কুতুবে যমান হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:)
------------------------------------------------------------------------------- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
ঐতিহাসিক পটভূমি
এই বিশ্বজগত, গ্রহ-নক্ষত্ররাজি, সৌরমন্ডল-নভোমন্ডল এবং সমস্ত জীব ও জড় পদার্থ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বিনা কারণে সৃষ্টি করেন নি। একটি মহাপরিকল্পনা তথা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ তাঁর রহস্য তথা ভেদ এতে নিহিত রয়েছে। ওই মহাপরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানব জাতির সৃষ্টি। একজন নিপুণ চিত্রকর যেমন তাঁর চিত্রকর্মে কোনো প্রতিপাদ্য বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে ক্যানভাসে আনুষাঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক উপাদানগুলো সংযোজন করে একটি আবহ বা পরিবেশ সৃষ্টি করেন, ঠিক তেমনি মহান সৃষ্টিকর্তাও সমগ্র সৃষ্টি জগতকে মানব সৃষ্টির অনুষঙ্গ করেছেন।
মানব জাতি সৃষ্টির প্রাক্ লগ্নে আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাকুলকে বলেন, “আমি ধরণীর বুকে আমার খলীফা তথা (মনুষ্য) প্রতিনিধি প্রেরণ করতে চাই।” এতে ফেরেশতাকুল উত্তর দিলেন, “হে পরওয়ারদেগার! আমরাই আপনার এবাদত-বন্দেগী করছি। এরা (মনুষ্যজাতি) তো পৃথিবীতে ফিতনা ফ্যাসাদে লিপ্ত হবে”। অতঃপর আল্লাহ্তা’লা বল্লেন, “আমি যা জানি তা তোমরা জানো না” (সূরা বাকারায় বর্ণিত আয়াতের সার সংক্ষেপ)। এই যে খোদাতা’লা বল্লেন তিনি যা জানেন তা ফেরেশতাবৃন্দ জানেন না, এটাই মানব সৃষ্টির রহস্য। মানবকে তিনি শুধুমাত্র এবাদত-বন্দেগীর জন্যে সৃষ্টি করেন নি যার জন্যে ফেরেশতাকুলই যথেষ্ট ছিলেন; বরং তাঁর এই ভাষ্যমতে মানব সৃষ্টি তাঁরই মহা রহস্য হিসেবে প্রমাণিত হয় যা ফেলেশতাকুলও জানেন না।
এই গূঢ় রহস্য সম্পর্কে আমরা কিঞ্চিত ধারণা পাই একটি হাদীসে কুদসীতে যেখানে আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান, “আমি রহস্যের গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম; অতঃপর প্রকাশ হতে চাইলাম।” এই প্রকাশ হওয়ার মাধ্যম সম্পর্কে তিনি অপর এক হাদীসে কুদসীতে এরশাদ ফরমান- “হে রাসূল (দ:)! আপনাকে যদি আমি সৃষ্টি না করতাম, তাহলে আকাশ মন্ডল (অর্থাৎ, বিশ্বজগত) সৃষ্টি করতাম না।” আরেক কথায়, আল্লাহ্ তা’লা নবী করীম (দ:)-এর মাধ্যমেই প্রকাশ হতে চেয়েছিলেন। নবী আদম (আ:)-কে খলীফা হিসেবে ধরণীর বুকে প্রেরণের মাধ্যমে তিনি যে বিভিন্ন নবী-রসূল প্রেরণের ক্রমধারা আরম্ভ করেছিলেন, তা শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধরাধামে শুভাগমন দ্বারা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। আমাদের আখেরী নবী (দ:)-এর বেসাল তথা খোদার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির পরে আর কোনো নবী-রসূল পৃথিবীতে আসবেন না। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার ওই খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্ব জারি রয়েছে, জারি থাকবে কেয়মত পর্যন্ত। কেননা, মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন, “(হক্কানী) উলামাবৃন্দ পয়গাম্বরগণের ওয়ারিশ” (বুখারী)। আমরা জানি, মহানবী (দ:) কোনো পার্থিব উত্তরাধিকারের কথা এখানে উল্লেখ করেন নি। ওয়ারিশীর বিষয়টি হলো ইসলামী এলম (জ্ঞান) যা ‘উলামা’ শব্দটি ব্যবহারের দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি অন্যত্র এরশাদ করেছেন, “ইসলামী এলম দুই প্রকার। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য।” আরও এরশাদ করেছেন, “অপ্রকাশ্য জ্ঞান (এলমে মারেফত) আ’রেফ (খোদা সম্পর্কে জ্ঞানী)-দের কলবে তথা অন্তরে বিরাজমান।” অর্থাৎ নবী করীম (দ:)-এর ওয়ারিশ তথা উত্তরাধিকারী, যাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানের অধিকারী বুযূর্গ আলেম-উলামা, পীর-আউলিয়া ও তাসাউফের ইমামগণই আয়াতোক্ত খেলাফত জারি রাখবেন। এই খলীফা তথা নায়েবে নবী, অর্থাৎ, মহানবী (দ:)-এর প্রতিনিধিবৃন্দ বান্দাদেরকে আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন, আল্লাহ্ প্রেমে সিক্ত করবেন, যেমনটি রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন একটি হাদীসে কুদসীতে - “আমার (প্রিয়) বান্দা নফল এবাদত (মওলানা সানাউল্লাহ্ পানি-পথীর মতে এইটি তরীকতের রেয়াযত বা সাধনা) দ্বারা আমার এতো নিকটবর্তী হন যে আমি তাঁকে ভালোবাসি; এতো ভালোবাসি যে আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজকর্ম করেন এবং তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন” (আল বোখারী)। এই মহব্বতের উদ্দেশ্যেই খোদা তা’লা মানব সৃষ্টি করেছেন এবং ফেরেশতাকুলকে বলেছেন তাঁরা ওই বিষয়ে জানেন না যা তিনি জানেন (সুরা বাকারা)। আল্লাহর এই সকল প্রিয় বান্দা তথা নবী-ওলিগণ আল্লাহ্ তা’লার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন।
রাসূলে খোদা (দ:)-এর বেসালের পরে তাঁরই বিশিষ্ট সাহাবীবৃন্দ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:), হযরত উমর ফারুক (রা:), হযরত উসমান যিন্নুরাইন (রা) এবং হযরত আলী মুরতজা (ক:) যথাযথভাবে খলীফার দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় অন্যান্য সাহাবী এবং সর্বসাধারণ তাঁদের খেলাফতের প্রতি বায়াত গ্রহণ করেন। শাহ্ ওলিউল্লাহ্ প্রণীত ’ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল্ খুলাফা’ পুস্তকে লেখা হয়েছে যে এই খলীফাবৃন্দের মূলতঃ তিনটি দায়িত্ব ছিল: (১) মহানবী আনীত শরীয়তের প্রকাশ্য বিধানগুলো জারি করা তথা শিক্ষা-দীক্ষা দেয়া; (২) অপ্রকাশ্য ইসলামী জ্ঞান তথা এলমে মারেফত বিশিষ্ট ও যোগ্য উম্মতদের মধ্যে বিতরণ করা এবং (৩) রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু ৬১ হিযরীতে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা ও ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ইমাম যাইনুল আবেদীন (রহ:) আধ্যাত্মিক রাজ্যের খেলাফতকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিন থেকে আজ পর্যন্ত কেনো সূফী-দরবেশ আর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেকে নিয়োজিত করেন নি। এ বিষয়টি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সূফী-দরবেশদের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আহলা দরবার শরীফে আউলিয়ার আগমন
নবী করিম (দ:)-এর বেসাল তথা খোদা তা’লার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির পর আর কোনো নবী আসবেন না। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বুযূর্গ সাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী যুগের আওলিয়া কেরাম সচেষ্ট ছিলেন। সুদূর আরব থেকে আউলিয়া কেরাম এদেশে এই উদ্দেশ্যে জলপথে আসা আরম্ভ করেন আনুমানিক ৮০০ খৃষ্টাব্দে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে এতদঞ্চলের প্রবেশ-দ্বার। এই চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রতট ইত্যাদি নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ আউলিয়া কেরাম ও সূফী সাধকদের আধ্যাত্ম সাধনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁরা চট্টগ্রামের বর্তমান শহর এলাকা ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গড়ে তুলেন এবং মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণী প্রচার করেন। ১৬০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমনি একটি আস্তানা বর্তমান বোয়ালখালী থানার আহলা মৌজায় গড়ে তুলেন সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে আগত সূফীকূল শিরোমণি হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)। তিনি তৎকালীন বাংলার গৌররাজ্য হয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে এখানে তশরীফ আনেন। তাঁর সাধনা, ইসলামের শিক্ষা ও তাসাওফের দীক্ষা দানের ফলে এতদঞ্চলের মানুষ সত্যপথ প্রাপ্ত ও খোদাতা’লার নৈকট্য লাভ করেন। ইসলামের মৌলিক নিয়ম-কানুন সুষ্ঠুভাবে শিক্ষাদান ও আমল করার জন্যে প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট স্থান। এই উদ্দেশ্যে হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান আহলা দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মানুষের সুবিধার্ধে তাঁর আমলেই এই মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি বিশাল দীঘি খনন করা হয়। ইসলামের শান্তিবাণী প্রচার ও বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজের ফলে এবং তাঁর আধ্যাত্মিক কামালিয়াতের (পূর্ণতার) কারণে এতদঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠিভুক্ত মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
কথিত আছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে আগমনের পূর্বে হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:) একবার পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন শেষে মদীনা মুনাওয়ারায় হুজুর পূর নূর (দ:)-এর রওযা শরীফ যিয়ারতে যান। যিয়ারতকালে রওযা মোবারক হতে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো ইসলাম প্রচারের জন্যে তিনি যেন দক্ষিণ এশিয়ার চট্টগ্রাম অঞ্চলে গমন করেন। এই নির্দেশ পাওয়ায় হুজুর পাক (দ:)-এর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় রওযা শরীফের পবিত্র গিলাফ মোবারক স্পর্শ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি আরজি পেশ করেন, অজানা এই গন্তব্যের স্থানে ইসলামের প্রচার-প্রসার যেন তাঁর আওলাদে পাকগণের মাধ্যমে চিরস্থায়ী হয়। তাঁর এই ফরিয়াদ রাসূলে করিম (দ:)-এর দরবারে কবুল হয়। বস্তুত যুগে যুগে তাঁর বংশপরস্পরায় আওলিয়া কেরামের বেলাদত (জন্ম) হয়েছে। এই মহান সাধক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বেসালপ্রাপ্ত হন। তাঁর বেসালের পরে তাঁর বংশধরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওলাদগণ হলেন হযরত শেখ দানু মিয়া, হযরত শেখ মুনির আহমেদ মিয়া, হযরত শেখ আনিস মিয়া, হযরত মাওলানা সফর আলী, কুতুবে জমান হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী কাজী আসাদ আলী (রহ:), সুলতানুল মুনাযেরীন, হযরত মওলানা শাহ্ সুফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী ওয়াল চিশতি (রহ:) এবং আমার পীর ও মুরশীদ হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী দৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দিন খালেদ আল্ কাদেরী ওয়াল্ চিশতী (মাঃ জিঃ আঃ)।
সুলতানুল আরেফিন হযরত সুলতান আহমদ আল্ বাগদাদী (রহ:)
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষলগ্নে হযরত গাউসে পাক বড় পীর সাহেব কেবলার আওলাদে পাক শামছুল আরেফিন হযরত সুলতান আহমদ আল বাগদাদী (রহ:) সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে নানা দেশ ভ্রমণেশেষে এ অঞ্চলে আগমন করেন। এই সুফী সাধক আধ্যাত্মিক সাধনার পবিত্র স্থান হিসেবে হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)-এর মাযার শরীফ এলাকাকে সুনির্দিষ্ট করেন। তাঁর রিয়াযত তথা আধ্যাত্ম সাধনা এত উচ্চমার্গের ছিল যে তিনি মোরাকাবা, মোশাহাদায় ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করতেন। জনশ্রুতি আছে যে, আনুমানিক ১৬৮০ সালে মঘ জরিপকর্মীরা এই এলাকায় এসে “আল্লাহু”, “আল্লাহু” জিকিররত অবস্থায় সুফী হযরত সৈয়দ সুলতান আহমদ বাগদাদী (রহ:)-এর দর্শন লাভ করেন এবং তাঁর দেহ মোবারকের চারপাশে অসংখ্য উইপোকার সৃষ্ট ঢিবি দেখতে পান। এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে জরিপকর্মীরা হযরত বাগদাদীর “আল্লাহু” জিকির ধ্বনি অনুসারে এই অঞ্চলের নাম “আহলা” রাখেন। হযরত বাগদাদী (রহ:)-এর শুভাগমনে আহলা দরবার শরীফ আধ্যাত্ম্য সাধনার স্থান হিসেবে আরও সমৃদ্ধ হয়। এলাকার জনগণ ইসলাম ধর্মের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামের সুমহান আর্দশ প্রতিষ্ঠায় ব্রতি হন। তাঁর সাধনা, ঈমান, আকীদা, আমল ইত্যাদির ফলে আহলা দরবার শরীফ ইসলাম ধর্ম প্রচার ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭০০ খৃষ্টাব্দের সূচনালগ্নে এই মহান সাধক হযরত সুলতান আহমদ আল্ বাগদাদী (রহ:) বেসালপ্রাপ্ত হন।
কুতুবে জমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর জীবনী ও কারামত
আহলা দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ, আধ্যাত্ম জগতের সম্রাট, হযরত মওলানা শাহ্ সুফী কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)-এর দোয়ার বাস্তব রূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মৌলভী সফর আলী চৌধুরী সাহেবের ঔরসে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। সৈয়দ সফর আলী সাহেব ছিলেন পটিয়ার বড় উঠান অন্ঞ্চলের জমিদার। আহলা মৌজা ছিল তাঁর জমিদারীর আওতাভুক্ত একটি পরগনা। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত জমিদার পরিবারের অভিজাত পরিবেশে হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) বেড়ে ওঠেন।
শিক্ষা
পূর্বপুরুষদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে লালিত হওয়ার কারণে শৈশবেই তাঁর মনে গভীর খোদাপ্রেম, সৃষ্টি জিজ্ঞাসা ও ধর্মানুরাগের উন্মেষ ঘটে। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি হিন্দুস্তান গমন করেন। কোলকাতা থেকে আরবী টাইটেল অর্জন শেষে দেশে ফিরে এলে শিক্ষানুরাগী প্রায় চার’শ মানুষের একটি দল চট্টগ্রামে তৎকালীন নৌবন্দর ফিরিঙ্গি বাজারে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপণ করেন। সে সময় ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন তাঁর ছোটবেলার শিক্ষক বাবু হরিচন্দ্র বসাক। তিনি কৌতুহলবশত সম্বর্ধনা দেখতে গেলে জনাব কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সম্মান করতেই পুরোনো ছাত্রকে চিনে বাবু হরিচন্দ্র বসাক তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন। শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এই ঘটনা প্রমাণ করে হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলার (রহ:) কাছে শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষাকে তিনি খুবই মূল্যায়ন করতেন।
কর্মজীবন
উচ্চ শিক্ষা শেষে ফিরে এসে হযরত কাজী সাহেব কেবলা (রহ:) আহলা মৌজায় স্বগৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন। বাড়িতে কোরআন, হাদীস ও ফেকাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রচুর পড়াশুনা করেন এবং নিষ্ঠার সাথে পরহেযগারী ও তাক্ওয়া অর্জনে ব্রতী হন। এ সময়ে নিজ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মানুষের আগ্রহের কারণে বিভিন্ন মাহফিলে তিনি ওয়ায করতেন। এ ছাড়া এলাকাবাসীর বিভিন্ন ধর্ম-জিজ্ঞাসার সমাধান, তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার সুরাহা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে সত্য পথের দিক-নির্দেশনা দান, এলাকাবাসীর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসা ইত্যাদি নানান সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধানের ফলে তাঁর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই সকল জনহিতকর কাজের সুখ্যাতির পরিপ্রেক্ষিতে অল্পকাল পরেই বৃটিশ প্রশাসন হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:)-কে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার তৎকালীন কাউখালিতে অবস্থিত বিচারালয়ে কাজী তথা বিচারকের পদ গ্রহণের প্রস্তাব প্রদান করে। সর্বসাধারণের মামলা-মোকদ্দমায় সুবিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তিনি সানন্দে এই সম্মানজনক পদ গ্রহন করেন। সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সহকারে তিনি কাজী পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং সুনাম অর্জন করেন। কর্মস্থল কাউখালি কোর্ট হতে নিজ বাড়ি আহলা মৌজায় সপ্তাহান্তে যাতায়াতের বিড়ম্বনা এবং কর্মস্থলে বসবাসের বিভিন্ন অসুবিধা সত্ত্বেও সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করে যান।
বায়াত গ্রহণ ও আধ্যাত্মিক জীবন
জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) যুগপৎ বিচারক হিসেবে কর্মজীবন এবং জমিদার হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন যাপনের চাইতেও প্রধান আত্মজিজ্ঞাসা খোদাপ্রেমের পথ অন্বেষণে তিনি পথপ্রদর্শক একজন কামেল পীরের সন্ধানে ব্যাপৃত হন।
পরম করুণাময় আল্লাহ তা’লা একটি হাদীসে কুদসীতে ঘোষণা করেছেন, কেউ তাঁর দিকে এক বিঘত অগ্রসর হলে তিনি তাঁর দিকে এক কদম অগ্রসর হন। তাই হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:)-এর আরযি অচিরেই পূর্ণ হলো। তিনি উপমহাদেশখ্যাত মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গোড়াপত্তনকারী গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ আহমদউল্লাহ শাহ্ সাহেব কেবলা (রহ:)-এঁর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণ করে ধন্য হন।
