির্মাণ, গাড়ীর মিছিল, কাংগালী ভোজ ইত্যাদি করছে। তাদের মতে এতে নাকি খাতামুন নাবিয়্যিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রূহ মোবারক শোকে ক্রন্দন করছেন। কত বড় কাশফ-ওয়ালা মওলভী! হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হালত নাকি জেনে গিয়েছেন! মূর্খ আর কাকে বলে! তাদের জেনে রাখা আবশ্যক যে, কোনো ব্যক্তির নিজের জন্যে জৌলুসপূর্ণ ব্যয় ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও দ্বীনের জন্যে জৌলুসপূর্ণ ব্যয় হারাম নয়। ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঈমানী চেতনার উৎস তা চার খলিফার বাণী থেকেও প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় যারা এর উদযাপন থেকে মুসলিম সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তারা অবশ্যঅবশ্যই শয়তানের দোসর। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জরুরি।
--কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম।
প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক যে, ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখকে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিবর্তে “নবী দিবস” বলার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এর অর্থের সাথে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত তথা ধারাধামে শুভাগমনের কোনো সম্পর্কই নেই। তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপনের অনুমতি তিনি স্বয়ং দিয়েছেন। যথা- মুসলিম শরীফ নামক হাদীস গ্রন্থ থেকে মেশকাত শরীফের রোযা অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার দিন রোজা রাখতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর তিনি এরশাদ ফরমান, ”ওই দিন (সোমবার) আমি জন্ম গ্রহণ করেছি এবং ওই দিন আমার কাছে ওহী এসেছে (আল হাদীস)। হাদীসটিতে প্রতিভাত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বেলাদত দিবস উদযাপন করতেন। তাই এ দিনটি উদযাপন করা সুন্নাতে রাসূল। যেহেতু তিনি বেলাদতের কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ‘উলিদতু’ শব্দটি ব্যবহার করে, সেহেতু “নবী দিবস” বা “সীরাতুন্নবী” (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে এ দিবসকে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করা তাঁর সুন্নাতের খেলাফ বা পরিপন্থী। এখানে উল্লেখ্য যে, আরবী শব্দ ‘উইলাদাত’ (জন্ম) থেকেই মীলাদ, মওলিদ, মওলুদ ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। মহানবী (দ:) ‘উলিদতু’ শব্দটি ব্যবহার করায় উৎপত্তি হওয়া উপরোক্ত শব্দগুলো সম্পূর্ণ বৈধ বলে সাব্যস্ত হয়। এগুলো বেদআত বা ধর্মের মধ্যে বর্জনীয় নতুন উদ্ভাবন নয়। আরও উল্লেখ্য যে, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরোধীরা প্রথমে এর উদযাপনকে ‘বর্জনীয় বেদআত’ বল্লেও উপরোল্লিখিত হাদীসখানি দেখানোর পর বলে যে শুধু সোমবার রোযা রেখে সুন্নাত অনুযায়ী হুযূর (দ:)-এর জন্মদিন পালন করা জায়েয! তাদের কথা পরস্পরবিরোধী। বস্তুতঃ হাদীসটিতে প্রতিভাত হয়, নেক আমল পালন করে জন্মদিন উদযাপন ছিল রাসূলে পাক (দ:)-এর উদ্দেশ্য, আর রোযা ছিল মাধ্যম। এর দ্বারা তিনি এই ধরায় তাঁকে রহমত হিসেবে প্রেরণের খোদায়ী ইচ্ছার প্রতি শোকরিয়া জ্ঞাপণ করেছিলেন। ওই একই উদ্দেশ্যে কেউ অন্যান্য নেক আমল পালন করলে তা হারাম ও বেদআত হবে কেন? প্রতি সোমবার কেউ রোযা ও অন্যান্য নেক আমল পালন করে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পারলে অতি উত্তম কাজ হবে। আমরা পাপী-তাপী বান্দা এটা পারি না বলেই বছরে অন্ততঃ একবার তাঁর বেলাদত দিবসে (১২ই রবিউল আউয়াল) বিভিন্ন নেক আমল পালন করে থাকি।
জশন্ শব্দের অর্থ খুশি (লোগাতে কিশওয়ারী)। জুলুস ‘জলসা’ শব্দের বহু বচন। জলসা অর্থ হলো বসা বা উপবেশন করা (গিয়াসুল লোগাত)। নামায হলো আল্লাহর যিকিরের জলসা যা একই স্থানে বসে সম্পন্ন করা হয়। হজ্ব হচ্ছে আল্লাহর যিকিরের জুলুস যা এক বৈঠকে সম্পন্ন করা যায় না, বরং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে সম্পন্ন করতে হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র বেলাদতের সময় কী ঘটেছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে মা আমেনা (রা:) বলেন- “রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতের সময় আমার ঘরে ফেরেশতাগণ মিছিল সহকারে অবতীর্ণ হন এবং তাঁরা উচ্চস্বরে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সালাত-সালাম পাঠ করছিলেন” (ইমাম সেহাবউদ্দীন আহমদ ইবনে হাজর হায়তামী শাফেয়ী আল মক্কী কৃত ”আন্ নে’মাতুল কুবরা আ’লাল আ’লম ফী মওলিদে সাইয়্যেদে ওয়ালাদে আদম”, ৬৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। উদ্ধৃতিটিতে পরিস্ফুট হয় যে, ফেরেশতাগণও জুলুস করেছিলেন।
ঈদ অর্থ খুশি এবং মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অর্থ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শুভাগমন উপলক্ষে মিছিল সহকারে খুশি প্রকাশ করা। এটা তাঁর প্রতি মুহাব্বত ও ভক্তি শ্রদ্ধার একটি সুন্দর বহিঃপ্রকাশ।