আধ্যাত্ম সাধনা ও রিয়াযতের সুকঠিন সোপানসমূহ পার হয়ে সিদ্ধিলাভের পর তিনি হযরত আহমদউল্লাহ শাহ্ সাহেব কেবলার (রহ:) অন্যতম খলীফা হিসেবে পরিণত হন এবং নিজ পীর সাহেব কর্তৃক ‘জনাব’ উপাধিতে বিভূষিত হন। তাঁর অপর লকব (উপাধি) ছিল ’কুতুবে যমান’, অর্থাৎ, যুগের কুতুব।
খেলাফতপ্রাপ্তির পর জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) আহলা দরবার শরীফে কায়েম মকাম তথা অধিষ্টিত হন; তিনি সূফীতত্ত্বের চর্চা, ইসলাম ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এযং ধর্মপ্রাণ সর্বসাধারণকে হেদায়াত ও দীক্ষা দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলামের হুকুম-আহকাম পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন। পান্ঞ্জেগানা নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াত, মীলাদ ও সেমা মাহফিল, ঈদের জামাতে ইমামতি করা ছাড়াও তাঁর জীবনযাপন ছিল সম্পূর্ণভাবে শরীয়তের বিধানানুগ।
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) পেশাগত জীবনে কাউখালিতে অবস্থানকালে কোর্টে আসা যাওয়ার সময়ে কোর্টের কাছে বাচা ফকির নামে এক আশেক তাঁর এই বিচারকের নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বুযুর্গীর চেহারা মোবারক দেখতে পেয়ে সর্বদা তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ করতেন। আশেক যেমন মাশুককে চিনতে পারেন, তেমনি মাশুকও তাঁর আশেকের হাল বুঝতে পারেন। আর তাই বাচা ফকিরের নিরন্তর শ্রদ্ধাবনত চিত্তকে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। পীরে কামেল ওয়াল মোকাম্মেল (যিনি নিজে পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং অন্যকেও পূর্ণতা দিতে সক্ষম এমন বুযুর্গ) জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দয়াপরবশ হয়ে এই বাচা ফকিরকে ফয়েয ও তাওয়াজ্জুহ দান করলেন। পরবর্তীকালে আধ্যাত্ম-সাধনার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বাচা ফকির ’মজযুব’ (সংসার-বিরাগী দরবেশ) হিসেবে কাউখালি কোর্টের সন্নিকটে তাঁর আস্তানায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বেসালের পরে একই স্থানে সমাধিস্থ হন। তাঁর মাযারে প্রতি বাংলা সালের ২রা ফাল্গুন ওরস্ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সর্বসাধারণকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে খেলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনকালে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সবিশেষ ব্যস্ত থাকায় পার্থিব পেশাগত জীবনে বিচারকের দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটে। আর তাই নিয়মিত এজলাশে উপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে তাঁর অপারগতায় কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কেউ কেউ বৃটিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গোপনে এ বিষয়টি অবহিত করেন। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে কর্তৃপক্ষ কাউখালিতে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। নিরীক্ষণকালে ওই প্রতিনিধি দেখতে পান যে সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্রে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এঁর প্রতিদিনকার উপস্থিতির সই ও প্রমাণ বিদ্যমান। এই কারামত দেখে কোর্টের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং সংশ্লিষ্ট সবাই বিস্মিত হয়ে যান এবং উপলব্ধি করেন যে বিচারকের ভূমিকায় আসীন এই সিদ্ধপুরুষ আসলেই একজন ওলিয়ে কামেল ওয়াল মোকাম্মেল। এই ঘটনা উম্মোচিত হওয়ার পরপরই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বিচারকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
নিয়মিত মোরাকাবা, মোশাহেদার মাধ্যমে ধ্যানমগ্ন হওয়া ছাড়াও প্রায়ই জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে আহলা দরবার শরীফের অদূরে করলডাঙ্গা পাহাড় ও জঙ্গলে গভীর আধ্যাত্ম-সাধনায় ধ্যানস্থ হতে দেখা যেতো। রেয়াযতের এক পর্যায়ে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের নয়নমণি গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী সাহেব কেবলা (রহ:) ও জনাব কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) একযোগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দেয়াঙ্গ পাহাড়ে দীর্ঘদিন আধ্যাত্ম সাধনায় নিয়োজিত থাকেন।
কারামত
কারামতের অর্থ: আগেই বলেছি, যুগে যুগে আল্লাহ্ তালা তাঁর পরিচয় প্রদানের জন্যে আম্বিয়া ও রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন তাঁরই বান্দাদের হেদায়াত তথা সঠিক পথপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে। এই সকল খাস্ বান্দাকে তিনি মো’জেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। নবীগণের বেলায় এ মোজেযা খাস্ বা নির্দিষ্ট ছিল। যেমন - হযরত ঈঁসা (আ:) মৃতকে জিন্দা তথা জীবিত করেছিলেন; হযরত ইব্রাহীম (আ:) জ্বলন্ত আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন; হযরত ওযাইর (আ:) জন্মান্ধকে তাঁর চোখে হাত বুলিয়ে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ জমানার নবী হযরত আহমদে মোজতবা মোহাম্মদে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদকে দু’টুকরো করেছিলেন। একবার আবু জেহেল নিজ হাতের মুঠির ভেতর পাথর নিয়ে রাসূলে খোদা (দ:)-কে জিজ্ঞেস করেছিল মুঠির মধ্যে কী আছে। হুজুর পূর নূর (দ:)-এর মোজেযায় পাথর তাঁকে চিনতে পেরে কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্” বাক্যটি পাঠ করেছিল। রাসূলে পাক (দ:)-এর বেসালপ্রাপ্তির পরে নবুয়ত শেষ হয়েছে। অর্থাৎ, নবী করীম (দ:)-এর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। কিন্তু দ্বীন ইসলাম জারি রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্তা’লা কেয়ামত পর্যন্ত নবীগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে ওলি-আওলিয়াগণকে প্রেরণ করতে থাকবেন। তাঁরা যেহেতু নবীগণের প্রতিনিধি, সেহেতু তাঁদের দ্বারাও অলৌকিক ঘটনাবলী ঘটতে থাকবে। আকায়েদের কেতাবে বর্ণিত আছে: ’কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন্’ অর্থাৎ, আউলিয়া বুযূর্গবৃন্দের কারামত তথা আলৌকিক ঘটনাবলী সত্য। যেমন- হযরত বড় পীর মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) মুর্দাকে জিন্দা করেন। হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনউদ্দিন আজমেরী সাঞ্জেরী (রহ:) আনা সগরের সমস্ত পানি একটি পাত্রে তুলে নিয়ে রেখেছিলেন। হযরত শাহ্ আহমদ উল্লাহ্ আল্ হাসানী সাহেব কেবলা (রহ:) বহু দূরে গহীন অরণ্যে অবস্থিত বাঘকে বদনা দ্বারা আঘাত করে নিজ কাঠুরে মুরীদকে বাঘের কবল থেকে রক্ষা করেন। এ কারণেই শরীয়তসিদ্ধ বিশ্বাস হলো, আম্বিয়া ও আউলিয়াগণ আল্লাহ্ পাকের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্তা’লা এরশাদ ফরমান - “আমার প্রিয় বান্দা নফল এবাদত (মাওলানা সানাউল্লাহ্ পানিপথীর মতে এর অর্থ তরীকতের সাধনা) পালন দ্বারা আমার এমন নিকটবর্তী তথা সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হন যে আমি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসি; এমন ভালোবাসি যে আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজ করেন এবং তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন” (বুখারী)।
অনেকে বলে, কারামত আসলে যাদুকরী বিদ্যা যা কোনো যাদুকরও প্রদর্শন করতে সক্ষম। বস্তুত যাদুকরের যাদুকরী বিদ্যা প্রদর্শনীর স্থানেই সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন, একটি ডিম থেকে পাখির বাচ্চা বের করা অথবা বাঁশিকে আকাশে উড়ানো কিংবা ঘড়ির কাঁটা দেখায় দৃষ্টিভ্রম ঘটানো। এ সব কাজের প্রভাব সাময়িক। কিন্তু আল্লাহর আউলিয়াগণ যে কোনো স্থানে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো বিষয়ে আলৌকিক ও অসম্ভব কর্ম সংঘটন করতে সক্ষম, আর তাঁদের কারামতের প্রভাবও চিরস্থায়ী। কেননা তাঁদের এ ক্ষমতা খোদাপ্রদত্ত।
হযরত কাজী সাহেব কেবলার কারামত
বাঘের পিঠে আরোহণ
হযরত কাজী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর যৌবনকালে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গাউসুল আযম হযরত শাহ্ আহমদ উল্লাহ্ আল্ হাসানী সাহেব কেবলার (রহ:) কাছ থেকে ফয়েয তথা আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি পাওয়ার পরে বিভিন্ন পাহাড়ে ও জঙ্গলে গিয়ে গভীর ধ্যান-সাধনা ও রেয়াযত আরম্ভ করেন। এ কারণে বহু রাতে তিনি বাসার বাইরে থাকতেন। সমাজে মানুষের মধ্যে নিন্দুকের তো অভাব নেই। তাই প্রজাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর জমিদার পিতা জনাব সফর আলী চৌধুরীর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে হযরত কাজী সাহেব কেবলা উচ্ছন্নে গেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। তাঁকে শাসন করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব ওই সময় তাঁর অপর পরিবারকে সাথে নিয়ে পশ্চিম পটিয়ার দেয়াং নামক স্থানে বসবাস করতেন। কিছু প্রজার এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর শেখ চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে চলে আসেন যেখানে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা বসবাস করতেন। সন্ধ্যার পর তিনি হাতে একটি ছোরা নিয়ে বাড়ির দরজায় জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জন্যে অপেক্ষা করতে থাকনে এবং রাগতঃ স্বরে বার বার বলতে থাকেন, “আজিয়া বাড়ি ফিরুক, ফিরি আইলেই তারে আঁই টু’রা টু’রা গরি কাডি ফালাইয়ুম”, অর্থাৎ, আজ বাড়ি ফিরুক, ফিরে আসলেই তাকে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। এদিকে হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার মাতা সাহেবানী শাহজাদার সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় এবং পিতা-পুত্রের মধ্যে যে কোনো অপ্রিয় পরিস্থিতি সামলাবার উদ্দেশ্যে নিজের একটি আঙ্গুলে ক্ষতের সৃষ্টি করেন এবং তা বাটা মরিচে ডুবিয়ে বসে থাকেন। এটা তিনি ঘুমে ঢলে পড়া থেকে রক্ষা পাবার জন্যেই করেছিলেন। রাত গড়িয়ে যখন শেষ প্রহর, ঠিক তখনই জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব দেখতে পেলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) একটি বিশাল আকৃতির বাঘের পিঠে চড়ে বাড়ির উঠোনে এসে নামলেন। অতঃপর বাঘটি তাঁকে কুর্ণিশ করে বিদায় নিয়ে ধীর গতিতে স্থান ত্যাগ করলো। এই আজব কারমত দেখে তাঁর পিতা জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব উপলব্ধি করতে পারলেন যে তাঁর পুত্র উচ্ছন্নে যান নি, বরং বেলায়াত রাজ্যে সম্রাটের আসনে আসীন হয়েছেন। অজ্ঞ প্রজারাই বরং তাঁকে ভুল বুঝেছেন। তাই সাথে সাথেই তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সামনে গিয়ে বল্লেন, “বাবা, তুমি তো আমার পুত্র নও, তুমি আমার বাবা।” বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার এই কারামত সবাইকে এলান দিয়ে যায় যে আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বেলায়তের সিংহাসনে নব ওলিকুল সম্রাটের অভিষেক হয়েছে।
দীঘি থেকে জ্বিন-দেও-দানব বিতাড়ন
এ কথা সর্বজনবিদিত যে চট্টগ্রাম আদিকালে জ্বিন-পরী ও দেও-দানবের আবাসস্থল ছিল। আউলিয়াগণই তাদেরকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং তা আবাদ করেন। কথিত আছে যে হযরত বদর শাহ্ (রহ:) যখন সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের তীরে এসে পৌঁছেন, তখন এই এলাকা ছিল মিশমিশে অন্ধকার ও জ্বীন-দেও-দানবের আখড়া। তিনি তাদের কাছে এবাদত-বন্দেগীর জন্যে একটু খানি জায়গা চেয়ে সেখানে আলো জ্বালাতে একটি চেরাগ (চাটি) প্রজ্জ্বলনের অনুরোধ করলেন। দেও-দানবরা অনুমতি দিলে তিনি চেরাগ জ্বালালেন। অমনি এই মহান ওলির কারামতে এই চেরাগের আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং সমগ্র অঞ্চল আলোকিত হলো। এতে অন্ধকার জগতের দেও-দানবকুল এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায়। কথিত আছে যে, চট্টগ্রামের কদম মোবারকে অবস্থিত চেরাগী পাহাড়ে হযরত বদর শাহ্ (রহ:) তাঁর বরকতময় চেরাগ জ্বেলেছিলেন। অনুরূপভাবে, বর্তমানে আহলা দরবার শরীফ যেখানে অবস্থিত, সেখানেও ওই সব দেও-দানবের উপদ্রব ছিল। তাদের অত্যাচারে মানুষের জীবনযাপন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় এই এলাকার অধিবাসীরা আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি, ওলিকুল শিরোমণি, কুতুবে যমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে এসে দেও-দানবদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে আরজি দেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জ্বিনদের উপদ্রবের মূল স্থানটি ছিল আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বিশাল দীঘি, যা আজো দরবার প্রাঙ্গনে অবস্থান করছে। ভক্তবৃন্দ ও এলাকাবাসীর বারংবার আরজির পরিপ্রেক্ষিতে জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) একদিন জযবা হালতে, অর্থাৎ, ঐশী ভাবে তন্ময় অবস্থায় দীঘির পানিতে ডুব দেন। ডুব যে তিনি দিলেন, আর তো ওঠেন না। কয়দিন কয় রাত তিনি পানির নিচে ছিলেন তা নিয়ে অবশ্য এ ঘটনার বর্ণনাকারীদের মধ্যে মতান্তর আছে। কেউ কেউ বলেছেন তিন দিন ও তিন রাত; আবার কেউ কেউ বলেছেন সাত দিন সাত রাত। সময় যেটাই হোক না কেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এতোক্ষণ সময় পানির নিচে থাকাটা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি দীঘির পানির নিচে অবস্থানকালে হঠাৎ এই দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব পার ভেঙ্গে যায়। কথিত আছে যে, জ্বিন-দেও-দানবরা ওই দিক দিয়েই পালিয়ে যায়। অতঃপর তিনি পানির নিচ থেকে উঠে আসলে এই অঞ্চলে আর কখনো জ্বিনের উপদ্রব হয়নি। আউলিয়াগণ কারামত প্রদর্শন করেই মানুষদেরকে দ্বীনের পথে পরিচালিত করেন, তাদেরকে হেদায়াত দান করেন।
কেউ কেউ বলেন, আজকাল বহু ডুবুরি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই অনেক সময় ধরে পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম। তাহলে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামতের মাহাত্ম্য কোথায়? আমরা এ ব্যাপারে বলবো, বর্তমানে যারা ওইভাবে পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম, তারা বহুদিন যাবত অনুশীলন করেই তা সম্ভব করেছেন। পক্ষান্তরে, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বিনা অনুশীলনেই তা সম্ভব করেছেন। বিনা অনুশীলনে এ রকম করতে পারাটাই হলো কারামত। সর্বোপরি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তিন দিন ও তিন রাত দীঘির পানির নিচে ছিলেন সেখান থেকে জ্বীন-পরী-দেও-দানবদের বিতাড়িত করে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। তিনি ওই সমস্যা উক্ত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে পেরেছিলেন বলেই ওপরে ওঠে এসেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে যদি সমস্যা সমাধান না হতো, তবে যতো দিন ও যতো রাত প্রয়োজন হতো, ততো দিনই তিনি পানির নিচে থাকতেন। তাঁর কাজ ছিল মানুষের সমস্যা সমাধান করা, কোনো ডুব প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করা নয়।
দেও-দানব বিতাড়নের পরে আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বিশাল দীঘিটি সর্বসাধারণের ব্যবহারোপযোগী হয়। এই ঘটনার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দীঘিতে কিছু চিনি ঢেলে দেন এবং বলেন, “যে কেউ, যে কোনো নিয়্যতে, এই দীঘির পানি পান করলে তার (নেক) মকসুদ পূরণ হবে।” ওলির জবান আল্লাহর বিধান। সর্বসাধারণ এই পানি পান করে আজো উপকার পাচ্ছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, দীঘির পানিতে কোনো প্রকার ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু নেই। কোনো পানিবাহিত রোগেও আক্রান্ত হওয়ার নজির নেই।
একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সহধর্মিনীদের একজন, যিনি আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা (রহ:)-এর মা সাহেবানী, তিনি একদিন জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হুজুর, আপনার কাছে এতো লোকজন আসে কেন? ওরা কি আপনাকে ফকির-দরবেশ মনে করে আসে? দয়া করে আমাদের কিছু দেখাবেন কি? উত্তরে জনাব হযরত
কাজী আসাদ আলী (রহ:) বল্লেন, “আমি তো সরকারি চাকরি করি, আমাকে ফকির-দরবেশ কে বলে?” অতঃপর এক রাতে সহধর্মিনীগণ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্যে এক সাথে পাহারা দিতে লাগলেন। কেউ পা টিপতে থাকলেন, কেউ বা হাত, আর কেউ বা মাথা টিপতে থাকলেন। জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) কিন্তু ফজর নামাজের ওয়াক্ত পর্যন্ত সারা রাত গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন। অতঃপর ফজরের নামাজ ও দোয়া-কালাম পড়লেন। তাঁর স্ত্রীগণ পরস্পর এ মর্মে আলোচনা করতে লাগলেন যে, কোনো কিছুই তো তাঁরা এ সময়ে দেখতে পেলেন না। এই আলাপ-আলোচনা যখন চলছিল, ঠিক এমনি সময়ে হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বল্লেন, “মা জান, গত রাতে বাবাজান কেবলা (হযরত কাজী সাহেব) আমাদের বাসায় ভাত খেতে বসে এক লোকমা (গ্রাস) খাওয়ার পরে জযবা হালতে (ঐশী ভাবোন্মত্ত অবস্থায়) উঠে চলে এসেছেন। আমি ওই খাবার নিয়ে এসেছি। দয়া করে এগুলো তাঁর সামনে পেশ করবেন।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) স্ত্রীগণ ওই মুরীদকে পীরের পক্ষে ওকালতি করার অভিযোগে ভর্ৎসনা করেন। এমন সময় আরেক মুরীদ এসে উপস্থিত হন। তিনি বল্লেন, “মা জান, গতরাতে বাবাজান কেবলা আমাদের ওখানে খেতে বসেছিলেন। হঠাৎ অর্ধেক মরিচ খাওয়ার পরে জযবা হালতে তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে যান এবং সবাইকে চড়-থাপ্পড় মেরে চলে এসেছেন। তাঁর খাবার আমি নিয়ে এসেছি। অনুগ্রহ করে এগুলো তাঁর কাছে পেশ করবেন।” সহধর্মিনীগণ এবার বিস্ময়ে হতবাক। এও কি সম্ভব? তাঁদের এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় অপর এক মুরীদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। তিনি আরয করলেন, “মা জান, গত রাতে বাবাজান কেবলা আমাদের ওখানে জযবা হালতে পাহাড়ে-পর্বতে ছুটোছুটি করেছেন এবং সবাইকে চড়-থাপ্পড় মেরেছেন। এর পর হঠাৎ তিনি তাঁর এক পাটি জুতো ফেলে রেখেই চলে এসেছেন। আমি তাঁর জুতো মোবারক ফেরত দিতে এসেছি।” এ কথা বলেই ওই মুরীদ জনাব হযরত কাজী আলী কেবলার এক পাটি জুতো সবিনয়ে মেঝেতে রাখলেন। জুতোটি ছিল কর্দমাক্ত। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সহধর্মিনীগণ বিস্ফোরিত নয়নে ওই জুতোর পাটির দিকে তাকালেন। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সারারাত পাহারা দেয়া জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) সম্পর্কে এতোগুলো অসম্ভব ঘটনা শুনে হতবিহ্বল স্ত্রীগণ কর্দমাক্ত জুতোর পাটি নিয়ে তাঁর শোবার ঘরে গিয়ে অত্যন্ত বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, গত রাতে রাখা জুতো জোড়ার কেবল এক পাটিই সেখানে পড়ে আছে। এ ঘটনায় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) স্ত্রীগণের ভুল ভেঙ্গে যায়। এই মহান ওলির কারামত দ্বারা আবারও প্রমাণ হয় যে, আউলিয়ায়ে কেরাম একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত হতে পারেন। ইসলামী উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে এ বিষয়কে স্বীকার করেছেন এবং এটিকে ‘তাঈয়ে মকান’ বলেছেন। তাঁরা আল্ কুরআনের সুরা নমলের ৩৮-৩৯ আয়াতে বর্ণিত হযরত সুলাইমান পয়গম্বর (আ:)-এর উযির আসফ বিন বারখিয়ার ঘটনাটি এর সপক্ষে পেশ করেছেন। উক্ত ঘটনায় আসফ বিন বারখিয়া চোখের পলকে রানী বিলকিসের সিংহাসনটি ইয়েমেন হতে দামেস্কে নিয়ে আসেন। গাউসে পাক হযরত বড় পীর সাহেব (রহ:)-ও একবার একই সময়ে অনেক মুরীদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছিলেন।
জাহাজে নাবিকদের জীবন রক্ষা
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জনৈক মুরীদ সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করতেন। একবার অথৈ সাগরে জাহাজে পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এই সংকটের পেছনে একটি কারণ হতে পারে, জাহাজ বন্দর ছেড়ে আসার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পানি জাহাজে সংরক্ষণ না করা। অথবা সমুদ্রে অবস্থানের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় অতিবাহিত করার কারণেই হয়তো পানির এই সংকট দেখা দিয়েছিল। জাহাজের নাবিকরা কোনো উপায়ন্তর না দেখে হাহাকার করতে লাগলেন। কেউ কেউ কান্নায়ও ভেঙ্গে পড়লেন। তারা পানি ছাড়া কীভাবে ৭-৮ দিন টিকে থাকবেন তাই নিয়ে আহাজারি করছিলেন। ঠিক সেই সময় ওই মুরীদসহ আরো দুই/তিন জনের মনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কথা স্মরণ হয়। তারা তাঁর কাছে রূহানী মদদ তথা আধ্যাত্মিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। অমনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাদের সামনে হাজির হন। তাঁকে দেখতে পেয়ে তারা সবাই বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন, “এই তো আমাদের পীর সাহেব কেবলা।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কি খাবার পানি নেই?” তারা সবাই এক বাক্যে বল্লেন, “জ্বি, হুজুর।” তিনি বল্লেন, “জাহাজ থামাও এবং আমাকে সাগরে ছেড়ে দাও। আমি পানিতে ডুব দেবার পরে তোমরা সাগর থেকে পানি সংগ্রহ করবে। তোমাদের চাহিদা পূরণ হলেই আমি ওঠে আসবো।” এ কথা শুনে তারা সবাই ভয় পেয়ে গেলেন এবং তাঁকে বল্লেন, “হুজুর, আপনাকে আমরা কীভাবে এই গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দেই? এখানে তো হাঙ্গর জাতীয় নানা হিংস্র মাছের আবাস।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বল্লেন, “তোমরা ভয় পাচ্ছো যখন, ঠিক আছে একটা কাজ করো। আমার কোমরে একটা দড়ি বেঁধে আমাকে সমুদ্রে ছেড়ে দাও। যতোক্ষণ সমুদ্র থেকে পানি সংগ্রহে তোমাদের চাহিদা পূরণ না হবে, ততোক্ষণ আমাকে পানি থেকে ওপরে ওঠাবে না।” তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাই করা হলো। তিনি সমুদ্রে নামার সাথে সাথেই নাবিকদের চাহিদানুযায়ী পানি সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা হলো। অতঃপর তাঁকে তারা সাগর বক্ষ থেকে জাহাজে তুলে নিলেন। কোমরের রশি খোলামাত্রই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই মহান ওলির আজব কারামতে সাগর বক্ষ থেকে সংগৃহীত পানিও লবণাক্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং পানীয় জলে পরিণত হয়। আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত যে প্রাকৃতিক নিয়মকেও পাল্টে দিতে পারে তা এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়। আরেকটি বিষয় এতে পরিস্ফুট হয়। আউলিয়াবৃন্দ দূরবর্তী কোনো স্থানে সংকটাপন্ন ভক্ত-মুরীদানকে রূহানী মদদ প্রদানে সক্ষম। উপরন্তু, স্থলচর ও জলচর হিংস্র জীব-জন্তুও আল্লাহর ওলিকুলকে সমীহ করে চলে। যাঁদের কাছে পরওয়ারদেগারের কুল-মাখলুকাতের প্রশাসনিক ক্ষমতা, তাঁদের বশ্যতা তো সৃষ্টিকুল স্বীকার করতে বাধ্য।
মায়ের কাছে প্রবাসী ছেলের প্রত্যাবর্তন
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এক বৃদ্ধা মুরীদ ছিলেন। তিনিও একই গ্রামে, অর্থাৎ, আহলা দরবার শরীফ যে গ্রামে অবস্থিত সেই শেখ চৌধুরীপাড়া গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁর এক পুত্র ইসমাইল কন্ট্রাক্টর ভাগ্যের অন্বেষণে বার্মায় গমন করেন। সেই যুগে মানুষেরা ভাগ্যান্বেষণে যেতেন, ঠিক যেমনি আজকাল মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি স্থানে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন। বার্মা গিয়ে কন্ট্রাক্টর ছেলে তাঁর বৃদ্ধা মাকে ভুলে যান। বৃদ্ধা মা পুত্রের বিচ্ছেদে শোকার্ত হয়ে পড়েন। তিনি বার বার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন যাতে ছেলে তাঁর কাছে ফিরে আসে। একদিন ভোরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জযবা হালতে ওই বৃদ্ধার ঘরের উঠোনে উপস্থিত হন এবং ঘরের চালে অবস্থিত একটি লাউকে হাতের আ’সা (লাঠি) দ্বারা দু’বার আঘাত করেন। লাঠি দিয়ে বাড়ি দেবার সময় তিনি বৃদ্ধাকে বলেন, “এই বুড়ি, তোর ছেলের জন্যে ভাত রাধ্ (রান্না করো)! তোর ছেলে আসছে।” এদিকে তাঁর হাতের লাঠির আঘাত আলৌকিকভাবে গিয়ে পড়লো বার্মায় বিছানায় ঘুমন্ত ইসমাইলের পিঠে! কন্ট্রাক্টর পুত্রের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি সামনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর কদম মোবারক দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে বল্লেন, “ওডা, তোর মা কান্দি কান্দি মরি যারগই আর তই আইজো এন্ডে পড়ি রইয়স। স’রে স’রে বাড়ি যাগোই” (অর্থাৎ, এই বেটা, তোর মা একজন কাঁদতে কাঁদতে মরতে বসেছেন, আর তুই এখনো এখানে। শিগগির বাড়ি যা)! এ কথা বলেই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ইসমাইল কন্ট্রাক্টর সাহেব আর দেরি না করে বাড়ির পথে রওনা হলেন। বার্মা থেকে সকালে রওনা হয়ে চট্টগ্রামের আহলা মৌজায় দুপুরে পৌঁছানো এবং বাড়িতে ভাত খাওয়া স্বাভাবিকভাবে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্তু জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর কারামতে ইসমাইল কন্ট্রাক্টরের জন্যে পথের এই দূরত্ব সংকুচিত হয়ে যায় এবং তিনি দুপুরে বাড়িতে ফিরে মায়ের রান্না করা ভাত খান। বৃদ্ধার দুঃখ বহু দিন পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামত দ্বারা ঘুচে গেল। আল্লাহর আউলিয়াগণ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা যে সমাধান করতে সক্ষম, তা এ ঘটনায় প্রতীয়মান হয়।
খুনের মিথ্যে মামলা হতে বেকসুর খালাস
চট্টগ্রাম মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গাউসুল আযম হযরত শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল্ হাসানী (রহ:) মাঝে মাঝে আহলা দরবার শরীফে তশরীফ আনতেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) যাহেরী তথা প্রকাশ্য জীবদ্দশায় গাউসুল আযম শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী (রহ:) একবার এ রকম এক সফরে আহলা দরবার শরীফে এসেছিলেন। ওই সময় ইমামউল্লাহর চরের শোকর আলী নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে খুনের মামলা সাজানো হয় এবং তাঁকে আসামী করা হয়। তাঁর মা তাঁকে এই মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাবার জন্যে উক্ত দুই বুযূর্গের কাছে আরজি দিতে দরবার শরীফে পাঠান। তাঁর মা চেয়েছিলেন যেন হযরত গাউসুল আযম (রহ:) ও কুতুবে যমান জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দোয়ার বরকতে তিনি খুনের আসামীর মিথ্যা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পান। মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী শোকর আলী দরবার শরীফে এসে তাঁর আরজি পেশ করেন। অতঃপর জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দোয়া করা জন্যে গাউসুল আযম শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল্ হাসানী (রহ:)-এর প্রতি সম্মানের সাথে ইশারা করেন। প্রত্যুত্তরে তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) প্রতি অনুরূপ ইশারা করেন। কয়েকবার ইশারা ও পাল্টা ইশারা করার পরে তাঁরা দু’জনেই শোকর আলীর দুই বাহু ধরেন এবং জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর পিঠে একটি মৃদু থাপ্পড় মেরে তাঁকে ছেড়ে দেন। ওই মিথ্যা মামলার পরবর্তী হাজিরার দিনে কোর্টে বিচারকার্য পরিচালনার জন্যে কোনো ফাইল ও কাগজপত্র আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এই আজব কেরামতের ফলে মিথ্যা ও সাজানো মামলাটি খারিজ হয়ে যায় এবং শোকর আলী বেকসুর খালাস পান। এই ঘটনার পরে শোকর আলী আধ্যাত্মিক সাধানায় ব্রতী হন এবং কালক্রমে শোকর আলী শাহ্ নামে কামেল সাধক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সাধারণতঃ করলডাঙ্গা জঙ্গলে কালাতিপাত করতেন এবং বিভিন্ন ধরনের জীব-জন্তুর সাথে তাঁকে দেখা যেতো। তাঁর মাযার শরীফ ইমামুল্লার চরে অবস্থিত।
বৃটিশ সরকারের মামলা থেকে মুরীদকে খালাস
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জনৈক মুরীদ একবার সরকারি রাস্তার ‘আইল’ অর্থাৎ ধার কেটে ফেলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়। এতে তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে আরজি দেন এবং অনুনয় বিনয় করে এ থেকে মুক্তি কামনা করেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর ওই মুরীদকে কোর্টে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় তাঁর চেহারা মোবারক খেয়াল তথা স্মরণ করে সত্য সাক্ষ্য দিতে আদেশ করলেন। অতঃপর কোর্টে শুনানির দিন ওই মুরীদ তাঁর পীরের চেহারা মোবারক খেয়াল করতেই দেখতে পেলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সামনে উপস্থিত। কিন্তু কোর্টে অবস্থানরত অন্য কেউই তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) নির্দেশ দেন যেন তিনি যা বলেন শুধু তাই ওই মুরীদ পুনরাবৃত্তি করেন, অন্য কোনো জবাব যেন না দেন। শুনানি শুরু হলে ইংরেজ জজ ওই মুরীদকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি রাস্তার ধার কেটেছ?” উত্তর এলো “জি হুজুর”! জজ সাহেব রাগতঃ স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কেটেছ”? উত্তর এলো, “হুজুর,গালে দাড়ি মোচ যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন ঠোঁটের ওপরে ঝুলে পড়া মোচের অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে ফেলতে হয়; ফলে তা চেহারার শোভা বর্ধন করে। ঠিক তেমনি আমিও রাস্তার ধারের বাড়ন্ত কাছা ও লতাপাতা কেটে পরিষ্কার করেছি যাতে করে রাস্তার শোভা বৃদ্ধি পায়।” এ চমকপ্রদ জবাব শুনে ইংরেজ জজ সাহেব সন্তুষ্ট হন এবং ওই মুরীদকে বেকসুর খালাস দেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাই (রহ:) এই বিচক্ষণ উত্তর নিজ মুরীদকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। দেখুন, তাঁকে এবং তাঁর এই আজব কারামত কোর্টে অবস্থানরত কেউই দেখতে পায়নি, শুধু ওই মুরীদ ছাড়া। যে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়া হয়েছে তা এক কথায় অতুলনীয়। সত্যি, খোদাতা’লার প্রশাসনের ক্ষমতাধরদের সামনে দুনিয়ার সমস্ত প্রশাসনই ফেল্। মহা শক্তিধর বৃটিশ রাজও এখানে অচল।
চিলও কাজী সাহেব কেবলার তাবেদার
কুতুবে যমান জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর মেয়ের জামাই, বিশিষ্ট জমিদার জনাব আব্দুল খালেক চৌধুরী একবার দরবার শরীফে, অর্থাৎ, শ্বশুরালয়ে বেড়াতে আসেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মেয়ের জামাইকে আপ্যায়ন করতে খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন। কিন্তু আব্দুল খালেক চৌধুরী সাহেব খেতে বসার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মেহমানকে কী খাওয়ানো হচ্ছে তা তদারকি করার উদ্দেশ্যে সেখানে দেখতে গেলে তিনি দেখতে পান, মুরগির রোস্টটি রান্না হওয়া সত্ত্বেও ফরাশে (ওই যুগে খাওয়ার জন্যে বিছানো ম্যাট) অনুপস্থিত। তিনি সাথে সাথে কাজের মেয়ে বলিকে (নাদুর মা) রোস্টের কথা জিজ্ঞেস করেন। বলি ভয়ে ভয়ে বলে, মেহমানখানায় রোস্টটি নেয়ার সময় একটি চিল ছোঁ মেরে তা নিয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জযবা হালতে বলিকে তার শাড়ীর আঁচল মেলে ধরতে বলেন এবং তার পরে চিলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এই চিল, তোর এতো বড় দুঃসাহস যে তুই আমার অনুমতি ছাড়াই মুরগির রোস্টটি নিয়ে গেছিস। শিগগির ওই রোস্ট ফেরত দে!” কী আজব কারামত! যেই বলা অমনি চিলটি ওই মুরগির রোস্ট বলির শাড়ীর আঁচলে ফেলে দিয়ে গেল। অতঃপর রোস্টটি ধুয়ে পরিষ্কার করে জামাই সাহেবের পাতে দেয়া হলো। আউলিয়া কেরামের আধ্যাত্মিক প্রশাসন যে পশু-পাখির জগত পর্যন্ত সুবিস্তৃত, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত তারই প্রমাণবহ।
মুরীদকে চির তারুণ্য প্রদান
চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন মরহুম আব্দুল লতিফ কেরানী। বৃটিশ আমলের হাতে গোণা শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। মুরীদ হবার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর হাত মোবারক কেরানী সাহেবের মুখমন্ডলে বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি চির তরুণ থাকবে।” অতঃপর কেরানী সাহেবের ইন্তেকাল অবধি আনুমানিক ১২৫ বছরের জীবনে তাকে দেখতে বুড়ো মনে হয়নি। সব সময় তরুণের মতোই দেখা গেছে। আর তিনিও তরুণদের মতো সর্বদা ক্লিন শেইভ থাকতেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামত দ্বারা চির তারুণ্য পেয়েছিলেন এই ভদ্রলোক।
কারামত দ্বারা স্থানের দূরত্ব সংকুচিত করা
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কিছু হলের গরু ছিল। দরবার শরীফের খাদেমবৃন্দ সব সময়ই এগুলোকে জনাব হযরত কাজী