মহান আল্লাহ্তা’লা পবিত্র কুরআন মজিদে এরশাদ ফরমান-“আল্লাহর দিবসগুলো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন” (সুরা ইব্রাহীম, ৫ আয়াত)।
আমরা জানি যে, সমস্ত দিন-রাত্রির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ্ তা’লাই। তাহলে এখানে স্মরণ করার জন্যে কোন্ বিশেষ দিনসমূহের কথা বলা হয়েছে? অতএব, এ আয়াতটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাফছীরকারদের শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), হযরত উবাই ইবনে কায়াব (রা:), হযরত মোজাহিদ (রা:), হযরদ কাতাদা (রা:) প্রমুখ বুযূর্গানে দ্বীন অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে আয়াতোক্ত “আল্লাহর দিবসসমূহ” বলতে সেই সব দিবসকে বোঝায়, যে সব দিবসে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছে (তাফসীরে ইবনে জরির তাবারী, তাফসীরে খাযায়ীন ও তাফসীরে মাদারেক)। যেহেতু আল্লাহ তা’লা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন যে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন বিশ্ব-জগতের জন্যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা, সেহেতু তাঁর বেলাদত দিবস নিঃসন্দেহে আয়াতোক্ত একটি স্মরণীয় আল্লাহর দিবস। সুতরাং এ দিবসটি ঈদ হিসেবে উদযাপন করা আল্লাহ্ তা’লার বিধানের সাথে সঙ্গতি পূর্ণ।
মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান- “হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করুনঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণাপ্রাপ্তিতে মানব জাতির উচিৎ খুশি উদযাপন করা” (সুরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)। এ আয়াতে “ফাল্ ইয়াফরাহু” (খুশি উদযাপন করা উচিৎ) শব্দটি একটি আদেশ সূচক ক্রিয়া এবং এর অর্থ হলো মানব জাতির খুশি উদযাপন করা উচিৎ। এটা খোদায়ী আদেশ। আর “বি ফাদলিহী” ও “বি রাহমাতিহী” শব্দগুলোর অর্থ হলো আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা হলেন তাঁরই প্রিয় হাবীব (বন্ধু) হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পবিত্র বেলাদত বা ধরাধামে শুভাগমন দিবস। আল্লাহ্ তা’লা কুরআন মজীদে উপরোক্ত অনুগ্রহের ঘোষণা দিয়েছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহতা’লা মোমেন বান্দাদের প্রতি এক মহা অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কল্যাণের জন্যে একজন রাসূল (হুজূর পাক-দ:)-কে প্রেরণ করেছেন” (সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত)। সুরা আম্বিয়ার মধ্যে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর করুণার ঘোষণা দিয়েছেন- “হে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনাকের সমগ্র বিশ্ব-জগত তথা সৃষ্টিকুলের জন্যে আমার করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি” (১০৭ আয়াত)। তাই যে দিনটিতে রাব্বুল আলামীনের এ সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত আমাদের প্রতি বর্ষিত হলো, সেই ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিনটি উদযাপন করা এবং তাতে খুশি প্রকাশ করা আল্লাহ্ তা’লার বিধানের আলোকে সিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমন-“হে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনারই খাতিরে আপনার যিকির তথা স্মরণকে আমি উচ্চ মর্যাদা দিয়েছি” (সূরা এনশারাআ)। এ আয়াতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা’লা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁরই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির করতে দেখতে চান। এটা তাঁর ঐশী বিধান যে বান্দাগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির করবেন। তাই বান্দাগণের উচিৎ ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিনদিতে তাঁর স্মরণার্থে মীলাদ কেয়াম, জশনে জুলুছ ইত্যাদি যিকির পালন করে তাঁকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে তোলা।
মুসলমানগণ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফযল (অনুগ্রহ) ও রহমতপ্রাপ্তির ফলে তাঁর শান-মান প্রকাশার্থে ও তাঁর স্মরণে যে খুশিসূচক জুলুছ বা মিছিলের আয়োজন করেন তা অত্যন্ত বরকতময়। এ আমল সাহাবায়ে কেরাম হতে প্রাপ্ত। যথা-বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে, হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করেন, তখন মদীনাবাসী আনসার সাহাবীগণ তাঁকে ইসতেকবাল (অভ্যর্থনা) জানাতে মদীনার উপকণ্ঠে সানিয়াতুল বিদা নামক স্থানে জুলুস (মিছিল) করে গিয়েছিলেন। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত বরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত- হিজরতের সময় মদীনা নগরীর নারী পুরুষগণ ঘরের ছাদগুলোতে আরোহণ করেন। ছোট ছোট ছেলে ও গোলামগণ মদীনা শরীফের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েন এবং সকলেই স্লোগান দিতে থাকেন-“হে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” (মুসলিম শরীফ ২য় জিলদের হাদীসুল হিজরত অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। সাহাবায়ে কেরাম হিজরতের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তাঁদের মাঝে পাওয়ার খুশিতে জুলুছ করেছিলেন, আর আমরা তাঁকে আমাদের মাঝে আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হিসাবে পাওয়ার খুশিতে জুলুস করছি। যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে জুলুছ প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু এটা মন্দ হতে পারে না।