আসাদ আলী কেবলার (রহ:) চোখের আড়ালে রাখতেন। কেননা তিনি অনেক সময় জযবা হালতে “মাওলার হুকুম হয়েছে”- এ কথা বলে হালের গুরুগুলোকে জবাই করার আদেশ দিতেন। একবার এ রকম একটি হালের গরু তিনি জবাই করার নির্দেশ দেন। খাদেমবৃন্দ তাঁর কাছে আরজ করলেন, “হুজুর, এখন চাষাবাদের সময়; হালের গরুর তীব্র সংকট। এ রকম আরেকটি গরু পাওয়া দুরূহ হবে।” কিন্তু জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অনড়, তাঁর হুকুমই বহাল রইলো। অতঃপর গরু জবাই হবার পরে তিনি খানা পাক করার নির্দেশ দিলেন। রান্না শেষ হবার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অপরাহ্নে ইমাম আলী ফকির নামে তাঁর এক মুরীদকে কিছু তবাররুক দিয়ে বল্লেন, “যাও, এই তবাররুক তুমি মাইজভান্ডার দরবার শরীফে আমার পীর সাহেব কেবলার (হযরত শাহ্ আহ্ম্মদ উল্লাহ্ সাহেব কেবলা) দরবারে দিয়ে এসে এখানে মাগরিবের নামাজ পড়বে এবং ভাত খাবে।” এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ থেকে আহলা দরবার শরীফ আসা যাওয়ার রাস্তা ওই যুগে এতো সহজ ছিল না। আজকের মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা মহাসড়ক এবং মটর গাড়ী ও যানবাহনও ছিল না। পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বাহন তখন ছিল না। এই সব বিবেচনায় ইমাম আলী ফকির তার পীরের কাছে আরজ করলেন, “হুজুর, এতো অল্প সময়ে এতো দূরত্ব অতিক্রম করা তো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জবাবে বল্লেন, “হযরত সাহেব (শাহ্ আহমদউল্লাহ্ আল্ হাসানী) কেবলার অসিলা করে রওয়ানা হও।” ইমাম আলী ফকির তাই করলেন। কী আজব কেরামত! ইমাম আলী ফকির তবাররূক নিয়ে পদব্রজে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ পৌঁছে ওখানে আসরের নামাজ আদায় করলেন; অতঃপর তবাররুক পৌঁছে দিয়ে আহলা দরবার শরীফের দিকে হাঁটা আরম্ভ করলেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যে মাগরিবের নামাজের আগেই ফেরত এসে তা আদায় করলেন এবং ভাতও খেলেন। এই হুকুম তা’মিলের সময় তার কোনো ধারণাই ছিল না কতো পথ তিনি হেঁটেছেন, পথ চলার ক্লান্তিও তাকে গ্রাস করে নি। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দ্বারা পথের দূরত্ব সংকুচিত হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওই অপরাহ্নেই জনৈক আশেক-ভক্ত জোড়ারগঞ্জ থেকে দুইটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হালের গরু হাদিয়া হিসেবে দরবারে পেশ করেন। দরবারের খাদেমবৃন্দ যে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে চাষাবাদের সময় হালের গরুর সংকটের কথা জানিয়ে ফরিয়াদ করেছিলেন, তিনি তাদের আরজিও মঞ্জুর করলেন। এটিও তাঁর একটি কারামত।
কারামত দ্বারা হেদায়াত দান
একবার গ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদার রমজান আলী জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) তার বাড়িতে ভাত খাওয়ার জন্যে দাওয়াত দেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে জমিদার পরিবার, আর চৌকিদার তো গ্রামের সাধারণ মানুষ; তিনি জমিদারেরই প্রজা। কিন্তু দেখুন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:)-এঁর কোনো জাত্যাভিমান ছিল না। মানুষকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে তিনি জমিদারী মর্যাদার কথা চিন্তাই করতেন না। তাই রমজান আলীর দাওয়াত তিনি কবুল করে নিলেন নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে। অতঃপর যথাসময়ে তিনি রমজান আলীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। গিয়েই রমজান আলীকে বল্লেন, “তোর মাছের তরকারিতে কেরোসিনের গন্ধ। তুই আমাকে শাক ও ডাল দিয়ে দু’টো ভাত খেতে দে।” রমজান আলী রান্না ঘরে ঢুকে দেখেন, সত্যি মাছের তরকারিতে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জনাব হযরত কাজী অঅসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দর্শনে রমজান আলী রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই শায়খের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) তখন তাকে বলেন, “রমজান, তুই ওয়াদা কর, আর কখনোই অন্যের পুকুরের মাছ চুরি করবি না; তাহলে খোদাতা’লা তোর গুনাহ মাফ করে দেবেন।” রমজান আলী অপরের পুকুর থেকে মাছ চুরি করে এনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) খেতে দিয়েছেন, একথা পীর সাহেব কেবলা জেনে ফেলেছেন বুঝতে পেরে তার কান্না আরও বেড়ে গেল। অনুতপ্ত হয়ে তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে অঙ্গীকার করেন যে জীবনে আর কোনো দিন তিনি কোনো ধরনের চুরি করবেন না। বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) এভাবেই কারামত প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে সত্য, সঠিক পথে পরিচালিত করতেন।
পিতা-পুত্রের কেরামতি
আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি, ওলিকুল শিরোমণি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সুযোগ্য পুত্র হযরত আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিস্তী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর মায়ের গর্ভে থাকাকালিন মাঘ মাসে দরবার শরীফে ওরস্ মোবারক সমাগত হয়। ওই ওরশের দিনই তাঁর মায়ের প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়। এমতাবস্থায় তাঁর মাতা সাহেবানী জনাবা গুলবাহার খাতুন জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) বলেন, “আজ ওরশের দিন; কতো হাজার হাজার নর-নারীর আগমন ঘটবে এই দরবারে। এই অবস্থায় আমি পড়ে থেকে লজ্জিত হবো, কোনো খেদমত করতে পারবো না - এটা আমি সইতে পারবো না। দয়া করে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান দিন।” এ কথা শুনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মৃদু হেসে তাঁর স্ত্রীর পিঠে আলতো এক চড় মেরে বল্লেন, “আজকে না বেটা, কাল।” এ কথা বলেই তিনি ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। তৎক্ষণাৎ তাঁর স্ত্রীর প্রসব বেদনা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ওরস্ মোবারকের খেদমত আঞ্জাম দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অতঃপর ওই ওরস্ সুসম্পন্ন হওয়ার পরের দিন হযরত আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা (রহ:) ভূমিষ্ঠ হন। আহলা দরবার শরীফের এই মহান বুযর্গ যে জন্মগত ওলি, তা এ ঘটনায় দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আউলিয়ার বিস্মৃত মাযার চিহ্নিতকরণ
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ‘আহলে কাশফ’ তথা দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি কবরবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে জানতেন। এই আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে তিনি খিতাবচরের হাসান শাহ্ ইউনানী (রহ:) ও ইউনুস শাহ্ ইউনানী (রহ:), বেঙ্গুরার শাহ্ চাঁন্দ আউলিয়া (রহ:) ও করলডাঙ্গার কলন্দর শাহের দরগাহ, এবং কালাইয়ারহাটের মহিউদ্দীন শাহের বিস্মৃত মাযার সনাক্ত করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই মাযারগুলো ওই সময় ঝোপ-ঝাড়ে আচ্ছাদিত ছিল এবং সর্বসাধারণ এই পথে আসা যাওয়া করতেন না। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) উক্ত আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার-দরগাহ সর্বসাধারণের জন্যে আবার উন্মুক্ত করে দেন। হাসীস্ শরীফে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “যদি মাযারস্থ আউলিয়াবৃন্দ না থাকতেন, তাহলে দুনিয়াবাসী (অনলে) জ্বলে পুড়তো।” এই হাদীস্ ইমাম মানাবী (রহ:) তাঁর প্রণীত কানযুদ্ দাকাইক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিতে মাযারস্থ আউলিয়া কেরামের ফুয়ুজাত তথা দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণাপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সর্বসাধারণের জন্যে এই দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণাপ্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত করেন। তাঁর এই কারামত দেখে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সুন্নী আলেম আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ:) তাঁর রচিত ‘দেওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে জনাব হযরত কাজী আসাদ কেবলা (রহ:)-কে “কাশফুল কুবুর” খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ওই গ্রন্থে কবিতার আকারে আরও লিখেন, “আলেমগণের অগ্রগণ্য, সালেকগণের অনুকরণীয়, আলোকিত শক্তির অধিকারী জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নির্ভেজাল ওলি। তাঁর আলোকময় পাক রওযা আহলা বোয়ালখালীতে অবস্থিত। তাঁর জ্যোতির্ময় মোবারক (পবিত্র) সত্তা থেকে সর্বসাধারণ ফরেয (দয়া, করুণা, অনুগ্রহ) অর্জন করেন সর্বক্ষণ।” (ভাবানুবাদ)
কারামত দ্বারা অন্তর পরিবর্তন
চট্টগ্রাম পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত মুরাদাবাদ গ্রামের খায়রুজ্জামান মাষ্টার কুতুবে যমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর কাছে মুরীদ হবার আগে পীর-ফকিরে ততোটা বিশ্বাস ও ভক্তি করতেন না। ওই সময় একবার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) পটিয়ার খরনায় সফরে আসেন। এখানেই খায়রুজ্জামান মাষ্টারের সাথে তাঁর দেখা হয়। উভয়েই একে অপরের দিকে তাকান, কিন্তু মাষ্টার সাহেবের অন্তরে এই মহান ওলির প্রতি কোনো মহব্বতপূর্ণ ভাবের উদয় না হওয়ায় তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:)-এর কাছে বায়াত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। অতঃপর রিযিকের সন্ধানে এক সময় খায়রুজ্জামান মাষ্টার বার্মার রেঙ্গুন গমন করেন এবং সেখানে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। রেঙ্গুনে অবস্থানকালীন হঠাৎ এক রাতে তিনি বশরতে (স্বপ্নে) জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দর্শন পান। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে বলেন, “তোমাকে দেখার জন্যে আমি এখানে চলে এসেছি।” স্বপ্নের মধ্যে কথাবার্তার এক পর্যায়ে খায়রুজ্জামান মাষ্টার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে অনুরোধ করেন, “হুজুর, আমাকে আপনার পবিত্র হাতে বায়াত (মুরীদ) করুন।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁকে বায়াত করেন। খায়রুজ্জামান মাষ্টার এর কিছু দিন পরে রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন এবং দরবার শরীফে গিয়ে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কদম মোবারকে লুটিয়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন, আর ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন তার এই অবহেলার জন্যে। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সাদরে গ্রহণ করেন। খায়রুজ্জামান মাষ্টার ছিলেন বৃটিশ আমলের শিক্ষিত একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি পীরের মহব্বতে ওই সময় তাঁর শানে একটি শে’র (পদ্য) রচনা করেন। এটি বাংলা ও উর্দু এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে রচিত হলেও পাঠককুলের হৃদয়ঙ্গম হতে অসুবিধা হবে না। নিচে শে’রটি দেয়া হলো:
কাজী সোনা খায়রের সব পেয়ারা হামারা,
সোনালী বর্ণ শাহা কাজী ধন,
এ জীবনের জীবন, অমূল্য রতন,
খোদা নিজের হাতে বানাইছে পুতুলা ।।
কুতুবুদ্দীনো, নেজামুদ্দীনো,
আরো যতো আছে বাবা আউলিয়াগণ,
সব হইতে কাজী সোনা সরদারওয়ালা।।
আরব, আজম, বোগদাদ, মিসির,
কাজী সোনার নামের ’পরে হইয়াছে জিকির,
আরো মদীনামে ফুঁকে নবী মেরা।।
(জরুরি নোট: মুরীদের কাছে নিজের পীরকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ধ্যান-জ্ঞান করা অতীব জরুরি। কেননা, পীরের মাধ্যমেই মুরীদ কুরবাত/নৈকট্য পেয়ে থাকেন। এতে অন্যান্য পীর-মাশায়েখকে খাটো করা মূল উদ্দেশ্য নয়। গাউসে পাক বড় পীর সাহেব কেবলা (রহ:)-এর সময় অন্য এক পীরের কতিপয় মুরীদ তাঁর কাছ থেকে নিজেদের মুখ আড়াল করতেন। এটা দেখে বড় পীর সাহেব কেবলা (রহ:) তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন।)
বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দ্বারা অন্তর পরিবর্তনের পরে খায়রুজ্জামান মাষ্টার তরীকত প্রচারে আত্মনিবেদিত হন। তাঁর ওরস্ ১০ই চৈত্র পটিয়ার মুরাদাবাদে অনুষ্ঠিত হয়।
অদৃশ্য ও ভবিষ্যত জ্ঞান
আহলা দরবার শরীফের অলিকুল শিরোমণি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সুযোগ্য পুত্র হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিস্তী সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা জন্মগতভাবে ওলি। তিনি যে বড় ওলি হবেন, তা জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর আরেকটি কারামতে প্রকাশ পেয়েছিল। ওই সময় হযরত নূরী বাবা (রহ:)-এর বয়স মাত্র এক বছর। চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার ইমামুল্লার চর গ্রামের নবী হোসেন নামে এক ব্যক্তি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দরবারে চাষাবাদের কাজ করতেন। একদিন তিনি হযরত নূরী বাবাকে (রহ:) কোলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করছিলেন। ঠিক এমনি সময় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সেখানে উপস্থিত হন এবং নূরী বাবা (রহ:)-কে কোলে নিয়ে গরু দ্বারা ধান মাড়াই করতে দেখে তিনি নবী হোসেনের প্রতি রাগান্বিত হন। তিনি তাকে ধিক্কার দিয়ে বলেন, “এই বেটা, তুই চিনিস কাকে কোলে নিয়ে গরুর কাছে এসেছিস? ওর গায়ে গরুর বাতাস লাগবে, শিগগির দূরে সরিয়ে নেয়। এই ছেলে একদিন তোর পীর হবে।” উল্লেখ্য যে, নবী হোসেনের বয়স তখন ২৭-২৮ বছর। কিন্তু ওলির জবান তো বিফলে যাবার নয়। অতএব, বৃদ্ধ বয়সে তিনি ঠিকই নূরী বাবা (রহ:)-এর মুরীদ হন। আরও উল্লেখ্য যে, ‘গরুর বাতাস’ বলতে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সম্ভবত কোনো অদৃশ্য ক্ষতিকারক প্রভাবকে বুঝিয়েছেন, যা আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করতে বা বুঝতে সক্ষম নয়। এই বিষয়টি তাঁর অদৃশ্য জ্ঞান (গায়েবী এলম) বলেই সাব্যস্ত হয়।
বিনা চাবিতে ঘড়ি চলে
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) যৌবনে চট্টগ্রামে রাঙ্গুনিয়া উপজেলাস্থ কাউখালী মুন্সেফ কোর্টে কাজী তথা বিচারকের চাকরি করতেন। প্রতি সপ্তাহের একদিন তিনি বাড়িতে আসতেন পরিবার পরিজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে। একবার অফিসে যাওয়ার সময় তাঁর ঘড়িটি তিনি বাড়িতে রেখে যান। এখানে উল্লেখ্য যে, বৃটিশ আমলে হাত ঘড়ির প্রচলন ছিল না, বরং একটি চেইন দ্বারা আটকে কোটের বা শেরওয়ানীর পকেটে রাখা হতো এবং এ সকল ঘড়িতে প্রতিদিন চাবি দিতে হতো। একদিন পরই চাবি না দেয়ার কারণে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে যায়। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সহধর্মিনী জনাবা গুলবাহার খাতুন ঘড়িটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেখে মনে মনে ভাবলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ঘড়িতে চাবি দিয়ে যান নি, তাই তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় কাউকে চাবি দেয়ার জন্যে তা হস্তান্তর করাও তো নিষেধ। কী করা যায় ভেবে তিনি চুপ করে রইলেন। কী আশ্চর্য! তিনি পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘড়ি ঠিকই চলছে, কোনো দম দেয়ার প্রয়োজন হয় নি। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সপ্তাহশেষে আবার বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের সময় পর্যন্ত ওই ঘড়ি টিক্ টিক্ করে চলেছিল। এই কারামত দেখে বাড়ির সবাই এবং ভক্তবৃন্দ হতবাক হয়ে যান।
বৈবাহিক জীবন
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সহধর্মিনী মোসাম্মৎ গুলবাহার খাতুন। এই অনন্য সাধারণ মহিলার গর্ভে আহলা দরবার শরীফের ওলিকুল শিরোমণি, হাজতে রওয়া, মুশকিল কুশা, সুলতানুল মোনাযেরীন, হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিশ্তী সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা (রহ:) জন্ম গ্রহণ করেন। বস্তুতঃ মোসাম্মৎ গুলবাহার খাতুন তরীকতের একজন সমঝদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর সহধর্মিনী হিসেবে এই মহীয়সী নারী তাঁর স্বামীকে তরীকতের পথে সর্বপ্রকার সহায়তা করেন এবং বাধা সৃষ্টি করেন নি। এই বিদুষী মহিলা এক্ষেত্রে ছিলেন অনন্যা।
বেসাল ও ওরস্ শরীফ
মহানবী (দ:) একটি হাসীসে এরশাদ করেছেন, “মৃত্যু একটি সেতু; এক বন্ধুকে অপর বন্ধুর সাথে মিলিত করে।” এই হাদীসটি থেকেই আমরা জানতে পারি, আল্লাহর আউলিয়াগণ বেসাল তথা আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্ত হন। তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো মৃত্যু বরণ করেন না, বরং পর্দা করেন মাত্র। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাও (রহ:) খোদাপ্রেমের শিক্ষাদান ও তরীকত প্রচারের দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে ১৩৩৬ হিজরীর ১লা শাবান মোতাবেক ১৯১৫ ইং সালে মহাপ্রভুর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্ত হন। তাঁর এই বেসাল নিয়েও একটি কারামত রয়েছে। তিনি কোন্ দিন বেসালপ্রাপ্ত হলে মানুষজনের দরবারে আসা সুবিধাজনক হবে এমন একটি প্রশ্ন তিনি খাদেমগণকে করেছিলেন। তারা রোববার বলার পরে তিনি ঠিক ওই দিনই বেসালপ্রাপ্ত হন (২৯শে বৈশাখ, বাংলা)।
------------------------------------------------------------------------------- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
ঐতিহাসিক পটভূমি
এই বিশ্বজগত, গ্রহ-নক্ষত্ররাজি, সৌরমন্ডল-নভোমন্ডল এবং সমস্ত জীব ও জড় পদার্থ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বিনা কারণে সৃষ্টি করেন নি। একটি মহাপরিকল্পনা তথা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ তাঁর রহস্য তথা ভেদ এতে নিহিত রয়েছে। ওই মহাপরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানব জাতির সৃষ্টি। একজন নিপুণ চিত্রকর যেমন তাঁর চিত্রকর্মে কোনো প্রতিপাদ্য বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে ক্যানভাসে আনুষাঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক উপাদানগুলো সংযোজন করে একটি আবহ বা পরিবেশ সৃষ্টি করেন, ঠিক তেমনি মহান সৃষ্টিকর্তাও সমগ্র সৃষ্টি জগতকে মানব সৃষ্টির অনুষঙ্গ করেছেন।
মানব জাতি সৃষ্টির প্রাক্ লগ্নে আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাকুলকে বলেন, “আমি ধরণীর বুকে আমার খলীফা তথা (মনুষ্য) প্রতিনিধি প্রেরণ করতে চাই।” এতে ফেরেশতাকুল উত্তর দিলেন, “হে পরওয়ারদেগার! আমরাই আপনার এবাদত-বন্দেগী করছি। এরা (মনুষ্যজাতি) তো পৃথিবীতে ফিতনা ফ্যাসাদে লিপ্ত হবে”। অতঃপর আল্লাহ্তা’লা বল্লেন, “আমি যা জানি তা তোমরা জানো না” (সূরা বাকারায় বর্ণিত আয়াতের সার সংক্ষেপ)। এই যে খোদাতা’লা বল্লেন তিনি যা জানেন তা ফেরেশতাবৃন্দ জানেন না, এটাই মানব সৃষ্টির রহস্য। মানবকে তিনি শুধুমাত্র এবাদত-বন্দেগীর জন্যে সৃষ্টি করেন নি যার জন্যে ফেরেশতাকুলই যথেষ্ট ছিলেন; বরং তাঁর এই ভাষ্যমতে মানব সৃষ্টি তাঁরই মহা রহস্য হিসেবে প্রমাণিত হয় যা ফেলেশতাকুলও জানেন না।
এই গূঢ় রহস্য সম্পর্কে আমরা কিঞ্চিত ধারণা পাই একটি হাদীসে কুদসীতে যেখানে আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান, “আমি রহস্যের গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম; অতঃপর প্রকাশ হতে চাইলাম।” এই প্রকাশ হওয়ার মাধ্যম সম্পর্কে তিনি অপর এক হাদীসে কুদসীতে এরশাদ ফরমান- “হে রাসূল (দ:)! আপনাকে যদি আমি সৃষ্টি না করতাম, তাহলে আকাশ মন্ডল (অর্থাৎ, বিশ্বজগত) সৃষ্টি করতাম না।” আরেক কথায়, আল্লাহ্ তা’লা নবী করীম (দ:)-এর মাধ্যমেই প্রকাশ হতে চেয়েছিলেন। নবী আদম (আ:)-কে খলীফা হিসেবে ধরণীর বুকে প্রেরণের মাধ্যমে তিনি যে বিভিন্ন নবী-রসূল প্রেরণের ক্রমধারা আরম্ভ করেছিলেন, তা শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধরাধামে শুভাগমন দ্বারা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। আমাদের আখেরী নবী (দ:)-এর বেসাল তথা খোদার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির পরে আর কোনো নবী-রসূল পৃথিবীতে আসবেন না। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার ওই খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্ব জারি রয়েছে, জারি থাকবে কেয়মত পর্যন্ত। কেননা, মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন, “(হক্কানী) উলামাবৃন্দ পয়গাম্বরগণের ওয়ারিশ” (বুখারী)। আমরা জানি, মহানবী (দ:) কোনো পার্থিব উত্তরাধিকারের কথা এখানে উল্লেখ করেন নি। ওয়ারিশীর বিষয়টি হলো ইসলামী এলম (জ্ঞান) যা ‘উলামা’ শব্দটি ব্যবহারের দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি অন্যত্র এরশাদ করেছেন, “ইসলামী এলম দুই প্রকার। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য।” আরও এরশাদ করেছেন, “অপ্রকাশ্য জ্ঞান (এলমে মারেফত) আ’রেফ (খোদা সম্পর্কে জ্ঞানী)-দের কলবে তথা অন্তরে বিরাজমান।” অর্থাৎ নবী করীম (দ:)-এর ওয়ারিশ তথা উত্তরাধিকারী, যাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানের অধিকারী বুযূর্গ আলেম-উলামা, পীর-আউলিয়া ও তাসাউফের ইমামগণই আয়াতোক্ত খেলাফত জারি রাখবেন। এই খলীফা তথা নায়েবে নবী, অর্থাৎ, মহানবী (দ:)-এর প্রতিনিধিবৃন্দ বান্দাদেরকে আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন, আল্লাহ্ প্রেমে সিক্ত করবেন, যেমনটি রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন একটি হাদীসে কুদসীতে - “আমার (প্রিয়) বান্দা নফল এবাদত (মওলানা সানাউল্লাহ্ পানি-পথীর মতে এইটি তরীকতের রেয়াযত বা সাধনা) দ্বারা আমার এতো নিকটবর্তী হন যে আমি তাঁকে ভালোবাসি; এতো ভালোবাসি যে আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজকর্ম করেন এবং তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন” (আল বোখারী)। এই মহব্বতের উদ্দেশ্যেই খোদা তা’লা মানব সৃষ্টি করেছেন এবং ফেরেশতাকুলকে বলেছেন তাঁরা ওই বিষয়ে জানেন না যা তিনি জানেন (সুরা বাকারা)। আল্লাহর এই সকল প্রিয় বান্দা তথা নবী-ওলিগণ আল্লাহ্ তা’লার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন।
রাসূলে খোদা (দ:)-এর বেসালের পরে তাঁরই বিশিষ্ট সাহাবীবৃন্দ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:), হযরত উমর ফারুক (রা:), হযরত উসমান যিন্নুরাইন (রা) এবং হযরত আলী মুরতজা (ক:) যথাযথভাবে খলীফার দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় অন্যান্য সাহাবী এবং সর্বসাধারণ তাঁদের খেলাফতের প্রতি বায়াত গ্রহণ করেন। শাহ্ ওলিউল্লাহ্ প্রণীত ’ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল্ খুলাফা’ পুস্তকে লেখা হয়েছে যে এই খলীফাবৃন্দের মূলতঃ তিনটি দায়িত্ব ছিল: (১) মহানবী আনীত শরীয়তের প্রকাশ্য বিধানগুলো জারি করা তথা শিক্ষা-দীক্ষা দেয়া; (২) অপ্রকাশ্য ইসলামী জ্ঞান তথা এলমে মারেফত বিশিষ্ট ও যোগ্য উম্মতদের মধ্যে বিতরণ করা এবং (৩) রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু ৬১ হিযরীতে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা ও ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ইমাম যাইনুল আবেদীন (রহ:) আধ্যাত্মিক রাজ্যের খেলাফতকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিন থেকে আজ পর্যন্ত কেনো সূফী-দরবেশ আর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেকে নিয়োজিত করেন নি। এ বিষয়টি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সূফী-দরবেশদের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আহলা দরবার শরীফে আউলিয়ার আগমন
নবী করিম (দ:)-এর বেসাল তথা খোদা তা’লার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির পর আর কোনো নবী আসবেন না। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বুযূর্গ সাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী যুগের আওলিয়া কেরাম সচেষ্ট ছিলেন। সুদূর আরব থেকে আউলিয়া কেরাম এদেশে এই উদ্দেশ্যে জলপথে আসা আরম্ভ করেন আনুমানিক ৮০০ খৃষ্টাব্দে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে এতদঞ্চলের প্রবেশ-দ্বার। এই চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রতট ইত্যাদি নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ আউলিয়া কেরাম ও সূফী সাধকদের আধ্যাত্ম সাধনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁরা চট্টগ্রামের বর্তমান শহর এলাকা ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গড়ে তুলেন এবং মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণী প্রচার করেন। ১৬০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমনি একটি আস্তানা বর্তমান বোয়ালখালী থানার আহলা মৌজায় গড়ে তুলেন সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে আগত সূফীকূল শিরোমণি হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)। তিনি তৎকালীন বাংলার গৌররাজ্য হয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে এখানে তশরীফ আনেন। তাঁর সাধনা, ইসলামের শিক্ষা ও তাসাওফের দীক্ষা দানের ফলে এতদঞ্চলের মানুষ সত্যপথ প্রাপ্ত ও খোদাতা’লার নৈকট্য লাভ করেন। ইসলামের মৌলিক নিয়ম-কানুন সুষ্ঠুভাবে শিক্ষাদান ও আমল করার জন্যে প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট স্থান। এই উদ্দেশ্যে হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান আহলা দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মানুষের সুবিধার্ধে তাঁর আমলেই এই মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি বিশাল দীঘি খনন করা হয়। ইসলামের শান্তিবাণী প্রচার ও বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজের ফলে এবং তাঁর আধ্যাত্মিক কামালিয়াতের (পূর্ণতার) কারণে এতদঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠিভুক্ত মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
কথিত আছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে আগমনের পূর্বে হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:) একবার পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন শেষে মদীনা মুনাওয়ারায় হুজুর পূর নূর (দ:)-এর রওযা শরীফ যিয়ারতে যান। যিয়ারতকালে রওযা মোবারক হতে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো ইসলাম প্রচারের জন্যে তিনি যেন দক্ষিণ এশিয়ার চট্টগ্রাম অঞ্চলে গমন করেন। এই নির্দেশ পাওয়ায় হুজুর পাক (দ:)-এর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় রওযা শরীফের পবিত্র গিলাফ মোবারক স্পর্শ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি আরজি পেশ করেন, অজানা এই গন্তব্যের স্থানে ইসলামের প্রচার-প্রসার যেন তাঁর আওলাদে পাকগণের মাধ্যমে চিরস্থায়ী হয়। তাঁর এই ফরিয়াদ রাসূলে করিম (দ:)-এর দরবারে কবুল হয়। বস্তুত যুগে যুগে তাঁর বংশপরস্পরায় আওলিয়া কেরামের বেলাদত (জন্ম) হয়েছে। এই মহান সাধক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বেসালপ্রাপ্ত হন। তাঁর বেসালের পরে তাঁর বংশধরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওলাদগণ হলেন হযরত শেখ দানু মিয়া, হযরত শেখ মুনির আহমেদ মিয়া, হযরত শেখ আনিস মিয়া, হযরত মাওলানা সফর আলী, কুতুবে জমান হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী কাজী আসাদ আলী (রহ:), সুলতানুল মুনাযেরীন, হযরত মওলানা শাহ্ সুফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী ওয়াল চিশতি (রহ:) এবং আমার পীর ও মুরশীদ হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী দৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দিন খালেদ আল্ কাদেরী ওয়াল্ চিশতী (মাঃ জিঃ আঃ)।
সুলতানুল আরেফিন হযরত সুলতান আহমদ আল্ বাগদাদী (রহ:)
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষলগ্নে হযরত গাউসে পাক বড় পীর সাহেব কেবলার আওলাদে পাক শামছুল আরেফিন হযরত সুলতান আহমদ আল বাগদাদী (রহ:) সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে নানা দেশ ভ্রমণেশেষে এ অঞ্চলে আগমন করেন। এই সুফী সাধক আধ্যাত্মিক সাধনার পবিত্র স্থান হিসেবে হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)-এর মাযার শরীফ এলাকাকে সুনির্দিষ্ট করেন। তাঁর রিয়াযত তথা আধ্যাত্ম সাধনা এত উচ্চমার্গের ছিল যে তিনি মোরাকাবা, মোশাহাদায় ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করতেন। জনশ্রুতি আছে যে, আনুমানিক ১৬৮০ সালে মঘ জরিপকর্মীরা এই এলাকায় এসে “আল্লাহু”, “আল্লাহু” জিকিররত অবস্থায় সুফী হযরত সৈয়দ সুলতান আহমদ বাগদাদী (রহ:)-এর দর্শন লাভ করেন এবং তাঁর দেহ মোবারকের চারপাশে অসংখ্য উইপোকার সৃষ্ট ঢিবি দেখতে পান। এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে জরিপকর্মীরা হযরত বাগদাদীর “আল্লাহু” জিকির ধ্বনি অনুসারে এই অঞ্চলের নাম “আহলা” রাখেন। হযরত বাগদাদী (রহ:)-এর শুভাগমনে আহলা দরবার শরীফ আধ্যাত্ম্য সাধনার স্থান হিসেবে আরও সমৃদ্ধ হয়। এলাকার জনগণ ইসলাম ধর্মের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামের সুমহান আর্দশ প্রতিষ্ঠায় ব্রতি হন। তাঁর সাধনা, ঈমান, আকীদা, আমল ইত্যাদির ফলে আহলা দরবার শরীফ ইসলাম ধর্ম প্রচার ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭০০ খৃষ্টাব্দের সূচনালগ্নে এই মহান সাধক হযরত সুলতান আহমদ আল্ বাগদাদী (রহ:) বেসালপ্রাপ্ত হন।
কুতুবে জমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর জীবনী ও কারামত
আহলা দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ, আধ্যাত্ম জগতের সম্রাট, হযরত মওলানা শাহ্ সুফী কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত শায়খ মোহাম্মদ গৌরী (রহ:)-এর দোয়ার বাস্তব রূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মৌলভী সফর আলী চৌধুরী সাহেবের ঔরসে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। সৈয়দ সফর আলী সাহেব ছিলেন পটিয়ার বড় উঠান অন্ঞ্চলের জমিদার। আহলা মৌজা ছিল তাঁর জমিদারীর আওতাভুক্ত একটি পরগনা। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত জমিদার পরিবারের অভিজাত পরিবেশে হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) বেড়ে ওঠেন।
শিক্ষা
পূর্বপুরুষদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে লালিত হওয়ার কারণে শৈশবেই তাঁর মনে গভীর খোদাপ্রেম, সৃষ্টি জিজ্ঞাসা ও ধর্মানুরাগের উন্মেষ ঘটে। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি হিন্দুস্তান গমন করেন। কোলকাতা থেকে আরবী টাইটেল অর্জন শেষে দেশে ফিরে এলে শিক্ষানুরাগী প্রায় চার’শ মানুষের একটি দল চট্টগ্রামে তৎকালীন নৌবন্দর ফিরিঙ্গি বাজারে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপণ করেন। সে সময় ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন তাঁর ছোটবেলার শিক্ষক বাবু হরিচন্দ্র বসাক। তিনি কৌতুহলবশত সম্বর্ধনা দেখতে গেলে জনাব কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সম্মান করতেই পুরোনো ছাত্রকে চিনে বাবু হরিচন্দ্র বসাক তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন। শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এই ঘটনা প্রমাণ করে হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলার (রহ:) কাছে শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষাকে তিনি খুবই মূল্যায়ন করতেন।
কর্মজীবন
উচ্চ শিক্ষা শেষে ফিরে এসে হযরত কাজী সাহেব কেবলা (রহ:) আহলা মৌজায় স্বগৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন। বাড়িতে কোরআন, হাদীস ও ফেকাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রচুর পড়াশুনা করেন এবং নিষ্ঠার সাথে পরহেযগারী ও তাক্ওয়া অর্জনে ব্রতী হন। এ সময়ে নিজ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মানুষের আগ্রহের কারণে বিভিন্ন মাহফিলে তিনি ওয়ায করতেন। এ ছাড়া এলাকাবাসীর বিভিন্ন ধর্ম-জিজ্ঞাসার সমাধান, তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার সুরাহা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে সত্য পথের দিক-নির্দেশনা দান, এলাকাবাসীর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসা ইত্যাদি নানান সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধানের ফলে তাঁর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই সকল জনহিতকর কাজের সুখ্যাতির পরিপ্রেক্ষিতে অল্পকাল পরেই বৃটিশ প্রশাসন হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:)-কে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার তৎকালীন কাউখালিতে অবস্থিত বিচারালয়ে কাজী তথা বিচারকের পদ গ্রহণের প্রস্তাব প্রদান করে। সর্বসাধারণের মামলা-মোকদ্দমায় সুবিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তিনি সানন্দে এই সম্মানজনক পদ গ্রহন করেন। সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সহকারে তিনি কাজী পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং সুনাম অর্জন করেন। কর্মস্থল কাউখালি কোর্ট হতে নিজ বাড়ি আহলা মৌজায় সপ্তাহান্তে যাতায়াতের বিড়ম্বনা এবং কর্মস্থলে বসবাসের বিভিন্ন অসুবিধা সত্ত্বেও সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করে যান।
বায়াত গ্রহণ ও আধ্যাত্মিক জীবন
জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) যুগপৎ বিচারক হিসেবে কর্মজীবন এবং জমিদার হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন যাপনের চাইতেও প্রধান আত্মজিজ্ঞাসা খোদাপ্রেমের পথ অন্বেষণে তিনি পথপ্রদর্শক একজন কামেল পীরের সন্ধানে ব্যাপৃত হন।
পরম করুণাময় আল্লাহ তা’লা একটি হাদীসে কুদসীতে ঘোষণা করেছেন, কেউ তাঁর দিকে এক বিঘত অগ্রসর হলে তিনি তাঁর দিকে এক কদম অগ্রসর হন। তাই হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:)-এর আরযি অচিরেই পূর্ণ হলো। তিনি উপমহাদেশখ্যাত মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গোড়াপত্তনকারী গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ আহমদউল্লাহ শাহ্ সাহেব কেবলা (রহ:)-এঁর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণ করে ধন্য হন।