ঈদে মীলাদুন্নবী (দঃ) উদযাপন সম্পর্কে ইসলামের চার খলিফার বাণীও আমরা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করবো। এই খলিফাদের সম্পর্কে হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের প্রতি পালনীয় কর্তব্য করা হলো আমার খলিফাগণের সুন্নাত (রীতি-নীতি)” (বোখারী শরীফ)। অতএব, তাঁদের বাণী আমাদের জন্যে শরীয়তের দলিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ তথা যিকির পালনে একটি দিরহাম ব্যয় করেন, তিনি বেহেস্তে আমার বন্ধু হবেন” (ইমাম সেহাবউদ্দীন আহমদ ইবনে হাজর হায়তামী শাফেয়ী আল মক্কী কৃত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭ম পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
হযরত উমর ফারুক (রা:) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্মান করেন, নিশ্চয় তিনি দ্বীন ইসলামকে হায়াত দান করেন” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭ম পৃষ্ঠা)।
হযরত উসমান যিন্নুরাইন (রা:) বলেন- “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকিরে এক দিরহাম ব্যয় করেন, তিনি বদর ও হুনাইনের জেহাদে শরীক হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৭/৮ পৃষ্ঠা)।
হযরত আলী (রা:) “যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর জন্যে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিকির পৃথিবী হতে ঈমান সহকারে প্রাণ ত্যাগ ও বিনা জবাবদিহিতায় বেহেশতে প্রবেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়” (প্রাগুক্ত আন্ নে’মাতুল কুবরা, ৮ পৃষ্ঠা)।
আমরা আগেই বলেছি যে, ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তে পালিত ’যিকরে রাসুল’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তথা জশনে জুলুছ, মীলাদ-কেরাম ইত্যাদি দেখে এক শ্রেণীর বদ আকিদাসম্পন্ন মওলবীর গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। তারা অপযুক্তি খাড়া করছে এই মর্মে যে, ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিবসটি শুধুমাত্র নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতেরই নয়, এই দিনে তো তাঁর বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তি) শরীফও সংঘটিত হয়। তাহলে শোক পালন করা হচ্ছে না কেন? জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো ওই সকল ওহাবী-মওদুদী-’সালাফী’পন্থী মওলবীর কথানুযায়ী প্রচার করছে যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেসালের স্মৃতি বিজড়িত দিবস পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শব্দটির সাথে কী অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য! আমরা সকলের জাতার্থে জানতে চাই যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন হায়াতুন্নবী। অর্থাৎ, তাঁর যাহেরী (প্রকাশ্য) জিন্দেগী ও বেসাল শরীফের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি এরশাদ করেছেন-“আমার যাহেরী জিন্দেগী তোমাদের জন্যে উপকারী এবং আমার বেসালপ্রাপ্তিও তদনুরূপ” (হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বাযযায কৃত ফতোওয়া গ্রন্থ)। হাদীসটি অপযুক্তি পেশকারীদের বক্তব্যকে সমূলে উৎপাটিত করেছে এবং প্রতিভাত করেছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেসালপ্রাপ্তিতে শোক পালনের কোনো অবকাশই নেই।
নবীদ্রোহী ওহাবীরা বলে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানের সুন্নীরা তাঁর বেলাদত দিবসে জৌলুসপূর্ণ তোরণ নির্মাণ, গাড়ীর মিছিল, কাংগালী ভোজ ইত্যাদি করছে। তাদের মতে এতে নাকি খাতামুন নাবিয়্যিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রূহ মোবারক শোকে ক্রন্দন করছেন। কত বড় কাশফ-ওয়ালা মওলভী! হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হালত নাকি জেনে গিয়েছেন! মূর্খ আর কাকে বলে! তাদের জেনে রাখা আবশ্যক যে, কোনো ব্যক্তির নিজের জন্যে জৌলুসপূর্ণ ব্যয় ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও দ্বীনের জন্যে জৌলুসপূর্ণ ব্যয় হারাম নয়। ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঈমানী চেতনার উৎস তা চার খলিফার বাণী থেকেও প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় যারা এর উদযাপন থেকে মুসলিম সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তারা অবশ্যঅবশ্যই শয়তানের দোসর। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জরুরি।