আধ্যাত্ম সাধনা ও রিয়াযতের সুকঠিন সোপানসমূহ পার হয়ে সিদ্ধিলাভের পর তিনি হযরত আহমদউল্লাহ শাহ্ সাহেব কেবলার (রহ:) অন্যতম খলীফা হিসেবে পরিণত হন এবং নিজ পীর সাহেব কর্তৃক ‘জনাব’ উপাধিতে বিভূষিত হন। তাঁর অপর লকব (উপাধি) ছিল ’কুতুবে যমান’, অর্থাৎ, যুগের কুতুব।
খেলাফতপ্রাপ্তির পর জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) আহলা দরবার শরীফে কায়েম মকাম তথা অধিষ্টিত হন; তিনি সূফীতত্ত্বের চর্চা, ইসলাম ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এযং ধর্মপ্রাণ সর্বসাধারণকে হেদায়াত ও দীক্ষা দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলামের হুকুম-আহকাম পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন। পান্ঞ্জেগানা নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াত, মীলাদ ও সেমা মাহফিল, ঈদের জামাতে ইমামতি করা ছাড়াও তাঁর জীবনযাপন ছিল সম্পূর্ণভাবে শরীয়তের বিধানানুগ।
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) পেশাগত জীবনে কাউখালিতে অবস্থানকালে কোর্টে আসা যাওয়ার সময়ে কোর্টের কাছে বাচা ফকির নামে এক আশেক তাঁর এই বিচারকের নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বুযুর্গীর চেহারা মোবারক দেখতে পেয়ে সর্বদা তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ করতেন। আশেক যেমন মাশুককে চিনতে পারেন, তেমনি মাশুকও তাঁর আশেকের হাল বুঝতে পারেন। আর তাই বাচা ফকিরের নিরন্তর শ্রদ্ধাবনত চিত্তকে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। পীরে কামেল ওয়াল মোকাম্মেল (যিনি নিজে পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং অন্যকেও পূর্ণতা দিতে সক্ষম এমন বুযুর্গ) জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দয়াপরবশ হয়ে এই বাচা ফকিরকে ফয়েয ও তাওয়াজ্জুহ দান করলেন। পরবর্তীকালে আধ্যাত্ম-সাধনার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বাচা ফকির ’মজযুব’ (সংসার-বিরাগী দরবেশ) হিসেবে কাউখালি কোর্টের সন্নিকটে তাঁর আস্তানায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বেসালের পরে একই স্থানে সমাধিস্থ হন। তাঁর মাযারে প্রতি বাংলা সালের ২রা ফাল্গুন ওরস্ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সর্বসাধারণকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে খেলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনকালে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সবিশেষ ব্যস্ত থাকায় পার্থিব পেশাগত জীবনে বিচারকের দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটে। আর তাই নিয়মিত এজলাশে উপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে তাঁর অপারগতায় কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কেউ কেউ বৃটিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গোপনে এ বিষয়টি অবহিত করেন। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে কর্তৃপক্ষ কাউখালিতে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। নিরীক্ষণকালে ওই প্রতিনিধি দেখতে পান যে সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্রে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এঁর প্রতিদিনকার উপস্থিতির সই ও প্রমাণ বিদ্যমান। এই কারামত দেখে কোর্টের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং সংশ্লিষ্ট সবাই বিস্মিত হয়ে যান এবং উপলব্ধি করেন যে বিচারকের ভূমিকায় আসীন এই সিদ্ধপুরুষ আসলেই একজন ওলিয়ে কামেল ওয়াল মোকাম্মেল। এই ঘটনা উম্মোচিত হওয়ার পরপরই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বিচারকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
নিয়মিত মোরাকাবা, মোশাহেদার মাধ্যমে ধ্যানমগ্ন হওয়া ছাড়াও প্রায়ই জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে আহলা দরবার শরীফের অদূরে করলডাঙ্গা পাহাড় ও জঙ্গলে গভীর আধ্যাত্ম-সাধনায় ধ্যানস্থ হতে দেখা যেতো। রেয়াযতের এক পর্যায়ে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের নয়নমণি গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী সাহেব কেবলা (রহ:) ও জনাব কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:) একযোগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দেয়াঙ্গ পাহাড়ে দীর্ঘদিন আধ্যাত্ম সাধনায় নিয়োজিত থাকেন।
কারামত
কারামতের অর্থ: আগেই বলেছি, যুগে যুগে আল্লাহ্ তালা তাঁর পরিচয় প্রদানের জন্যে আম্বিয়া ও রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন তাঁরই বান্দাদের হেদায়াত তথা সঠিক পথপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে। এই সকল খাস্ বান্দাকে তিনি মো’জেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। নবীগণের বেলায় এ মোজেযা খাস্ বা নির্দিষ্ট ছিল। যেমন - হযরত ঈঁসা (আ:) মৃতকে জিন্দা তথা জীবিত করেছিলেন; হযরত ইব্রাহীম (আ:) জ্বলন্ত আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন; হযরত ওযাইর (আ:) জন্মান্ধকে তাঁর চোখে হাত বুলিয়ে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ জমানার নবী হযরত আহমদে মোজতবা মোহাম্মদে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদকে দু’টুকরো করেছিলেন। একবার আবু জেহেল নিজ হাতের মুঠির ভেতর পাথর নিয়ে রাসূলে খোদা (দ:)-কে জিজ্ঞেস করেছিল মুঠির মধ্যে কী আছে। হুজুর পূর নূর (দ:)-এর মোজেযায় পাথর তাঁকে চিনতে পেরে কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্” বাক্যটি পাঠ করেছিল। রাসূলে পাক (দ:)-এর বেসালপ্রাপ্তির পরে নবুয়ত শেষ হয়েছে। অর্থাৎ, নবী করীম (দ:)-এর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। কিন্তু দ্বীন ইসলাম জারি রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্তা’লা কেয়ামত পর্যন্ত নবীগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে ওলি-আওলিয়াগণকে প্রেরণ করতে থাকবেন। তাঁরা যেহেতু নবীগণের প্রতিনিধি, সেহেতু তাঁদের দ্বারাও অলৌকিক ঘটনাবলী ঘটতে থাকবে। আকায়েদের কেতাবে বর্ণিত আছে: ’কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন্’ অর্থাৎ, আউলিয়া বুযূর্গবৃন্দের কারামত তথা আলৌকিক ঘটনাবলী সত্য। যেমন- হযরত বড় পীর মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) মুর্দাকে জিন্দা করেন। হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনউদ্দিন আজমেরী সাঞ্জেরী (রহ:) আনা সগরের সমস্ত পানি একটি পাত্রে তুলে নিয়ে রেখেছিলেন। হযরত শাহ্ আহমদ উল্লাহ্ আল্ হাসানী সাহেব কেবলা (রহ:) বহু দূরে গহীন অরণ্যে অবস্থিত বাঘকে বদনা দ্বারা আঘাত করে নিজ কাঠুরে মুরীদকে বাঘের কবল থেকে রক্ষা করেন। এ কারণেই শরীয়তসিদ্ধ বিশ্বাস হলো, আম্বিয়া ও আউলিয়াগণ আল্লাহ্ পাকের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্তা’লা এরশাদ ফরমান - “আমার প্রিয় বান্দা নফল এবাদত (মাওলানা সানাউল্লাহ্ পানিপথীর মতে এর অর্থ তরীকতের সাধনা) পালন দ্বারা আমার এমন নিকটবর্তী তথা সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হন যে আমি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসি; এমন ভালোবাসি যে আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজ করেন এবং তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন” (বুখারী)।
অনেকে বলে, কারামত আসলে যাদুকরী বিদ্যা যা কোনো যাদুকরও প্রদর্শন করতে সক্ষম। বস্তুত যাদুকরের যাদুকরী বিদ্যা প্রদর্শনীর স্থানেই সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন, একটি ডিম থেকে পাখির বাচ্চা বের করা অথবা বাঁশিকে আকাশে উড়ানো কিংবা ঘড়ির কাঁটা দেখায় দৃষ্টিভ্রম ঘটানো। এ সব কাজের প্রভাব সাময়িক। কিন্তু আল্লাহর আউলিয়াগণ যে কোনো স্থানে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো বিষয়ে আলৌকিক ও অসম্ভব কর্ম সংঘটন করতে সক্ষম, আর তাঁদের কারামতের প্রভাবও চিরস্থায়ী। কেননা তাঁদের এ ক্ষমতা খোদাপ্রদত্ত।
হযরত কাজী সাহেব কেবলার কারামত
বাঘের পিঠে আরোহণ
হযরত কাজী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর যৌবনকালে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গাউসুল আযম হযরত শাহ্ আহমদ উল্লাহ্ আল্ হাসানী সাহেব কেবলার (রহ:) কাছ থেকে ফয়েয তথা আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি পাওয়ার পরে বিভিন্ন পাহাড়ে ও জঙ্গলে গিয়ে গভীর ধ্যান-সাধনা ও রেয়াযত আরম্ভ করেন। এ কারণে বহু রাতে তিনি বাসার বাইরে থাকতেন। সমাজে মানুষের মধ্যে নিন্দুকের তো অভাব নেই। তাই প্রজাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর জমিদার পিতা জনাব সফর আলী চৌধুরীর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে হযরত কাজী সাহেব কেবলা উচ্ছন্নে গেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। তাঁকে শাসন করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব ওই সময় তাঁর অপর পরিবারকে সাথে নিয়ে পশ্চিম পটিয়ার দেয়াং নামক স্থানে বসবাস করতেন। কিছু প্রজার এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর শেখ চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে চলে আসেন যেখানে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা বসবাস করতেন। সন্ধ্যার পর তিনি হাতে একটি ছোরা নিয়ে বাড়ির দরজায় জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জন্যে অপেক্ষা করতে থাকনে এবং রাগতঃ স্বরে বার বার বলতে থাকেন, “আজিয়া বাড়ি ফিরুক, ফিরি আইলেই তারে আঁই টু’রা টু’রা গরি কাডি ফালাইয়ুম”, অর্থাৎ, আজ বাড়ি ফিরুক, ফিরে আসলেই তাকে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। এদিকে হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার মাতা সাহেবানী শাহজাদার সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় এবং পিতা-পুত্রের মধ্যে যে কোনো অপ্রিয় পরিস্থিতি সামলাবার উদ্দেশ্যে নিজের একটি আঙ্গুলে ক্ষতের সৃষ্টি করেন এবং তা বাটা মরিচে ডুবিয়ে বসে থাকেন। এটা তিনি ঘুমে ঢলে পড়া থেকে রক্ষা পাবার জন্যেই করেছিলেন। রাত গড়িয়ে যখন শেষ প্রহর, ঠিক তখনই জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব দেখতে পেলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) একটি বিশাল আকৃতির বাঘের পিঠে চড়ে বাড়ির উঠোনে এসে নামলেন। অতঃপর বাঘটি তাঁকে কুর্ণিশ করে বিদায় নিয়ে ধীর গতিতে স্থান ত্যাগ করলো। এই আজব কারমত দেখে তাঁর পিতা জমিদার সফর আলী চৌধুরী সাহেব উপলব্ধি করতে পারলেন যে তাঁর পুত্র উচ্ছন্নে যান নি, বরং বেলায়াত রাজ্যে সম্রাটের আসনে আসীন হয়েছেন। অজ্ঞ প্রজারাই বরং তাঁকে ভুল বুঝেছেন। তাই সাথে সাথেই তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সামনে গিয়ে বল্লেন, “বাবা, তুমি তো আমার পুত্র নও, তুমি আমার বাবা।” বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার এই কারামত সবাইকে এলান দিয়ে যায় যে আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বেলায়তের সিংহাসনে নব ওলিকুল সম্রাটের অভিষেক হয়েছে।
দীঘি থেকে জ্বিন-দেও-দানব বিতাড়ন
এ কথা সর্বজনবিদিত যে চট্টগ্রাম আদিকালে জ্বিন-পরী ও দেও-দানবের আবাসস্থল ছিল। আউলিয়াগণই তাদেরকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং তা আবাদ করেন। কথিত আছে যে হযরত বদর শাহ্ (রহ:) যখন সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের তীরে এসে পৌঁছেন, তখন এই এলাকা ছিল মিশমিশে অন্ধকার ও জ্বীন-দেও-দানবের আখড়া। তিনি তাদের কাছে এবাদত-বন্দেগীর জন্যে একটু খানি জায়গা চেয়ে সেখানে আলো জ্বালাতে একটি চেরাগ (চাটি) প্রজ্জ্বলনের অনুরোধ করলেন। দেও-দানবরা অনুমতি দিলে তিনি চেরাগ জ্বালালেন। অমনি এই মহান ওলির কারামতে এই চেরাগের আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং সমগ্র অঞ্চল আলোকিত হলো। এতে অন্ধকার জগতের দেও-দানবকুল এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায়। কথিত আছে যে, চট্টগ্রামের কদম মোবারকে অবস্থিত চেরাগী পাহাড়ে হযরত বদর শাহ্ (রহ:) তাঁর বরকতময় চেরাগ জ্বেলেছিলেন। অনুরূপভাবে, বর্তমানে আহলা দরবার শরীফ যেখানে অবস্থিত, সেখানেও ওই সব দেও-দানবের উপদ্রব ছিল। তাদের অত্যাচারে মানুষের জীবনযাপন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় এই এলাকার অধিবাসীরা আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি, ওলিকুল শিরোমণি, কুতুবে যমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে এসে দেও-দানবদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে আরজি দেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জ্বিনদের উপদ্রবের মূল স্থানটি ছিল আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বিশাল দীঘি, যা আজো দরবার প্রাঙ্গনে অবস্থান করছে। ভক্তবৃন্দ ও এলাকাবাসীর বারংবার আরজির পরিপ্রেক্ষিতে জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) একদিন জযবা হালতে, অর্থাৎ, ঐশী ভাবে তন্ময় অবস্থায় দীঘির পানিতে ডুব দেন। ডুব যে তিনি দিলেন, আর তো ওঠেন না। কয়দিন কয় রাত তিনি পানির নিচে ছিলেন তা নিয়ে অবশ্য এ ঘটনার বর্ণনাকারীদের মধ্যে মতান্তর আছে। কেউ কেউ বলেছেন তিন দিন ও তিন রাত; আবার কেউ কেউ বলেছেন সাত দিন সাত রাত। সময় যেটাই হোক না কেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এতোক্ষণ সময় পানির নিচে থাকাটা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি দীঘির পানির নিচে অবস্থানকালে হঠাৎ এই দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব পার ভেঙ্গে যায়। কথিত আছে যে, জ্বিন-দেও-দানবরা ওই দিক দিয়েই পালিয়ে যায়। অতঃপর তিনি পানির নিচ থেকে উঠে আসলে এই অঞ্চলে আর কখনো জ্বিনের উপদ্রব হয়নি। আউলিয়াগণ কারামত প্রদর্শন করেই মানুষদেরকে দ্বীনের পথে পরিচালিত করেন, তাদেরকে হেদায়াত দান করেন।
কেউ কেউ বলেন, আজকাল বহু ডুবুরি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই অনেক সময় ধরে পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম। তাহলে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামতের মাহাত্ম্য কোথায়? আমরা এ ব্যাপারে বলবো, বর্তমানে যারা ওইভাবে পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম, তারা বহুদিন যাবত অনুশীলন করেই তা সম্ভব করেছেন। পক্ষান্তরে, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বিনা অনুশীলনেই তা সম্ভব করেছেন। বিনা অনুশীলনে এ রকম করতে পারাটাই হলো কারামত। সর্বোপরি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তিন দিন ও তিন রাত দীঘির পানির নিচে ছিলেন সেখান থেকে জ্বীন-পরী-দেও-দানবদের বিতাড়িত করে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। তিনি ওই সমস্যা উক্ত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে পেরেছিলেন বলেই ওপরে ওঠে এসেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে যদি সমস্যা সমাধান না হতো, তবে যতো দিন ও যতো রাত প্রয়োজন হতো, ততো দিনই তিনি পানির নিচে থাকতেন। তাঁর কাজ ছিল মানুষের সমস্যা সমাধান করা, কোনো ডুব প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করা নয়।
দেও-দানব বিতাড়নের পরে আহলা দরবার শরীফের ঐতিহ্যবাহী বিশাল দীঘিটি সর্বসাধারণের ব্যবহারোপযোগী হয়। এই ঘটনার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দীঘিতে কিছু চিনি ঢেলে দেন এবং বলেন, “যে কেউ, যে কোনো নিয়্যতে, এই দীঘির পানি পান করলে তার (নেক) মকসুদ পূরণ হবে।” ওলির জবান আল্লাহর বিধান। সর্বসাধারণ এই পানি পান করে আজো উপকার পাচ্ছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, দীঘির পানিতে কোনো প্রকার ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু নেই। কোনো পানিবাহিত রোগেও আক্রান্ত হওয়ার নজির নেই।
একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সহধর্মিনীদের একজন, যিনি আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা (রহ:)-এর মা সাহেবানী, তিনি একদিন জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হুজুর, আপনার কাছে এতো লোকজন আসে কেন? ওরা কি আপনাকে ফকির-দরবেশ মনে করে আসে? দয়া করে আমাদের কিছু দেখাবেন কি? উত্তরে জনাব হযরত
কাজী আসাদ আলী (রহ:) বল্লেন, “আমি তো সরকারি চাকরি করি, আমাকে ফকির-দরবেশ কে বলে?” অতঃপর এক রাতে সহধর্মিনীগণ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্যে এক সাথে পাহারা দিতে লাগলেন। কেউ পা টিপতে থাকলেন, কেউ বা হাত, আর কেউ বা মাথা টিপতে থাকলেন। জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) কিন্তু ফজর নামাজের ওয়াক্ত পর্যন্ত সারা রাত গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন। অতঃপর ফজরের নামাজ ও দোয়া-কালাম পড়লেন। তাঁর স্ত্রীগণ পরস্পর এ মর্মে আলোচনা করতে লাগলেন যে, কোনো কিছুই তো তাঁরা এ সময়ে দেখতে পেলেন না। এই আলাপ-আলোচনা যখন চলছিল, ঠিক এমনি সময়ে হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বল্লেন, “মা জান, গত রাতে বাবাজান কেবলা (হযরত কাজী সাহেব) আমাদের বাসায় ভাত খেতে বসে এক লোকমা (গ্রাস) খাওয়ার পরে জযবা হালতে (ঐশী ভাবোন্মত্ত অবস্থায়) উঠে চলে এসেছেন। আমি ওই খাবার নিয়ে এসেছি। দয়া করে এগুলো তাঁর সামনে পেশ করবেন।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) স্ত্রীগণ ওই মুরীদকে পীরের পক্ষে ওকালতি করার অভিযোগে ভর্ৎসনা করেন। এমন সময় আরেক মুরীদ এসে উপস্থিত হন। তিনি বল্লেন, “মা জান, গতরাতে বাবাজান কেবলা আমাদের ওখানে খেতে বসেছিলেন। হঠাৎ অর্ধেক মরিচ খাওয়ার পরে জযবা হালতে তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে যান এবং সবাইকে চড়-থাপ্পড় মেরে চলে এসেছেন। তাঁর খাবার আমি নিয়ে এসেছি। অনুগ্রহ করে এগুলো তাঁর কাছে পেশ করবেন।” সহধর্মিনীগণ এবার বিস্ময়ে হতবাক। এও কি সম্ভব? তাঁদের এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় অপর এক মুরীদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। তিনি আরয করলেন, “মা জান, গত রাতে বাবাজান কেবলা আমাদের ওখানে জযবা হালতে পাহাড়ে-পর্বতে ছুটোছুটি করেছেন এবং সবাইকে চড়-থাপ্পড় মেরেছেন। এর পর হঠাৎ তিনি তাঁর এক পাটি জুতো ফেলে রেখেই চলে এসেছেন। আমি তাঁর জুতো মোবারক ফেরত দিতে এসেছি।” এ কথা বলেই ওই মুরীদ জনাব হযরত কাজী আলী কেবলার এক পাটি জুতো সবিনয়ে মেঝেতে রাখলেন। জুতোটি ছিল কর্দমাক্ত। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সহধর্মিনীগণ বিস্ফোরিত নয়নে ওই জুতোর পাটির দিকে তাকালেন। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সারারাত পাহারা দেয়া জনাব হযরত কাজী আলী কেবলা (রহ:) সম্পর্কে এতোগুলো অসম্ভব ঘটনা শুনে হতবিহ্বল স্ত্রীগণ কর্দমাক্ত জুতোর পাটি নিয়ে তাঁর শোবার ঘরে গিয়ে অত্যন্ত বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, গত রাতে রাখা জুতো জোড়ার কেবল এক পাটিই সেখানে পড়ে আছে। এ ঘটনায় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) স্ত্রীগণের ভুল ভেঙ্গে যায়। এই মহান ওলির কারামত দ্বারা আবারও প্রমাণ হয় যে, আউলিয়ায়ে কেরাম একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত হতে পারেন। ইসলামী উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে এ বিষয়কে স্বীকার করেছেন এবং এটিকে ‘তাঈয়ে মকান’ বলেছেন। তাঁরা আল্ কুরআনের সুরা নমলের ৩৮-৩৯ আয়াতে বর্ণিত হযরত সুলাইমান পয়গম্বর (আ:)-এর উযির আসফ বিন বারখিয়ার ঘটনাটি এর সপক্ষে পেশ করেছেন। উক্ত ঘটনায় আসফ বিন বারখিয়া চোখের পলকে রানী বিলকিসের সিংহাসনটি ইয়েমেন হতে দামেস্কে নিয়ে আসেন। গাউসে পাক হযরত বড় পীর সাহেব (রহ:)-ও একবার একই সময়ে অনেক মুরীদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছিলেন।
জাহাজে নাবিকদের জীবন রক্ষা
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জনৈক মুরীদ সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করতেন। একবার অথৈ সাগরে জাহাজে পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এই সংকটের পেছনে একটি কারণ হতে পারে, জাহাজ বন্দর ছেড়ে আসার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পানি জাহাজে সংরক্ষণ না করা। অথবা সমুদ্রে অবস্থানের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় অতিবাহিত করার কারণেই হয়তো পানির এই সংকট দেখা দিয়েছিল। জাহাজের নাবিকরা কোনো উপায়ন্তর না দেখে হাহাকার করতে লাগলেন। কেউ কেউ কান্নায়ও ভেঙ্গে পড়লেন। তারা পানি ছাড়া কীভাবে ৭-৮ দিন টিকে থাকবেন তাই নিয়ে আহাজারি করছিলেন। ঠিক সেই সময় ওই মুরীদসহ আরো দুই/তিন জনের মনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কথা স্মরণ হয়। তারা তাঁর কাছে রূহানী মদদ তথা আধ্যাত্মিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। অমনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাদের সামনে হাজির হন। তাঁকে দেখতে পেয়ে তারা সবাই বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন, “এই তো আমাদের পীর সাহেব কেবলা।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কি খাবার পানি নেই?” তারা সবাই এক বাক্যে বল্লেন, “জ্বি, হুজুর।” তিনি বল্লেন, “জাহাজ থামাও এবং আমাকে সাগরে ছেড়ে দাও। আমি পানিতে ডুব দেবার পরে তোমরা সাগর থেকে পানি সংগ্রহ করবে। তোমাদের চাহিদা পূরণ হলেই আমি ওঠে আসবো।” এ কথা শুনে তারা সবাই ভয় পেয়ে গেলেন এবং তাঁকে বল্লেন, “হুজুর, আপনাকে আমরা কীভাবে এই গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দেই? এখানে তো হাঙ্গর জাতীয় নানা হিংস্র মাছের আবাস।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) বল্লেন, “তোমরা ভয় পাচ্ছো যখন, ঠিক আছে একটা কাজ করো। আমার কোমরে একটা দড়ি বেঁধে আমাকে সমুদ্রে ছেড়ে দাও। যতোক্ষণ সমুদ্র থেকে পানি সংগ্রহে তোমাদের চাহিদা পূরণ না হবে, ততোক্ষণ আমাকে পানি থেকে ওপরে ওঠাবে না।” তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাই করা হলো। তিনি সমুদ্রে নামার সাথে সাথেই নাবিকদের চাহিদানুযায়ী পানি সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা হলো। অতঃপর তাঁকে তারা সাগর বক্ষ থেকে জাহাজে তুলে নিলেন। কোমরের রশি খোলামাত্রই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই মহান ওলির আজব কারামতে সাগর বক্ষ থেকে সংগৃহীত পানিও লবণাক্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং পানীয় জলে পরিণত হয়। আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত যে প্রাকৃতিক নিয়মকেও পাল্টে দিতে পারে তা এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়। আরেকটি বিষয় এতে পরিস্ফুট হয়। আউলিয়াবৃন্দ দূরবর্তী কোনো স্থানে সংকটাপন্ন ভক্ত-মুরীদানকে রূহানী মদদ প্রদানে সক্ষম। উপরন্তু, স্থলচর ও জলচর হিংস্র জীব-জন্তুও আল্লাহর ওলিকুলকে সমীহ করে চলে। যাঁদের কাছে পরওয়ারদেগারের কুল-মাখলুকাতের প্রশাসনিক ক্ষমতা, তাঁদের বশ্যতা তো সৃষ্টিকুল স্বীকার করতে বাধ্য।
মায়ের কাছে প্রবাসী ছেলের প্রত্যাবর্তন
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এক বৃদ্ধা মুরীদ ছিলেন। তিনিও একই গ্রামে, অর্থাৎ, আহলা দরবার শরীফ যে গ্রামে অবস্থিত সেই শেখ চৌধুরীপাড়া গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁর এক পুত্র ইসমাইল কন্ট্রাক্টর ভাগ্যের অন্বেষণে বার্মায় গমন করেন। সেই যুগে মানুষেরা ভাগ্যান্বেষণে যেতেন, ঠিক যেমনি আজকাল মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি স্থানে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন। বার্মা গিয়ে কন্ট্রাক্টর ছেলে তাঁর বৃদ্ধা মাকে ভুলে যান। বৃদ্ধা মা পুত্রের বিচ্ছেদে শোকার্ত হয়ে পড়েন। তিনি বার বার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন যাতে ছেলে তাঁর কাছে ফিরে আসে। একদিন ভোরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জযবা হালতে ওই বৃদ্ধার ঘরের উঠোনে উপস্থিত হন এবং ঘরের চালে অবস্থিত একটি লাউকে হাতের আ’সা (লাঠি) দ্বারা দু’বার আঘাত করেন। লাঠি দিয়ে বাড়ি দেবার সময় তিনি বৃদ্ধাকে বলেন, “এই বুড়ি, তোর ছেলের জন্যে ভাত রাধ্ (রান্না করো)! তোর ছেলে আসছে।” এদিকে তাঁর হাতের লাঠির আঘাত আলৌকিকভাবে গিয়ে পড়লো বার্মায় বিছানায় ঘুমন্ত ইসমাইলের পিঠে! কন্ট্রাক্টর পুত্রের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি সামনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর কদম মোবারক দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে বল্লেন, “ওডা, তোর মা কান্দি কান্দি মরি যারগই আর তই আইজো এন্ডে পড়ি রইয়স। স’রে স’রে বাড়ি যাগোই” (অর্থাৎ, এই বেটা, তোর মা একজন কাঁদতে কাঁদতে মরতে বসেছেন, আর তুই এখনো এখানে। শিগগির বাড়ি যা)! এ কথা বলেই জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ইসমাইল কন্ট্রাক্টর সাহেব আর দেরি না করে বাড়ির পথে রওনা হলেন। বার্মা থেকে সকালে রওনা হয়ে চট্টগ্রামের আহলা মৌজায় দুপুরে পৌঁছানো এবং বাড়িতে ভাত খাওয়া স্বাভাবিকভাবে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্তু জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর কারামতে ইসমাইল কন্ট্রাক্টরের জন্যে পথের এই দূরত্ব সংকুচিত হয়ে যায় এবং তিনি দুপুরে বাড়িতে ফিরে মায়ের রান্না করা ভাত খান। বৃদ্ধার দুঃখ বহু দিন পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামত দ্বারা ঘুচে গেল। আল্লাহর আউলিয়াগণ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা যে সমাধান করতে সক্ষম, তা এ ঘটনায় প্রতীয়মান হয়।
খুনের মিথ্যে মামলা হতে বেকসুর খালাস
চট্টগ্রাম মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গাউসুল আযম হযরত শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল্ হাসানী (রহ:) মাঝে মাঝে আহলা দরবার শরীফে তশরীফ আনতেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) যাহেরী তথা প্রকাশ্য জীবদ্দশায় গাউসুল আযম শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী (রহ:) একবার এ রকম এক সফরে আহলা দরবার শরীফে এসেছিলেন। ওই সময় ইমামউল্লাহর চরের শোকর আলী নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে খুনের মামলা সাজানো হয় এবং তাঁকে আসামী করা হয়। তাঁর মা তাঁকে এই মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাবার জন্যে উক্ত দুই বুযূর্গের কাছে আরজি দিতে দরবার শরীফে পাঠান। তাঁর মা চেয়েছিলেন যেন হযরত গাউসুল আযম (রহ:) ও কুতুবে যমান জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দোয়ার বরকতে তিনি খুনের আসামীর মিথ্যা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পান। মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী শোকর আলী দরবার শরীফে এসে তাঁর আরজি পেশ করেন। অতঃপর জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) দোয়া করা জন্যে গাউসুল আযম শাহ্ সৈয়দ গোলামুর রহমান আল্ হাসানী (রহ:)-এর প্রতি সম্মানের সাথে ইশারা করেন। প্রত্যুত্তরে তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) প্রতি অনুরূপ ইশারা করেন। কয়েকবার ইশারা ও পাল্টা ইশারা করার পরে তাঁরা দু’জনেই শোকর আলীর দুই বাহু ধরেন এবং জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর পিঠে একটি মৃদু থাপ্পড় মেরে তাঁকে ছেড়ে দেন। ওই মিথ্যা মামলার পরবর্তী হাজিরার দিনে কোর্টে বিচারকার্য পরিচালনার জন্যে কোনো ফাইল ও কাগজপত্র আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এই আজব কেরামতের ফলে মিথ্যা ও সাজানো মামলাটি খারিজ হয়ে যায় এবং শোকর আলী বেকসুর খালাস পান। এই ঘটনার পরে শোকর আলী আধ্যাত্মিক সাধানায় ব্রতী হন এবং কালক্রমে শোকর আলী শাহ্ নামে কামেল সাধক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সাধারণতঃ করলডাঙ্গা জঙ্গলে কালাতিপাত করতেন এবং বিভিন্ন ধরনের জীব-জন্তুর সাথে তাঁকে দেখা যেতো। তাঁর মাযার শরীফ ইমামুল্লার চরে অবস্থিত।
বৃটিশ সরকারের মামলা থেকে মুরীদকে খালাস
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) জনৈক মুরীদ একবার সরকারি রাস্তার ‘আইল’ অর্থাৎ ধার কেটে ফেলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়। এতে তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে আরজি দেন এবং অনুনয় বিনয় করে এ থেকে মুক্তি কামনা করেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর ওই মুরীদকে কোর্টে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় তাঁর চেহারা মোবারক খেয়াল তথা স্মরণ করে সত্য সাক্ষ্য দিতে আদেশ করলেন। অতঃপর কোর্টে শুনানির দিন ওই মুরীদ তাঁর পীরের চেহারা মোবারক খেয়াল করতেই দেখতে পেলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সামনে উপস্থিত। কিন্তু কোর্টে অবস্থানরত অন্য কেউই তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) নির্দেশ দেন যেন তিনি যা বলেন শুধু তাই ওই মুরীদ পুনরাবৃত্তি করেন, অন্য কোনো জবাব যেন না দেন। শুনানি শুরু হলে ইংরেজ জজ ওই মুরীদকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি রাস্তার ধার কেটেছ?” উত্তর এলো “জি হুজুর”! জজ সাহেব রাগতঃ স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কেটেছ”? উত্তর এলো, “হুজুর,গালে দাড়ি মোচ যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন ঠোঁটের ওপরে ঝুলে পড়া মোচের অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে ফেলতে হয়; ফলে তা চেহারার শোভা বর্ধন করে। ঠিক তেমনি আমিও রাস্তার ধারের বাড়ন্ত কাছা ও লতাপাতা কেটে পরিষ্কার করেছি যাতে করে রাস্তার শোভা বৃদ্ধি পায়।” এ চমকপ্রদ জবাব শুনে ইংরেজ জজ সাহেব সন্তুষ্ট হন এবং ওই মুরীদকে বেকসুর খালাস দেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাই (রহ:) এই বিচক্ষণ উত্তর নিজ মুরীদকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। দেখুন, তাঁকে এবং তাঁর এই আজব কারামত কোর্টে অবস্থানরত কেউই দেখতে পায়নি, শুধু ওই মুরীদ ছাড়া। যে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়া হয়েছে তা এক কথায় অতুলনীয়। সত্যি, খোদাতা’লার প্রশাসনের ক্ষমতাধরদের সামনে দুনিয়ার সমস্ত প্রশাসনই ফেল্। মহা শক্তিধর বৃটিশ রাজও এখানে অচল।
চিলও কাজী সাহেব কেবলার তাবেদার
কুতুবে যমান জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর মেয়ের জামাই, বিশিষ্ট জমিদার জনাব আব্দুল খালেক চৌধুরী একবার দরবার শরীফে, অর্থাৎ, শ্বশুরালয়ে বেড়াতে আসেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মেয়ের জামাইকে আপ্যায়ন করতে খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন। কিন্তু আব্দুল খালেক চৌধুরী সাহেব খেতে বসার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মেহমানকে কী খাওয়ানো হচ্ছে তা তদারকি করার উদ্দেশ্যে সেখানে দেখতে গেলে তিনি দেখতে পান, মুরগির রোস্টটি রান্না হওয়া সত্ত্বেও ফরাশে (ওই যুগে খাওয়ার জন্যে বিছানো ম্যাট) অনুপস্থিত। তিনি সাথে সাথে কাজের মেয়ে বলিকে (নাদুর মা) রোস্টের কথা জিজ্ঞেস করেন। বলি ভয়ে ভয়ে বলে, মেহমানখানায় রোস্টটি নেয়ার সময় একটি চিল ছোঁ মেরে তা নিয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জযবা হালতে বলিকে তার শাড়ীর আঁচল মেলে ধরতে বলেন এবং তার পরে চিলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এই চিল, তোর এতো বড় দুঃসাহস যে তুই আমার অনুমতি ছাড়াই মুরগির রোস্টটি নিয়ে গেছিস। শিগগির ওই রোস্ট ফেরত দে!” কী আজব কারামত! যেই বলা অমনি চিলটি ওই মুরগির রোস্ট বলির শাড়ীর আঁচলে ফেলে দিয়ে গেল। অতঃপর রোস্টটি ধুয়ে পরিষ্কার করে জামাই সাহেবের পাতে দেয়া হলো। আউলিয়া কেরামের আধ্যাত্মিক প্রশাসন যে পশু-পাখির জগত পর্যন্ত সুবিস্তৃত, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত তারই প্রমাণবহ।
মুরীদকে চির তারুণ্য প্রদান
চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন মরহুম আব্দুল লতিফ কেরানী। বৃটিশ আমলের হাতে গোণা শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। মুরীদ হবার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁর হাত মোবারক কেরানী সাহেবের মুখমন্ডলে বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি চির তরুণ থাকবে।” অতঃপর কেরানী সাহেবের ইন্তেকাল অবধি আনুমানিক ১২৫ বছরের জীবনে তাকে দেখতে বুড়ো মনে হয়নি। সব সময় তরুণের মতোই দেখা গেছে। আর তিনিও তরুণদের মতো সর্বদা ক্লিন শেইভ থাকতেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কারামত দ্বারা চির তারুণ্য পেয়েছিলেন এই ভদ্রলোক।
কারামত দ্বারা স্থানের দূরত্ব সংকুচিত করা
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কিছু হলের গরু ছিল। দরবার শরীফের খাদেমবৃন্দ সব সময়ই এগুলোকে জনাব হযরত কাজী
আসাদ আলী কেবলার (রহ:) চোখের আড়ালে রাখতেন। কেননা তিনি অনেক সময় জযবা হালতে “মাওলার হুকুম হয়েছে”- এ কথা বলে হালের গুরুগুলোকে জবাই করার আদেশ দিতেন। একবার এ রকম একটি হালের গরু তিনি জবাই করার নির্দেশ দেন। খাদেমবৃন্দ তাঁর কাছে আরজ করলেন, “হুজুর, এখন চাষাবাদের সময়; হালের গরুর তীব্র সংকট। এ রকম আরেকটি গরু পাওয়া দুরূহ হবে।” কিন্তু জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অনড়, তাঁর হুকুমই বহাল রইলো। অতঃপর গরু জবাই হবার পরে তিনি খানা পাক করার নির্দেশ দিলেন। রান্না শেষ হবার পরে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অপরাহ্নে ইমাম আলী ফকির নামে তাঁর এক মুরীদকে কিছু তবাররুক দিয়ে বল্লেন, “যাও, এই তবাররুক তুমি মাইজভান্ডার দরবার শরীফে আমার পীর সাহেব কেবলার (হযরত শাহ্ আহ্ম্মদ উল্লাহ্ সাহেব কেবলা) দরবারে দিয়ে এসে এখানে মাগরিবের নামাজ পড়বে এবং ভাত খাবে।” এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ থেকে আহলা দরবার শরীফ আসা যাওয়ার রাস্তা ওই যুগে এতো সহজ ছিল না। আজকের মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা মহাসড়ক এবং মটর গাড়ী ও যানবাহনও ছিল না। পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বাহন তখন ছিল না। এই সব বিবেচনায় ইমাম আলী ফকির তার পীরের কাছে আরজ করলেন, “হুজুর, এতো অল্প সময়ে এতো দূরত্ব অতিক্রম করা তো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) জবাবে বল্লেন, “হযরত সাহেব (শাহ্ আহমদউল্লাহ্ আল্ হাসানী) কেবলার অসিলা করে রওয়ানা হও।” ইমাম আলী ফকির তাই করলেন। কী আজব কেরামত! ইমাম আলী ফকির তবাররূক নিয়ে পদব্রজে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ পৌঁছে ওখানে আসরের নামাজ আদায় করলেন; অতঃপর তবাররুক পৌঁছে দিয়ে আহলা দরবার শরীফের দিকে হাঁটা আরম্ভ করলেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যে মাগরিবের নামাজের আগেই ফেরত এসে তা আদায় করলেন এবং ভাতও খেলেন। এই হুকুম তা’মিলের সময় তার কোনো ধারণাই ছিল না কতো পথ তিনি হেঁটেছেন, পথ চলার ক্লান্তিও তাকে গ্রাস করে নি। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দ্বারা পথের দূরত্ব সংকুচিত হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওই অপরাহ্নেই জনৈক আশেক-ভক্ত জোড়ারগঞ্জ থেকে দুইটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হালের গরু হাদিয়া হিসেবে দরবারে পেশ করেন। দরবারের খাদেমবৃন্দ যে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে চাষাবাদের সময় হালের গরুর সংকটের কথা জানিয়ে ফরিয়াদ করেছিলেন, তিনি তাদের আরজিও মঞ্জুর করলেন। এটিও তাঁর একটি কারামত।
কারামত দ্বারা হেদায়াত দান
একবার গ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদার রমজান আলী জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) তার বাড়িতে ভাত খাওয়ার জন্যে দাওয়াত দেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে জমিদার পরিবার, আর চৌকিদার তো গ্রামের সাধারণ মানুষ; তিনি জমিদারেরই প্রজা। কিন্তু দেখুন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:)-এঁর কোনো জাত্যাভিমান ছিল না। মানুষকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে তিনি জমিদারী মর্যাদার কথা চিন্তাই করতেন না। তাই রমজান আলীর দাওয়াত তিনি কবুল করে নিলেন নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে। অতঃপর যথাসময়ে তিনি রমজান আলীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। গিয়েই রমজান আলীকে বল্লেন, “তোর মাছের তরকারিতে কেরোসিনের গন্ধ। তুই আমাকে শাক ও ডাল দিয়ে দু’টো ভাত খেতে দে।” রমজান আলী রান্না ঘরে ঢুকে দেখেন, সত্যি মাছের তরকারিতে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জনাব হযরত কাজী অঅসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দর্শনে রমজান আলী রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই শায়খের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী (রহ:) তখন তাকে বলেন, “রমজান, তুই ওয়াদা কর, আর কখনোই অন্যের পুকুরের মাছ চুরি করবি না; তাহলে খোদাতা’লা তোর গুনাহ মাফ করে দেবেন।” রমজান আলী অপরের পুকুর থেকে মাছ চুরি করে এনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) খেতে দিয়েছেন, একথা পীর সাহেব কেবলা জেনে ফেলেছেন বুঝতে পেরে তার কান্না আরও বেড়ে গেল। অনুতপ্ত হয়ে তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কাছে অঙ্গীকার করেন যে জীবনে আর কোনো দিন তিনি কোনো ধরনের চুরি করবেন না। বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) এভাবেই কারামত প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে সত্য, সঠিক পথে পরিচালিত করতেন।
পিতা-পুত্রের কেরামতি
আহলা দরবার শরীফের নয়নমণি, ওলিকুল শিরোমণি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সুযোগ্য পুত্র হযরত আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিস্তী সাহেব কেবলা (রহ:) তাঁর মায়ের গর্ভে থাকাকালিন মাঘ মাসে দরবার শরীফে ওরস্ মোবারক সমাগত হয়। ওই ওরশের দিনই তাঁর মায়ের প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়। এমতাবস্থায় তাঁর মাতা সাহেবানী জনাবা গুলবাহার খাতুন জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাকে (রহ:) বলেন, “আজ ওরশের দিন; কতো হাজার হাজার নর-নারীর আগমন ঘটবে এই দরবারে। এই অবস্থায় আমি পড়ে থেকে লজ্জিত হবো, কোনো খেদমত করতে পারবো না - এটা আমি সইতে পারবো না। দয়া করে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান দিন।” এ কথা শুনে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) মৃদু হেসে তাঁর স্ত্রীর পিঠে আলতো এক চড় মেরে বল্লেন, “আজকে না বেটা, কাল।” এ কথা বলেই তিনি ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। তৎক্ষণাৎ তাঁর স্ত্রীর প্রসব বেদনা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ওরস্ মোবারকের খেদমত আঞ্জাম দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অতঃপর ওই ওরস্ সুসম্পন্ন হওয়ার পরের দিন হযরত আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা (রহ:) ভূমিষ্ঠ হন। আহলা দরবার শরীফের এই মহান বুযর্গ যে জন্মগত ওলি, তা এ ঘটনায় দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আউলিয়ার বিস্মৃত মাযার চিহ্নিতকরণ
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ‘আহলে কাশফ’ তথা দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি কবরবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে জানতেন। এই আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে তিনি খিতাবচরের হাসান শাহ্ ইউনানী (রহ:) ও ইউনুস শাহ্ ইউনানী (রহ:), বেঙ্গুরার শাহ্ চাঁন্দ আউলিয়া (রহ:) ও করলডাঙ্গার কলন্দর শাহের দরগাহ, এবং কালাইয়ারহাটের মহিউদ্দীন শাহের বিস্মৃত মাযার সনাক্ত করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই মাযারগুলো ওই সময় ঝোপ-ঝাড়ে আচ্ছাদিত ছিল এবং সর্বসাধারণ এই পথে আসা যাওয়া করতেন না। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) উক্ত আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার-দরগাহ সর্বসাধারণের জন্যে আবার উন্মুক্ত করে দেন। হাসীস্ শরীফে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “যদি মাযারস্থ আউলিয়াবৃন্দ না থাকতেন, তাহলে দুনিয়াবাসী (অনলে) জ্বলে পুড়তো।” এই হাদীস্ ইমাম মানাবী (রহ:) তাঁর প্রণীত কানযুদ্ দাকাইক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিতে মাযারস্থ আউলিয়া কেরামের ফুয়ুজাত তথা দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণাপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সর্বসাধারণের জন্যে এই দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণাপ্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত করেন। তাঁর এই কারামত দেখে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সুন্নী আলেম আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ:) তাঁর রচিত ‘দেওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে জনাব হযরত কাজী আসাদ কেবলা (রহ:)-কে “কাশফুল কুবুর” খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ওই গ্রন্থে কবিতার আকারে আরও লিখেন, “আলেমগণের অগ্রগণ্য, সালেকগণের অনুকরণীয়, আলোকিত শক্তির অধিকারী জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নির্ভেজাল ওলি। তাঁর আলোকময় পাক রওযা আহলা বোয়ালখালীতে অবস্থিত। তাঁর জ্যোতির্ময় মোবারক (পবিত্র) সত্তা থেকে সর্বসাধারণ ফরেয (দয়া, করুণা, অনুগ্রহ) অর্জন করেন সর্বক্ষণ।” (ভাবানুবাদ)
কারামত দ্বারা অন্তর পরিবর্তন
চট্টগ্রাম পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত মুরাদাবাদ গ্রামের খায়রুজ্জামান মাষ্টার কুতুবে যমান জনাব কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর কাছে মুরীদ হবার আগে পীর-ফকিরে ততোটা বিশ্বাস ও ভক্তি করতেন না। ওই সময় একবার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) পটিয়ার খরনায় সফরে আসেন। এখানেই খায়রুজ্জামান মাষ্টারের সাথে তাঁর দেখা হয়। উভয়েই একে অপরের দিকে তাকান, কিন্তু মাষ্টার সাহেবের অন্তরে এই মহান ওলির প্রতি কোনো মহব্বতপূর্ণ ভাবের উদয় না হওয়ায় তিনি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:)-এর কাছে বায়াত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। অতঃপর রিযিকের সন্ধানে এক সময় খায়রুজ্জামান মাষ্টার বার্মার রেঙ্গুন গমন করেন এবং সেখানে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। রেঙ্গুনে অবস্থানকালীন হঠাৎ এক রাতে তিনি বশরতে (স্বপ্নে) জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দর্শন পান। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে বলেন, “তোমাকে দেখার জন্যে আমি এখানে চলে এসেছি।” স্বপ্নের মধ্যে কথাবার্তার এক পর্যায়ে খায়রুজ্জামান মাষ্টার জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-কে অনুরোধ করেন, “হুজুর, আমাকে আপনার পবিত্র হাতে বায়াত (মুরীদ) করুন।” জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাঁকে বায়াত করেন। খায়রুজ্জামান মাষ্টার এর কিছু দিন পরে রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন এবং দরবার শরীফে গিয়ে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) কদম মোবারকে লুটিয়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন, আর ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন তার এই অবহেলার জন্যে। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সাদরে গ্রহণ করেন। খায়রুজ্জামান মাষ্টার ছিলেন বৃটিশ আমলের শিক্ষিত একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি পীরের মহব্বতে ওই সময় তাঁর শানে একটি শে’র (পদ্য) রচনা করেন। এটি বাংলা ও উর্দু এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে রচিত হলেও পাঠককুলের হৃদয়ঙ্গম হতে অসুবিধা হবে না। নিচে শে’রটি দেয়া হলো:
কাজী সোনা খায়রের সব পেয়ারা হামারা,
সোনালী বর্ণ শাহা কাজী ধন,
এ জীবনের জীবন, অমূল্য রতন,
খোদা নিজের হাতে বানাইছে পুতুলা ।।
কুতুবুদ্দীনো, নেজামুদ্দীনো,
আরো যতো আছে বাবা আউলিয়াগণ,
সব হইতে কাজী সোনা সরদারওয়ালা।।
আরব, আজম, বোগদাদ, মিসির,
কাজী সোনার নামের ’পরে হইয়াছে জিকির,
আরো মদীনামে ফুঁকে নবী মেরা।।
(জরুরি নোট: মুরীদের কাছে নিজের পীরকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ধ্যান-জ্ঞান করা অতীব জরুরি। কেননা, পীরের মাধ্যমেই মুরীদ কুরবাত/নৈকট্য পেয়ে থাকেন। এতে অন্যান্য পীর-মাশায়েখকে খাটো করা মূল উদ্দেশ্য নয়। গাউসে পাক বড় পীর সাহেব কেবলা (রহ:)-এর সময় অন্য এক পীরের কতিপয় মুরীদ তাঁর কাছ থেকে নিজেদের মুখ আড়াল করতেন। এটা দেখে বড় পীর সাহেব কেবলা (রহ:) তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন।)
বস্তুতঃ জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) এই কারামত দ্বারা অন্তর পরিবর্তনের পরে খায়রুজ্জামান মাষ্টার তরীকত প্রচারে আত্মনিবেদিত হন। তাঁর ওরস্ ১০ই চৈত্র পটিয়ার মুরাদাবাদে অনুষ্ঠিত হয়।
অদৃশ্য ও ভবিষ্যত জ্ঞান
আহলা দরবার শরীফের অলিকুল শিরোমণি, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সুযোগ্য পুত্র হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিস্তী সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা জন্মগতভাবে ওলি। তিনি যে বড় ওলি হবেন, তা জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর আরেকটি কারামতে প্রকাশ পেয়েছিল। ওই সময় হযরত নূরী বাবা (রহ:)-এর বয়স মাত্র এক বছর। চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার ইমামুল্লার চর গ্রামের নবী হোসেন নামে এক ব্যক্তি জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) দরবারে চাষাবাদের কাজ করতেন। একদিন তিনি হযরত নূরী বাবাকে (রহ:) কোলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করছিলেন। ঠিক এমনি সময় জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সেখানে উপস্থিত হন এবং নূরী বাবা (রহ:)-কে কোলে নিয়ে গরু দ্বারা ধান মাড়াই করতে দেখে তিনি নবী হোসেনের প্রতি রাগান্বিত হন। তিনি তাকে ধিক্কার দিয়ে বলেন, “এই বেটা, তুই চিনিস কাকে কোলে নিয়ে গরুর কাছে এসেছিস? ওর গায়ে গরুর বাতাস লাগবে, শিগগির দূরে সরিয়ে নেয়। এই ছেলে একদিন তোর পীর হবে।” উল্লেখ্য যে, নবী হোসেনের বয়স তখন ২৭-২৮ বছর। কিন্তু ওলির জবান তো বিফলে যাবার নয়। অতএব, বৃদ্ধ বয়সে তিনি ঠিকই নূরী বাবা (রহ:)-এর মুরীদ হন। আরও উল্লেখ্য যে, ‘গরুর বাতাস’ বলতে জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সম্ভবত কোনো অদৃশ্য ক্ষতিকারক প্রভাবকে বুঝিয়েছেন, যা আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করতে বা বুঝতে সক্ষম নয়। এই বিষয়টি তাঁর অদৃশ্য জ্ঞান (গায়েবী এলম) বলেই সাব্যস্ত হয়।
বিনা চাবিতে ঘড়ি চলে
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) যৌবনে চট্টগ্রামে রাঙ্গুনিয়া উপজেলাস্থ কাউখালী মুন্সেফ কোর্টে কাজী তথা বিচারকের চাকরি করতেন। প্রতি সপ্তাহের একদিন তিনি বাড়িতে আসতেন পরিবার পরিজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে। একবার অফিসে যাওয়ার সময় তাঁর ঘড়িটি তিনি বাড়িতে রেখে যান। এখানে উল্লেখ্য যে, বৃটিশ আমলে হাত ঘড়ির প্রচলন ছিল না, বরং একটি চেইন দ্বারা আটকে কোটের বা শেরওয়ানীর পকেটে রাখা হতো এবং এ সকল ঘড়িতে প্রতিদিন চাবি দিতে হতো। একদিন পরই চাবি না দেয়ার কারণে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে যায়। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার (রহ:) সহধর্মিনী জনাবা গুলবাহার খাতুন ঘড়িটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেখে মনে মনে ভাবলেন, জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) ঘড়িতে চাবি দিয়ে যান নি, তাই তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় কাউকে চাবি দেয়ার জন্যে তা হস্তান্তর করাও তো নিষেধ। কী করা যায় ভেবে তিনি চুপ করে রইলেন। কী আশ্চর্য! তিনি পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘড়ি ঠিকই চলছে, কোনো দম দেয়ার প্রয়োজন হয় নি। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:) সপ্তাহশেষে আবার বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের সময় পর্যন্ত ওই ঘড়ি টিক্ টিক্ করে চলেছিল। এই কারামত দেখে বাড়ির সবাই এবং ভক্তবৃন্দ হতবাক হয়ে যান।
বৈবাহিক জীবন
জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলার সহধর্মিনী মোসাম্মৎ গুলবাহার খাতুন। এই অনন্য সাধারণ মহিলার গর্ভে আহলা দরবার শরীফের ওলিকুল শিরোমণি, হাজতে রওয়া, মুশকিল কুশা, সুলতানুল মোনাযেরীন, হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল্ কাদেরী আল্ চিশ্তী সাহেব কেবলা প্রকাশ নূরী বাবা (রহ:) জন্ম গ্রহণ করেন। বস্তুতঃ মোসাম্মৎ গুলবাহার খাতুন তরীকতের একজন সমঝদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলা (রহ:)-এর সহধর্মিনী হিসেবে এই মহীয়সী নারী তাঁর স্বামীকে তরীকতের পথে সর্বপ্রকার সহায়তা করেন এবং বাধা সৃষ্টি করেন নি। এই বিদুষী মহিলা এক্ষেত্রে ছিলেন অনন্যা।
বেসাল ও ওরস্ শরীফ
মহানবী (দ:) একটি হাসীসে এরশাদ করেছেন, “মৃত্যু একটি সেতু; এক বন্ধুকে অপর বন্ধুর সাথে মিলিত করে।” এই হাদীসটি থেকেই আমরা জানতে পারি, আল্লাহর আউলিয়াগণ বেসাল তথা আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্ত হন। তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো মৃত্যু বরণ করেন না, বরং পর্দা করেন মাত্র। জনাব হযরত কাজী আসাদ আলী কেবলাও (রহ:) খোদাপ্রেমের শিক্ষাদান ও তরীকত প্রচারের দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে ১৩৩৬ হিজরীর ১লা শাবান মোতাবেক ১৯১৫ ইং সালে মহাপ্রভুর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্ত হন। তাঁর এই বেসাল নিয়েও একটি কারামত রয়েছে। তিনি কোন্ দিন বেসালপ্রাপ্ত হলে মানুষজনের দরবারে আসা সুবিধাজনক হবে এমন একটি প্রশ্ন তিনি খাদেমগণকে করেছিলেন। তারা রোববার বলার পরে তিনি ঠিক ওই দিনই বেসালপ্রাপ্ত হন (২৯শে বৈশাখ, বাংলা)।